প্রীতিকাহন পর্ব ২৩+২৪

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_২৩

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

“দেখো ভাই, আমি যেহেতু তোমার বড় তাই আমাকে আপু বলেই ডাকতে হবে।” বেশ কিছুক্ষণ ভেবে মিষ্টি ম্যাসেজ পাঠালো নবাবকে আর প্রতিত্তোরে নবাব জানালো, “ঠিক আছে, যখন চাও না আমি তোমাকে বন্ধু মনে করি তবে আমি আজকে রাতে খাবো না।” এতেই মিষ্টি ঘাবড়ে গিয়ে চুপটি করে আছে। ভাবনার দিঘির গভীর হচ্ছে তার। অতিরিক্ত ভাবনায় মত্ত হলে আপনার থেকে মিষ্টির ডান হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুল মুখে চলে যায়। নখ আর দাঁতের মিলন হতেই সে চোখ চঞ্চল করে আর সমাধান খুঁজতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে৷

“তুমি কি চলে গেছো?” মিষ্টি অনেকক্ষণ যাবত ম্যাসেজ পাঠায়নি বলে নবাব জানতে চাইলো। মুখ থেকে হাত সরিয়ে মিষ্টি টাইপ করতে শুরু করলো, “তুমি না খেলে শরীর অসুস্থ হবে সেটা তোমার অজানা নয় তবুও এমন জেদি আর আপসহীন কেন হচ্ছো আজ?” এবার নবাবের ম্যাসেজ আসতে দেরি হলো।

“তোমাকে তো বলছি না আমার জেদ দেখতে৷ গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো তুমি।” এমন ম্যাসেজে মিষ্টির বেশ রাগ হচ্ছে। তাই চোখ-মুখ খিঁচে বাতাস টেনে নিশ্বাস ছাড়লো। নিজেকে মানানোর চেষ্টায় কিছু সময় চোখ বুজে পার করলো।

“নবাব, তুমি না খেলে কতটা অসুস্থ হবে জানি না কিন্তু আমার যে কষ্ট হবে সেটা বুঝেও এমন করছো। ঠিক আছে, মেনে নিলাম তোমার আবদার।” জোরপূর্বক রাজি হলো মিষ্টি।

“সত্যি?”

“হুম, সত্যি।” ম্যাসেজটা টাইপ করতে গিয়ে ভীষণ রাগ হলো মিষ্টির কিন্তু জেদি এবং আপসহীন নবাবের কাছে হার স্বীকার করলো।

“এই মিষ্টি, তুমি না সত্যিই মিষ্টি।”

আজ চলন্ত ট্রেনে বসে খেতে গিয়ে সেদিনের কথা মনে পড়লো নবাবের। নত দৃষ্টিতে খাবার দেখে হালকা এসে উঠতেই সেটা নজরে এলো মিষ্টির, “কী হলো? হাসছো কেন হঠাৎ?”

মুখের হাসি আরও ঝলমলে উঠলো নবাবের আর সেটা বহাল রেখে জবাব দিলো, “কিছু মিষ্টি অতীত আচম্বিতে হৃদয় নাড়িয়ে দিলো বলে।”

.

ভোর ছয়টা নাগাদ উদয়ন এক্সপ্রেস সমস্ত চঞ্চলতা থামিয়ে নিশ্চুপ হলো চট্টগ্রামে। স্টেশনের পরিবেশে থমথমে হিম হাওয়া বইছে। লোকজনের চলাচল অতি অল্প কেবল উদয়ন এক্সপ্রেস বয়ে যাদের নিয়ে এসেছে, তারাই স্টেশনের হাওয়া গরম করছে।

সারারাত ঘুম হয়নি কিন্তু ঠিক সময়ে জেগে উঠেছিল নবাব। তবে বিপত্তি ঘটেছে মিষ্টিকে নিয়ে। ওকে ডেকে তুলতে গেলেই মিষ্টি নবাবের বাহু আঁকড়ে ধরে। হিজাব পড়া সত্ত্বেও ঘুমের ঘোরে নবাবের বাহুতে নাক ঘষে বলে, “ঘুমাবো আমি।”

