প্রীতিকাহন পর্ব ২১+২২

#প্রীতিকাহন❤️
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_২১

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

নবাব ফোনে কথা বলার মাঝে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো। এক হাতে ফোন ধরে রেখে অন্য হাতে তোয়ালে এবং কাপড়-চোপড় নিতে শুরু করলো। ওর হাবভাবে মিষ্টি বুঝতে পারছে নবাব এবার ওয়াশরুমে ঢুকবে আর সেই আশায় মিষ্টি অপেক্ষার প্রহর গুনছে।

“নিলয়, আমি রাখছি। গোসল সেরে আবার খেতে যেতে হবে… হুম, তুইও সাবধানে থাকিস।” এই বলে নবাব ফোনটা বিছানার পাশে থাকা ছোট্ট টেবিলের উপর রেখে দিলো। বেলকনির পাশ দিয়ে ওয়াশরুমে যাবে নবাব– এমন ভাবনায় মিষ্টি উঁকিঝুঁকি দেওয়া বন্ধ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।

সাদা তোয়ালে গলায় ঝুলিয়ে কাপড়-চোপড় নিয়ে নবাব ওয়াশরুমে চলে এলো। তবে বেলকনির ঘা ঘেঁষে আসতে গিয়ে আঁড়চোখে মিষ্টিকে একবার দেখে নিলো। এখন সেই অজানা অনুভূতির রেশও নেই নবাবের মাঝে কিন্তু তাকাতে গিয়ে যেন ওর মনে হলো, “মানুষের সৌন্দর্য একটা অদ্ভুত জিনিস। হুটহাট করে কাউকে খুব বেশি সুন্দর লাগে অথচ এই সুন্দর লাগার পিছনে কোনও আহামরি কারণ থাকে না।”

শব্দ করে ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ হতে বেলকনি ত্যাগ করলো মিষ্টি। অতি সাবধানে হাঁটতে গিয়েও নূপুরে সুর উঠলো। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে মিষ্টি আলতো হাতে নবাবের ফোন নিয়ে লক খোলার চেষ্টা করলো। কালকে মাঝরাতেও অনেকবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু বারংবার ব্যর্থ হওয়ার পর ফোন আধঘন্টার জন্য পাসওয়ার্ড অপশন দেখানো বন্ধ করে দিয়েছিল।

“কী এমন পাসওয়ার্ড এতে দেওয়া যে খুলছেই না? কালকে রাতে কত কী দিলাম কিন্তু হলো না। এদিকে নবাব হয়ত টের পেয়ে গেছে আমি ওর ফোন নাড়াচাড়া করার চেষ্টা করি ওর অজান্তে।” মনে মনে এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মিষ্টি। এরপর বিড়বিড় করলো, “নবাব, এভাবে জীবন চলতে পারে না। তাছাড়া আমি মেয়ে হয়ে পরিবারের সর্বনাশ করে নিশ্চয়ই তোমার সাথে এভাবে ঘুরে বেড়াতে পারি না। আমাকে যে করে হোক জানতে হবে আমার পরিবারের এখনকার অবস্থা আর…” ফোনের লক খুলছে না বলে বিরক্ত হলো মিষ্টি, “ধ্যাত!”

আন্দাজের ওপর মিষ্টি পাসওয়ার্ড টাইপ করে যাচ্ছে কিন্তু কোনও কাজ হচ্ছে না। একাধিকবার ভুল পাসওয়ার্ড টাইপ করার কারণে আবারও আধঘন্টার জন্য পাসওয়ার্ড অপশন বন্ধ হয়ে গেল।

“হায় আল্লাহ! এটা কী করলাম আমি? এখন তো নবাব ফোন হাতে নিলেই বুঝে যাবে আমি ফোন আনলক করার চেষ্টা করেছি। তাছাড়া আধঘন্টা ধরে তো ও আর গোসল করবে না।” ভাবতে গিয়ে বাচ্চাদের মতো হাতের নখে দাঁত চাপলো মিষ্টি। সাত-পাঁচ না ভেবে ফোনটা আগের জায়গা রেখে সেখান থেকে সরে এলো।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথার তোয়ালে হাত দিতেই ওয়াশরুমের দরজা খুলে গেল। মিষ্টি ভয়ে যেন কাঁপতে শুরু করলো, “আল্লাহ, এই যাত্রায় আমাকে বাঁচিয়ে দিন।” আনমনে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে ভেজা চুল মেলে দিলো। অগোছালো চুলে তোয়ালে চালিয়ে যখন পিছন ফিরলো, তখন নবাবের মুখোমুখি হলো মিষ্টি। নবাব এতক্ষণ ওর পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু ভয়ের দরুন সে এটা টের পায়নি।

