#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_১৯
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
“অর্ষা!” অবাক হয়ে জানতে চাইলো মিষ্টি।
“হুম।”
“এটা কেমন নাম? এমন নাম তো কোনওদিন শুনিনি।”
“আমিও শুনিনি তবে মেয়েটা না সুন্দর। আমার সাথে নিজে থেকে এসে কথা বলেছে। জানতে চেয়েছে আমি ওর ফ্রেন্ড হবো না-কি?”
হালকা হেসে টাইপ করলো মিষ্টি, “তুমি কী বললে?”
“কী আর বলবো? আমি হ্যাঁ বলে দিয়েছি।”
“বাহ! তারপর?”
“তারপর তো জানি না কিন্তু আমার ওর কথাবার্তা অনেক ভালো লেগেছে। দেখতেও কত মিষ্টি। এই যা! কারোর প্রশংসা করলেও দেখি তুমি চলে আসো।” এবারের ম্যাসেজে শরীর দুলিয়ে হেসে উঠলো মিষ্টি। বেশ কিছুক্ষণ ধরে সে হেসেই চলেছে তাই পুনরায় নবাবের কাছ থেকে ম্যাসেজ এলো, “এই আপু?”
“এই মিষ্টি?” হঠাৎ নবাবের ডাকে মিষ্টির চৈতন্য হলো। ইঞ্জিনের তীব্র শব্দ উপেক্ষা করে আসা নবাবের সম্বোধনে সে ফিরে তাকালো নবাবের দিকে৷ মিষ্টির নিষ্প্রাণ চোখ নবাবের চোখে পড়তে প্রসন্ন মুখে জানতে চাইলো, “কী ভাবছো?”
দৃষ্টি সামনে রেখে সবুজের সমারোহ আর নদীর জলে চোখ ডুবিয়ে কিঞ্চিৎ বেখেয়ালি মনে জবাব দিলো মিষ্টি, “অর্ষার কথা।”
“অর্ষার কথা মানে?” কপালে ভাঁজ পড়লো নবাবের।
কালকে রাতে অর্ষার জন্য না চাইতেও অনেক ঘটনা মঞ্চায়িত হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া শেষে যখন বালিশে মাথা রেখেছিল মিষ্টি, অজানা চিন্তার উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠেছিল। এসব বিষয় নিয়ে সে আজকে বিছানাকান্দি যাবে না বলে সকালে নবাবকে বারণ করেছিল, “আজকে আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি যাও।”
“আমি যাবো মানে? আমি একা গিয়ে ওখানে কী করবো?”
“আমি সঙ্গে গেলেও চুপচাপ থাকি, তাই না? তাছাড়া আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।”
“আমি বুঝতে পারছি মিষ্টি কিন্তু আজকে না গেলে আর যাওয়া হবে না। কারণ পরশুদিন আমরা সিলেট ত্যাগ করবো।”
অবাক হয়ে, “কেন? বাসায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছো?”
“পাগল! অন্য কোথাও। এখন চটপট তৈরি হয়ে নাও।”
“কিন্তু…” মিষ্টিকে বলতে না দিয়ে নবাব বলে ছিল, “তোমার সব কিন্তুই শুনবো তবে সেটা বিছানাকান্দির পাথরের বিছানায় দাঁড়িয়ে।”
অর্ষাকে নিয়ে ভাবছিল বলেই মিষ্টি অর্ষার নাম নিয়ে ফেলেছে। কিন্তু একে নিয়ে নতুন কোনো ঝামেলা করতে চায় না বলে মিষ্টি স্বাভাবিক গলায় জানতে চাইলো, “নাহ, অর্ষার সাথে কথা বলেছিলে, কেন কল করেছিল তোমায়?”
“এর কথা কেন নিচ্ছো আবার?” বিরক্তিতে নবাবের ভ্রুকুঞ্চন দেখতে পেয়ে ডান দিকে ঘাড় কাত করে গলায় আদুরী ভাব টানলো মিষ্টি, “রাগ করলে?”
