প্রীতিকাহন পর্ব ২৯+৩০

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_২৯

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

“তো সেটার প্রমাণ দাও তর্ক না করে।” এই বলে নবাব চলার গতি বাড়িয়ে দিলো। নবাবের সাথে চলন গতির সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে মিষ্টি বাক্য ব্যয় থামিয়ে দিলো।

হোটেলে প্রবেশ করেই নবাব চমকে উঠলো। এমন ভোর রাতেও হোটেলের রিসিপশনে উপচে পড়া ভিড়। রিসিপশনের লোকের সাথে কথা বলে নবাব জানতে পেরেছে দুপুর একটার আগে হোটেল রুম খালি পাওয়া যাবে না। বিষয়টা শুনে নবাবের চিন্তা হলেও এখন করার মতো কিছুই নেই কারণ সূর্যের রশ্মি আকাশে ভাসমান হয়নি।

“এই মিষ্টি, রুম পেতে তো অনেক দেরি। এখানেই অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।”

রিসিপশনের উল্টোদিকের একটা সোফায় বসে ঘুমে ঢুলতে থাকা মিষ্টি জবাব দিলো, “সমস্যা নেই কিন্তু আমার তো বড্ড ঘুম পাচ্ছে। আমি কি সোফায় একটু…” মিষ্টির কথার মাঝেই নবাব বলে উঠলো, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি হেলান দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করো।”

“আর তুমি?”

হালকা হাসলো নবাব, “আমি? দেখি কী করতে পারি?” মিষ্টি জবাব দিলো না কিন্তু ওর চোখ হাসলো যেন।

প্রায় বিশ মিনিটের মতো চুপচাপ বসে থেকে নবাবের চোখেও ঘুম এসে হাতছানি দিচ্ছে। এদিকে মিষ্টি ঘুমে কাদা হয়ে আছে। সোফায় হেলান দিয়ে নবাব ক্ষণিকের জন্য চোখ বুজে দিয়েছিল কিন্তু এর মাঝেই কারোর স্পর্শে জেগে উঠলো। মিষ্টি ঘুমের ঘোরে নবাবের বাহু চেপে কাঁধে মাথা রেখেছে। এটা দেখে নবাব হালকা হেসে উঠলো আর অতি সাবধানে ওর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। তবে সোফায় নয়, নিজের বুকে মিষ্টিকে মাথা রাখতে দিলো। মিষ্টিও ঠাঁই পেয়ে নির্বিঘ্নে মাথা রাখলো।

বাম হাতে মিষ্টিকে জড়িয়ে হালকা হাসলো নবাব, “নিজের অজান্তে কতকিছুই হয়ে যায়, কত কাহন জীবনে নতুন রঙের প্রলেপ লাগায়। কিন্তু এসব কাহনে একটু প্রীতি থাকুক সেটাই একান্ত কামনা আমার। ভাগ্যক্রমে যদি সেই কাহনে তুমি আমি মিলিত হই মিষ্টি তবে দেখে নিও তুমি। দেখে নিও নবজন্ম লাভ করা আমাদের অমোঘ প্রীতিকাহন।” নবাবের আনমনে বলা কথার মাঝে ঘুমের ঘোরে মিষ্টি ‘হুম’ উচ্চারণ করে বাম হাতে টি-শার্ট খামচে ধরলো। আর হিজাব পরা সত্ত্বেও নবাবের বুকে নাক ঘষে ঘুমকে জিতিয়ে দিলো।

আস্ত দানার মুগডালে পরোটা গড়িয়ে নিয়ে মুখে পুড়লো মিষ্টি। এর আগে কখনও মিষ্টি মুগডাল খায়নি। মাকে যখন বলতো, “মা, মুগডাল রান্না করলে খেতে পারতাম।”

“আমাকে দিয়ে এসব হবে না। বড় হয়ে নিজে রান্না করে খাবি।” মায়ের জবাব শুনে মিষ্টি ঠোঁট উল্টে একাই বিড়বিড় করতো, “সামান্য মুগডাল খাওয়ার জন্য আবার বড় হতে হবে?”

