প্রীতিকাহন পর্ব ২৫+২৬

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_২৫

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

তৃতীয় ব্যক্তির কণ্ঠস্বরে চমকে তাকালো অর্ষা এবং নবাব। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হেঁটে আসা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে নবাবের চোয়াল শক্ত হলো। অন্যদিকে অর্ষা দুই কদম এগিয়ে গিয়ে গেল। অবাক-খুশি হয়ে জানতে চাইলো, “আরে আসিফ! আমি তো ভাবলাম তুমি চলে গেছো।”

একটু বেশি ফর্সা এবং স্বাস্থ্যের অধিকারী আসিফ শরীর দুলিয়ে বলে উঠলো, “আমি তো প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।”

“ওহ।”

“বাসায় যাবে না?”

“হ্যাঁ, তা যাবো কিন্তু বৃষ্টি…” অর্ষার আমতাআমতা করার মাঝে আসিফ বলে উঠলো, “ডিয়ার, আমি আছি না? কাম উইথ মি।”

এতক্ষণ ধরে নবাব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সবটা দেখলো চুপটি করে। এখন অর্ষার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে সে আসিফের সাথেই যাবে। নবাব গত এক সপ্তাহ ধরেই অর্ষা প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠেছে। বিষয়টা সে মিষ্টিকেও জানিয়ে ছিল, “এই আপু, অর্ষাকে দেখলে আমার রাগ লাগে।”

“কেন ভাই?”

“ওর আচরণে হয়ত।”

“তাহলে কী করতে চাও এখন?”

“জানি না। আসলে এখনও কিছু ভাবিনি।” সেদিন নবাব দ্বিধায় ভুগছিল কিন্তু আজ এই মূহুর্তে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো, “এমন মেয়ের সাথে আর কোনও সম্পর্ক নয়।”

বাইরে চকচকে রোদ কিন্তু মনের আকাশে গুড় মুড় করছে ধূসর মেঘ। ঘরময় গরমের ছোড়াছুড়িতে পাখার বাতাস যেন গায়ে পৌঁছানোর আগেই মিইয়ে যাচ্ছে। মোটামুটি গোছানো কক্ষের এক পাশে পাতা কাঠের বিছানায় শরীর এলিয়ে আছে নবাব। বালিশের ওপরে ডান হাত তার ওপরে মাথা রেখে ভাবছে সে। সাদা চোখে তাকিয়ে সে মনে মনে কথা বলছে, “আজকে অর্ষা নাচতে নাচতে আসিফের সাথে চলে গেল। আসিফকে পেয়ে আমার কথা একদম ভুলে গেছে। রাগে যে আমি পিছন থেকে চলে এসেছি সেটাও দেখেনি। ওর মতো মেয়েকে নিয়ে চিন্তা করাও ঠিক নয়।” ছোট্ট একটা নিশ্বাসে চোখ বুজে দিতেই পাশের ফোনটা বেজে উঠলো।

গেম খেলার জন্য মায়ের ফোনটা নিয়ে এসেছিল নবাব কিন্তু একটুও খেলতে ইচ্ছে করেনি তার। তাই বালিশের পাশে ফেলে রেখে চিন্তায় ডুব দিয়েছিল। সব ভাবনা এবার ঝেড়ে ফেলে যখন ফোনটা হাতে নিলো নবাব, তখন নিজের অজান্তেই ঠোঁট প্রসারিত হয়ে নড়ে উঠলো, “মিষ্টি।”

কল রিসিভ করতেই নবাব শুনতে পেল, “ঘুমোচ্ছো না-কি গেম খেলছো?”

“একটাও না।”

“মন খারাপ?” নবাব বেশ স্বাভাবিক গলায় এবং হাসিমুখে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তার প্রচণ্ড মন খারাপ টের পেয়ে গেল মিষ্টি। এড়ানোর চেষ্টা না করে নবাব মিনমিনে গলায় জিজ্ঞেস করলো, “কে বলেছে তোমায়?”