স্মিত হেসে জবাব দিলো নবাব, “টক ঝালের ওপর রাগ করা যায়, মিষ্টির ওপর নয়।”
মুখে হিজাব বাঁধা সত্ত্বেও অভ্যাসবশত মিষ্টি মুখে চাপ হেসে উঠলো। পাশে বসা নবাব মুগ্ধ নয়নে মিষ্টিকে দেখে একটু কাছে এসে বলে উঠলো,
“চঞ্চল নদী স্তব্ধ হলো
তোমার ঐ হঠাৎ হাসিতে।
নয়ন আমার ব্যাকুল হলো
তার অতৃপ্ত তৃষ্ণা মেটাতে।
মনে আমার ঘোর লাগে
দেখলে তোমার হাসি।
কবে তুমি বলবে আমায়,
এই তো ভালোবাসি?”
আচমকা মিষ্টির হাসি থেমে গেল আর সে বিস্মিত চোখে নবাবকে দেখলো। নবাব সোজা হয়ে বসে ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলো। মাথার ক্যাপ খুলে চুলে হাত বুলিয়ে পুনরায় সেটা পড়ে নিলো। নবাব সাধারণত মাথার চুল কপালের দিকে একটু বেশিই লম্বা রাখতে পছন্দ করে। কিন্তু এইসব ছোটাছুটি করতে গিয়ে চুল এতটাই লম্বা হয়েছে যে ক্যাপ দিয়ে সামলে রাখতে হচ্ছে।
মিষ্টি এখনও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে কিন্তু মুখ ফুটে কিচ্ছু বলছে না। তাই নবাব ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইলো, “সুন্দর না কবিতাটা? এই মাত্র মনে মনে লিখে ফেললাম।” এই বলে নবাব সামনের সবুজ গাছপালায় চোখ নিবদ্ধ করলো। মিষ্টি নবাবকে দেখে ধীরে ধীরে মাথা নুইয়ে নিলো। ওর মনে হয়েছিল নবাব ওর কাছে জানতে চেয়েছে, “কবে তুমি বলবে আমায়, এই তো ভালোবাসি?” কিন্তু সেটা হয়নি বিধায় হৃদয় একটুখানি ব্যথিত হলো।
“সুন্দর।” কিঞ্চিৎ কষ্ট প্রতীয়মান হলো এই ছোট্ট শব্দে।
“তা কবে বলবে আমায়, এই তো ভালোবাসি?” নবাব প্রথমেই টের পেয়েছে মিষ্টি অন্যবারের মতো এটাকে কবিতা না ভেবে সত্যি হিসেবে গ্রহণ করেছে। আগেও নবাব প্রায়শই মিষ্টিকে ছোট-খাটো ছন্দ বলে বিনোদন দেওয়ার চেষ্টা করতো। কিন্তু আজকে মিষ্টি সত্যি হিসেবে মেনে নেওয়ায় সে পুনরায় জানতে চাইলো।
“মানে?” মিষ্টি যেন ভেবেই পাচ্ছে না নবাব কীসব বলছে।
“সোজা বাংলায় তো জানতে চাইলাম।”
“তুমি আমাকে সবসময় এমন গোলকধাঁধায় ছেড়ে দাও কেন? আমি তোমাকে আজও বুঝতে পারি না। ভবিষ্যতে পারবো বলেও মনে হয় না।”
এক গাল হেসে নবাব মাথা নুইয়ে নিলো। তারপর কী যেন ভেবে অন্য প্রসঙ্গ টানলো, “বিছানাকান্দি নামকরণ কেন করা হয়েছে জানো বা বিছানাকান্দির সম্পর্কে?”
নবাব প্রসঙ্গ পাল্টিয়েছে বুঝতে পেরেও মিষ্টি সেটা নিয়ে কথা বাড়ালো না। নবাবের করা প্রশ্নের প্রেক্ষিতে সে জবাব দিলো, “নাহ, বিছানাকান্দি নিয়ে কখনও খোঁজখবর নিয়ে দেখিনি এমনকি এই নামে জায়গা হতে পারে সেটাও জানতাম না।”
“তাহলে জানলে কীভাবে?”
“কলেজে একবার রিতা খবরের কাগজ নিয়ে এসেছিল। সেখানে বিছানাকান্দির সুন্দর একটা ছবিসহ বেশ কিছু তথ্য দেওয়া ছিল। আমি ছবিটা মনোযোগ দিয়ে দেখলেও তথ্যগুলোর দিকে ফিরেও তাকাইনি।”
“এই কেন, কেন?”