নবাব হালকা হেসে বলেছিল, “ঘুমাবে, কিন্তু ট্রেন এবার ছাড়তে হবে মিষ্টি। দেরি করলে তো কোনও কিছু পাওয়া না-ও যেতে পারে।” মিষ্টি কোনও জবাব দেয়নি। হতাশ হলেও ঘুমন্ত মিষ্টির উপর নবাব ক্রোধিত হয়নি। শেষমেষ ঘুম পরিহার করে নবাবের সঙ্গ নিয়ে ট্রেন ছাড়লো মিষ্টি।

ট্রেন থেকে নেমেই নবাবের মনে প্রথম যে প্রশ্ন এলো, “এতও সকালে কি সিএনজি পাওয়া যাবে?” ভাবনার সাথে তাল মিলিয়ে রেখে বেশ দ্রুত পায়ে স্টেশনের বাইরে চলে এলো তারা। বাইরের পরিবেশ দেখে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো, “এখানে তো বাসের ব-ও নেই। যাবে কীভাবে?”

মিষ্টির ঘুম এখনও কাটেনি ওর হেলদোল শরীর তারই প্রমাণ বহন করছে। সেটা বুঝতে পেরে নবাব মাস্কের আড়ালে হেসে নিয়ে জবাব দিলো, “কখনও শুনেছো স্টেশনের বাইরে বাস পাওয়া যায়?” নবাবের প্রশ্নে মিষ্টির চৈতন্য হলো কিন্তু সে কিছু বলবার আগেই নবাব একটা সিএনজির দিকে ছুটে গেল। মিষ্টিও নবাবের পিছু নিলো আর সব ঠিকঠাক হতে সিএনজির সিটে গা এলিয়ে দিলো।

সশব্দে ছুটে চলেছে সিএনজি। চট্টগ্রামের রাস্তায় এখন ভিড় নেই তবে ফাঁকা বললেও ভুল বলা হবে। কর্মের সন্ধানে বেরিয়ে পড়া মানুষের পদভারে রাস্তাঘাট ধীরে ধীরে গিজগিজ করে উঠছে।

“এটা চট্টগ্রাম, না?” হঠাৎ সিএনজির শব্দ ভেদ করে মিষ্টির গলা শুনতে পেল নবাব। সে অন্যমনস্ক হয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। এখন জবাব দিতে তাকালো মিষ্টির পানে, “হ্যাঁ, এটা চট্টগ্রাম।”

“এখানে থাকবে?”

“নাহ।” জবাব দিয়ে সোজা হয়ে বসলো নবাব।

মিষ্টির ইচ্ছে করছে নবাবের কাছ থেকে জানার জন্য, তারা এখন কোথায় যাবে? কিন্তু নবাব যে বলবে না সেটা মিষ্টি জানে। তাই সে কথা না বাড়িয়ে নিরবতাকে আঁকড়ে ধরলো। সিএনজির বাইরে থাকা আস্ত এই চট্টগ্রাম শহরের দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে জানতে চাইলো, “এবার আমার গন্তব্য কোথায়?”

“ফয়েজ লেক।” মিষ্টি নিজেকে প্রশ্ন করেছিল কিন্তু ওর মনের প্রশ্নের উত্তর দিলো নবাব। অবাক চাহনিতে তাই জানতে চাইলো, “মানে?” তাকালো নবাব আর মাথার ক্যাপ খুলে দিতেই প্রয়োজনের চেয়ে বড় হওয়া চুল বাতাসের তোরে এলোমেলো হয়ে গেল।

“আমরা এখন চট্টগ্রামের ফয়েজ লেকে যাচ্ছি।”

“তারমানে চট্টগ্রামেই থাকছো?” দ্বিধান্বিত হচ্ছে মিষ্টি।

চুলে হাত বুলিয়ে নবাব পুনরায় ক্যাপ বসিয়ে দিলো মাথায়, চুল সামলাতে। কন্ঠে একটু গাম্ভীর্য টেনে জবাব দিলো, “হয়ত।”

“সকালবেলা এমন ভণিতা না করলেই পারো। তুমি না বলতে চাইলে তো আমি জোর করি না, তাই না?”

হঠাৎ শরীর দুলিয়ে হেসে উঠলো নবাব আর এমন হাসি দেখে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো, “আশ্চর্য! এমন করে হাসছো কেন? আমি কি হাসার মতো কিছু জিজ্ঞেস করেছি?”

স্বাভাবিক গলায় জবাব দিলো নবাব, “নাহ।”

“তাহলে?”

