প্রীতিকাহন পর্ব ৩১

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_৩১

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

নবাবের এলোমেলো চুল আর মলিন মুখ দেখে মিষ্টি বিচলিত হলো, “নবাব, কী হয়েছে তোমার? চেহারা এমন লাগছে কেন?”

মিথ্যা কথাটা বলতে যদিও মুখে বিঁধছে তবুও বলতে হলো নবাবকে, “তেমন কিছু না। মাথাটা একটু ধরেছে। তুমি আমার মাথাটা একটু টিপে দিবে মিষ্টি?”

“এখন?” চমকে উঠলো মিষ্টি।

“হ্যাঁ।”

মিষ্টি জানে নবাবকে বারণ করলেও সে শুনবে না। তাই অগত্যা সে রাজি হলো কিন্তু বাসা ভর্তি মেহমানের কথা মনে পড়তেই বললো, “ছাদে গিয়ে দেই? বাসায় তো…” মিষ্টির কথার মাঝে নবাবের একটু রাগ হলো, “ইট’স ওকে মিষ্টি। লাগবে না। আমি গেলাম।” এই বলে নবাব চলে যেতে নিলে মিষ্টি নবাবের হাত ধরে আদুরে গলায় বললো, “সবসময় ভুল বুঝো কেন আমায়? তোমাকেও তো আমি বুঝতে পারি না। কালকে কত করে বললাম আজকে আমার বাগদানের অনুষ্ঠানে তুমি এসো কিন্তু তুমি রাজি হলে না। এখন অনুষ্ঠান শেষ হতে চলে এলে আবার তিনসন্ধ্যায় মাথা টিপে দিতে বলছো। আমি তো বারণ করিনি কিন্তু বাসা ভর্তি মেহমান তাই ভাবলাম…”

ফিরে তাকালো নবাব এবং স্থির দৃষ্টিতে অনর্গল বলে গেল, “তোমাকে আমি কখনও ভুল বুঝিনি মিষ্টি হয়ত তুমিই আমাকে কোনও দিন বুঝবে না। আমি সপ্তাহ খানেক পরে বিদেশ চলে যাবো। তাই আজকে শেষবারের মতো দেখা করতে এসেছি।”

“কী বলছো তুমি এসব?” আঁতকে উঠলো মিষ্টি।

নবাবের নির্বিকায় উত্তর, “হ্যাঁ।”

“কিন্তু এর জন্য তো অনেক দেরি আছে, তাই না? আমাকে তো ফুপ্পি বললো…” মিষ্টির চোখে অসীম বিস্ময় বলে সে কথা হারিয়ে ফেলছে৷ এদিকে নবাবও চাপা কষ্টে যেন বোবা হয়ে আছে প্রায়৷ গলায় আঁটকে থাকা কষ্টকে গিলে সে বললো, “আমি ছাদে যাচ্ছি। তুমি এসো।” বলেই নবাব চলো গেল৷ কিন্তু ‘তুমি এসো’ বাক্যে দুনিয়ার সমস্ত কষ্ট যেন সে বুঝিয়ে দিয়ে গেল মিষ্টিকে। আর সেই ভাবনায় মত্ত হয়ে শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে বলে উঠলো, “কী হচ্ছে এসব?”

“মিষ্টি আপু?” হঠাৎ লামিয়ার কন্ঠ শুনে সম্বিত ফিরলো মিষ্টির।

“কী?”

“বড় চাচী ডাকছে তোমাকে।”

“কেন?”

“জানি না।”

“হঠাৎ আবার মা কেন ডাকছে? এদিকে দেরি করলে নবাব হয়ত রাগ করবে।” এমন ভাবনায় মিষ্টি লামিয়াকে বললো, “তুই যা। আমি যাচ্ছি।”

“ঠিক আছে।”

লামিয়া চলে যেতেই মিষ্টি নিজের মায়ের খোঁজ করতে লাগলো। মেহমানদের নজর এড়িয়ে ডাইনিং রুমে মাকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আমায় ডেকেছো?”

“হ্যাঁ।” জবাব দিয়ে মেয়েকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “এ কি! তুই এখনও কাপড় বদল করিসনি?”

