প্রীতিকাহন পর্ব ২৭+২৮

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_২৭

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

হালকা হাসলো নবাব, “মেনে কোথায় নিলাম? সবকিছুই তো জোর করে করলাম কিন্তু এখন বাকিটা শুধু অনুভব করতে চাই।”

নবাবের কাছে হাত বন্দি রেখে মিষ্টি মাথা নুইয়ে নিলো। মাঝিরা নৌকা চালাতে ব্যস্ত হলেও সেসব নজর করার হুঁশ নেই নবাব আর মিষ্টির। সন্তপর্ণে নবাব মিষ্টির কানের কাছে এসে ফিসফিস করলো, “ভালোবাসাও অনুভবেই রাখবো। তোমার প্রগাঢ় ভালোবাসায় খুন হয়েও শুনতে চাইবো না ভালোবাসো কি না? তবে আমি জানি, তুমি আমাকে ভালোবাসো। হয়ত সেদিনই ভালোবাসার প্রথম অনুভূতি তোমার হৃদয়ে স্থান পেয়েছে, যেদিন…” নবাবের বলার মাঝে লজ্জায় চঞ্চল হওয়া চোখ আর কাঁপা কন্ঠে মিষ্টি বললো, “থামো। তুমি বড্ড বেশি বলছো। নৌকায় আমরা একা নই।”

হাসতে হাসতে সোজা হয়ে বসলো নবাব কিন্তু মিষ্টির হাত ছাড়লো না। এরপর বললো, “কথার রেলগাড়ী চলতে শুরু করলে আশেপাশের হুঁশ থাকে না।”

তেমনই নত মাথা আর লজ্জায় জড়ানো কন্ঠে মিষ্টি বললো, “এটা নতুন আর কী? তোমার মুখ তো সবসময়ই লাগামহীন।”

“এত চুপ থাকার পরেও এমন অপবাদ দিলে?” অবাক হওয়ার ভঙ্গি করলো নবাব।

মিষ্টি জবাব না দিয়ে বললো, “হাত ছাড়ো আমার।” অথচ হাত একটু ছাড়ানোর চেষ্টা করলেই সরে যেতো। কোনওরূপ চেষ্টা না করেই মিষ্টি হাত ছেড়ে দেওয়ার কথা বলতে নবাব আরও শক্ত করে চেপে ধরলো।

“এই হাত ধরেই তো ভবিষ্যতের পথে হাঁটবো আমি তাহলে ছাড়ার কথা বলছো কীভাবে?” মিষ্টি জবাব দিলো না কিন্তু নবাব ওর মুখপানে তাকিয়ে অপেক্ষা করলো। এই অপেক্ষার অবসান ঘটলো নৌকা থামার ফলে। পাড়ে এসে নৌকা থেমেছে বলে নবাব মিষ্টির হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো৷

“চলো। এবার আমাদের নামতে হবে।” এই বলে নবাব পায়ে পায়ে নৌকা থেকে নেমে দাঁড়ালো শুকনো মাটিতে। তবে নামার পূর্বে মাঝিদের সাথে একটু সময় ব্যয় হলো ভাড়া মিটাতে গিয়ে। মিষ্টি নৌকার শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ালো কিন্তু নামতে গিয়ে ওর মাঝে একটু ভয় কাজ করলো, “এই বোরকা যদি পায়ে পেঁচিয়ে যায় আর আমি যদি পড়ে যাই?” অতি অল্প সময়ে মিষ্টি ভাবনায় ডুব দিলো। এদিকে নবাব অস্থির হয়ে হাত বাড়ালো, “দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? হাত দাও জলদি।” যেই হাত এতক্ষণ নবাবের মুঠোয় বন্দী ছিল, সেই হাত আবার বাড়িয়ে দিতে গিয়ে মিষ্টির মাঝে অস্বস্তির সৃষ্টি হলো। কিন্তু নবাবের হাতের স্পর্শ পেতেই চোখের পলকে একটা অবাক কাণ্ড হয়ে গেল।

“এই, কী করলে তুমি? নামাও শিগগির।” পাজাকোলে থেকে মিষ্টি আঁতকে উঠলো কিন্তু নবাব ভ্রুক্ষেপহীন হেসে উঠলো, “আমিই তো কোলে নিলাম। তাহলে এত চটছো কেন?”