“আমার মন বলেছে। এই দেখো না, এখন ফোন করলাম। এমন দুপুরে কখনও দেখেছো আমায় তোমাকে কল করতে?”

“তুমি না অনেক ভালো মিষ্টি আপু।” বলতে গিয়ে হঠাৎ চাপা কান্নায় গলা ভারী হলো নবাবের। মিষ্টি সেটা টের না পাক এমনটা চেয়েছিল নবাব। কিন্তু কন্ঠস্বর তার মনের অবস্থা মিষ্টিকে জানান দিতে সে জিজ্ঞেস করলো, “কী হয়েছে ভাই?”

নবাব চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, “কিছু হয়নি। তবে আমি অর্ষার সাথে যোগাযোগ রাখতে চাই না।”

“কেন?” অবাক হলো মিষ্টি।

“কোনও কারণ নেই আপু। তবে যোগাযোগের কোনেও ইচ্ছে নেই আমার। তাছাড়া ও নিজের লাইফে অনেক খুশি। অনেক বন্ধু-বান্ধব আছে ওর। বড় হয়ে আবার সিনেমায় কাজ করার শখ আছে। ওর এমন চাকচিক্যময় জীবনে আমার কোনও ভূমিকা নেই। তাই জন্যে যোগাযোগ বন্ধ করা।”

“ভালোবাসতে ওকে?” মিষ্টির গলায় সহানুভূতির সুর।

একটু সময় নিলেও বেশ শক্ত গলায় জবাব দিলো নবাব, “বোধহয় না।”

“বোধহয় কেন? তুমি নিশ্চিত করে জানো না বুঝি, তুমি ওকে ভালোবাসো কি না?”

“আসলে আপু, আজকে আমি উপলব্ধি করলাম আমি এখনও ভালোবাসার মানেই জানি না। বুঝি না ভালোবাসা কাকে বলে? তবে অর্ষার প্রতি হয়ত আমার কখনও ভালোবাসা ছিল না। আমি ওকে কখনও বলেও দেখিনি ভালোবাসার কথা। ওকে ভালো লাগতো, ওর সাথে কথা বলতে ভালো লাগতো তার মানে এইসব আমার ভালো লাগা ছিল, ভালোবাসা নয়।”

“বাহ! ভালোই তো বলতে শিখে গেছো দেখছি। তা হুট করে এত বড় কবে থেকে হয়ে গেল।”

নরম গলায় জবাব দিলো নবাব, “যবে থেকে তুমি আমার জীবনে এলে।”

“কিহ!” বিস্মিত হলো মিষ্টি।

“হ্যাঁ আপু, সত্যি বলছি। তোমার সাথে কথা বললে নিজেকে কখনও ছোট মনে হয় না, বয়সে বড়ই মনে হয়। তাছাড়া তোমার সাথে রোজ রোজ কথা না বললে খুব খারাপ লাগে আমার। আর তুমি যে আমার এত খবর নাও। মন খারাপ হলেও বুঝে যাও অথচ তোমাকে বলতে হয় না এমনটা না মা ছাড়া কেউ বুঝে না। বাবার সাথে তো তেমন কথা হয় না। জানোই তো বাবা কাজ নিয়ে থাকেন আর দাদী তো অসুস্থ থাকেন বেশিরভাগ। তাছাড়া উনাকে আমার খুব একটা পছন্দ নয়।” শেষ বাক্যে নবাবের কন্ঠে বিরক্ত ফুটে উঠলো।

“এভাবে বলতে হয় না ভাই।”

“জানি আপু, কিন্তু সত্যিটাই বললাম। আর এটাও সত্যি যে মা এবং তুমি ছাড়া আমার তেমন কোনো বন্ধু নেই।”

“হুম, তা তো জানি। একটা কথা বলবো?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলো।” আগ্রহ প্রকাশ করলো নবাব।