নবাবের চোখ রক্তবর্ণ হয়ে আছে। কারণ ঠাওর করতে না পারলেও ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে জানতে চাইলো, “কিছু বলবে?”

“সরে দাঁড়াও সামনে থেকে।” নবাবের কন্ঠ অনেক ভারী শোনালো আর এতে চমকে গিয়ে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কান্না করেছো?”

চোখ নামিয়ে নিলো নবাব কিন্তু পরক্ষণেই দাঁতে দাঁত চেপে বললো, “তোমাকে আমি সরতে বলেছি।”

“কেন এমন করছো তুমি আমার সাথে? কী করেছি আমি?” মিষ্টির প্রশ্নে একটা কষ্ট ভেসে উঠলো কিন্তু সেসবে পাত্তা না দিয়ে নবাব বললো, “সেটা নিজেকে জিজ্ঞেস করো, কী করেছো তুমি?” এই বলে পাশ কাটিয়ে নবাব আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। মিষ্টি পিছন থেকে নবাবকে দেখলো অসহায়ের ভঙ্গিতে এরপর মনে মনে বললো, “জিজ্ঞেস করে আর কী হবে? আমার মন তো জানে আমি কোনও অন্যায় করিনি নবাব।”

.

সারাদিন মেঘাচ্ছন্ন থাকলেও বিকালের পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। এখন রাত বাড়ছে আর রেলস্টেশন ধীরে ধীরে ফাঁকা হচ্ছে সাথে কোলাহলও অনেকটা কমে আসছে। একটা বেঞ্চে বসে পেটের ক্ষুধায় কাতর হচ্ছে মিষ্টি। এক-দুই বেলা না খেয়ে থাকার অভ্যাস আছে ওর। কিন্তু রাগের মাথায় না খেলে ক্ষুধা যেন প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে মাঠে নামে।

আজকে সকাল থেকেই নবাবের অদ্ভুত আচরণে মিষ্টি ব্যথিত হয়েছে বারংবার। মধ্যাহ্নভোজে যখন গেল, তখনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মুখোমুখি বসে যখন ওয়েটার আসার অপেক্ষা চলছিল, তখন গম্ভীর কন্ঠে নবাব জিজ্ঞেস করেছিল, “কী খাবে?”

গম্ভীর কন্ঠ আর রাগে ভরপুর চেহারার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি চট করে ভাবতে পারছে না, কী বলা উচিত? কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে সে জবাব দিলো, “তুমি যা খাবে।”

নবাব মুষ্টিবদ্ধ হাতের ওপর মুখ রেখে বসে ছিল। এখন জবাব পেতেই সোজা হয়ে পুনরায় ওয়েটারকে ডাকতে শুরু করলো। ওয়েটার আসার আগ পর্যন্ত সময়টুকুতে নবাব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিষ্টিকে দেখলো। নবাবের এমন চাহনিতে মিষ্টি চুপসে গিয়ে চোখের পাতা নামালো।

ওয়েটার এসে যখন জানতে চাইলো কী কী অর্ডার করবেন, তখন নবাব মিষ্টির দিকে তাকিয়ে ওয়েটারের কাছে জানতে চাইলো, “সবচেয়ে ঝাল জাতীয় খাবারে মধ্যে কী কী আছে?” এমন প্রশ্নে মিষ্টি আচম্বিতে তাকালো নবাবের দিকে। হিজাবের ফাঁকে তার দুই চোখের তারায় নবাব যেন প্রশ্ন খুঁজে পেল, “তুমি তো ঝাল খাও না নবাব। তাহলে এমনটা কেন জানতে চাইছো?” মিষ্টির চোখে ভাসমান প্রশ্নের মাঝেই ওয়েটার বেশ কয়েকটা খাবারের নাম বললো আর সেখান থেকে কিছু খাবার নবাব অর্ডার করলো।