“চটছি মানে? এমন কাণ্ডের পর কি তোমার তপস্যা করবো? তুমি ইচ্ছে করে আমার হাত ধরে নাড়ালে যেন আমি বেসামাল হয়ে যাই আর তারপর তুমি…” মিষ্টি রাগে মুখ ফিরিয়ে নিতে নবাব বললো, “বাহ! বুঝে গেছো দেখছি।”

“নামাও বলছি। সবাই তাকিয়ে আছে নবাব।”

নবাব হাঁটতে শুরু করলো আর সামনে তাকিয়ে বললো, “পরিচিতের ভিড়ে আমাদের চক্ষুলজ্জা প্রখর থাকে কিন্তু অপরিচিতের ভিড়ে সেটা ক্রমশই সংকীর্ণ হয়ে পড়ে।”

“তোমাকে এত যুক্তি উত্থাপন করতে বলিনি। আমাকে নামিয়ে দিতে বলছি।” খানিকটা খেঁকিয়ে উঠলো মিষ্টি, “নামাও শিগগির।”

“মিস টিউন, এখন নিশ্চয়ই কোমড় ভাঙতে চাও না। আর একবার যদি ঐ দু’টো শব্দ আমার কানে আসে তো এমন ভাবে নামাও যে সারাজীবন আফসোস করবে।” মুখে যতই বলে বদলে গেছে নবাব কিন্তু মনে মনে এখনও পিস্তলের কথা চিন্তা করলেই আঁতকে উঠে মিষ্টি। তাই তো নবাব দায়সারা ভাব নিয়ে কথা বললেও এখন মিষ্টি খানিকটা ভয় পেয়ে গেল। কোনও জবাব তো দিলোই না উল্টো নবাবের গলা জড়িয়ে নিলো দু’হাতে যেন পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে আসে। আর এতেই নিজ মনে হেসে নিলো নবাব।

“দেখতে তো রোগা, পাটকাঠি কিন্তু ওজন তো দেখছি কম নয় তোমার।” হালকা হেসে ব্যঙ্গ করলো নবাব। স্বভাবতই মিষ্টির রাগ হলো কিন্তু জবাবের বিপরীতে নিরবতাকে আগলে নিলো। তবে আনমনে ফুঁসে উঠলো, “পরিকল্পনা করে এমনটা করেছে আবার আমাকেই খুঁচিয়ে মারছে। হুহ।”

.

রাত দশটা। ফয়েজ লেকে আজকে শেষ দিন পার করতে হয়েছে বিশ্রাম নিয়ে। কারণ নবাব আজকে সকালে মিষ্টিকে জানিয়ে ছিল, “মিষ্টি, সন্ধ্যার পর ব্যাগ গুছিয়ে নিও।”

“কেন?”

“আজকে চট্টগ্রাম ছেড়ে দিচ্ছি।”

“কালকেই এলে আর আজকেই চলে যাবে?”

“হ্যাঁ, এখানে বেশি থাকার পরিকল্পনা নেই।”

“ওহ।” মিষ্টি আর কথা বাড়ায়নি কিন্তু নবাব জিজ্ঞেস করেছিল, “জানতে চাইবে না এবার কোথায় যাবো?”

জবাব দিতে গিয়ে মিষ্টি হালকা হেসেছিল, “যেই প্রশ্নের উত্তর পাবো না, সেই প্রশ্ন করে তোমার অস্বস্তি বাড়াতে চাই না।” নবাব মিষ্টির উত্তরে অবাক হয়েছিল আর সঠিক জবাব পেয়ে মাথা নুইয়ে নিয়েছিল। কারণ নবাব অনুভব করেছিল তার হয়ত মিষ্টিকে বলা উচিত কিন্তু সে কোনও ঝুঁকি নিতে রাজি নয়।

রেস্টুরেন্টে বসে রাতের খাবার শেষ করলো নবাব আর মিষ্টি। নবাব লক্ষ্য করছে খাওয়া শেষ হতেই মিষ্টি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। ওর মনোযোগ নিজের দিকে টানতে নবাব জানতে চাইলো, “এই মিষ্টি, চা খাবে? সিলেটের চা কিন্তু বাংলাদেশের বাইরেও সুনাম কুড়িয়েছে।”

নবাবের কথা শুনে মিষ্টি অবাক হলো কিন্তু সেটা চোখেমুখে ভাসলেও কন্ঠে ধরা দিলো না, “চট্টগ্রামে বসে সিলেটের চায়ের কথা কেন বলছো? তোমার মাথা কি ঠিক আছে?”