“দেখো, ভালোবাসা কাকে বলে আমিও জানি না। এসব নিয়ে তোমার সাথে আলোচনা করার বয়সও হয়নি তোমার। তবে এতটুকুই বলবো তোমার বয়স এখন কম। তাই তোমার চোখে এখন রঙিন চশমা আর এই চশমা পড়া চোখ যা দেখবে তাই ভালো লাগবে। কিন্তু এই হাজারও ভালো লাগার ভিড়ে যেই মেয়ে তোমার হৃদয়ে স্থান করে নিবে, যে তোমার শত কষ্টের মাঝে এক চিলতে হাসির কারণ হবে, যাকে চাইলেও ভুলতে পারবে না; বুঝে নিবে সে-ই ছিল তোমার ভালোবাসা।” মিষ্টির প্রতিটা কথা নবাব খুব মন দিয়ে শুনলো আর অনুভবও করলো, “হ্যাঁ, এটাই তো ভালোবাসা আর আমি এমন ভালোবাসাই চাই।”

স্কুলে পা রাখতে গিয়েই অর্ষাকে দেখতে পেল নবাব। আসিফের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে আর হেসে হেসে লুটিয়ে পড়ছে। এমন দৃশ্যে নবাবের হাতের মুঠো শক্ত হলো। কিন্তু সারারাত ধরে সে যা ভেবেছে, সেটা মনে পড়তেই নিজেকে শান্ত করলো। ধীরে ধীরে অর্ষার কাছে এসে ডাকলো, “অর্ষা?”

ফিরে তাকালো অর্ষা কিন্তু নবাবকে দেখে ওর মুখের হাসিটা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো একটু একটু করে মিইয়ে গেল। কী যেন ভেবে হঠাৎ-ই হারিয়ে যাওয়া হাসিটা টেনে এনে ঠোঁটের কোণে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কখন এলে?”

আঁড়চোখে আসিফকে দেখে গম্ভীর গলায় নবাব বললো, “তোমার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে।”

“তো বলো।”

“এখানে নয়।” নবাব ইতস্তত করতেই অর্ষা এবং আসিফ দুইজনেই সেটা বুঝতে পারলো আর তাই আসিফ নিজেই চলে যাওয়ার চিন্তা করলো, “অর্ষা, তোমরা কথা বলো। আমি যাচ্ছি।”

“ওকে।” অর্ষা জবাব দিতেই আসিফ দ্রুত পায়ে চলে গেল। সামনে পা বাড়িয়ে নবাব বললো, “চলো।”

চলতে চলতে অর্ষা জিজ্ঞেস করলো, “তোমাকে এমন লাগছে কেন নবাব? আর ইউ ওকে?”

কাঠ গলায় নবাব জবাব দিলো, “আমি এসব কিছু শেষ করতে চাইছি।”

“কোন সব?” বুঝতে পারলো না অর্ষা।

জবাব দিতে দাঁড়ালো নবাব, “এত বিস্তারিত বলার মতো কিছু নেই। আজকের পর তুমি আমাকে কখনও কল বা ম্যাসেজ করবে না এমনকি স্কুলেও কথা বলার চেষ্টা করবে না।”

“কেন?” স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলো অর্ষা। কিন্তু নবাব অবাক হলো ওর স্বাভাবিক কন্ঠে কারণ নবাব ভেবেছিল অর্ষা অবাক হবে। অর্ষা যেহেতু অবাক হয়নি তাই নবাব নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা বললো, “সেটা তো তোমার জানার কথা, তাই না? নিজে থেকে প্রেমপত্র দিলে আমাকে অথচ বন্ধু বলে পরিচয় করাও সবার কাছে। আবার ঐ আসিফের সাথে…” বলতে গিয়ে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো নবাব।