“কারণ রিতার ওপর আমার অনেক রাগ উঠেছিল। পাঁজিটা আমাকে বলেছিল, মিষ্টি বিয়ের পর তুই হানিমুনে বিছানাকান্দি যাবি। এটা না অনেক সুন্দর জায়গা।” মিষ্টি মুখ বাঁকিয়ে কথাগুলো বলতেই নবাব অবাক হয়ে খানিকটা জোরে বলে উঠলো, “হোয়াট?” এরপর উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলো। নবাবকে হাসতে দেখে মিষ্টির হুঁশ হলো নবাবের সাথে বিয়ে হওয়ার পর সে বিছানাকান্দি এসেছে। পালিয়ে বেড়ালেও এটা একপ্রকার হানিমুনের পর্যায়েই পড়ে।
নবাবের হাসি থামার কোনো নাম নেই। এদিকে রাগে এবং লজ্জায় মিষ্টি বলে উঠলো, “ধ্যাত! সবাই আমার সাথেই এমন করে।” এই বলে উঠে দাঁড়ালো মিষ্টি। চলন্ত নৌকায় কোনওরকমে হাঁটতে শুরু করলে নবাব জানতে চায়, “এই মিষ্টি, কোথায় যাচ্ছো?” মিষ্টি জবাব দিলো না কিন্তু তীব্র হাসিতে মত্ত নবাবকে একবার দেখে নিলো মাঝিরা। মাঝবয়েসী দুইজন মাঝি নবাবকে দেখে নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করে আবার কাজে লেগে পড়লো৷
হেলে-দুলে নবাবের মুখোমুখি বসে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো মিষ্টি। নবাবও সময় ব্যয় না করে মিষ্টির পাশে বসে হাসি সংযত করার চেষ্টায় জানতে চাইলো, “শুনবে না বিছানাকান্দি সম্পর্কে?”
“নাহ।” গোমড়ামুখে মিষ্টি জবাব দিতে নবাব ওর কানে ফিসফিস করলো, “বিছানাকান্দি সম্পর্কেই বলবো অন্য কিছু না।” এই শুনে প্রায় সাথে সাথে মিষ্টি কপাল কুঁচকে তাকালো নবাবের দিকে। ওর এমন দৃষ্টিতে নবাব বুঝে গেল মিষ্টি রেগেমেগে একাকার। আর সেটা টের পেয়েই নবাব আরেক দফা হেসে নিলো প্রাণ ভরে।
“এই, তুমি এখান থেকে যাও তো। অসহ্য লাগছে আমার।”
নবাব হাসি থামানোর সর্বোচ্চ চেষ্টায় বললো, “ঠিক আছে, আর হাসবো না। এবার বিছানাকান্দির কথা শুনো।”
“একদম না। আমি কোনও কান্দি-ফান্দির কথা শুনতে চাই না। তুমি এখান থেকে যাও তো।”
“আবার একই কথা রিপিট করছো মিস টিউন?”
“মোটেও না। তোমাকে শুধু অন্য জায়গায় গিয়ে বসতে বলেছি।”
দায়সারা ভাব নিয়ে বেঞ্চে হেলান দিয়ে নবাব বললো, “মিষ্টি যেখানে থাকে মাছি তো সেখানেই যাবে, তাই না?”
অবাকে মিষ্টির চোখ গোলগোল হয়ে গেল, “কী বললে তুমি? দেখো, তোমার মুখ কিন্তু লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে।”
শীতল কন্ঠে নবাব বললো, “তাহলে আর লাগামহীন হতে দিও না।” এবার স্বাভাবিক গলায় বললো, “শুনো এবার বিছানাকান্দি সম্পর্কে।” মিষ্টির একটুও ভালো লাগছে না বিছানাকান্দি সম্পর্কিত কোনো কথা শুনতে কিন্তু নবাবকে থামাতে গেল সে বারংবার তাকে অস্বস্তিতে ফেলছে। পুনরায় লজ্জায় পড়তে মিষ্টির ঘোরতর আপত্তি আছে বিধায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুনতে লাগলো বিছানাকান্দির না জানা কথা।
#প্রীতিকাহন❤️
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_২০
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
নবাব সামনে তাকিয়ে সবুজের সমারোহে চোখ ভাসলো আর বাতাসে মন দুলিয়ে বলতে লাগলো, “বিছানাকান্দি মূলত একটি পাথর খনি। ভারতের খাসিয়া পর্বত থেকে পানির প্রবাহ এসে এখানে মিলিত হয়েছে এবং হ্রদের সৃষ্টি করেছে। এই হ্রদ পিয়াইন নদীর সাথে মিশেছে। এই হ্রদ নিয়ে আসে প্রচুর পাথর। বিছানাকান্দির এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে পাথর আর পাথর। দেখে মনে হবে যেন এক পাথরের বিছানা। নদীর স্বচ্ছ পানি, পাহাড় আর আকাশ মিলিয়ে এখানকার সৌন্দর্য অসাধারণ।”
.