“আসলে তুমি না অল্পতেই রেগে যাও। তোমাকে রাগানো খুব সহজ তাই।” মিষ্টির এবার সত্যি খুব রাগ হচ্ছে কিন্তু এই সাত-সকালে রাগ দেখানোর কোনও ইচ্ছে নেই ওর। তাই আবার মন ভাসালো অচেনা শহরের অজানা বাতাসে। কিন্তু এবারও নবাবের কন্ঠ ভেসে এলো, “হয়েছে। আর বাইরে তাকিয়ে মন খারাপ করতে হবে না।”

ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো মিষ্টি, “তো কী করবো শুনি?”

“আমি তোমাকে ফয়েজ লেক সম্পর্কে বলছি, সেটাই মন দিয়ে শোনো।”

“তুমি কি ইতিহাসবেত্তা?” কন্ঠ গম্ভীর শোনালো মিষ্টির।

“এইসব কেন হতে যাবো?”

“তো যেখানে নিয়ে যাও, সেখানের ইতিহাস শোনাতে বসে যাও কেন?”

“কী অবাক কান্ড! একটা জায়গায় যাবে আর সেখানের ইতিহাস জানবে না?” কিঞ্চিৎ অবাক হলো যেন নবাব।

“নাহ, জানবো না। কারণ ইচ্ছে নেই আমার।”

“তো ফয়েজ লেক সম্পর্কে শুনবে না তুমি?”

“আমি বারণ করলে কি তুমি থামবে?”

“অবশ্যই না।”

“তো আমার মাথায় বসে ডুগডুগি বাজিয়ে ইতিহাসবেত্তা হয়ে যাও।” বিরক্তিতে মুখ ঘুরিয়ে নিলো মিষ্টি আর এতে হেসে কুটিকুটি হয়ে নবাব বললো, “সকাল সকাল আমার ডায়াবেটিস বাড়িয়ে দিও না তো যদিও ডায়াবেটিস হয়নি। কিন্তু তোমার জন্য হয়ত এবার হয়ে যাবে।” নবাবের কথা শুনে আঁড়চোখে তাকালো মিষ্টি। ওর চাহনিতে নবাব রোমাঞ্চিত হওয়ার ভঙ্গিতে বলে উঠলো, “হায়!” এরপর ডান হাতে মাথার ক্যাপ ধরে হেসে উঠলো।

সিএনজির ড্রাইভার শুরু থেকেই সবকিছু লক্ষ্য করছে কিন্তু মাঝ বয়সী এই লোকের ভাড়া নিয়ে কথা। তাই এসব বিষয়ে ধ্যান দেওয়ার চেয়ে সিএনজি চালাতে মনোযোগ বেশি। তবে আঁড়চোখে মিষ্টি আর নবাবকে দেখে আনমনে বলে উঠেছিল, “আজকালকার ছেলেমেয়েদের লজ্জা-শরমের বালাই নাই।”

মিষ্টি ভেবেছিল নবাব হয়ত ফয়েজ লেক নিয়ে আর কোনও কথা বাড়াবে না। তাই সে নিজের মতো করে চট্টগ্রামের হাওয়া খেয়ে মন ভরাচ্ছে। কিন্তু হাসি থামিয়ে নবাব নিজের মতো করে বলতে শুরু করলো, “তো যা বলছিলাম।”

মিষ্টির খুব বিরক্ত লাগছে এসব শুনতে কারণ তার এখন ঘুমের প্রয়োজন। কিন্তু সে নবাবকে সেটা না বুঝিয়ে এবং কোনওরূপ বাঁধা প্রয়োগ না করে কেবল শুনে গেল। এদিকে নবাব বলে চলেছে, “ফয়েজ লেক চট্টগ্রামের পাহাড়তলী রেলস্টেশনের অদূরে খুলশি এলাকায় অবস্থিত একটি কৃত্রিম হ্রদ। চট্টগ্রামের জিরো পয়েন্ট থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখান থেকে কতদূর তা আমার অজানা। এটি ১৯২৪ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কতৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে খনন করা হয় এবং সে সময় পাহারতলী লেক হিসেবে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে লেকটি ব্রিটিশ প্রকৌশলীর নামে নামকরণ করা হয় যিনি এটির নকশা তৈরিতে সহায়ক ছিলেন। বেশ বড় মাপের (৩৩৬ একর জমি) এই লেকটি পাহাড়ের এক শীর্ষ থেকে আরেক শীর্ষের মধ্যবর্তী একটি সংকীর্ণ উপত্যকায় আড়াআড়ি ভাবে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে সৃষ্ট। আড়াআড়ি ভাবে নির্মিত বাঁধটি চট্টগ্রাম শহরের উত্তর দিকের পাহাড় শ্রেণী থেকে নেমে আসা পানির প্রবাহের দিক পরিবর্তনের মাধ্যমে এই লেকটিকে সৃষ্টি করেছে। ফয়েজ লেকের পাশেই আছে চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় বাটালি হিল। লেকের আশেপাশের মনোরম পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর্ষণে প্রতি বছর দেশি বিদেশি বহু পর্যটক ছুটে আসেন। যেমন আমরাও ছুটে এলাম।”