অর্ষা হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে সবটা শুনে বললো, “তোমার কাছ থেকে এটা আমি আশা করিনি নবাব। তোমাকে আমি ভালো ভেবেছিলাম কিন্তু তুমি এমন নিচ…” অর্ষার কথার নবাব থামিয়ে দিলো, “ওয়েট, ওয়েট, কী বললে তুমি? আমি নিচ? সিরিয়াসলি অর্ষা? আমাকে নিচ বলতে তোমার মুখে বাঁধেনি? তুমি কি ভেবেছো আমি বাচ্চা? তোমার এই স্কুলে হঠাৎ আসার কারণ আমি জানি না।” হঠাৎ উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলো। ওকে হাসতে দেখে চমকে গেল অর্ষা। আশেপাশের ছাত্রছাত্রীরা তাদের কৌতূহলী চোখে দেখছে বলে অর্ষা মাথা নুইয়ে নিলো।

অর্ষা দিকে এগিয়ে এসে হিসহিসিয়ে নবাব বললো, “নাঈমের সাথে যে প্রেমপ্রীতি করতে আর সেই জন্য তোমাকে স্কুল থেকে বের করে দিয়েছে, এসব আমার অজানা নয়। নেহাতই তোমার বাবা বড় লোক বলে আগের স্কুলের প্রিন্সিপাল বিষয়টা চেপে গেছে। এতসব কান্ড করে তুমি আসছো নবাবের সাথে প্রেম করতে?”

ছলছল চোখে অর্ষা তাকিয়ে নবাবকে বুঝানোর চেষ্টা করলো, “বাট নবাব, আই রিয়েলি লাভ ইউ।”

নবাব বুঝতে পারছে অর্ষা নাটক করছে। তাই সে এসবে পাত্তা না দিয়ে বলে উঠলো, “তোমার মতো মেয়েরাই মেয়ে জাতিকে কলঙ্কিত করছে। তোমাদের কাছে ছেলেদের মন খেলনা হয়ে গেছে। ইচ্ছে হলো খেললে এরপর ছুঁড়ে ফেলে দিলে। তোমার দিকে তাকাতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে।… ভবিষ্যতে তোমার এই নোংরা চেহারা আমাকে দেখাতে এলে আমি এসিড ছুঁড়ে মারবো, মনে রেখো।” সেদিন অর্ষাকে পিছনে ফেলে হাঁটতে গিয়ে নবাব অনুভব করেছিল, “অর্ষা এবং মিষ্টি আপু দুইজনেই মেয়ে জাতি অথচ আকাশ-পাতাল ব্যবধান। মিষ্টি আপুকে নিয়ে ভাবতেও ভালো লাগে। আচ্ছা, এই ভালো লাগাটা কি শুধুই ভালো লাগা?” ঐদিনের প্রশ্ন আজকে মনের খাতায় ভেসে উঠতে হেসে ফেললো নবাব৷ আয়নাতে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে জবাব দিলো, “নাহ, ভালো লাগা যদিও শুধু ভালো লাগাই হতে পারে কিন্তু এর স্থায়ীত্ব বৃদ্ধি পেলেই সেটা চট করে ভালোবাসায়ও পরিণত হতে পারে।”

দরজার শব্দ হতেই ওয়াশরুমের দিকে তাকালো নবাব। ভেজা মুখে তোয়ালে চালিয়ে দৃষ্টি চঞ্চল করছে মিষ্টি। ওর চেহারায় এখন রক্তিম আভা ছড়ানো রয়েছে অর্থাৎ এখনও লজ্জায় আবদ্ধ হয়ে আছে। আর সেটা বুঝতে পেরে নবাব নিজের মনে কিঞ্চিৎ হেসে নিলো।

মিষ্টি ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে রুমের দিকে যেতে নিলে নবাব ডেকে উঠলো, “এই মিষ্টি?” নবাবের কন্ঠে এমন একটা তীব্রতা ভেসে উঠলো যে মূহুর্তেই মিষ্টির হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি পেল এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু লজ্জার জালে মন জড়িয়ে থাকলে সাধারণ কথাবার্তায়ও ভয়ংকর লজ্জা লাগে।
#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_২৬