“একটু বিশ্রাম নিয়ে গোসল করে নিবে। আজকে দুপুরের খাবার তাড়াতাড়ি সারতে হবে।”
সকালের নাস্তা শেষ করে সদ্য পা রেখেছে নবাব আর মিষ্টি তাদের রুমে। আর রুমে এসে দাঁড়াতেই নবাব এসব বলছে বলে মিষ্টি জানতে চাইলো, “কেন?”
“গোছগাছ করতে হবে।” জবাব দিয়ে বিছানায় বসলো নবাব। এদিকে মিষ্টি মুখের হিজাব খুলতে গিয়ে বললো, “গোছগাছ? কীসের জন্য?”
“আজকে হোটেল ছেড়ে দিবো। আমরা সিলেট ছেড়ে দিচ্ছি আজকে রাতে।”
মিষ্টির মুখের হিজাব সম্পূর্ণ খোলা হয়ে গেছে। কালো কাপড়টা এখন হাতের মুঠোয় বন্দী করে সে অবাক চোখে নবাবকে দেখলো, “সিলেট ছেড়ে দিচ্ছি মানে? তুমি তো গতকালকে বললে পরশুদিন যাবে মানে আগামীকাল।”
বিছানায় হেলান দিলো নবাব, “গতকালকে পরশুদিনের কথা বলেছিলাম আর এখন বলছি আজকে রাতের কথা। অসুবিধা আছে কোনও?” রাগী দৃষ্টিতে নবাব তাকালো মিষ্টির দিকে। মিষ্টি বুঝতে পারছে না নবাব হঠাৎ করে এমন ব্যবহার কেন করছে?
“নবাব, আমার অসুবিধা হলেও তোমাকে কখনও অসুবিধায় ফেলবার ইচ্ছে নেই আমার। কিন্তু আমাকে বলতে চাও না ঠিক আছে। তবে মিথ্যা বলে কেন…” মিষ্টির কথার মাঝে নবাব নির্বিকায় গলায় বললো, “মিথ্যা ভাবো আর সত্যি আমার আপত্তি নেই কিন্তু আমি কোনেও ঝামেলাকে নিমন্ত্রণ করতে চাই না।”
“তোমার সত্যিই মনে হয় আমি ঝামেলা ডাকতে পারি?” অবিশ্বাসের গলায় জানতে চাইলো মিষ্টি।
এক গাল হেসে নবাব তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, “মেয়েদের ওপর কোনও বিশ্বাস আছে? তারা কখন কী করে?” নবাবের এমন তিক্ত কথায় মিষ্টি আঘাত পেলেও ভয়ে ভেতরটা কেঁপে উঠলো। আনমনে সে নিজেকে প্রশ্ন করলো, “নবাব কি কিছু টের পেয়ে গেছে? সকাল থেকে খুব একটা কথা বলছে না আবার এখনও কীসের সব ইঙ্গিত দিচ্ছে?”
মিষ্টি নিজেকে যথেষ্ট সামলে মুখের চেহারায় নরম ভাব ফুটিয়ে বললো, “অবিশ্বাসী মনে হচ্ছে আমাকে তোমার?” নবাব জবাব দিলো না। মিষ্টিকে দেখে নিয়ে মোবাইলে ব্যস্ত হলো। মিষ্টি নিজে থেকে বললো, “যা খুশি ভাবতে পারো তবে বেঁচে থাকতে নিশ্চয়ই তোমার খারাপ চাইবো না।” এবারও নবাব নিশ্চুপ রইলো। এই মূহুর্তে নবাবের এমন গাম্ভীর্যে মিষ্টির হৃদয় যেন তপ্ত অনলে ছারখার হলো। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মিষ্টি এবার কাপড়-চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করলো।
ফোন নিয়ে ব্যস্ত হলেও নবাবের মাথায় নতুন একটা চিন্তা ঘুরছে পরশুদিন থেকে, “অর্ষা আমার ফোনের নতুন নাম্বারে কল দিলো কিন্তু নাম্বার কোথায় পেল?”
