নিখোঁজ প্রেমের শহরে, পর্ব:১৫

#পর্ব_১৫
#আতিয়া_আদিবা

চারিদিকে এলোমেলো বাতাস। সেই বাতাসের তোড়ে কারেন্টের তারে কিছু একটা হয়েছে হয় তো! ঘন্টাখানিক ধরে পুরো এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। এর মাঝে দরজায় ঠক ঠক করে কে? মনে কৌতুহল চেপে রাতুল দরজা খুললো। তার এক হাতে মোমবাতি। মোমবাতির ক্ষীণ আলোয় দরজার ওপাশের মানুষটাকে দেখে রাতুল হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলো ক্ষণিককাল।
বর্ষা কালো চাদর গায়ে জড়িয়ে কাঁপছে। এমন কাকভেজা অবস্থায় তাকে দেখে রাতুল বললো,

তুমি এখানে? এত রাতে?

বাহিরে দাঁড়িয়েই কথা বলবো নাকি ভেতোরে ঢুকতে দিবে?

এসো।

বর্ষা এই প্রথমবারের মতো রাতুলের বাসায় এসেছে। দুই রুমের বাড়ি। পাশের ঘরে সম্ভবত রাতুলের মা ঘুমিয়ে আছে। এ ঘরটায় তেমন বেশি আসবাবপত্র নেই। একটি খাট। তাও অনেক পুরোনো বলে মনে হচ্ছে। জানালার ওদিকটায় ঘুনে ধরা একটি টেবিল। তার ওপর ধূলো পরে যাওয়া কিছু বই। একটা আলনা। তাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাপড় রেখে দেওয়া। রুমে সিগারেটের গন্ধ। বিছানায় খাবারের প্লেট রাখা। রাতুল এখনো খায় নি। দরজার কোণায় কিছু মদের বোতল দেখতে পাওয়া গেলো।
বর্ষা বললো,
তুমি মদ খাও? কখনো বলো নি তো!
রাতুল অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
না। না। আমি মদ খাই না। এগুলো আমার বন্ধুর। আমার কাছে রেখে গেছে। আগামীকাল নিয়ে যাবে।
তোমার বন্ধুর বাসায় মদের বোতল রাখতে কি সমস্যা?

কি বলো! অনেক সমস্যা। ওর আব্বু ওকে মেরে ফেলবে। আমার তো আব্বু নেই। শাসন করারও কেউ নেই। তুমি তো একদম ভিজে গেছো বর্ষা। ঠান্ডা লেগে যাবে। জামা নিয়ে এসেছো?

কিছুই আনি নি। ব্যাগে কিছু টাকা আছে। বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বের হয়ে এসেছি। তোমার সাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে আমার।

রাতুল বললো,
তোমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আমি অবশ্যই শুনবো। কিন্তু ভিজে কাপড় পরে তো থাকা যাবে না।

রাতুল ব্যস্ত ভঙ্গিতে আলনা থেকে একটি টি শার্ট এনে বর্ষাকে দিলো। বললো,
এটা পরে ফেলো। ভিজে কাপড়গুলো ছেড়ে ফেলো। আমি বারান্দায় মেলে দিয়ে আসি।

বর্ষা বাথরুমে থেকে জামা পালটে এলো। ইতোমধ্যে রাতুল দুই কাপ চা প্রস্তুত করে ফেলেছে।
বর্ষা হেসে বললো,
এত দ্রুত চা বানিয়ে ফেললে কিভাবে?
ফ্লাক্সে বানিয়ে রেখেছিলাম। রাত জাগলে মাঝে মধ্যে খাওয়া হয়। নাও চা খাও।

রাতুল বর্ষার দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো।

এখন বলো তো, এত রাতে বাড়ি ছেড়ে কেনো এসেছো?
বর্ষা আরাম করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো,
এত রাতে প্রেমিকের বাসায় কোনো মেয়ে কেনো আসবে?
রাতুল জিজ্ঞাসু চোখে বর্ষার দিকে তাঁকালো।

অবশ্যই সেই মেয়ে যদি বাসা থেকে পালায় তবে। সহজ উত্তর।

রাতুল অবাক হয়ে বললো,
তুমি বাসা থেকে পালিয়ে এসেছো?
হু।
কিন্তু কেনো?
বাসা থেকে ধরে বেঁধে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা ভাবনা করছে।
ও।
ভুল করেছি?
না। ভুল করোনি।
বর্ষা হাসলো।
তুমি তো বেশ ভালো চা বানাতে পারো।

মায়ের কাছে শিখেছি।

বিয়ের পর প্রতিদিন আমাকে চা বানিয়ে খাওয়াবে?

খাওয়াবো।

বর্ষা আর রাতুল এই বৃষ্টিভেজা রাতে এক বিছানায় পাশাপাশি বসে গল্পের ফুলঝুড়ি ছড়াতে লাগলো। সময়ের পার হতে লাগলো। রাত গভীর হতে লাগলো। একসময় রাতুল আলগোছে বর্ষার হাত ধরলো। বর্ষা দেখলো, রাতুল কেমন অদ্ভূত দৃষ্টিতে তার দিকে তাঁকিয়ে আছে।
রাতুলের এই চাহনি অন্যরকম। আকাঙ্ক্ষায় আচ্ছন্ন! তার এই অন্যরকম চাহনীতে বিমোহিত হয়ে গেলো বর্ষা। দুজন দুজনের খুব কাছাকাছি চলে এলো। ভালোবাসার মানুষের প্রতিটি স্পর্শ স্বর্গসুখের মতো। যা উপেক্ষা করার ক্ষমতা কোনো মেয়ে মানুষকে সৃষ্টিকর্তা দেন নি। একজন মেয়ে তার সবটুকু দিয়ে কাউকে ভালোবাসলে শুধুমাত্র তার সামনে আত্মসমর্পণ করে। বর্ষার মতে, রাতুলকে সে তার সবটুকু দিয়েই ভালোবাসে। এ বয়সে ভালোবাসা আর আবেগের পার্থক্য বোঝা যায় না। ভুল মানুষকেও সঠিক বলে মনে হয়।