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

নিঃশব্দে দাঁড়ালো মিষ্টি কারণ সে বুঝতে পারছে না নবাব এখন কী বলতে চাইছে। এদিকে তার মনের ঘর ঝড়ে নড়বড়ে হচ্ছে। একটা অস্বস্তি তাকে যেন গ্রাস করছে।

শ্লথ পায়ে নবাব এসে দাঁড়লো মিষ্টির কাছে। মাথা নামানো আর মুখ মলিন হয়ে আছে যা মিষ্টি এক ঝলকে দেখে নিলো। চোখেমুখে মলিনতার ছায়া টেনেই কন্ঠ নরম করলো নবাব, “কালকে আমার ওইভাবে বলা ঠিক হয়নি। দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় আমি যদি এমন না করতাম তাহলে হয়ত রাতে তোমাকে এতটা…”

মিষ্টি ভাবেনি নবাব এখন কালকের প্রসঙ্গ টেনে কথা বলবে। তবে এমনটা হওয়াতে সে স্বস্তি ফিরে পেল এবং নিজেকে অতি দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় এনে বললো, “নবাব, কালকের কথা কেন টানছো? কালকের বিষয় সূর্যের সাথে সাথে অস্তমিত হয়েছে। আজকে যেমন আকাশ নতুন করে উজ্জ্বল হয়েছে, তেমন নতুন প্রসঙ্গেই কথা হোক। কালকের বিষয় মনে রেখো না।”

“তুমি কষ্ট পাওনি?” নবাবের চোখে কিঞ্চিৎ বিস্ময় দেখতে পেল মিষ্টি। এতে ম্লান হেসে জবাব দিলো, “আমি কষ্ট পেতে পারি– এটা যে বুঝতে পেরেছো এতেই খুশি হয়েছি। তবে সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম তুমি বিদেশে ফিরে গেলে।”

“আমার সঙ্গ পীড়াদায়ক, তাই তো?” হঠাৎ নবাবের মুখের মলিনতা গাম্ভীর্যের আড়ালে ঢাকা পড়লো। অতি সহজে সেটা ধরতে পেরে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো, “বিদেশে গেল খুশি হওয়ার কথা বলেছি তাই এমনটা বলছো?”

“নাহ, এমনিতেও তো আমাকে তোমার সহ্য হয় না। এতে কাছে থেকেও তোমার মুখে হাসি ফুটাতে ব্যর্থ আমি। লোকমুখে শুনেছি আপন মানুষের মুখদর্শন করলেও প্রশান্তি আসে মনে কিন্তু আমার মুখ দেখে তো তোমার হৃদয় ফাটে কষ্টে।” নবাব যেন ইচ্ছে করেই মিষ্টিকে ব্যথিত করতে চাইছে।

“নবাব, এসব কী বলছো তুমি?” ধমকে উঠলো মিষ্টি আর আচমকা নবাব পিছন ফিরে দুই কদম সামনে চলে গেল। মিষ্টি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাগে যেন কাঁপছে কিঞ্চিৎ। কয়েক মূহুর্ত নবাব কী যেন ভেবে আবার মুখোমুখি হলো মিষ্টির কিন্তু এবার ভিন্ন সুরে জানতে চাইলো, “এই মিষ্টি, আমাকে গ্রহণ করা কি খুব কঠিন?”

নবাবের এমন কন্ঠ মিষ্টির কাছে অপরিচিত নয়। নবাব নিজেকে সর্বদা মিষ্টির চেয়ে বড় এবং দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ মনে করলেও মাঝে মাঝে সেই ছোট্ট নবাব হয়ে যায়; যেই নবাব বড্ড ভালোবাসা কাতুরে, যেই নবাব মিষ্টি কাতুরে।

“এটা নিজেকেই না হয় জিজ্ঞেস করো।” একটু শক্ত গলায় উত্তর দিলো মিষ্টি।

“করেছি।” হালকা হাসলো নবাব।

“কী জবাব পেলে?” তোয়ালে সুদ্ধ হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো মিষ্টি।