ওয়েটার চলে যেতেই নবাব আগের মতো টেবিলের উপর কনুইয়ের ভরে হাতের ওপর মুখ রাখলো। স্থির দৃষ্টিতে যখন মিষ্টি দেখলো নবাবকে, তখন নবাবের চোখে রাগের রাজত্ব ভেসে উঠলো। হিংস্র হলো নবাবের চোখজোড়া, চোয়াল হলো টানটান আর এসবের মাঝে ভয়ে কেঁপে উঠলো যেন মিষ্টির মন।

ওয়েটার খাবার পরিবেশন করে যখন প্রস্থান করলো, তখন এক প্লেট খাবার মিষ্টির সামনে দিয়ে থমথমে গলায় নবাব বললো, “খাও।”

প্লেটে তাকিয়ে মিষ্টি বুঝতে পারলো এটা মুরগির মাংস দিয়ে তৈরি কোনও খাবার। কিন্তু এতে ঝালের পরিমাণ অনেক বেশি মনে হচ্ছে কারণ খাবারটা লাল হওয়ার পাশাপাশি কাঁচা মরিচের বাহার দেখা যাচ্ছে।

নবাব যেমন ঝাল খায় না, তেমনি মিষ্টিরও ঝাল সহ্য হয় না। অনেক আগে একবার শুঁটকির ভর্তা খেয়েছিল। এত পরিমাণ ঝাল ছিল যে, ওর মনে হয়েছিল শুঁটকির চেয়ে মরিচ বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। এরপর অতিরিক্ত ঝালে মিষ্টির পেটে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয় এবং ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয়েছিল। কারণ মিষ্টির আলসারের সমস্যাও আছে কিঞ্চিৎ। ঐ ঘটনার পর থেকে অতিরিক্ত ঝাল খাওয়ার সাহস আর হয়নি মিষ্টির। সেটা মনে করেই এখন নিচু গলায় জবাব দিলো, “খাবো না।”

“কেন?”

“ক্ষিধে নেই।”

মিষ্টির সামনে থেকে খাবার প্লেট নিয়ে নিজের সামনে রাখলো নবাব। এরপর সোজা হয়ে বসে দুই হাতের তালু একে অপরের সাথে শব্দ করে ঘষে বললো, “আমি তো খাবো কারণ আমার প্রচুর ক্ষিধে পেয়েছে।” এই বলে নবাব খেতে শুরু করলো।

খাবারে হালকা ঝাল দিলেই নবাব তার মায়ের সাথে রাগারাগি করতো– এই বিষয়টা মিষ্টির জানা আছে বিধায় মিষ্টি বলার চেষ্টা করলো, “কিন্তু নবাব…” এইটুকু বলতেই নবাব দাঁতে দাঁত চাপলো, “ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।” নবাব বিদেশে থাকলেও হুটহাট ইংরেজি বলে না। তবে রেগে থাকলে ইংরেজির জাহাজ হয়ে যায় যা মিষ্টির অজানা নয়। কিন্তু এখন তিন শব্দের এই ইংরেজি বাক্য মিষ্টিকে দমিয়ে দিলো। ফলে মিষ্টির সাহস হলো নবাবকে আর কিছু বলবার।

নবাব খেয়ে চলেছে একে একে ঝালযুক্ত খাবার। খাবারগুলো একটু একটু করে মুখের ভেতর নড়ছে আর ওর চোখজোড়া টাটকা মরিচের মতো লাল হয়ে বিন্দু বিন্দু জল জমছে। নবাবের এমন চেহারায় মিষ্টি নিজের অন্তরে ব্যথা অনুভব করলো। তাই হুট করে নবাবের হাত ধরে বললো, “নবাব, থামো দয়া করে। হাতজোর করছি আমি তোমার কাছে। খেয়েও না আর।”

“হাত ছাড়ো।” দাঁত কিড়মিড় করলো নবাব।

মিষ্টির গলায় কান্না ভাসতে লাগলো, “দোহাই লাগে তোমার। বন্ধ করো নবাব। কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো? বলো না আমার অন্যায়টা কী?”