“হ্যাঁ, মাথা ঠিকই আছে। আসলে সিলেটে তো চা খাওয়া হয়নি। সিলেটে এসে সিলেটের বিখ্যাত চা-ই খাওয়া হলো না। এরচেয়ে বড় অন্যায় আর হতে পারে?”

“জানি না।” মিষ্টি কথা বাড়াতে চাইলো না আর নবাব সেটা টের পেল। কিন্তু সে-ও কথা না বাড়িয়ে ওয়েটারকে এক কাপ চা দিতে বললো।

বেশ কিছুক্ষণ পর ওয়েটার এসে এক কাপ দুধ চা দিয়ে গেল। ধোঁয়া উঠানো গাঢ় চায়ে যেন চিরাচরিত প্রেম জমে আছে। চায়ের দিকে একঝলক দেখে হাসলো নবাব এরপর মিষ্টিকে বললো, “এই মিষ্টি, একটু খেয়ে দেখো তো চিনি ঠিকঠাক আছে কি না?”

মিষ্টি এবার বিরক্ত হলো, “কী হয়েছে তোমার? হঠাৎ চা নিয়ে কেন পড়লে? আর তুমি জানো না আমি চা খাই না?”

দায়সারা ভাব নিয়ে নবাব বললো, “চা খাওয়ার জিনিস নয়, পান করার। আর তোমাকে তো পুরোটা খেতে বলিনি এই একটু খেয়ে শুধু চিনির পরিমাণ যাচাই করবে।”

“এটা তো তুমি নিজেই করতে পারো।”

“তা পারি কিন্তু মিষ্টি যদি দেখে চায়ে কতটা মিষ্টি হলো তাহলে ভালো হয় না?” বলেই হাসলো নবাব আর মিষ্টি বুঝতে পারলো ওকে চা না পান করিয়ে নবাব ছাড়বে না। তাই অগত্যা চায়ের কাপ নিয়ে এক চুমুক দিয়ে মিষ্টি কাপটা পেয়ালার ওপর রেখে দিলো আর গম্ভীর গলায় জবাব দিলো, “সব ঠিক আছে।”

নবাব নিঃশব্দে চায়ের কাপ হাতে নিলো। টেবিলের উপর কনুইয়ের ভর দিয়ে কাপ মুখের সামনে ধরে রহস্যময় হাসি দিয়ে চায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর মিষ্টির দিকে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দিলো। মিষ্টি পুরো বিষয়টা বাঁকা চোখে দেখলো। ওর মনে কিঞ্চিৎ খটকা লাগলেও স্বাভাবিক বিষয় ভেবে উড়িয়ে দিলো। কিন্তু নবাব একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি করায় মিষ্টির চোখে অবাকের আলো এসে হাতছানি দিলো। নবাব এবার মিষ্টির দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের হাসি দ্বিগুণ করলো আর ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, “কী?”

মিষ্টি দাঁতে দাঁত চেপে চোখ নামিয়ে নিলো আর আনমনে বলে উঠলো, “কত্ত চালাক! আমার এঁটো চা খাওয়ার জন্য এসব করেছে আবার আমি বুঝতে পারিনি বলে সেটা বোঝাতে এমন নির্লজ্জের মতো হাসছে।”

“মনে মনে আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ না হয়ে সরাসরি বলো না। আর হ্যাঁ, চা কিন্তু মারাত্মক মিষ্টি হয়েছে।” বলেই ঠোঁট টিপে হাসলো নবাব। চায়ের কাপে আরেক দফা চুমুক দিতেই শুনতে পেল মিষ্টির মুখ বিরক্তিতে বলছে, “ফাজিল কোথাকার।”

“সেই ছোট্টবেলা থেকে ফাজিল শব্দটা বলে আসছো। এখন তো বড় হয়েছি কিন্তু শব্দটা এক জায়গাতেই তুমি রেখে দিলে।”

“এই, তোমার কী হয়েছে বলো তো? হঠাৎ এমন উদ্ভট আচরণ করছো কেন?” নবাব জবাব না দিয়ে চা শেষ করলো। প্যান্টের পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে টাকা নিতে শুরু করলো আর মুখে বিস্তর হাসি।

“হাসছো কেন?” নবাবের হাসি দেখে মিষ্টি জানতে চাইলো।

কপাল কুঁচকে নবাব তাকালো মিষ্টির দিকে, “হাসিতে কি কারফিউ জারি করেছো?”