“অনেক আগেই আমায় গ্রহণ করে ফেলেছো।” কথা বলে নবাব যেন মজা পেল এমন ভঙ্গিতে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। এদিকে একটু লজ্জা নিয়ে রাগ এসে ঘাড়ে চেপে বসলো মিষ্টির। সেটাকে পাত্তা না দিয়ে মিষ্টি বললো, “দিনকে দিন অনেক পরিবর্তন হচ্ছে তোমার।”

“হবেই তো সম্পর্ক যে গভীর থেকে গভীরতম হচ্ছে। বন্ধু থেকে প্রীতি…” হাত দেখিয়ে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো, “দুপুরে নিশ্চয়ই মার খেয়ে পেট ভরাতে চাও না।”

“আমার কিন্তু খেতে আপত্তি নেই।” টাউজারের পকেটে হাত গলিয়ে ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলো নবাব। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বড় হওয়া চুলগুলো ঝড়ের বেগে পল্লবের মতো যেন নেচে চলেছে। এমন সৌন্দর্যে নবাবকে কি ভালো লাগছে? নাহ, মিষ্টির মনে হলো এমন সৌন্দর্যে বেমানান লাগছে নবাবকে। তবে মুখের হাসিতে সে তৃপ্তি খুঁজে পাচ্ছে।

“নিজের মাঝে কষ্ট চেপে এভাবে আমাকে হাসতে শেখাবে? আমি তোমার মতো হৃদয়ে কষ্ট চেপে হাসতে চাই।” আচমকা মিষ্টির এমন কথায় নবাবের হাসি যেন মাঝদরিয়ায় ডুব দিলো। বিস্মিত চোখে সে মিষ্টিকে দেখে চোখ নামিয়ে নিলো। মিষ্টি বুঝতে পারলো নবাব কোনও উত্তরের সন্ধান পাচ্ছে না। তাই পিছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে নরম সুরে বললো, “নবাব, অতি অল্প কথায় বলছি আমি, একটু কষ্ট করে বুঝে নিও তুমি। যার জীবন থেকে হাসি বিলীন হয়ে গিয়েছিল তাকে তুমি সেই হাসি ফিরিয়ে দিয়েছো। যার কাছে তুমি তার হাসির কারণ; এটা কি বলা লাগবে যে সে হতে চায় না তোমার মৃত্যুর কারণ?”

.

“এই মিষ্টি, গান গাও তো।” অন্যমনস্ক হয়ে মিষ্টি বিকালকে দেখছিল কিন্তু নবাবের কন্ঠে তার চেতনা ফিরে এলো। স্নিগ্ধ বিকালের সুমিষ্ট হাওয়ায় এলোমেলো হচ্ছে মিষ্টির কালো হিজাব। সেটা ডান হাতে সামলে নিয়ে তাকালো মিষ্টি নবাবের দিকে। নিষ্পলক চোখে তার বিস্ময়ের ছড়াছড়ি। মিষ্টির চোখের তারা শত প্রশ্নেরা করছে ভিড় কিন্তু সব উপেক্ষা করে নবাব বললো, “চুপ করে না থেকে গান শুরু করো।”

দুপুরের আহার শেষে নবাব মিষ্টিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল ফয়েজ লেকের অপার সৌন্দর্যে হারিয়ে যেতে। এই অঞ্চলের চারদিকে পাহাড় আর মাঝখানে রয়েছে অরুনাময়ী, গোধূলী, আকাশমনি, মন্দাকিনী, দক্ষিনী, অলকানন্দা নামের হৃদ। হৃদের পাড়ে যেতেই দেখা মিললো সারি সারি নৌকা। সেই সারি সারি নৌকার ভিড়ে নবাব খুঁজে নিলো ছোট্ট একটা নৌকা কেবল দু’জনার জন্য। নৌকায় বসে কিছু দূর যেতেই চোখে পড়লো দুই দিকের সবুজ পাহাড়, মাঝে মধ্যে দু-একটি বক এবং নাম না জানা হরেক রকম পাখি। এতোসব মুগ্ধতার ভিড়ে ডুবে ছিল মিষ্টি আর নবাবও ছিল নিশ্চুপ। কিন্তু হঠাৎ এমন আবদারে যেন সকল নিশ্চুপের ছুটি হয়ে গেল।