মুখের খাবারটুকু গিলতে গিয়ে চোখ-মুখ খিঁচে গেল নবাবের। গলা আর বুক যেন ঝালে জ্বলে যাচ্ছে। নবাবের এই মূহুর্তে ইচ্ছে করছে এক পুকুর পানি গোগ্রাসে গিলতে। কিন্তু রাগের বশে সে চোখের সামনে থাকা পানির গ্লাসও স্পর্শ করছে না।

নবাব বাম হাতে মিষ্টির হাত সরিয়ে দিলো। চাপা কষ্ট আর তীব্র ঝালে ফুঁসে উঠলো সে এবার, “অন্যায় তোমার কেন হবে? আমার অন্যায় হয়েছে… হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার অন্যায় হয়েছে তোমার কাছ থেকে ভালোবাসা পাওয়ার আশা করে।”

মিষ্টি চোখ নামিয়ে আশেপাশে নজর করতে নবাবের হুঁশ হলো সে একগাদা লোকের সামনে চেঁচামেচি করছে। তাই এবার গলার স্বর নামিয়ে কিন্তু রাগের তেজ দ্বিগুণ করে বললো, “একটু তো ভালোবাসাই চেয়েছিলাম আমি তোমার কাছে। কিন্তু তুমি আমার সাথে এমন বেইমানি কেন করছো?” নবাবের মুখ নিসৃত এমন বাক্যে অবাক চোখে তাকালো মিষ্টি নবাবের দিকে। এতক্ষণ ধরে যেই অশ্রু সে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, এখন সেটা বিনা বাধায় উপছে পড়লো। বিস্ময়ের পরিমাণ এতোটাই বেশি যে, মিষ্টি যেন সেটা নিজের মাঝে চেপে রাখতে গিয়ে কেঁপে উঠছে।

“আমি তোমার সাথে বেইমানি করছি?” অনেক কষ্ট নিজেকে স্থির করে মিষ্টি প্রশ্ন করলো নবাবকে। ওর প্রশ্নে ক্ষেপে গিয়ে নবাব বললো, “তুমি কী আমাকে বাচ্চা মনে করো মিষ্টি? হ্যাঁ? আমি দুই বছরের বাচ্চা। তাই আমাকে যা বুঝাবে, আমি তাই বুঝবো? তুমি কালকে রাত থেকে আমার ফোন নাড়াচাড়া করছো, সেটা কি আমার অজানা? আজকে যখন গোসল করছিলাম আমি একশো ভাগ নিশ্চিত তুমি আমার ফোন ধরেছো?… নিজের পরিবারের জন্য এত মায়া করছো অথচ সেই পরিবার তোমার জীবন নিয়ে খেলা করতে মত্ত। এদিকে যে তোমাকে জীবন দিয়ে ভালোবাসে, নিজের চাকচিক্যময় বিদেশের জীবন ফেলে, খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে; তার প্রতি তোমার মায়া হয় না মিষ্টি?”

নবাবের এত কথার ভিড়ে মিষ্টি যেন হারিয়ে গেল বিস্ময়ের দুনিয়ায়। সে ভেবেই পাচ্ছে না নবাবকে কী জবাব দিবে? তাই শুধু ছোট্ট একটা শব্দ তার মুখ থেকে নিসৃত হলো, “নবাব…”

এঁটো হাত দেখিয়েই মিষ্টিকে থামিয়ে দিলো নবাব। এরপর বলতে শুরু করলো, “বলেছিলে আমার মৃত্যু তুমি সহ্য করতে পারবে না। এটা যে মিথ্যা তার প্রমাণই দিলে। কারণ তুমি ভালো করেই জানো বাসায় যোগাযোগ করলেই আমরা ধরা পড়ে যাবো। কেন মিষ্টি? আমি কি এতটাই ঘৃণার পাত্র হয়ে গিয়েছি তোমার কাছে? যে আমাকে বিপদে ফেলবার এত বুদ্ধি খাটিয়ে বেড়াচ্ছো।”