নবাবের মনে চিন্তা বিচরণ করলেও সে মিষ্টিকে কিছু বুঝতে দেয়নি৷ এমনকি নিজে থেকে কল করেও অর্ষার সাথে কথা বলেনি। অর্ষা মিষ্টির সাথে কথা বলার পর অনেকবার কল করেছিল। কিন্তু নবাব কল রিসিভ না করে ওর কল করবার পথ বন্ধ করে রেখেছে।
স্কুলে প্রথমদিন দেখেই অর্ষাকে নবাবের ভালো লেগেছিল। কিন্তু সেই ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা গভীর হওয়ার আগেই নবাব অনুধাবন করলো, সে অর্ষার প্রতি নয় মিষ্টির প্রতি দূর্বল। কিন্তু এই দূর্বলতার নাম যে ভালোবাসা, সেটা নবাবের জানা ছিল না।
ধীরে ধীরে অর্ষার সাথে নবাবের বন্ধুত্ব হয়েছিল। একদিন হুট করে ছুটির পর অর্ষা নবাবকে একটা ছোট্ট কাগজ ধরিয়ে বলেছিল, “এটা বাসায় গিয়ে পড়বে।”
“এখানে পড়লে কী হবে?”
মুচকি হেসে অর্ষা জবাব দিয়েছিল, “আমার লজ্জা করবে।” এই বলে ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল অর্ষা আর নবাব কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরে সেখানে দাঁড়িয়েই পড়েছিল,
“নবাব,
আমি এতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতে পারি না। উইল ইউ বি মাই বয়ফ্রেন্ড?” ছোট্ট এই লেখায় অর্ষা নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে মিষ্টিকে নবাব সেদিনই জানিয়ে ছিল, “আপু, ও তো আমাকে ভালোবাসে।”
“আর তুমি?”
“বুঝতে পারছি না। আসলে ওর অনেক ছেলের সাথেই বন্ধুত্ব আছে যা আমি জানতাম না। তবে ওর সাথে না আমার রোজ কথা হয়। ভালো লাগে অনেক ওর সাথে কথা বলতে। কিন্তু…”
“কিন্তু কী ভাই?”
“আমি দোটানায় আছি আপু।” নবাব সেদিন মিষ্টিকে এড়িয়ে গিয়েছিল। মিষ্টি অবশ্য নবাবকে বুঝিয়ে ছিল, “দেখো, এই বয়সে আমরা যা দেখি তা-ই আমাদের ভালো লাগে। এত ভালো লাগার মাঝে সঠিক ভালো লাগাটা খুঁজে বের করতে আমাদের নিজেকে সময় দিতে হবে। অনেক বিজ্ঞ লোকও এসব বিষয়ে ভুল করে সারাজীবন আফসোস করে কাটিয়ে দেন। আমি চাই না তুমি এমন কিছু করো যাতে তোমার আফসোস হয়।” মিষ্টির কথাগুলো তখন নবাবের কাছে অহেতুক জ্ঞান ছাড়া কিছুই মনে হয়নি। কিন্তু নবাব কোনও প্রতিবাদ না করে মনোযোগ দিয়ে শুনেছিল। তবে অর্ষাকে সে মানা করতে পারেনি।
দীর্ঘ ছয়মাস অর্ষার সাথে নবাবের যেই যোগাযোগ ছিল, একদিন সেটার ইতি টেনেছিল নবাব। সেদিন সরাসরি সে অর্ষাকে বলেছিল, “তোমার মতো মেয়েরাই মেয়ে জাতিকে কলঙ্কিত করছে। তোমাদের কাছে ছেলেদের মন খেলনা হয়ে গেছে। ইচ্ছে হলো খেললে এরপর ছুঁড়ে ফেলে দিলে। তোমার দিকে তাকাতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে।… ভবিষ্যতে তোমার এই নোংরা চেহারা আমাকে দেখাতে এলে আমি এসিড ছুঁড়ে মারবো, মনে রেখো।” সেদিন এত কথা শোনানোর পরও অর্ষা হঠাৎ করে কেন কল করছে, সেই বিষয়টাই নবাব ধরতে পারছে না। সেদিনের পর অর্ষা নবাবের সামনেও আসেনি ফোনেও যোগাযোগ করেনি। মাঝখানে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে বিধায় নবাবের মনে সন্দেহের পোকা বাসা বাঁধছে।
মিষ্টি এখনও ওয়াশরুমে অবস্থান করছে আর এই সুযোগে নবাব নিলয়কে কল করলো। প্রথমবার কল রিসিভ না হওয়ায় নবাব হতাশ হলো কিন্তু দ্বিতীয়বারে নিলয়ের কন্ঠ শুনে স্বস্তি পেল, “নিলয়, কই তুই?”