“যদি সম্ভব হতো তবে তোমার ওপরই জারি করতাম।”

নবাব চট করে উঠে দাঁড়ালো। ওয়ালেট প্যান্টের পকেটে গুঁজে হাঁটতে শুরু করলো। বিল পে করতে যাবে কিন্তু মিষ্টির চেয়ারের পাশে এসে থেমে গেল নবাব। সামনে তাকিয়েই নিচু গলায় মিষ্টিকে বললো, “মনের ওপর কারফিউ জারি করার পর আর কি প্রয়োজন আছে এর? এতগুলো বছর ধরে কারফিউ চলছে আমার মনের ওপর কিন্তু তুমি এই কারফিউ আর শিথিল করলে না।” এই বলে নবাব চলে গেল আর মিষ্টি তেমনই বসে রইলো নিশ্চুপ হয়ে কিন্তু চোখ গোল গোল হয়ে আছে অতি বিস্ময়ে।

সাড়ে এগারোটা নাগাদ নবাব আর মিষ্টি পৌঁছে গেল সিনেমা প্যালেসের সামনে। এখান থেকে সৌদিয়া বাস সার্ভিসের সুবাদে নবাব কক্সবাজার যাওয়ার পরিকল্পনায় আছে। বাসের টিকিটের ব্যবস্থা আগে থেকেই করা আছে। ফয়েজ লেক থেকে আসার পথেই মিষ্টিকে নবাব কক্সবাজারের কথা জানিয়ে ছিল। তাই কোথায় যাচ্ছে– এমন ভাবনায় মিষ্টি এখন আর চিন্তিত নয়।

সিলেটে ফোন ফেলে এসেছে বিধায় মিষ্টি নবাবকে জিজ্ঞেস করে ছিল, “এতে তোমার সমস্যা হবে না?”

“আশা করছি হবে না। এখান থেকে সেখান থেকে কল করে খবর নিচ্ছি।”

“বাসার অবস্থা কি জানতে পেরেছো? তোমার আমার বাসায় এখন কী চলছে?” মিষ্টি খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেও নবাব জবাব দেয়নি আর মিষ্টিও জোর করার মতো সাহস পায়নি।
#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_২৮

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

কাঁটায় কাঁটায় রাত বারোটায় সৌদিয়া বাস যাত্রা শুরু করলো কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। সময়মতো বাস চলতে শুরু করায় নবাব নিজ মনে বলে উঠেছিল, “বাব্বা! একদম সময়মতোই ছেড়েছে দেখছি।”

সৌদিয়া বাসে এয়ারকন্ডিশনারের সুবিধা না থাকায় এখন বাসের জানালাই একমাত্র এয়ারকন্ডিশনারের কাজ দিচ্ছে। বরাবরের মতো জানালার পাশের সিট মিষ্টির দখলে। মিষ্টিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোনও এক চিন্তায় আচ্ছন্ন সে। সিটে মাথা এলিয়ে বাইরে দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে নির্বিঘ্নে।

আজকের আকাশ আলো শূন্য। সূর্যের থেকে ধার নিয়ে চাঁদ যদিও বা আলোকিত করে বিশ্বপ্রকৃতিকে। কিন্তু আজ ঘোর অমাবস্যায় সেই চাঁদ লুকিয়ে আছে কোনও এক প্রান্তে। তবে পৃথিবী আঁধারে ঢাকা নয়। কৃত্রিম আলোয় ঝলমল করছে প্রকৃতি আর বাতাস এসে নাকে সুড়সুড়ি দিয়ে জানান দিচ্ছে মিষ্টি সুগন্ধ। এত কিছুর ভিড়ে মিষ্টির মনে একটা গান ভেসে উঠলো,

“আজ কেন এ মনে ভালোবাসা
উঁকি দেয় লুকোচুরির মতো।
যদি থাকো এই আমার কাছে
আমি থেকে যাই অবিরত।

সাদা মেঘে বর্ষা তুমি
আমি বৃষ্টি ভেজা রাত।” হঠাৎ এই গানটা মনে পড়তেই আনমনে হেসে উঠলো মিষ্টি আর নিজের কাছেই প্রশ্ন রাখলো, “এই গান কেন মনে ভাসছে? আজকে তো বৃষ্টিও হচ্ছে না। তবে কেন এই গানের সুর আমার ঠোঁট নাড়াচ্ছে?” এই সব ভাবনার ভিড়ে আচমকা মনের কোণে ভেসে উঠলো সেই বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যা।

“এই মিষ্টি, কী করছো?”