“কী হয়েছে তোমার?” পানির শব্দের মাঝে মিষ্টির কন্ঠের স্নিগ্ধতায় মৃদু হাসলো নবাব, “গান গাইতে বললাম এখানে কিছু হওয়ার কী আছে?”

“চট্টগ্রামে কোনও কালোজাদু হয়?”

“কেন?” জানতে চাইলো নবাব।

“সেদিন জিপে জ্ঞান ফেরার পর যেই নবাবকে দেখেছি, এখানে এসে তার কোনও মিল খুঁজে পাচ্ছি না।” মিষ্টির কথায় নবাব শুধু হাসলো আর যেন একটু লজ্জায় চোখ নামালো। সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখলেও মিষ্টি ধরতে পেরেছে, নবাব হয়ত লজ্জা পেয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের মনকে জিজ্ঞেস করেছে, “ছেলেরা লজ্জা পায়?” ঠিকঠাক উত্তর পেল না মিষ্টি।

“আচ্ছা, চট্টগ্রামে ট্রেন ছাড়া আসা যায় না?” খুব দ্রুততার সাথে মিষ্টি প্রসঙ্গ বদলে দিলো আর সেটা নবাব ধরতে না পেরে মিষ্টির কথার স্রোতেই ভাসতে লাগলো, “কেন যাবে না? বাসেও আসা যায়।”

“তাহলে বাসে না এসে হঠাৎ ট্রেনে করে কেন এলো?”

“তোমার জন্য।”

“আমার জন্য?” অবাক হলো যেন মিষ্টি।

“হ্যাঁ।”

“কিন্তু কেন? আমি তো তোমায় বলিনি ট্রেনে করে আসতে।”

“ট্রেনে আসতে বলোনি কিন্তু ট্রেনে উঠতে বলছো।”

একটু বিরক্ত হলো মিষ্টি, “নবাব, ভণিতা করো না তো। আমি কবে তোমাকে বলেছি ট্রেনে উঠতে? তুমি কিন্তু মিছিমিছি এসব বলছো।”

নিজের কোমরে দুই হাত রেখে একটু কপট রাগ দেখাতে নবাব বললো, “এই মিষ্টি, নৌকায় বসে কিন্তু তুমি আমায় মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছো। জানো না, পানির মাঝে দাঁড়িয়ে কেউ মিথ্যা বলে না।” নবাবের ভাবভঙ্গিতে শব্দ করে হেসে উঠলো মিষ্টি, “নবাব তোমাকে না ঝগড়ুটে মহিলাদের মতো লাগছে। ঐ যে, যারা এমন কোমড় বেঁধে ঝগড়া করে আর আমরা মোটেও পানির মাঝে দাঁড়িয়ে নই, বসে আছি তাও নৌকায়।”

“সবসময় আমার কথায় ভুল ধরে এসেছো।” সোজা হয়ে বসে নবাব বললো।

নবাবের দিকে তাকিয়ে ঘাড় কাত করলো মিষ্টি এবং সেই অবস্থায় জিজ্ঞেস করলো, “ভুল করলে সেটা ধরবো না?”