“এই তো বাসার বাইরে। সব ঠিক আছে তো।”
অন্যমনস্ক গলায় নবাব জবাব দিলো, “তা আছে আর কী।… আচ্ছা, তোর সাথে অর্ষার যোগাযোগ আছে?”
“অর্ষা?” নিলয় চিনতে পারেনি এমন স্বরে অর্ষার নাম উচ্চারণ করলো।
“হ্যাঁ, আরে আমার সাথে স্কুলে পড়তো। তোকে বলেছিলাম না অনেক আগে। তোর সাথেও তো পরিচয় ছিল।”
“ও হ্যাঁ, হ্যাঁ। কিন্তু আমার সাথে তো এখন কথা হয় না। কেন? কী হয়েছে?”
“পরশুদিন থেকে আমাকে লাগাতার কল করে যাচ্ছে। ওর নাম তো ফোনে সেভ করা ছিল। তাই আমার নতুন নাম্বার হলেও ওর নাম ভাসতে সমস্যা হয়নি।”
একটু ভেবে নিলয় জিজ্ঞেস করলো, “আরে তুই কি ভুলে গিয়েছিস? অর্ষা তো জিসানের চাচাতো বোনের বান্ধবী। এই শালা যেই হাবলা। আমার তো মনে হয় ওর থেকেই তোর নাম্বার ঝেড়েছে।”
রাগে চোখ বুজে এলো নবাবের। নিজেকে সামলে নিতে অনেকটা সময় লাগলো। নবাবকে নিশ্চুপ দেখে নিলয় জিজ্ঞেস করলো, “কোনও সমস্যা তৈরি করেছে?”
“নাহ।” নবাবের কন্ঠ যেন রাগে ভারী হয়ে গেল। নিজের কন্ঠকে ওর নিজেরই অপরিচিত মনে হলো।
“আমি জিসানকে কি জিজ্ঞেস করবো?”
“বাদ দেয়। আমি নতুন সীম তোলার চেষ্টা করবো।”
“আবার এসব ঝামেলা করতে যাবি? তার চেয়ে কথা বলে দেখ, কী বলতে চায়?”
“ওর মতো মেয়ের সাথে আমার কথা বলতে রুচিতে বাঁধে। তাছাড়া ওর সাথে আমার কোনও গভীর সম্পর্কও ছিল না। নতুন করে আর ঝামেলা টানতে চাই না। তুই বরং আমার বাড়ির হালচাল দেখে জানা আমায়।”
“ঠিক আছে, কিন্তু তুই সিলেট ছাড়ছিস কবে?”
“আজকে রাতে।”
নিলয় একটু অবাক হলো, “রাতে? রাত করে ভ্রমণ নিরাপদ হবে?”
হালকা হাসলো নবাব, “যেখানে জীবনের নিশ্চয়তাই নেই, সেখানে নিরাপত্তার কথা আর কী ভাববো?”
“তবুও…”
“সমস্যা হবে না। আমি খোঁজ নিয়েই যাচ্ছি। ট্রেনে গেলে কালকে সকালে পৌঁছে যাবো। আর…” হঠাৎ ওয়াশরুম থেকে দরজা খোলার শব্দ হতে নবাব বাঁধা প্রাপ্ত হলো। ফোন কানে ধরে দরজার দিকে দৃষ্টি দিতে দেখলো মিষ্টি দাঁড়িয়ে। ভেজা মুখ আর মুখের দুইপাশে খুচরো ভেজা চুল পড়ে আছে। মাথায় সেঁটে আছে সাদা তোয়ালে আর পরনে কালো রঙের থ্রি-পিস। এমন রূপে মিষ্টিকে আগে দেখেনি নবাব। একটা তরতাজা কালো গোলাপ জলে ডুবিয়ে ভাসালে যেমন অপূর্ব লাগে, তেমন মিষ্টিকেও লাগছে; অপূর্ব এক ভেজা কালো গোলাপ।
নবাব নিজের মাঝে হঠাৎ আসা অদ্ভুত এক অনুভূতির সাথে পরিচিত হলো এখন। এমন অনুভূতির দেখা আগে কখনও পায়নি সে। আচমকা তার হৃদয় থমকে গিয়ে হঠাৎ তড়িৎ গতিতে ছুটতে লাগলো। ফোনের ওপাশে থাকা নিলয় অনবরত হ্যালো হ্যালো করে চলেছে। কিন্তু সেসব উপেক্ষা করে নবাবের কানে কেবল নিজের হৃৎস্পন্দনের শব্দ ছন্দাকারে পৌঁছে যাচ্ছে। নবাবের সমস্ত মনোযোগ যেন মিষ্টির ওপর আঁচড়ে পড়ছে আর স্তম্ভিত হৃদয় জানতে চাইছে, “এই অজানা অনুভূতির নাম কী?”