একটু থামলো নবাব। কী যেন ভেবে বললো, “ওহ, তুমি তো আমাকে কখনও ভালোবাসোনি। আমি নিজেই বেহায়ার মতো তোমাকে ভালোবেসেছি আর এখনও বাসি। তাছাড়া জোর করে তোমায় বিয়ে করেছি।… ঠিক আছে, তুমি যখন চাইছো ঐ মানুষগুলোর হাতে আমার মরণ হোক, তোমার কাছে যখন তোমার পরিবারই বড় হয়ে গেছে। তাহলে আমি তোমাকে কথা দিলাম মিষ্টি। এই আমি তোমাকে নিজে বাসায় পৌঁছে দিতে যাবো কিন্তু তার আগে তোমার সাথে শেষ বোঝাপড়া করতে চাই। তবে সেটা সিলেট ছাড়ার পর।”
#প্রীতিকাহন❤️
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_২২

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

খাওয়া ফেলে উঠে দাঁড়ালো নবাব। সামনে পা বাড়িয়েও থেমে গেল। ফিরে এসে চেয়ারে ভর দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালো, “আমার ফোনের পাসওয়ার্ড ভয়ংকর কিছু ছিল না। যদি ভালোবাসতে আমায় তাহলে বুঝতে পারতে পাসওয়ার্ড ছিল মিষ্টি।… হ্যাঁ, আমার ফোন, ই-মেইল আইডি, ফেইসবুক আইডি, এমনকি ব্যাংকের কাজকর্মেও আমি এই মিষ্টি নামক পাসওয়ার্ডই ব্যবহার করি। এমনটা কবে থেকে করা শুরু করেছি জানো? যেই দিন আমার হৃদয় তোমাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে কবুল করেছিল সেই দিন থেকে। কিন্তু আফসোস এসবের মূল্য আমাকে এভাবে পেতে হলো।”

নবাব চলে গিয়েছিল দ্রুত পায়ে। ওর চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে যেই কান্নার ঝড় ঘুরপাক খাচ্ছিলো মিষ্টির হৃদয়ে, সেটা চাপা দিতে না পেরে টেবিলের ওপর হাত রেখে মুখ গুঁজে দিয়েছিল মিষ্টি। আর সাথে সাথেই অঝোরে কেঁদে উঠেছিল।আশেপাশের মানুষ তাকিয়ে দেখছে– এই ভাবনা এলো না তার মাঝে কারণ তার মন কেবল একটা কথাই আওড়াচ্ছে, “আমাকে তুমি ভুল বুঝলে নবাব, ভুল বুঝলে।”

“ধ্যাত!” হঠাৎ বিরক্তি ভরা কন্ঠে ছোট্ট একটা শব্দ কানে আসতেই মুখ ফিরিয়ে নবাবকে দেখলো মিষ্টি। ক্যাপ আর মাস্কের জন্য চেহারা দেখা না গেলেও সে বুঝতে পারছে নবাব এখন তিক্ত মেজাজে আছে। রেস্টুরেন্টে ঘটে যাওয়া কাহিনির পর মিষ্টি আর নবাবের সাথে কথা বলেনি। নবাবও তেমন আগ্রহ দেখায়নি। তবে প্রয়োজনে এটা সেটা বলেছিল।

“কী হয়েছে?” নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে মিষ্টি নবাবকে জিজ্ঞেস করলো কিন্তু নবাব জবাব না দিয়ে নিজের পকেটে হাত চালাতে ব্যস্ত। নবাবের হাবভাবে মিষ্টি ঠাওর করলো কিছু একটা খুঁজছে নবাব। তাই আবার জিজ্ঞেস করলো, “কী হয়েছে বলছো না কেন?”

মুখ ফিরিয়ে ফুঁসে উঠলো নবাব, “তোমাকে বললে কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?”