এবার আর চুপ করে রইলো না মিষ্টি, “সৌন্দর্যের টানে আমরা আসিনি। তবে তুমি টানের চটে আসতেই পারো কিন্তু আমাকে টেনেহিঁচড়ে আনা হয়েছে। সেক্ষেত্রে নিশ্চয়ই তোমার এসব কথা কচুপাতার চেয়ে খুব বেশি দামী হবে না।”

মিষ্টির কথায় আবারও হেসে উঠলো নবাব। সে নিজেও বুঝতে পারছে না সকাল সকাল তার এমন হাসি পাওয়ার কারণ কী? অথচ মিষ্টির কথা তেমন হাস্যকর নয় বোধহয় নাইট্রাস অক্সাইড শরীরে কোনও উপায়ে প্রবেশ করেছে তাই এমনটা হচ্ছে। নবাবকে খুব বেশি হাসতে দেখে এবার আর মিষ্টির মাঝে রাগ এলো না বরং আচম্বিতে বিস্ময় এসে ঝাপটে ধরলো, “কী হয়েছে তোমার বলো তো? এমন পাগলের মতো হাসছো কেন?”

একটু সময় নিয়ে হাসি থামিয়ে বললো, “আমি নিজেও অবাক এত হাসছি কেন? বোধহয় নাইট্রাস অক্সাইড শরীরে ঢুকেছে।”

“মানে?” বুঝতে না পেরে।

“আরে লাফিং গ্যাস। যেটা শরীরে প্রবেশ করলে মানুষ শুধু হাসতেই থাকে। হাজারও দুঃখ কষ্টেও পাগলের মতো হাসে।” হঠাৎ কন্ঠ নরম করে নবাব আবার বললো, “হয়ত তুমি আমার নাইট্রাস অক্সাইড, যাকে অনুভব করলেও আমার হৃদয় হেসে উঠে।”

.

অচেনা শহরের পথঘাট পেরিয়ে মিষ্টি আর নবাবকে সিএনজি এসে নামিয়ে দিয়ে গেল ফয়েজ লেকে। সিএনজি থেকে নেমেও মিষ্টির কৌতূহলের অন্ত নেই। সে আগে কখনও ফয়েজ লেকের নাম শুনেনি। তাই ধারণাও নেই এই জায়গা সম্পর্কে কিন্তু জোরপূর্বক হলেও নবাবের কাছ থেকে ফয়েজ লেক সম্পর্কে জানতে পেরে মোটামুটি একটা ধারণার সৃষ্টি হয়ে গেছে মস্তিষ্কে।

থাকার জন্য নবাব হানিমুন কটেজ পছন্দ করেছে তবে ফয়েজ লেকে রিসোর্টও আছে। কিন্তু তারা যেহেতু নবদম্পতি এবং একপ্রকার হানিমুনেই আছে। তাই রিসিপশনের লোকটা জিজ্ঞাসা করার সাথে সাথেই হানিমুন কটেজের কথা জানিয়েছে নবাব। পাশে থাকা মিষ্টি অবশ্য ভ্রু সংকুচিত করেছিল হানিমুন শব্দ শুনে কিন্তু সেটা সবার আড়ালে।

রুমে এসেই মিষ্টি বিছানায় বসে পড়লো। ওর চোখ বড্ড জ্বলছে হয়ত ঘুম কম হওয়ার কারণে। ওকে ঝিম মেরে বসে থাকতে দেখে নবাব জিজ্ঞেস করলো, “কী হলো? বসে পড়লে কেন?”