মিষ্টিও পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নবাবের অবাক নয়নে। মিষ্টি ডান হাতে ভেজা কাপড় আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাম হাতের বৃদ্ধ আঙ্গুল একে একে দুই ভ্রুতে চালিয়ে লেগে থাকা পানি ঝেড়ে ফেললো। এরপর বাম হাতের উল্টো পিঠে চিবুকের পানি মোছবার চেষ্টায় বেলকনিতে পা বাড়ালো।
নবাব তাকিয়ে রইলো মিষ্টির চলে যাওয়ার পথে। আগে কখনও মিষ্টিকে নবাব এমন করে দেখেনি। কত-শত চিন্তা আর জীবন বাঁচানোর তাগিদে এই চারদিনেও সে এতো পর্যবেক্ষণ করেনি মিষ্টির অথচ দু’টো মানুষ একই ঘরে অবস্থান করছে।
মিষ্টি বেলকনিতে চলে যেতে এবার নবাবের কানে নিলয়ের কন্ঠ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে ওর চৈতন্য হলো, “হ্যাঁ, নিলয়।”
“শালা, কই হারায় গেছোস তুই?”
“আরে মিষ্টি…” এইটুকু বলতেই নিলয় দুষ্ট হেসে জিজ্ঞেস করলো, “কী কয় ভাবী?… বয়সে তো বড়। তোরে মাইর-টাইর দেয়?”
“ধুর শালা! খালি রসিকতা।” বিরক্ত হলো নবাব কিন্তু একটু আগে হৃদয়ে ভাসা অনুভূতিটা এখনও হৃদয়ে কিঞ্চিৎ বিরাজমান।
“যাহ বাব্বা! রাগ করছিস কেন? মারতেও তো পারে, তাই না? আমার বউ তো ছোট হয়েও আমাকে কোনও ছাড় দেয় না।”
একটু গম্ভীর হলো নবাব, “তুই কি আমার সমস্যা শুনবি না-কি নিজের সমস্যার কথা বলেই…” নবাবের কথার মাঝে নিলয় বললো, “আরে না, তুই বল।”
“তাহলে শোন।”
.
কালকে বৃষ্টির বিপরীতে কড়া রোদ্দুরে ঝকমক করছিল আকাশ। কিন্তু আজকে সকাল থেকে আকাশ মুখ ভার করে আছে যেন সূর্যের সাথে আকাশের তুমুল ঝগড়া হয়েছে। বেলকনির জানালা দিয়ে খোলা আকাশের অনেকটাই দেখতে পাচ্ছে মিষ্টি। ধূসররঙের মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে এখানে-সেখানে।
ভেজা কাপড় জানালার গ্রিলে মেলে দিয়েও অহেতুক নাড়াচাড়া করছে মিষ্টি। আর বারংবার উঁকি দিয়ে নবাবকে দেখছে, “এত কীসের কথা চলছে ফোনে? মুখ দেখে তো বুঝা যাচ্ছে ফূর্তিতে আছে।” হালকা হেসে আনমনে বললো মিষ্টি, “ছেলেরা অন্য সবার সাথে ঠিকই হাসিখুশিতে কথা বলতে পারে। কিন্তু মেয়েদের সামনে দাঁড়ালেই তাদের হাসিখুশি উবে গিয়ে হতাশা এনে দাঁড় করায়। আমাদের সামনে এলেই এদের মনে হয় জীবন কাল্পনিক নয়, বাস্তবিক। আর এসব যুক্তি দেখিয়ে এরা আমাদের মনে আঘাত দিতে কার্পণ্য করে না।” এসব ভাবতে গিয়ে মূহুর্তেই আকাশের কালো মেঘ এসে জমা হলো মিষ্টির মন আকাশে।
চলবে…