“না মানে…” মিষ্টি ইতস্তত করতেই মিষ্টির মা কিছু একটা খাবারের বাটি এগিয়ে দিলেন। মিষ্টি দেখলো এতে পায়েস রয়েছে। খানিকটা বিস্মিত হলেও জিজ্ঞেস করার আগে শুনতে পেল, “হুট করে ছেলেটা এলো। ভাগ্যিস পায়েসটা আছে। এটা ওকে দিয়ে দিস আর তুই তো বললি নবাব আসবে না। আপাও বলেছিলেন। যাক, তুই নিয়ে যা।” মিষ্টি ভেবেছিল তার মা হয়ত তাকে অন্য কাজে ডেকেছে। সে বুঝতে পারেনি তার মা নিজেও নবাবকে নিয়ে এতটা ভাবে।

পিঠ ঘুরিয়ে শাড়ির আঁচল টেনে এক হাতের মুঠোয় রেখে অন্য হাতে পায়েসের বাটি নিলো মিষ্টি। ধীর পায়ে যখন ছাদে পৌঁছালো, তখন আকাশ কৃষ্ণ বর্ণের হয়ে গেছে। কৃত্রিম আলোয় ছাদ ঝলমল করছে আর সেই আলোকে ধার করে মিষ্টি দেখতে পেল নবাবকে। পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আকাশের হাজারো তারা দিকে তাকিয়ে।

নিঃশব্দে মিষ্টি এসে দাঁড়িয়ে ডাকলো নবাবকে, “নবাব?”

একটু সময় নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো নবাব। ক্লান্ত মুখে তার মলিনতার ছড়াছড়ি। চাপা দিতে গিয়েও কষ্ট ভাসছে দিনের আলোর মতো। কিন্তু সব সরিয়ে সে মিষ্টিকে জিজ্ঞেস করলো, “তোমাকে সমস্যায় ফেললাম, না?”

“তোমার আর আমার কথা সবাই জানে নবাব৷ আমরা কত ভালো বন্ধু তা কাউকে আলাদা করে বলা লাগে না। তাই সমস্যা হওয়ার মতো কারণ দেখছি না।”

“তাহলে মেহমানদের কথা বললে যে।”

মিষ্টি কী উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না তবুও নবাবকে বুঝাতে চেষ্টা করলো, “জানি না কেন বলেছি? হয়ত না ভেবেই বলেছি।”

“আমি কিছু খাবো না মিষ্টি।” হঠাৎ নবাব খাওয়ার কথা বলতে মিষ্টির খেয়াল হলো সে নবাবের জন্য পায়েস নিয়ে এসেছে। এখন সেটা মনে পড়তেই বললো, “মা পাঠিয়েছেন। না খেলে নিশ্চয়ই রাগ করবেন।”

ছাদে বসার সুন্দর ব্যবস্থা আছে। সিমেন্টের তৈরি চেয়ার দেখিয়ে মিষ্টি বললো, “ওখানে আগে বসো। এরপর লক্ষী ছেলের মতো খাবে তারপর তোমার সব কথা শুনবো।”

“মাথা ব্যথা নিয়ে এসব খেতে ইচ্ছে করছে না।”

“না খেলে নিশ্চয়ই সেরে যাবে না।… চলো।”

নিমরাজি হয়ে নবাব মিষ্টিকে অনুসরণ করলো। পাশাপাশি দু’জনে বসতেই মিষ্টি পায়েসের বাটি এগিয়ে দিয়ে বললো, “খাও। পায়েস তো তোমার খুব পছন্দ, তাই না?”