“ঘুম পাচ্ছে খুব।”

…চলবে
#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_২৪

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

রুমের দরজা বন্ধ করলো নবাব। হাতের ব্যাগগুলো একপাশে রেখে একে একে মাস্ক আর ক্যাপ খুলে মিষ্টিকে বললো, “তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। এখন নাস্তা করতে হবে।”

“সম্ভব না আমাকে দিয়ে।” এই বলে মিষ্টি বোরকা এবং হিজাবসহ বালিশে মাথা রাখলো। ওর এহেন কান্ডে নবাব চমকে গিয়ে বললো, “এই মিষ্টি, কী করছো এসব? বোরকা হিজাব না খুলেই কেন শুয়ে পড়লে? এমন পাগলামি না করে উঠো শীগগির।”

ডান দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মিষ্টি আর কাঠ গলায় বলে গেল, “সিলেটে গিয়ে যে মরার মতো ঘুমিয়ে ছিলে, আমি কিছু বলেছিলাম তখন? তো এবার চট্টগ্রামে আমার ঘুমানোর পালা। ঘুমাতে দাও আমায় কারণ বড্ড চোখ জ্বলছে।” এই বলে সোজা হয়ে চোখ বুজে দিলো মিষ্টি। ডান পাশের চিবুকে ডান হাত আর বাম হাতে অহেতুক বোরকা খামচে ধরে একটু একটু করে ঘুমের রাজ্যে হারাতে শুরু করলো। এতক্ষণ ধরে সবটা দেখে হালকা হেসে উঠলো নবাব, “কী অবস্থা!”

কমলা রঙের টি-শার্ট, কালো টাউজার আর তোয়ালে নিয়ে নবাব ফ্রেশ হতে চলে এলো। যতটা সম্ভব কম দামে রুম ভাড়া করেছে সে কারণ কালকেই চট্টগ্রাম ছেড়ে দিবে তারা। ভাড়া অনুযায়ী রুমটা বেশ ভালো কিন্তু ওয়াশরুমের অবস্থা সুবিধাজনক নয়।

মাথা ভিজিয়ে যখন পানির ফোটা তরতর করে গা গড়িয়ে ফ্লোরে পড়লো, তখন বুকের ভেতর উষ্ণ হাওয়ায় কষ্ট ভাসলো। দেয়ালে হাতের ভরে মাথা নুইয়ে রেখেছে নবাব। মাথার উপর অবিরত পানি পড়ছে। এই মূহুর্তে তার মনে হচ্ছে সে গোসল নয়, কষ্ট ধুয়েমুছে দিচ্ছে পানিতে।

পরিবারের একমাত্র সন্তান হয়েও পিতামাতার প্রতি তেমন কোনও কর্তব্য পালন করেনি নবাব। নিজের মনে যখন যা এসেছে সর্বদা তাই করে গেছে। শুধুমাত্র মিষ্টিকে হারানোর যন্ত্রণায় সে এতগুলো বছর বিদেশে কাটিয়েছে এমনকি এখনও বিদেশেই পড়ে আছে। নিজের ভালোবাসাকে পাওয়ার জন্য সে এতটাই লোভী হয়ে উঠেছে যে, মা-বাবাকে যেন একপ্রকার ভুলতে বসেছে।

বাসায় ফোন না করলেও নবাব জেনেছিল নিলয়ের কাছ থেকে৷ মিষ্টিকে তুলে আনার ফলে নবাবের মা এতটা আঘাত পেয়েছেন যে, সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। নিজের মায়ের এমন করুণ পরিনতি মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়েছিল নবাবের। সে মিষ্টির সাথে হাসিখুশি থাকলেও দুই পরিবার নিয়ে খুবই চিন্তিত। বাইরে থেকে নিজেকে যতটা শক্ত রাখছে, ভেতর থেকে ঠিক ততটাই ভেঙে পড়ছে নবাব।

ঝরনা কলের মুখ বরাবর নিজের মুখ রাখলো এবার। চোখ বুজে দিতে দু’টো জল ধারা চোখের কোল থেকে বেরিয়ে এলো ঝরনা কলের পানির সাথে মিশে। ভেজা মুখ এবার নড়ে উঠলো, “মা, খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তোমায়, না?”