মিষ্টি তার নিজের এলাকার হোটেলের পরোটা বহুবার খেয়েছিল। তার বাবা প্রায়শই এনে দিতেন কিন্তু সেখানে পরোটার সাথে ছোলার ডাল, সবজি, হালুয়া আর ডিম ভাজা পাওয়া যেত। এদিকে কক্সবাজারের হোটেলে ছোলার ডালের পরিবর্তে মিষ্টি মুগডাল খুঁজে পেল। খেতে গিয়ে অদ্ভুত স্বাদে বিড়বিড় করলো, “একই দেশ অথচ জায়গা ভেদে খাওয়ায় কত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।”

“এই মিষ্টি, খাসির পায়া খাবে?”

খাবারের দলা মুখের ডান পাশে রেখে মিষ্টি চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করলো, “খাসির পায়া?”

“হুম।”

“আমার খাসির নাম শুনলেই বমি পায়। তুমি খাও।”

“তাহলে চা খাবে?” নবাব সহজ গলায় প্রশ্ন করলেও মিষ্টি বুঝতে পারলো নবাব চট্টগ্রামের চা খাওয়ার বিষয়টা ইঙ্গিত করছে। কারণ প্রশ্ন করেও নবাব ঠোঁট টিপে হাসছে আর এতে মিষ্টির চোয়াল শক্ত হলো। তবে নিজেকে অতি দ্রুত সামলে নিয়ে স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করলো, “সকাল সকাল শুরু করে দিয়েছো?”

“চা তো মানুষ সকাল সকালই খায়। তাছাড়া তুমি যা ভাবছো আমি কিন্তু মোটেও সেটা ভেবে বলিনি।”

“আমাকে কি তোমার বোকা মনে হয়?”

“নাহ, তুমি তো যথেষ্ট বুদ্ধিমতি মেয়ে। আর সেজন্যই আমার সাধারণ প্রশ্নের আড়ালে থাকা অসাধারণ বিষয়টা বুঝতে পারো।” এই বলে নবাব আবার হাসতে শুরু করলো। আর মিষ্টি কিঞ্চিৎ রেগে বললো, “আবার যদি চা খাওয়ার কথা বলো তবে কেতলি ভর্তি চা তোমার মাথায় ঢালবো। ফাজিল কোথাকার।” মিষ্টির রাগ মিশ্রিত বাক্য শুনে নবাব কেবল হাসলো আর কাঁধ নাচিয়ে বিড়বিড় করলো, “পাগল একটা।”

.

কোনও শব্দ হলো না, কারো কন্ঠ ভেসে এলো না অথচ আচমকা জেগে উঠলো মিষ্টি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তার অজানা কারণে। বিছানায় বসে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো সে। আজ বিছানায় সে একা– এটা ভাবতে গিয়েই কষ্ট হলো তার অথচ সিলেটে আলাদা বিছানার জন্য নবাবের সাথে ঝগড়া করেছিল। কিন্তু কক্সবাজারে আলাদা রুম আর বিছানা দেখে মিষ্টির মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিল। তবে সেটা নবাব টের পেয়েছিল কি না মিষ্টির তা অজানা।

এখন মধ্যরাত। পাশাপাশি ছোট্ট দু’টো রুমের একটাতে অবস্থান করছে মিষ্টি। ওর নাক বরাবর যেই রুম রয়েছে, সেখানে ঘুমিয়ে আছে নবাব। মিষ্টির হঠাৎ ইচ্ছে করছে নবাবকে দেখতে। তাই সাত-পাঁচ না ভেবে বিছানা থেকে নেমে পড়লো। ধীর পায়ে নবাবের রুমে যখন উঁকি দিলো, তখন আধ আলোয় নবাবের ঘুমন্ত মুখ ওর চোখে দৃশ্যমান হলো।