বিকাল থেকেই একটানা বৃষ্টি হচ্ছে; ঝুম বৃষ্টি। মাঝে মাঝে মেঘ গর্জে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে আর ভেজা বাতাস রোমাঞ্চিত করছে। একলা ঘরে মিষ্টি এখন ফোনে অবসর সময় পার করছে। চেয়ারে বসে পায়ের ওপর পা রেখে দুলিয়ে দিতে ডান পায়ের পায়েলে মৃদু গুঞ্জন উঠছে। হাতে ফোন আর কানে ইয়ারফোন যেখানে মেয়েলি কন্ঠে সুর উঠছে,

“চোখেতে অনেক ছবি ভালো লাগে,
আপন করে পেতে সাধ যে জাগে।
তবু ভালোবাসা ভালো লাগা এক নয়।
ভালোবাসা ভালো লাগা এক নয়।” এই গান শোনবার মাঝেই নবাবের ম্যাসেজের এলো আর আচম্বিতে মিষ্টির মুখে হাসি ফুটলো। প্রায় সাথে সাথেই সে জবাব দিলো, “এই তো, গান শুনছি। তুমি?”

“আমিও গান শুনছি। তা কী গান শুনছো?”

“ভালোবাসা ভালোলাগা এক নয়– কবিতা কৃষ্ণমূর্তির গান।”

“আগের দিনের গান, না?”

“হুম কিন্তু আমার খুব পছন্দের।” সানন্দে জবাব দিলো মিষ্টি।

“মিষ্টি?” এখন নবাব মিষ্টিকে আর আপু বলে ডাকে না। মিষ্টির প্রথম প্রথম খুব অস্বস্তি হতো কিন্তু ধীরে ধীরে বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিতে গিয়ে অভ্যাসে পরিণত হলো। মিষ্টিও ইদানীং নিজের অজান্তে নবাবকে ভাই সম্বোধন করা কমিয়ে দিয়েছে। মানুষের মাঝে অনেক পরিবর্তন হুট করেই আসে, যেখানে তার কোনও হাত থাকে না।

“হুম।” জবাব দিলো মিষ্টি।

“আমি একটা গানের নাম বললে শুনবে?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, দাও। ভালো লাগলে অবশ্যই শুনবো।” জবাব দিয়ে পা দু’খানা চেয়ারের ওপর তুলে ভাঁজ করে বসলো মিষ্টি। চেয়ারে হেলান দিয়ে এবার যেন আরও আরাম বোধ হলো তার।

“আজ কেন এ মনে ভালোবাসা
উঁকি দেয় লুকোচুরির মতো।
যদি থাকো এই আমার কাছে
আমি থেকে যাই অবিরত।” নবাবের ম্যাসেজ পড়তে গিয়ে মিষ্টি একটু হকচকিয়ে গেল। মিষ্টির কারণহীন মনে হলো এই চার বাক্য গান নয়, নবাবের মনের কথা।

“এটা গান?” মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো।

“হ্যাঁ। শুনে দেখো খুব সুন্দর।”

“ঠিক আছে।” নবাবের কথা মতো মিষ্টি ইউটিউবে গানটা খুঁজতে শুরু করলো আর সেট পেয়ে চটজলদি শুনতে আরম্ভ করলো। একটুখানি শুনেই নবাবকে ম্যাসেজ পাঠালো, “হুম, আসলেই সুন্দর গানটা।”

“হ্যাঁ, একদম তোমার মতো সুন্দর।” নবাবের প্রশংসাসূচক বাক্যে মিষ্টি মৃদু হেসে জবাব দিলো, “ফাজলামি করো না তো। আমি মোটেও সুন্দর না।”

“এই মিষ্টি, এটা কী বললে তুমি?”

“কেন? ভুল কী বললাম?”