প্রায় আধঘন্টার মতো ওয়াশরুমে কাটিয়ে বেরিয়ে এলো নবাব। যেই কান্না হৃদয়ে উত্তাপের সৃষ্টি করেছে, সেটা এখন চোখের জলে শান্ত হয়েছে। ভেজা চুলে তোয়ালে চালিয়ে রুমের চারপাশে নজর বোলালো নবাব। হঠাৎ ঘুমন্ত মিষ্টির উপর চোখ পড়তে দেখলো গুটি-শুটি মেরে নবাবের দিকে কাত হয়ে শুয়ে আছে। ভেজা তোয়ালে গলায় ঝুলিয়ে নবাব হাঁটু ঘেরে বসলো মিষ্টির পাশে। খুব সাবধানে মুখের হিজাব তুলে দিতে দেখতে পেল মিষ্টি ঘুমে কাদা হয়ে আছে।

একরত্তি ঐ মুখে বিন্দু বিন্দু ঘামের বিচরণ। হালকা ফেঁপে উঠা মুখ দেখে নবাবের মন এক মূহুর্তের জন্য যেন হলো উচাটন। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থেকে ঠোঁটে হাসি ফুটলো নবাবের আর সোনালি হাসিতে সে বিড়বিড় করলো, “মিষ্টি, তোমার ঘর্মাক্ত ললাটের ঐ বিশাল উঠোনে আমি ভালোবাসার পুষ্প নিয়ে এখন হাঁটতে চাই। খুব ইচ্ছে করছে যে ঐ উঠোনে ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে যাই। কিন্তু বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হলেও মনের সম্পর্কে যে আজও নিবদ্ধ হতে পারলাম না। তাই সকল ইচ্ছেকে কবর দিয়ে বিষাদের পথে পথিক আমি আজও তাই।”

.

চোখের সামনে সিলিং আর এতে ঝোলানো পাখা ঘুরছে ক্লান্ত পথিক রূপে। নিজের অস্তিত্ব আঁচ করতে শোয়া থেকে উঠে বসলো মিষ্টি। শরীর হালকা আড়মোড়া করতেই বিছানার ডান দিকে চোখ পড়লো তার। মেঝেতে বসে বিছানায় মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে নবাব। সদ্য ঘুম ভাঙলেও মিষ্টির একটা হাত অজান্তেই চলে গেল নবাবের মাথার ওপর। হালকা ভেজা চুলে হাত চালাতেই নবাব ধুরমুর করে সোজা হয়ে বসলো। এতে চমকে গিয়ে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো, “এ কি! ঘুমাওনি তুমি?”

“এটা কি ঘুমানোর জায়গা?” পাল্টা প্রশ্নে মিষ্টিকে এড়াতে চাইলো নবাব।

“তাহলে মেঝেতে বসে কী করছিলে?”

উঠে দাঁড়িয়ে নবাব জবাব দিলো, “হা-ডু-ডু খেলছিলাম।” এই বলে ভেজা তোয়ালে এতক্ষণ পর ছড়িয়ে দিলো। এটা এতোটা সময় গলায় ঝোলানো ছিল বলে টি-শার্ট কেমন যেন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে নবাবের কাছে।

“কী? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?” মিষ্টির তীক্ষ্ণ চাহনি দেখে নবাব জানতে চাইলো। মিষ্টি সেই চাহনি বহাল রেখে বললো, “ভাবসাব খুব একটা ভালো ঠেকছে না তোমার।” মিষ্টির এমন কথায় নবাব হঠাৎ করে ওর উপর ঝুঁকে এলো। আচমকা এমন কিছু হবে ভাবতে পারেনি মিষ্টি। ভয়ে তাই সে বালিশে পড়ে গেল। নবাব দাঁড়িয়ে থেকে আরও খানিকটা ঝুঁকে এসে বললো, “এত বেশি কথা বলো কেন? তুমি কিন্তু আমাকে সন্দেহও করো অবশ্য সেটার প্রমাণ সিলেটেই দিয়েছো।”

মিষ্টি শোয়া থেকে উঠে বসলো কিন্তু নবাব তেমনই ঝুঁকে রইলো বিধায় সে জিজ্ঞেস করলো, “এমন ঝুঁকে থাকো কেন সর্বদা? হুটহাট চিলের মতো ঝুঁকে পড়ো আর আমি কি ভুল কিছু বলেছি?”

ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেললো নবাব। এরপর শীতল কন্ঠে বললো, “অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে কিন্তু বলবো না।”

কৌতূহলের সৃষ্টি হলো মিষ্টির মাঝে, “কেন? কেন?”