নবাবের বিছানার পাশে মেঝেতে বসলো মিষ্টি। নবাব উপুড় হয়ে বালিশ আঁকড়ে ঘুমিয়ে আছে। অবাধ্য চুল তার সারা মুখ ঢেকে যেন দেয়াল তৈরি করেছে। মিষ্টি আলতো হাতে চুল সরিয়ে দিতে মনে পড়লো ঘুমানোর আগে বলা নবাবের কথা, “সিলেট আর চট্টগ্রামে তোমার ঘুমাতে অনেক সমস্যা হয়েছিল তা আমি বুঝতে পেরেছি। তাই এখানে আর সেই ভুলটা করিনি। হোটেলে বলেছি আমাদের সুবিধার জন্য ডাবল বেডের রুম দিতে। এই হোটেলে লোকের সমাগম বেশি হলেও রুমের ভাড়া অনেকটাই কম। আশা করছি তোমার অসুবিধা হবে না।” এসব শুনে মিষ্টি হৃদয়ে কিছু একটা অনুভব করেছিল। এমন প্রাপ্তি সে চায় না তার হৃদয় সেটা বুঝতে পেরে ব্যথিত হয়েছিল আর তাই উত্তর দিতে গিয়ে বাক্যে দুঃখ প্রতিফলিত হয়েছিল, “আরও তো অসুবিধা আছে, সেগুলো কেন সমাধান করছো না?”

এক গাল হেসে নবাব বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে জবাব দিয়েছিল, “অন্য অসুবিধার সমাধানে বিচ্ছেদের জ্বালা নেই বলে।” মিষ্টি তখন নবাবের কথা বুঝতে পারিনি তাই নিরব থেকে ছিল। কিন্তু এই মধ্য রাতে নবাবের সম্মুখে বসে ঠিকই ঠাওর করতে পারছে, “তুমি আমাকে শায়েস্তা করতে এমনটা করেছো নবাব।” লজ্জায় নত চোখে মিষ্টি বিড়বিড় করলো আর হালকা হেসে নবাবকে মন ভরে দেখে নিলো।

বিছানার ওপর রাখা নিজের হাতে মাথা রেখে চোখ বুজে ভাবনায় ডুব দিলো মিষ্টি, “তুমি আমাকে দূর্বল করে দিচ্ছো নবাব। আমার মন এখন তোমার জন্য শক্ত পাথর হয়ে থাকতে পারছে না। তোমার ভালোবাসার কুড়াল আমার মন পাথরে আঘাত করে দ্বিখণ্ডিত করছে আর সেথায় হয়ত অচিরেই কিছু একটার সূচনা হবে।”

পাশ ফিরতে গিয়ে শরীরে কোনও কিছুর অস্তিত্ব বোধ হতেই জেগে উঠলো নবাব। আধশোয়া অবস্থায় সে মিষ্টিকে দেখে চমকে উঠলো, “এ কি! তুমি এখানে?”

নবাব নড়তেই মিষ্টির ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু জেগে উঠে চুপটি করে বসে থাকা ছাড়া তার মাথায় অন্য কোনো ভাবনা আসেনি। নবাব মিষ্টির উত্তরের অপেক্ষা করলেও মিষ্টি জবাব দেওয়ার মতো কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না বিধায় আমতা-আমতা করলো, “না মানে…”

“ভয় পাচ্ছিলে?”

“তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল।” নিজের অজান্তেই সত্যি বলে ফেললো মিষ্টি আর এতে অবাক-খুশি হলেও কথায় সেটা স্পষ্ট করলো না নবাব, “ঘুমের ঘোরে আবোল তাবোল কেন বকছো? আর মেঝেতে বসেছো কেন? জলদি উঠো নয়ত সর্দি হতে পারে।” মিষ্টি ভাবেনি নবাব এমন জবাব দিবে কিন্তু এমনটা পেয়ে সে খুশি হয়নি বিধায় মলিন মুখে বিছানায় বসলো।

নবাব চটজলদি বাতি জ্বালিয়ে চুলে হাত চালালো, “কী হয়েছে মিষ্টি? খারাপ স্বপ্ন দেখে কি জেগে উঠলে?”