“তোমার কাছে ধরা পড়তে চাই বলেই তো বারংবার এই ভুল করা।”

হঠাৎ দু’জনার চোখ স্থির হয়ে গেল। মুখের বিপরীতে এবার যেন চক্ষুদ্বয় কথোপকথন চালালো। শব্দহীন এই কথোপকথনে মিষ্টি কিছু খুঁজে না পেলেও অনুভব করলো, “ঐ চক্ষুদ্বয় প্রণয়ের নেশায় এত বুঁদ হয়ে আছে, যাকে ছাপিয়ে কখনও খুনের নেশার সৃষ্টি হতে পারে না। কিন্তু কোনওদিন যদি খুনের নেশার সৃষ্টি হয় তবে সেটা কেবলই ব্যর্থ প্রণয়ের আহাজারি হবে।”

নবাবের চোখের কোটরে চোখ রেখে মিষ্টি জানতে চাইলো, “বললে না তো কেন ট্রেনে করে চট্টগ্রামে এলে?”

নবাব একটু নড়ে-চড়ে বসলো। কিছু সময় নিশ্চুপ থেকে বললো, “একদিন তুমি বলেছিলে তোমার ট্রেনে উঠবার অনেক শখ।”

“সেই কবেকার কথা তুমি এখনও মনে রেখেছো?”

হালকা হেসে নবাব ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ালো। নবাব সোজা হয়ে বসে চোখ নামিয়ে রেখেছে আর তার পাশে বসা মিষ্টি নবাবের দিকে মুখ করে রেখেছে। চট্টগ্রামে এসে মিষ্টি নবাবকে যতই দেখছে, ততই অবাক হচ্ছে। এমনকি কবুল শব্দ উচ্চারণ যবে থেকে করেছে, সেই থেকে মিষ্টির জীবন অন্য দিকে বাঁক নিচ্ছে। তার জীবনে কিছু মিষ্টি অতীতের কথা সে ধীরে ধীরে ভুলতে বসেছিল বর্তমানের ছুরিকাঘাতে। কিন্তু এই নবাব একটু একটু করে তাকে তার অতীত ফিরিয়ে দিয়ে বর্তমানকে রাঙিয়ে তুলছে।

নদীতে ভাসমান নৌকায় বসে মিষ্টি এমন নবাবকে কল্পনা করেনি৷ ছাব্বিশ বছরের এই যুবকের মাঝে এতটা লজ্জা লুকিয়ে থাকতে পারে তা মিষ্টির অজানা ছিল। এই যুবক তাকে ভালোবাসে, জোর করে হলেও বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে তাকে কিন্তু এক মূহুর্তের জন্যও অসম্মান করেনি। এমন জীবনসঙ্গী কয়জনের ভাগ্যে জুটে? যতবার মিষ্টি এসব ভাবতে নেয়, ততবারই তার মনে হয়, “আমার জন্য নবাবের ক্ষতি হলে আমি পাগল হয়ে যাবো। এই মানুষটা আমাকে যতটা চেনে আর বুঝে, আমার মা-বাবাও হয়ত এরচেয়ে বেশি বুঝে না। সবাই তো চায় বাবা-মায়ের মতো আগলে রাখার মানুষটাই জীবনে আসুক। নবাব আমার পরিবারের চেয়েও আমার জন্য বেশি চিন্তিত কিন্তু ওর যে জীবনের নিশ্চয়তা নেই তাও আমার জন্য।”

একটা কষ্ট হৃদয়কে দুমড়ে মুচড়ে দিতেই নিজের অজান্তে মিষ্টি নবাবের হাত ধরলো। নবাব এতে বিস্মিত হয়ে যখন মিষ্টিকে দেখলো, তখন ছলছল নয়নে মিষ্টি বললো, “অনেককিছু বলতে ইচ্ছে করে কিন্তু আমি পারি না নবাব। বলতে নিলে নিজেকে স্বার্থপর মনে হয় আর…” মিষ্টি থেমে যেতেই নবাব দুই হাতে মিষ্টির হাত মিলিয়ে নিয়ে বললো, “আমি তো কিছু শুনতে চাই না মিষ্টি আর না ভাবতে চাই। আমায় শুধু অনুভব করতে দাও। এতেই খুশি আমি।”

“এত উদার কেন ভাবো নিজেকে? হ্যাঁ? সবকিছুই কেন তোমাকে মেনে নিতে হবে?”

…চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here