“কারণ এই মূহুর্তে রোমান্টিক কথাবার্তা বলতে আমার ইচ্ছে করছে না।”

বিস্ময়ে মিষ্টির মুখ থেকে নিসৃত হলো, “হোয়াট?”

“জি।” হালকা হেসে জবাব দিয়ে মিষ্টি কপালে আলতো করে টোকা দিলো নবাব। এতে আরও বিস্মিত হয়ে স্তম্ভিত হলো মিষ্টি। নবাব এবার সরে দাঁড়ালো আর মিষ্টিকে না দেখেই বললো, “এখন ফ্রেশ হয়ে নাও। না-কি দুপুরেও খাওয়ার ইচ্ছে নেই?” প্রশ্ন শেষে মিষ্টির দিকে তাকাতেই সে দেখতে পেল লজ্জায় রক্তিম হওয়া মুখ নামিয়ে নিয়েছে মিষ্টি। জড়ানো একটা কন্ঠে কোনোমতে বাক্য খরচ করলো, “আমার বেশিক্ষণ লাগবে না ফ্রেশ হতে।”

“ঠিক আছে।” উত্তর পেয়ে ভারী পায়ে হাঁটলো মিষ্টি ওয়াশরুমের দিকে। ওর দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে নবাব আনমনে জপলো, “এই রক্তিম হওয়া মুখ আমার হৃদয় রক্তিম করে। তবে ঐ ঘুমন্ত মুখ যেন আমায় খুব করে টানে তোমার তরে।” নিজের মনের কথায় হেসে উঠলো নবাব। হাসির মাঝে হঠাৎ তার নিলয়ের কথা মনে পড়লো, “ঐদিকের কাজ কতদূর হলো? নিলয়কে একবার ফোন করতে পারলে কাজ হতো। কিন্তু সেটা যে সিলেট পড়ে আছে। এখন নতুন করে এসবের ব্যবস্থা করাও বড্ড ঝামেলা।” চিন্তায় চোখের পাতা এক হতেই ভেসে উঠলো অর্ষার ছবি আর তাকে জড়িয়ে কিছু পুরাতন স্মৃতি।

ক্লাস শেষ কিন্তু বাইরে বৃষ্টি; ঝুম বৃষ্টি। মেঘ গুড় মুড় করছে না তবে এই নিস্তব্ধ আকাশের বুক চিরে নামা বৃষ্টি বাতাস ভারী করছে। বৃষ্টি উপেক্ষা করে অনেক শিক্ষার্থী বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু নবাব দাঁড়িয়ে আছে চুপটি করে আর তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে অর্ষা। একটু গম্ভীর আর ভয়কাতুর দেখাচ্ছে বলে নবাব জিজ্ঞেস করলো, “অর্ষা, তুমি কি ভয় পাচ্ছো?”

বয়সে বড় না হলেও অর্ষার স্বপ্ন সে চলচ্চিত্রে কাজ করে নায়িকা হবে। তাই তার কথাবার্তায়ও সেটা প্রকাশ করবার সর্বাত্মক চেষ্টা থাকে, “হুম, খু-উ-ব।” ঠোঁট উল্টে আবার বললো, “সবাই কেমন চলে যাচ্ছে। আসিফও চলে গেছে।”

ইদানীং কারণে অকারণে অর্ষা শুধু আসিফের নাম জপতে থাকে। বিষয়টা নবাবের পছন্দ নয় বলে সে জানিয়ে ছিল কিন্তু তখন অর্ষা বলেছিল, “বারে! আসিফ তো আমার বন্ধু।”

“আর আমি?”

“তুমিও আমার বন্ধু কিন্তু বন্ধুর চেয়ে একটু বেশি।”

নবাব রেগেমেগে বলে উঠেছিল, “বন্ধু! কেন? শুধু বন্ধু কেন? ভালোবাসো না না-কি আমায়?”

“তুমি রাগ করছো কেন নবাব?” বেশ কাঁদো কাঁদো মুখে অর্ষা জিজ্ঞেস করেছিল কিন্তু নবাব উত্তর না দিয়েই প্রস্থান করেছিল। আজকেও আসিফের নাম শুনে তার খুব রাগ হচ্ছে কিন্তু নিজেকে সামলানোর চেষ্টায় চুপ করে আছে।

“হেই অর্ষা।”

…চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here