যথেষ্ট শান্ত গলায় মিষ্টি জবাব দিলো, “রেস্টুরেন্টে সবার সামনে আমার চরিত্র উপস্থাপন করলে। কিচ্ছুটি বলিনি। তোমার যদি মনে হয় এত কথা শোনানোর পরও তোমার মন ভরেনি। তাহলে একটা মাইক হাতে দাঁড়িয়ে পড়ো। স্টেশনের সবাইকে জানিয়েও দাও আমি একটা রাক্ষসী, বেইমান আর তোমার সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ আমি ছিবলে ফেলে দিচ্ছি। তোমাকে আমি…” থেমে গেল মিষ্টি। প্রচন্ড কান্নায় ভেঙে পড়লো সে। এদিকে মিষ্টির হঠাৎ কান্নায় নবাবের রাগ উবে গেল। সে হতভম্বের মতো বসে রইলো। কিছু বলার জন্য ভাবছে কিন্তু অগোছালো হওয়া শব্দভাণ্ডারে ডুব দিয়েও কোনও শব্দ তুলতে পারলো না।

“নবাব, আমি তোমার মৃত্যু চাই– এটা বলার আগে আমাকে গুলি করে মেরে দিতে পারলে না? আমি বেইমানি করেছি– এমন বলার আগে একবারও আমার কথা ভাবলে না?” নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে মিষ্টি জানতে চাইলো কিন্তু নবাব প্রশ্নের বিপরীতে মাথা নুইয়ে নিলো।

“আমি তোমার অজান্তে ফোন নাড়াচাড়া করেছি কিন্তু তোমাকে মারার পরিকল্পনা করতে নয়। আমাদের পরিবারের হালচাল জানতে। তোমার এবং তোমার পরিবারের জন্য আমার খুব চিন্তা হচ্ছিল। তাই ভেবেছিলাম, আমি সবাইকে বুঝিয়ে এখান থেকেই তোমাকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিবো যাতে তোমার কোনও ক্ষতি না হয়। কিন্তু তুমি তো আমাকে বেইমান বানিয়ে দিলে।” মিষ্টি বলে গেল আর নবাব নিরবে শুনে গেল।

“সেই ছোট্টবেলা থেকে তোমাকে ভালোবাসি। আমার ভালোবাসাটা হয়ত বোন হিসেবে। তাই বলে ভালোবাসি না এটা বলতে পারলে?… আমার মতো স্বামী খাদক মেয়ের জীবন কেমন হতে পারে তুমি কি দেখোনি নবাব?”

“ওহ্… মিষ্টি… থামো এবার…” একটা কষ্ট ভেসে এলো নবাবের কন্ঠে কিন্তু মিষ্টি থামলো না। পূর্ন দৃষ্টিতে নবাবকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “কেন থামবো? আমি তো এমনই; স্বামী খাদক, তাই না বলো? আজকে তো আবার নতুন নাম পেলাম, বেইমান।” শেষ বাক্যে তাচ্ছিল্যের সুরের সাথে হালকা হেসে উঠলো মিষ্টি। এতে নবাব নিজের মাঝে থাকা অপরাধ বোধটা আবার জাগ্রত হলো। আশেপাশে তেমন কোনও মানুষ নেই। তবে যারা আছে, তারা মিষ্টি এবং নবাবের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে যেন সার্কাস দেখছে।

“আর পরিবারের চিন্তা করি শুধু– এটাই তো বলেছিলে। যদি পরিবারের চিন্তা থাকতো তবে তোমাকে কবুল বলে গ্রহণ করতাম না।” মিষ্টির কথার প্রেক্ষিতে নবাব এবার চোখ তুলে তাকালো, “কবুল বলে হয়ত আমার ওপর করুণা করলে। তুমি তো জানোই আমি যত উগ্রবাদী মানুষই হই না কেন তোমায় একটা আঁচড়ও লাগতে দিবো না।”

“নবাব, কেউ আমায় কোনওদিনও বুঝলো না। ভেবেছিলাম তুমি হয়ত আমায় বুঝবে কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস দেখো, তুমিও আমাকে বুঝলে না।”

“ভুল বললে তুমি…” হাত দেখিয়ে নবাবকে থামিয়ে দিয়ে মিষ্টি বললো, “কোনটা ভুল আর কোনটা সঠিক, সেই ব্যাখ্যা আমি আর এখন শুনতে চাই না নবাব। তুমি যেই কাজ করছিলে, সেটাই করো আর আমাকে একা থাকতে দাও।” এই বলে মিষ্টি খানিকটা সরে গিয়ে বসলো মুখ ফিরিয়ে। ওকে অপলক চোখে দেখে পুনরায় নিজের পকেটে হাত চালালো নবাব। এরপর যেন নিজেকেই বলে উঠলো, “ফোনটা তবে হোটেলেই ফেলে এলাম?”