পায়েসের বাটি হাতে নবাব বললো, “ভালোই তো আমার পছন্দ অপছন্দের খবর রাখো।”

হালকা হাসলো মিষ্টি, “হয়ত।”

বেশ কিছুক্ষণ আর ওদের মাঝে কথা হলো না। নবাব চুপচাপ খেয়ে গেল আর মিষ্টি আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। নবাবের খাওয়া শেষ হতেই বাটিটা মিষ্টিকে ফিরিয়ে দিয়ে বললো, “একটু বেশিই মিষ্টি।”

আনমনে ম্লান হাসলো মিষ্টি, “খাবার হোক বা অন্য কিছু। নামটা শুনলেই মনে হয় যেন আমাকে নিয়ে বলা হচ্ছে।”

মিষ্টিকে চুপ থাকতে দেখে নবাব বললো, “দেরি হওয়ার কথা ছিল কিন্তু সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তাই আমিও দেরি করতে চাই না।” মিষ্টির মুখ মলিন হলো নবাবের কথা শুনে।

“কিন্তু দুইমাস পরে আমার…” চাপা লজ্জায় মিষ্টি পুরো বাক্য শেষ করতে পারলো না। কিন্তু নবাবের বুঝতে অসুবিধা হয়নি মিষ্টি নিজের বিয়ের কথা বলছে।

“সবাই তো থাকছেই মিষ্টি। তাছাড়া আমার কোনও ভূমিকা নেই তোমার বিয়েতে।” গম্ভীর গলায় কথাগুলো বললো নবাব আকাশের দিকে মুখ করে।

“এটা তুমি বলতে পারলে নবাব? মা বাবার পর আমার জীবনে যদি কারোর ভূমিকা থেকে থাকে তবে সেটা তুমি নবাব, তুমি।”

“আমার ক্ষেত্রেই কিন্তু তাই মিষ্টি আর তোমাকে আঘাত করতে আমি কথাটা বলিনি। বিদেশে গেলে দুই মাস পরেই আমার পক্ষে দেশে ফেরা সম্ভব নয়। তাছাড়া এখন যেতে না পারলে এতগুলো টাকা নষ্ট হয়ে যাবে।”

মিষ্টির খুব কষ্ট লাগছে। ওর কেবলই মনে হচ্ছে টাকার ভিড়ে সে নবাবের কাছে ফিকে হয়ে গেছে। কষ্ট লুকাতে মানুষ গম্ভীর হয়ে উঠে আর অসীম রাগের চাদর চাপা কান্নাকে আড়াল করে। মিষ্টিও তাই করে বললো, “ঠিক আছে, যাও। সাবধানে থাকবে আর নিজের যত্ন করবে।” নবাব কোনো জবাব দিলো না।

আকাশে ঝলমল করা একটা নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো, “পৃথিবীর আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের নাম কী জানো মিষ্টি?” মিষ্টির এখন এসব শুনতে ভালো লাগছে না বিধায় থমথমে গলায় জবাব দিলো, “নাহ।”

নবাব তেমনই আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, “লুব্ধক, যাকে ইংরেজিতে বলে Sirius.” এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে মিষ্টির দিকে তাকালো নবাব। শীতল কন্ঠে বললো, “এর আরেকটা নামও আছে, স্বাতী নক্ষত্র। আমার কাছে তুমিও ঐ লুব্ধক নক্ষত্রের মতো। হাজারও নক্ষত্রের ভিড়ে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম একটা নক্ষত্র, স্বাতী নক্ষত্র।”

নবাব প্রায়শই এমন নতুন নতুন তথ্য জানিয়ে মিষ্টিকে অবাক করে দিতো। আজকেও ব্যতিক্রম হয়নি কিন্তু নবাবের কাছে স্বাতী নক্ষত্র হওয়ার মানে সম্পূর্ণরূপে বুঝতে পারছে না মিষ্টি। তাই এই সম্পর্কিত আলোচনা না করে বললো, “এসো তোমার মাথা টিপে দেই।”

“নাহ, এখন আমাকে যেতে হবে মিষ্টি।”

“আর একটু থাকো না নবাব। রাত তো এখনও তেমন করে হয়নি।” অনুনয়-বিনয় করলো মিষ্টি কিন্তু সেটা প্রত্যাখান করতে হালকা হাসলো নবাব, “চাইলেও থাকা সম্ভব নয় মিষ্টি। অনেক দেরি যে হয়ে গেল।… ভালো থেকো। বেঁচে থাকলে দেখা হবে একদিন।” এই বলে নবাব দ্রুত পায়ে ছাদ ত্যাগ করলো।

…চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here