মিষ্টি তার নত মাথা দুইবার নাড়িয়ে ছোট্ট করে জবাব দিলো, “উঁহু।”

“তাহলে?” বলতে বলতে নবাব মিষ্টির ডান হাত মুঠোয় বন্দী করলো। আচম্বিতে মিষ্টি তাকালো নবাবের দিকে আর অনুভব করলো তার গলা লজ্জায় ধরে এসেছে৷ ঢোক গিলতেও যেন কষ্ট হচ্ছে সাথে চোখ পিটপিট করছে আর এতসব দেখে নবাব ঠোঁট টিপে হাসছে, “এই মিষ্টি, তুমি কি ঠিক আছো?”

মিষ্টি যেন সব গুলিয়ে ফেলেছে এমন ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো, “হুম?”

“বললাম, তুমি কি ঠিক আছো না-কি…” এই বলে নবাব মিষ্টির দিকে ঝুঁকে এসে ধীর গলায় বললো, “মনটা এলোমেলো হয়ে গেছে।” এবার ঢোক গিলে স্থির হলো মিষ্টি এরপর স্বাভাবিক গলায় বললো, “আমার কিছু বলার ছিল নবাব। তুমি কি রেগে যাবে?”

সোজা হয়ে বসলো নবাব এরপর বললো, “না মিষ্টি, তুমি আমাকে যা খুশি বলতে পারো। আমি কিছু মনে করবো না গো।” নবাবের কন্ঠ অনেক আদুরে শোনালো। এত মায়া জড়ানো কন্ঠে নবাব কখনও কথা বলেছিল কি না মিষ্টির মনে নেই। নবাবের চেহারাতেও মায়া ফুটছে অবিরাম আর সেই মুখ পানে তাকিয়ে মিষ্টি বললো, “নবাব, আমি তোমার কাছে অনেক ভালো আছি। এমন ভালো কত বছর আগে ছিলাম আমার জানা নেই। কিন্তু বিশ্বাস করো এমন ভালো থাকতে গিয়ে নিজেকে স্বার্থপর মনে হয় আমায়। জানি না আমার শোকে মায়ের হাল কী হয়েছে? জানি না আমার জন্য তোমার পরিবারকে কী কী সহ্য করতে হচ্ছে? এসব ভেবে আমি শান্তি পাই না নবাব।” কথাগুলো বলতে গিয়ে মিষ্টির কন্ঠস্বর ভারী হলো আর চোখ ছলছল হলো জলবিন্দুতে।

“আমার মিষ্টি কখনও স্বার্থপর হতে পারে না আর তাকে এত কষ্ট পেতেও দিবো না আমি৷ এখানে আমরা বেশিদিন থাকবো না মিষ্টি।”

“কিন্তু নবাব…” মিষ্টি বিচলিত হতেই নবাব বললো, “কালকের দিন তো চলেই গেল। আজকে আর আগামী কালকে থেকে আমরা পরশু সরাসরি বাসায় চলে যাবো।”

“সত্যি নবাব?” মিষ্টির যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না নবাবের কথা।

“হুম, সত্যি আর আমি বিদেশেও ফিরে যাবো। তুমি তো তাই চাও।” এবার মিষ্টি নবাবের হাত নিজের দিকে টেনে মুঠোয় আবদ্ধ করলো। কন্ঠে মায়া ছড়িয়ে নিজের দ্বিধা তাড়াতে প্রশ্ন করলো, “তুমি সত্যি এসব করবে?”

“হ্যাঁ মিষ্টি, আমি সত্যিই এসব করবো৷ তোমার মুখে এক টুকরো হাসির জন্য আমি সব মেনে নিতে পারবো।” বলেই চোখ নামিয়ে ম্লান হাসলো নবাব।

“তুমি খুব ভালো নবাব। আমার বিশ্বাস ছিল এটাই আমার নবাব যাকে সেই ছোট্ট থেকে দেখে আসছি৷ পিস্তল হাতে ঐ উগ্র নবাব তুমি হতে পারো না। এমনটা হয়ত ক্ষণিকের জন্য করেছিলে। তবে সেসব আমি মনে রাখতে চাই না। তুমি যদি বিদেশে ফিরে যাও আমি সত্যিই খুব খুশি হবো। কিন্তু তুমি দুঃখ পাবে না তো?”
#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_৩০

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

চোখ তুলে তাকালো নবাব, “আমার কাছে মিষ্টি মানে সুখের একটা ছোট্ট পুঁটলি আর আমি সেই পুঁটলি থেকে যখন-তখন সুখ বের করে নিতে পারি। তাহলে দুঃখের কথা আসবে কেন?”