.

উদয়ন এক্সপ্রেস চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে সিলেট প্রস্থান করলো রাত নয়টা চল্লিশ মিনিটে। ট্রেন ছেড়ে দিতেই সিটে হেলান দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো নবাব।

“আবর্জনা সিলেটে ফেলে রেখে যাচ্ছি বলে বড্ড শান্তি লাগছে।” আনমনে কথাটা বলে মিষ্টিকে দেখলো নবাব। স্টেশনে উত্তেজিত হওয়ার পর মেয়েটা ওর সাথে আর একটা কথাও বলেনি। এখন নবাবের খুব ইচ্ছে হচ্ছে মিষ্টির সাথে কথা বলতে কিন্তু কোথাও একটা বাঁধা অনুভব করে ইচ্ছে বাতিল করলো সে।

আগে যত্রতত্র ঘুম আসতো না নবাবের চোখে। কিন্তু যবে থেকে সে মিষ্টিকে নিয়ে ছোটাছুটি করছে, তবে থেকে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে দিলেই ঘুম এসে ধরা দেয়। কখন যে চোখের পাতা এক বাঁধনে আবদ্ধ হয়েছে, সেটা টের পায়নি নবাব। হঠাৎ একটা গোঙানির শব্দে তার ঘুম উড়ে যেতে সে সোজা হয়ে বসে। মিষ্টির দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠে নবাব, “এই মিষ্টি, কী হয়েছে তোমার?”

দুই হাতে মাথা চেপে মিষ্টি চাপা কান্নায় কুঁকড়ে উঠছে। অনেক কষ্টে সে অস্ফুটস্বরে বললো, “কি… কিছু হয়নি… আ… আমার।”

“না হলে এমন করছো কেন? এই মিষ্টি, কী হয়েছে বলো না?” অস্থির হয়ে উঠলো নবাব।

সিটে মাথা রেখে আবার সরিয়ে নিচ্ছে। চোখ-মুখ খিঁচে কোনওমতে জবাব দিলো, “মা…মাথা ব্যথা করছে ভী…ভীষণ।”

“কেন? হঠাৎ মাথা ব্যথা করছে কেন?” হঠাৎ নবাবের হুঁশ হলো মিষ্টির হাইপোটেনশন আছে। আগে প্রায়শই ব্লাড প্রেসার লো হতো আর মাথা ব্যথায় ছটফট করতো। দুপুরে মিষ্টি কিছু খায়নি বিধায় এমনটা হচ্ছে আর এটা মাথায় আসতেই অনতিবিলম্বে নবাব উঠে দাঁড়ালো। ব্যাগ থেকে কিছু শুকনো খাবার আর পানির বোতল হাতে মিষ্টিকে বললো, “এগুলো খেয়ে নাও। দেখবে ঠিক হয়ে গেছে।” মিষ্টি কোনও জবাব দিলো না। নবাব এসব বলার আগে যেমন বসে ছিল মাথায় হাত চেপে এখনও তেমনই বসে আছে মিষ্টি।

“এই মিষ্টি, খেয়ে নাও। তোমার ব্লাড প্রেসার হয়ত লো হয়ে গেছে। আমার পাগলামির জন্য দুপুরে খাওয়া হয়নি তোমার। তাই তো এমনটা হলো। এখন আর না খেয়ে থেকো না।” শেষের দিকের কথাগুলোতে নবাবের কন্ঠ ভারী শোনালো। নিজের অসহ্য যন্ত্রণার মাঝে মিষ্টি নবাবের কষ্ট অনুভব করতে না পারলেও বুঝতে পারছে, মিষ্টির এখন কিছু খাওয়া দরকার।

হাত বাড়িয়ে প্রথমে পানির বোতল নিলো মিষ্টি এরপর অন্য হাতে মুখের হিজাব তুলে দিতেই নবাবের হৃদয় চাপা কষ্টে কুঁকড়ে উঠলো। ফ্যাকাশে আর ভেজা চোখের এই মুখটা নবাবকে বাধ্য করলো নিজেকে প্রশ্ন করতে, “কী করলি নবাব তুই? রাগ আর অভিমানে মেয়েটার এমন হাল করলি? এটাই কি তোর ভালোবাসা?”