“আলবাত ভুল বলেছো। এখন শিগগির সরি বলো আর বলো যে কখনও নিজেকে অসুন্দর বলবে না।”

“দেখো, আমি নিজেকে অসুন্দর বলিনি। বলেছি আমি সুন্দর নই।”

“এতে কোনও তফাৎ আছে? আমি তর্ক করতে চাই না। আমার এক কথা, তুমি নিজেকে এসব বলতে পারবে না। যদি বলো তো।”

“তো?” কৌতূহল প্রকাশ করলো মিষ্টি।

“তাহলে আমি কখনও তোমার সাথে কথা বলবো না।”

“কী বলছো তুমি এসব?” আঁতকে উঠলো মিষ্টি।

“মিষ্টি, আমি সত্যি বলছি। আচ্ছা শোনো, তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো?”

“হঠাৎ এ কথা কেন জানতে চাইছো?” প্রশ্নটা লিখতে গিয়ে বাইরে মেঘের গর্জন শুনতে পেল মিষ্টি। কিঞ্চিৎ অবাক হওয়ার বিষয়টা এখন ভয়ের রূপ পেল।

“বলো না আমায় বিশ্বাস করো কি না?”

“করি তো। আমি তোমাকে অনেক বিশ্বাস করি।” ম্যাসেজ পাঠিয়ে মিষ্টি অপেক্ষা করতে লাগলো কিন্তু নবাব কোনো উত্তর দিচ্ছে না। প্রায় পাঁচ মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন জবাব আসছে না, তখন মিষ্টি ফোন রেখে দেওয়ার চিন্তা করলো। কিন্তু হঠাৎ নবাবের ম্যাসেজ এলো আর সেটা পড়তে গিয়ে মিষ্টি কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো, “তাহলে সেই বিশ্বাসকে পুঁজি করে আমি যদি বলি আমি তোমায় ভালোবাসি। তবে কি অবিশ্বাস করবে মিষ্টি?”

সশব্দে বিদ্যুৎ চমকালো। এতটা জোরে মেঘ ডাকলো যে মিষ্টি নড়েচড়ে উঠলো। মনের ভেতরেও বিদ্যুৎ চমকেছে আর তাই অতি সাধারণ মেঘের গর্জন তার কাছে ভয়াবহ ঠেকেছে। হৃদয় থমকে দেবে এমন ম্যাসেজ মিষ্টি আশা করেনি নবাবের কাছ থেকে। সে স্পষ্টত বুঝতে পারছে নবাব কীসের ইঙ্গিত করছে। কিন্তু সেটা অতি সহজে বুঝতে দেওয়া বোকামি হবে বিধায় মিষ্টি জবাব দিলো, “বোনকে ভালোবাসো সেটা অবিশ্বাস কেন করবো?”

“মিষ্টি, আমি কিন্তু তোমাকে বোন ভাবা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি। বন্ধু তুমি আমার। সেটা এখন অন্য সম্পর্কে রূপ নিতে আপত্তি কোথায়? আশা করি অন্য সম্পর্কের মানে তুমি বুঝতে পারছো।”

মিষ্টি সবই বুঝতে পারছে কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছে না। তাই মিষ্টি প্রতিবাদ করলো, “ভাই, এমন রসিকতা করো না। এটা কেউ বিশ্বাস করবে না।” ভাই লিখতে গিয়ে মিষ্টির হাত যেন কেঁপে উঠলো। সে অনেকটা ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে এই সম্বোধন করলো আর হৃদয় বলে উঠলো, “ভাই? সম্বোধনটা আজকে মন থেকে আসছে না কেন?”

“আমার সিরিয়াস কথা তোমার রসিকতা মনে হচ্ছে?”

“নয়ত কী? কে বিশ্বাস করবে বলো? কে বিশ্বাস করবে আমার চেয়ে চার বছরের ছোট একটা ছেলে আমাকে…” ম্যাসেজ অসম্পূর্ণ রেখেই পাঠিয়ে দিয়েছে মিষ্টি।

“তোমাকে কী? হুম? ম্যাসেজ পুরোটা লেখোনি কেন? আর ছোট তো কী হয়েছে? ছোট হলে সেটা সমাজের রীতিনীতির বাইরে এমনটা কোথাও উল্লেখ আছে?”

“নাহ, তা নেই।” মিষ্টি অনেকটা সময় নিয়ে জবাব দিলো আর এরচেয়েও বেশি সময় নিয়ে নবাব জবাব পাঠালো, “আমি জানতাম তুমি এসব যুক্তি দেখাবে তাই তো আমিও।” নবাবের এমন ম্যাসেজে মিষ্টি হতভম্ব হয়ে গেল কিন্তু কৌতূহল বোধ জন্মাতে জিজ্ঞেস করলো, “তাই তো কী?”