মুগ্ধ নয়নে মিষ্টি নবাবকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার কথার ভিড়ে সর্বদা আমি হারিয়ে যাই নয়ত হেরে যাই। কখনওই তেমন করে জবাব দিতে পারি না।”

“হয়ত আমার কথায় তোমার মন ভুলে যায়।”

স্মিত হেসে মিষ্টি বললো, “হ্যাঁ, তুমি তো আবার কথার জাদু দিয়ে মানুষের মন ভুলিয়ে দিতে পারো। যাক, এখন ঘুমিয়ে পড়ো। রাত তো আর বেশি বাকি নেই।” এই বলে মিষ্টি নবাবের হাত ছেড়ে দিলো।

“যখন বাকি নেই তবে ঘুমিয়ে কী করবো?”

অবাক হলো মিষ্টি, “তাহলে কী করবে?”

মিষ্টির হাত পরম যত্নে আগলে নিয়ে নবাব বললো, “এই যে, হাত ধরে বসে বসে তোমার রাগ দেখবো।”

“বাজে না বকে ঘুমাও। আমি যাচ্ছি।” বলেই মিষ্টি উঠতে নিলে নবাব হাত টেনে বসিয়ে দেয় মিষ্টিকে আর গম্ভীর গলায় বলে উঠে, “পিস্তল কিন্তু গুলিতে একদম ঠাসা। একটাই গুলি খরচ করেছিলাম সেদিন। দ্বিতীয় গুলি কি আজকে খরচ করাতে চাও?”

মিষ্টি মাথা নুইয়ে রেখেছে কিন্তু যখন চোখ তুলে তাকালো, তখন দু’টো মুক্তোর দানা গড়িয়ে পড়লো। নবাব আঁতকে উঠলো তবে কিছু বলার সুযোগ পেল না, “নবাব, বিদেশে গিয়ে আমাকে ভুলে যাবে না তো?” মিষ্টির অশ্রু সিক্ত নয়ন আর আবেগ জড়ানো প্রশ্নে নবাব অবাক-খুশি হলো। কারণ তার মিষ্টি তাকে নিয়ে ভাবছে, তার মিষ্টি তাকে হারানোর ভয়ে চোখে শ্রাবণ ধারা নামিয়েছে। কিন্তু সে বুঝেও স্বাভাবিক রইলো আর মিষ্টির হাত ছেড়ে দিয়ে বললো, “তোমার ঘুম হয়নি মিষ্টি। যাও, গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নাও।”

“বলো না নবাব, বলো না আমায় ভুলে যাবে কি না?” মিষ্টির খুব ইচ্ছে করছিল নবাবকে এই প্রশ্ন করতে কিন্তু কোনও একটা অদৃশ্য বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে সে নিজেকে সংযত করলো।

.

সারি সারি ঝাউগাছ, চিকচিকে বালির নরম বিছানা আর সামনে নীল জলরাশি এবং শোঁ শোঁ গর্জনের মনোমুগ্ধকর সমুদ্র সৈকত। দুপুরের রোদ্দুরে গরম হওয়া বালিতে একজোড়া নূপুর পড়া পা অন্য জোড়া পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটছে। আকাশের নীল আর সমুদ্রের নীল এখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ঢেউয়ের ছন্দে মৃদু পবনের কোমল স্পর্শে রোমাঞ্চিত মিষ্টির মন ক্ষণে ক্ষণে বলে উঠছে, “আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি। দুই চোখ দিয়ে দেখেও মন ভরে না।”