কষ্টটা বুকে ভারী হতেই চোখ বুজে সেটা হৃদয় গহীনে আরও চাপা দিতে চাইলো নবাব। শুকনো মুখ দিয়ে যখন জল গড়িয়ে পড়লো মিষ্টির গলনালি দিয়ে এতেই কিঞ্চিৎ পরিবর্তন হয়ে গেল মিষ্টির মুখাবয়ব। কুয়াশা ভেদ করে আসা একরত্তি সূর্যের আলোর মতো স্বস্তি দেখা দিলো নবাবের মনে।

“এবার এগুলো খেয়ে নাও।” নরম কন্ঠে নবাব বললো এবং পাউরুটি আর কলা এগিয়ে দিলো। মিষ্টি নিঃশব্দে একটা পাউরুটি নিয়ে দাঁত বসিয়ে দিলো। শুকনো পাউরুটি যখন দাঁতের তলায় পিষে দলা হলো, তখন সেটা গিলতে গিয়ে পানির প্রয়োজন হলো। পানির সাহায্যে পাউরুটি পাকস্থলীতে পাঠিয়ে মিষ্টি এবার তাকালো নবাবের দিকে। কথা বলতে তার ইচ্ছে করছে না কারণ সেই শক্তিই যেন নেই মিষ্টির দেহে তবুও বললো, “তুমিও খাও। আমার একা খেতে ভালো লাগছে না যদিও একাই খাচ্ছি।”

ঠোঁট প্রসারিত হলো নবাবের। মিষ্টির দিকে তাকিয়েই সে একটা পাউরুটি হাতে নিলো। আলতো কামড়ে যখন আস্ত পাউরুটিকে ভাগ করলো, তখন ফ্যাকাশে চেহারায় হালকা হেসে মিষ্টিও খেতে শুরু করলো।

“ভাই, এমন করছো কেন?” ম্যাসেজ পাঠিয়ে জবাবের অপেক্ষা করছে মিষ্টি। এখন রাত এগারোটা। পড়াশোনা নেই বিধায় আজকে তাড়াতাড়িই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে মিষ্টি। ভার্সিটিতে পড়াশোনা করার সুবাধে এখন তার নিজের একটা চকচকে স্মার্টফোন আছে। এখন সেই চকচকে ফোন শোভা পাচ্ছে তার সরু আঙুলের ভাঁজে। আজকে হঠাৎ করে মান-অভিমানের পালা শুরু হয় নবাব এবং মিষ্টির মাঝে। অহেতুক রেগে গিয়ে নবাব বলেছে, “খাবো না আমি আজকে রাতে।”

“বাচ্চাদের মতো এমন কেন করছো? আঠারো হয়ে গেছে তোমার। এখন নিশ্চয়ই বাচ্চা নও তুমি।”

“বাচ্চা যখন নই, তখন যেটা বলছি সেটা নিয়ে আনসান করছো কেন? তুমি যে আমাকে ভাই ডাকো আমি তাতে কিছু বলি? তোমার ভালো লাগে তাই তুমি ভাই ডাকো। আমার আপু ডাকার ইচ্ছে নেই তাই আমি ডাকবো না।”

আজকে হঠাৎ করে নবাব ম্যাসেজে মিষ্টিকে নাম ধরে জিজ্ঞেস করে, “এই মিষ্টি, তুমি কি এখনই ঘুমিয়ে পড়বে?” এতে খুব বেশি অবাক হলেও মিষ্টি তার মতো করে জবাব দিয়েছিল, “না ভাই।”

“রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ কি মিষ্টির?” এবার আর মিষ্টি চুপ থাকতে পারেনি, “ভাই, তুমি হঠাৎ করে আমাকে আমার নাম ধরে ডাকছো কেন?”

“কেন? কী হয়েছে তাতে?”

“তুমি তো আমার চেয়ে ছোট।” মিষ্টি জবাব দিয়েছিল।

“ছোট তো কী হয়েছে? আমি তোমার ছোট বলে কী আপু বলতে হবে? আমি তো তোমার বন্ধু আর বন্ধুকে কেউ আপু বলে?”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here