“মজা করছিলাম তোমার সাথে… হা হা হা।” নবাবের কথায় মিষ্টি এবার অকূলে কূল খুঁজে পেল। হুট করে ওর মাথায় যেসব চিন্তা এসে ভীড় করেছিল তা এখন নিমিষেই মিলিয়ে গেল। স্বস্তির নিশ্বাস হৃদয় থেকে নির্গত হতে হালকা হেসে জবাব দিলো, ” ফাজিল ছেলে। দাঁড়াও তোমার রসিকতার খবর নিচ্ছি। দেখা হোক একবার তোমাকে আচ্ছা করে শায়েস্তা করবো।” প্রতিত্তোরে নবাব জানালো, “হা হা হা… তুমিও না মিষ্টি বড্ড বোকা। কী সুন্দর করে তোমায় দিলাম ধোঁকা।”

“এই মিষ্টি, ঘুমিয়ে পড়লে?” নবাবের ডাকে সোজা হয়ে বসলো মিষ্টি। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জবাব দিলো, “নাহ।”

“এই বাসে কি সমস্যা হচ্ছে?” নবাবের প্রশ্নের বিপরীতে মিষ্টি প্রশ্ন করলো, “আমার সবকিছু তুমি এত নিখুঁত করে কেন মনে রাখলে? একটা মূহুর্তও কি তোমার স্মৃতি থেকে বিলীন হয়নি?”

শেভ না করায় মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি অনেকটা গজিয়ে গেছে সাথে প্রয়োজনের চেয়ে বড় হওয়া চুল বাসের ঝাঁকুনিতে নেচে উঠছে। ক্যাপ দিয়ে চুল সামলাতে হয়ত নবাবের বিরক্ত লাগছে তাই সেটা খুলে হাতে নিয়ে বসে আছে। মিষ্টির প্রশ্নের জবাব দিলো না নবাব বরং নত দৃষ্টিতে হাতের ক্যাপ আর মাস্ক দেখতে শুরু করলো।

“চুপ করে আছো কেন?”

নবাব চোখ তুলে জানতে চাইলো, “কী বলবো?”

মিষ্টিকে পাওয়ার জন্য নবাব নিজেকে যেভাবে প্রকাশ করেছে, সেটা তার প্রকৃত চেহারা নয়। বিয়ে করা সত্ত্বেও নবাব এখনও মিষ্টির সাথে কথা বলতে নিলে শ্রদ্ধা ফুটিয়ে তুলে। তার আচরণে মিষ্টি বুঝতে পারে বড়-ছোটোর যেই ব্যবধান, সেটা এখনও নবাব পুষে রেখেছে। আর সেটা অনুভব করে মিষ্টি বললো, “আমি জানি তুমি আমাকে এখনও সমীহ করো। তোমার আচরণ সেটা স্পষ্টত বুঝিয়ে দেয় কিন্তু এখন তোমার বলার কিছু নেই?”

“আছে তো। অনেক কথা বলার আছে তোমায় কিন্তু…” নবাব থেমে গেল আর মিষ্টিও কথা বাড়ালো না।

সিটে হেলান দিয়ে আবারও কৃষ্ণ রাতে আলোর খোঁজ শুরু করলো মিষ্টি। এদিকে নবাব মিষ্টিকে এক ঝলক দেখে নিজেও সিটে হেলান দিলো কিন্তু হঠাৎ মিষ্টির হাতের উপর তার নজর গেল। হাঁটুর ওপরে রাখা হাতে এখনও মেহেদীর রঙ লেগে আছে। নবাবের খুব ইচ্ছে করছে ঐ হাত স্পর্শ করে মিষ্টিকে বলতে, “এই মিষ্টি, তোমাকে আমি ভালোবাসি কতটা তা নিজেরও অজানা। কিন্তু টুকরো টুকরো স্মৃতি আমার মস্তিষ্কে আঠার মতো লেগে থাকে। আমি চাইলেও যে মুছে দিতে পারি না।”

আচম্বিতে নবাবের সিলেটের কথা মনে পড়লো। সে যখন মিষ্টির হাত নিজের মুঠোয় বন্দী করেছিল, তখন মিষ্টি বারংবার বলেছিল, “হাত ছাড়ো আমার, হাত ছাড়ো আমার।” এখন সেটা মনে পড়তেই হালকা হাসলো নবাব আর মিষ্টির দিকে মুখ করে বলে উঠলো, “মিস টিউন।” ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মিষ্টি। তার চোখে নবাব দেখতে পেল হাজারও বিস্ময়ের ছড়াছড়ি।

“মিস টিউন?”