হাঁটাহাঁটি করে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। মিষ্টি আর নবাব একই চেয়ারে বসে আছে কিন্তু নিশ্চুপ হয়ে। কক্সবাজারের বালুচরে যখন প্রথম পা রাখে সেই থেকে দু’জনে চুপ করে আছে। তবে এখন পাশাপাশি বসে মিষ্টির নিরব থাকতে অস্বস্তি লাগছে। চারপাশে সমুদ্র, বাতাস আর মানুষের হৈ-হুল্লোড়ে প্রকৃতি চঞ্চল কিন্তু তার পাশের মানুষটাই কেমন স্থবির হয়ে আছে। কালকে রাত থেকেই নবাব চুপ হয়ে গেছে, অনেকটা হঠাৎ করে। নবাবের এমন নীরবতা মিষ্টির হা-হুতাশ বাড়িয়ে তুলছে।

“নবাব?” চারপাশের অজস্র আওয়াজ ভেদ করে মিষ্টির নরম ডাক নবাবের কান অবধি পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। তাই বাধ্য হয়ে মিষ্টি দ্বিতীয়বার নবাব নাম মুখে আনে, “নবাব?”

“হুম।” জবাব দিয়ে নবাব ফিরে তাকালো। মিষ্টি স্পষ্টত বুঝতে পারলো নবাব কোনো ভাবনায় ডুবে আছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে জিজ্ঞেস করলো, “কক্সবাজার নিয়ে কিছু বলবে না?”

নবাবের সাথে বিয়েতে আবদ্ধ হওয়ার পর থেকেই বাইরে বের হলে মিষ্টিকে বোরকা হিজাব পড়তে হয়। মূলত পালিয়ে বেড়ানোর জন্য হলেও নবাব ছোট্টবেলা থেকে চাইতো মিষ্টি যেন বোরকা পড়ে। সব দিক বিবেচনা করে মিষ্টি কোনও আপত্তি করেনি। তবে সমুদ্রের হাওয়া লাগাতে মুখের হিজাব তুলে দিয়েছে সে অনেক আগেই। এখনও দুপুর হয়নি তবে রোদের তেজে এই সমুদ্রে তাকানো দায়। মাথার উপর মস্ত বড়ো ছাতা থাকা সত্ত্বেও রোদ্দুরে তাকাতে মিষ্টির সমস্যা হচ্ছে। চোখ ছোট করে সে নবাবের দিকে তাকিয়ে আছে।

“কী হয়েছে তোমার? হঠাৎ এমন চুপ হয়ে গেলে কেন?” নবাব জবাব দিচ্ছে না বিধায় মিষ্টি বাধ্য হয়ে কারণ জানতে চাইলো।

একটু হাসলো নবাব, “বিছানাকান্দি সম্পর্কে জানাতে কত জোর করেছিলাম অথচ তুমি শুনবে না বলে জানিয়ে ছিল। কিন্তু আজকে নিজে থেকে জানতে চাইছো বলে অবাক লাগছে।”

“অবাক হওয়ার কী আছে? আমি কি জানতে পারি না?”

“হুম, পারো।”

“তাহলে বলো। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে।”

“কক্সবাজার সম্পর্কে তো তোমার জানা আছে। বই বা অন্য কোথাও হতে হয়ত জেনে থাকবে।”

একটু লজ্জা পেল যেন মিষ্টি এমন ভঙ্গিতে মাথা নামিয়ে বললো, “জানার তো শেষ নেই। একটু-আধটু হয়ত জেনেছিলাম কিন্তু আমার ইচ্ছে আমি তোমার মুখ থেকে শুনবো।”

“এই মিষ্টি, তুমি কি সত্যিই আমার মিষ্টি?” এই বাক্যে নবাবের কন্ঠস্বর বদলে গেল। মিষ্টি আবারও সেই চিরাচরিত নবাবকে দেখতে পেয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। মুখ ভরে হেসে জবাব দিলো, “জানি না।”

মিষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে হেসে নবাব জানতে চাইলো, “কী হয়েছে তোমার বলো তো? আজকে নিজে থেকে আমাকে কেন লাগামহীন হতে বলছো?”

অবাক চোখে তাকালো মিষ্টি, “তোমাকে আমি কক্সবাজার সম্পর্কে বলতে বলেছি। তুমি এখানে অন্য মানে খুঁজে বেড়াচ্ছো কেন?”