পরেরদিন রাতুল বর্ষাকে তার বাড়িতে ফিরে যেতে বললো। সে তার মাকে নিয়ে বর্ষার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দিতে যাবে এমন আশ্বাস দিলো। বর্ষা শুরুতে রাজী হলো না। রাতুল তাকে বোঝলো,
বড়দের দোয়া ছাড়া আমরা কি কখনো সুখী হতে পারবো বর্ষা? না। কখনোই সুখী হতে পারবো না। আমরা লুকিয়ে কেনো বিয়ে করবো? তোমার পরিবারকে জানিয়েই বিয়ে করবো। তুমি বাসায় ফিরে যাও। আমি মাকে নিয়ে তোমার বাসায় আসছি।

বাবা রাজী হবেন না। তুমি বেকার। পড়াশোনা করো না। তোমার কেনো মনে হচ্ছে বাবা খুশি খুশি তোমার হাতে আমাকে তুলে দিবে?

একটা না একটা উপায় বের হবে বর্ষা। তুমি চিন্তা করো না। কিন্তু এখন তোমার বাড়ি ফিরে যাওয়াটা জরুরি। এতক্ষণে হয়তো তোমাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছেন বাসার সবাই। পুলিশ বাড়িতে আসলে ঝামেলা। আমও যাবে, ছালাও যাবে।

রাতুলের কথা বর্ষার মনে ধরলো। বাসায় ফেরার আগে রাতুলের হাত শক্ত করে ধরে বললো,
আমি অপেক্ষা করবো।

অপেক্ষা। এবং অপেক্ষা।
বর্ষার অপেক্ষার প্রহর সেদিন ফুরায় নি। রাতুল তার মাকে নিয়ে আসে নি। এদিকে হেফাজত করিম মেয়েকে ঘরবন্দি করে ফেলেন। কত বড় সাহস! এ বংশের মেয়ে হয়ে কত বড় চুনকালি মাখালো তাদের মুখে! ছিঃ ছিঃ ছিঃ
নষ্ট মেয়ে!

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বর্ষা মনের অজান্তে হেসে উঠলো। শিহাব অবাক হয়ে বললো,
হোয়াই আর ইউ লাফিং?
বর্ষা বললো,
এমনি। আপনার মাথা ব্যাথা কমেছে?
কমেছে।
আগামীকাল কখন ফিরবেন?
অনেক সকালে। ৮ টার মধ্যে।
বর্ষা আর কোনো কথা বললো না। তারা নিঃশব্দে হাঁটতে লাগলো। ফারুককে আসতে দেখা গেলো। সম্ভবত লণ্ঠনগুলো পুনরায় জ্বালিয়ে দেওয়া হবে।
বাড়ির সামনে এসে শিহাব বললো,
থ্যাংক ইউ বর্ষা।
বর্ষা অবাক হয়ে বললো,
কিসের জন্য?
আমার মনে হয় মিস্টার নিয়াজ আপনার কথা শুনেই টাওয়ার বসাতে রাজি হয়েছেন।
বর্ষা হাসলো। বললো,
এর জন্য থ্যাংক ইউ দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
শিহাব হেসে বললো,
তবুও। কর্পোরেট পার্সন তো। ম্যানার গুলো মেনে চলতে হয়। ভালো থাকবেন।
আপনিও।
গুড নাইট।
শুভ রাত্রী।

শিহাব তার ঘরে ফিরে গেলো। সাথে সাথেই তুফান হন্তদন্ত হয়ে তার ঘরে ঢুকলো।

স্যার, আপনার মা আমার ফোনে কল করছাল। আপনি ম্যাডামের সাথে আছিলেন দেইখা ডাক দেই নাই।

শিহাব অস্ফূটস্বরে বলে উঠলো,
শিট!

স্যার ফোন লাগায়ে দিমু?

দিলে খুব ভালো হয় তুফান ভাই।

তুফান রেহণুমার নাম্বারে কল করলো। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ করা হলো। শিহাব বললো,
মা?
শিহাব! কই তুই? তোর ফোন বন্ধ কেনো?

চার্জ শেষ ফোনের। চার্জারটাও ফেলে আসছি। তবে সেইফ জায়গায় আছি। প্রজেক্টে আসছিলাম। আটকা পড়ে গেছি।

কিভাবে আটকা পড়লি?

ইটস এ লং স্টোরি। ফোনে বলা যাবে না। আমি ভালো আছি, তুমি চিন্তা করো না।

ফিরবি কবে?

আগামীকাল।

সুস্থ আছিস তো?

আই এম ওকে মা। ইন ফ্যাক্ট আই এম গুড। ওয়ান্ডারফুল কিছু এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে ফিরছি আগামীকাল। অনেক কিছু শেয়ার করা বাকি। আর একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটাও তোমাকে জানাতে হবে।

কি সিদ্ধান্ত?

ফিরে বলবো। এখন রাখছি মা। টেইক কেয়ার।

শিহাব ফোন রেখে দিতেই রেহণুমার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। তার ছেলে আবার কি সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে? তাকে না জানিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো ছেলে তো শিহাব না! তবে কি তার ধারনাই সত্যি?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here