“হুম।” নবাব মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলো।

“এটা বললে কেন? এখন তো কোনও কথা একাধিক বার বলিনি।”

“হয়ত বলতে।”

“কেন?” বুঝতে না পেরে।

“তোমার হাত স্পর্শ করলে। কারণ সিলেটে এমনটা করার পর একই কথা একাধিকবার বলেছিল।”

“অকারণে হাত ধরতে যাবে কেন?” হঠাৎ লজ্জায় অপ্রস্তুত হয়ে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো।

“কারণেই ধরতে হবে এমন তো কোনও কথা নেই, তাই না? আমার গোটা জীবনের চাবিকাঠি তো ঐ হাতেই বন্দী। একটু ছুঁয়ে দিলে যদি পায় মুক্তি, সেটা ভেবে খুব লোভ খুব হচ্ছিল।” নবাবের কথা শুনে মিষ্টির চোখের পাতা নেমে গেছে। লজ্জায় গলা ধরে এসেছে কিন্তু অদ্ভুত ভাবে কোনও রাগ হচ্ছে না তার মাঝে আর না কোনও বিরক্তি। কিন্তু অন্যদিন হলে হলে সেটা রাগ অথবা বিরক্তির রূপ পেত।

“দয়া করে এমন লাগামহীন হবে না কারণ এতে অসহ্য লাগে আমার।” নিচু গলায় মিষ্টি বলতেই নবাব মিষ্টির কানের কাছে এসে ফিসফিস করলো, “দয়া করে এমন লজ্জাকাতুর হবে কারণ এতে তৃপ্তি লাগে আমার।”

.

কক্সবাজারের ঘুম এখনও ভাঙেনি কিন্তু অগত্যা নবাবকে জেগে উঠতে হলো। বাস থেমেছে আর সবাই একে একে বাস ত্যাগ করছে। ঘুম জড়ানো চোখে নবাব আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো এখনও আকাশে কালো রঙের মেলা। চট করে সময় দেখতে গিয়ে জানলো এখন রাত চারটা। এমন অসময়ে কক্সবাজার পৌঁছাতে হবে সে বিষয়ে নবাবের ধারণা ছিল। কিন্তু মিষ্টির ঘুম ভাঙাতে হয়ত একটু সমস্যা হবে তাই নিয়ে চিন্তিত হলো নবাব।

“এই মিষ্টি?” নরম কন্ঠে নবাব ডাকলো মিষ্টিকে কিন্তু জবাব পেল না। তাই এবার একটুখানি জোরে লাগাতার ডাকতে লাগলো, “এই মিষ্টি? মিষ্টি?”

“হুম।” ঘুমের ঘোরে মিষ্টি জবাব দিতে নবাব বললো, “কক্সবাজার এসে গিয়েছি আমরা। এখন বাস ছাড়তে হবে। উঠো শিগগির।”

“আমার ঘুম পাচ্ছে।”

“তা তো আমারও পাচ্ছে। প্লিজ উঠো।”

খুব একটা ঝামেলা না করে মিষ্টি উঠে পড়ে আর বাস ছেড়ে নেমে অবাক গলায় জিজ্ঞেস করে, “এ কি! এখনও তো রাত শেষ হয়নি।”

হালকা হেসে নবাব জবাব দিলো, “শেষ হওয়ার দরকার কি? একটু সামনে গেলেই আমাদের হোটেল৷ এসো।”

মিষ্টি ঘুমের আঁকড়ে হাঁটছে বলে নবা বললো, “দেখেশুনে হাঁটো। এভাবে হাঁটলে কিন্তু গাড়ির তলায় পড়তে বেশি সময় লাগবে না।”

“সকাল সকাল এমন কথা বলছো কেন?” অবাক এবং রাগ দু’টোই প্রকাশ করলো মিষ্টি। কিন্তু নবাবের নির্বিকায় উত্তর, “এখন সকাল নয় বলেই এসব বলছি। সাবধানে হাঁটো।”

“তোমাকে বলতে হবে না। আমি শিশু নই।” বিরক্তি মেখে নবাবকে জবাব দিলো মিষ্টি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here