কাঁধ নাচালো নবাব, “না, না, অন্য মানে তো নিশ্চয়ই আছে কিন্তু আপাতত না হয় বন্ধ রাখলাম খোঁজাখুঁজি। এখন কক্সবাজারের ইতিহাস শোনো।” এই বলে নবাব মিষ্টির দিকে মুখ করে বসলো আর মিষ্টি একটু রেগেও শান্ত হয়ে রইলো।

“কক্সবাজারের প্রাচীন নাম পালংকী । একসময় এটি প্যানোয়া নামে পরিচিত ছিল। প্যানোয়া শব্দটির অর্থ হলো হলুদ ফুল। অতীতে কক্সবাজারের আশপাশের এলাকাগুলো এই হলুদ ফুলে ঝকমক করত। ইংরেজ অফিসার ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স ১৭৯৯ খ্রিঃ এখানে একটি বাজার স্থাপন করেন। উনার নামানুসারে সেটা কক্স সাহেবের বাজার বলে পরিচিত হয় যা পরবর্তীতে কক্সবাজার নামে সম্যক পরিচিত পায়।” এই বলে থামলো নবাব কারণ সে দেখলো মিষ্টি অন্যমনস্ক হয়ে কাকে যেন দেখছে। মিষ্টির মনোযোগ ফেরাতে নবাব বলে উঠলো, “বুঝলে মিষ্টি?”

মিষ্টির চৈতন্য ফিরলো কিন্তু নজর এক জায়গাতেই আটকে রইলো আর এতে নবাবের কপাল কুঁচকালো। মিষ্টিকে সে কিছু বলবার চিন্তা করতেই মিষ্টি হাত দেখিয়ে নবাবকে বললো, “সোহেল।” মিষ্টির মুখে নামটা শুনে পিছনে ঘুরে তাকালো নবাব আর নিজেও চমকে গেল।

কোঁকড়া চুল এবং ভরাট দেহের অধিকারী এক পুরুষ তার সঙ্গিনীর সাথে হাসিতে মত্ত। দু’জন দু’জনের হাত জড়িয়ে দিব্যি হাঁটছে কক্সবাজারের বালুচরে। এদের দেখে হুট করেই নবাব হাঁটতে শুরু করলো আর এটা লক্ষ্য করে মিষ্টি দ্বিগুণ চমকে গেল।

“নবাব…” মিষ্টি নবাবকে ডাকলো কিন্তু নবাব হনহন করে ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো। সোহেলের সাথে হাত মিলিয়ে বেশ হাসিখুশিতে কথা বলতে লাগলো। দূর থেকে এসব দেখে মিষ্টি অবাকের মাত্রা ছাড়িয়ে গেল এবং সে বিড়বিড় করলো, “যার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল তার সাথে নবাবের এত ভাব কীভাবে হলো?”

“এই মিষ্টি?” দূর থেকে নবাব হাত উঁচিয়ে মিষ্টিকে ডাকতেই তার মনের প্রশ্নপত্র যেন হাওয়ার তোড়ে উড়ে গেল। কত-শত ভয়, বিস্ময় আর রাগকে পুঁজি করে মিষ্টি যখন উঠে দাঁড়ালো, তখন দ্বিগুণ গতিতে হাত নেড়ে নবাব মিষ্টিকে কাছে ডাকলো। অগত্যা হাঁটতে লাগলো মিষ্টি। নবাবের একদম পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো মিষ্টি মুখে একরাশ বিরক্তি টেনে।

“উনারা এখানে বেড়াতে এসেছেন মিষ্টি।” নবাব বলে উঠলো আর সোহেলের পাশা থাকা মেয়েটাকে দেখিয়ে বললো, “উনি সোনিয়া, আমাদের ভাবী। সোহেল ভাই না-কি ইদানীং বিয়ে করেছেন।” নবাবের নির্লিপ্ত কণ্ঠ নিসৃত বাক্য শুনে অবাক চোখে তাকালো মিষ্টি। ওর অবাক চোখে তাকিয়ে নবাব মৃদু হেসে নিয়ে সোহেলকে জিজ্ঞাসা করলো, “কতদিন আছেন আপনারা?”

“সপ্তাহখানেক আরও আছি। কারণ বাড়ির পরিস্থিতি এখনও বোধহয় শিথিল হয়নি।” নবাবকে জবাব দিয়ে সোহেল মিষ্টির দিকে তাকালো। লোকটার মুখে একটা গম্ভীর ভাব স্পষ্ট দেখতে পেল মিষ্টি আর এতেই ধারণা করলো সোহেল রসকষহীন মানুষ।

“নিজের প্রেমিকাকে রেখে একটা বিধবা মেয়েকে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে ছিল না আমার। পরিবারের জন্য যদিও বা রাজি হয়েছিলাম কিন্তু বিয়ে হলে হয়ত ডিভোর্স দিতে দেরি করতাম না। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না৷ তবে আপনি অনেক ভাগ্যবতী। নবাবের মতো কাউকে স্বামী হিসেবে পেয়েছেন যে কিনা আপনাকে যে-কোনও মূল্যে পেতে রাজি অবশ্য এখানে মূল্যের পাল্লায় টাকা নয়, জীবন রেখেছে নবাব।” এমন কাটকাট কথা শুনে মিষ্টিসহ সবাই অবাক হয়ে গেল। সবার মুখের অবস্থা বদলে যেতে দেখে সোনিয়া বললো, “আপনারা ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। ও এমনই সোজাসাপটা কথা বলে দেয়। এতে কেউ কিছু মনে করলো কিনা বিবেচনা করে না।”

মিষ্টি একটু হাসার চেষ্টা করলেও নবাবের বেশ রাগ লাগছিল কিন্তু সে-ও মিষ্টির মতো চুপ থাকার চেষ্টা করলো। এদিকে সোহেল কাঁধ নাচিয়ে বললো, “আমার কথাবার্তা অন্যরকম হলেও এটা কিন্তু ঠিক যে নবাবের জন্য অসম্ভব কিছু সম্ভব হয়েছে।” কথাগুলো সোহেল সোনিয়াকে বললেও ভরদুপুরে নবাবের এসব শুনতে ইচ্ছে করছে না। তাই সোহেলের কাঁধে হাত রেখে নবাব বললো, “অনেক বেলা হয়ে গেছে। আমরা এখন আসি। বেঁচে থাকলে হয়ত দেখা হবে।” এই বলে নবাব মিষ্টির হাত ধরে হাঁটতে শুরু করলো। নবাবের বাচনভঙ্গি স্বাভাবিক থাকলেও চেহারায় রাগ জমে ছিল আর তাই সোহেল কোনও কথা খুঁজে পায়নি। এদিকে মিষ্টি এখনও বুঝতে পারছে না এতক্ষণ ধরে তার চোখ কী দেখলো আর কান কী শুনলো? তবে যেই শব্দ আজ অবধি নবাব কখনও মুখে আনেনি, সেই ‘বিধবা’ শব্দ শুনে মিষ্টির ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে গেল। হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই স্মৃতি যা মিষ্টির জীবনকে দুঃখের সম্মুখীন করতে বাঁক নিয়েছিল।

“মিষ্টি? নবাব এসেছে?” মায়ের কন্ঠ শুনতে পেল মিষ্টি ওয়াশরুম থেকে। জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে কেবলই ঢুকেছিল মিষ্টি কিন্তু নবাবের নাম শুনে কাপড়চোপড় হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লো। রুমের বাইরে যাওয়ার চিন্তা ছিল মিষ্টির মাথায় কিন্তু নিজের ঘরেই নবাবকে দেখে খানিকটা চমকে উঠলো, “কখন এলে?”

নবাব উল্টো দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল। মিষ্টির কন্ঠ শুনে ফিরে তাকিয়ে সে নিজেও চমকে গেল। কালো পেড়ে হলুদ শাড়িতে মিষ্টিকে অন্যরকম লাগছে। কিন্তু এই অন্যরকম লাগার ভিড়ে নবাব তার হৃদয়ে যন্ত্রণা অনুভব করছে। কষ্টের ওজন ভারী হতেই তার গলা ধরে আসছে। নিজেকে সামলানো বড্ড দায় হয়ে পড়ছে তবুও নবাব বললো, “এই মাত্র।”

…চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here