নিখোঁজ প্রেমের শহরে, পর্ব:১৪

#পর্ব_১৪
#আতিয়া_আদিবা
নৈশভোজের আয়োজনটাও নিয়াজ করিমের ফার্মহাউজে ভিন্ন। ডায়নিং টেবিলে বড় সাইজের তিনটি মোমবাতি জ্বলছে। পুরো ঘরে আবছা আলো আবছা অন্ধকার। কেমন ভুতুড়ে পরিবেশ। দেয়ালে নিজের ছায়ার নড়াচড়া দেখে মনে হচ্ছে অপচ্ছায়া হাত ইশারায় ডাকছে!
শিহাব আবার ভূতে ভয় পায়। এমন পরিবেশ দেখে সে কিছুটা ঘাবড়ে গেলো।
নিয়াজ করিম বললেন,
ইয়ং ম্যান, শুটকি খাওয়ার অভ্যাস আছে?
শিহাব অবাক হয়ে বলল,
শুটকি কি জিনিস?
নিয়াজ বললেন,
শুটকি হলো বিশ্রি গন্ধযুক্ত রোদে শুকানো মাছ যা আমার নাতনি পচ্ছন্দ করে। দুনিয়ার সব বিশ্রি জিনিসগুলো ওর খুব পচ্ছন্দ। খাবার টেবিলে শুটকি আনলে ভকভক করে এর অরুচিকর গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে যাবে। আমি নাক চেপে বসে থাকবো আর আমার নাতনি পেটপূজা করবে। আপনি চাইলে আমার ঘরে রাতের খাবারের পর্ব চুকিয়ে ফেলতে পারেন।

শিহাব ক্ষণিককাল চুপ করে রইলো। আগামীকাল সে ফিরে যাবে। হয়তো বর্ষার সাথে আর কোনোদিন তার দেখা হবে না। কিন্তু মেয়েটার সাথে সময় কাটাতে তার ভালো লাগে। মেয়েটার গলায় কঠিন থেকে কঠিনতর কথা শুনতেও তার ভালো লাগে। ‘ইংলিশ বাবু’ অথবা ‘ভম্বল’ নামটাও মধুর শোনায়!

সে বললো,
নো প্রবলেম। ইটস কমপ্লিটলি ওকে। এছাড়া ডায়নিং এ বসে খেতেই আমি কম্ফোর্ট ফিল করবো। থ্যাংকস ফর ইওর কনসার্ন।

নিয়াজ করিম মাথা নেড়ে বললেন,
ঠিকাছে। আমি তাহলে ঘরে যাচ্ছি। আজ নিজের ঘরে আরাম করে খাবো।

মালা ডায়নিং এ ছোট্ট একটি কাচের বাটি নিয়ে ঢুকলো। বাটিতে শুটকি। টেবিলের ওপর রাখার সাথে সাথেই পুরো ডায়নিং এ দুর্গন্ধ ছড়িয়ে গেলো।
নিয়াজ মালাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
আমার ঘরে খাবার দিয়ে আয়। আর তোর বর্ষা আপাকে ডেকে নিয়ে আয়। খেতে বল। রাত অনেক হলো।

নিয়াজ করিম ডায়নিং থেকে চলে গেলেন। মালা বর্ষাকে ডেকে আনলো।
বর্ষা বললো,
শুটকির বাটিটা নিয়ে যা এখান থেকে মালা। আমি আজ খাবো না। ক্ষুধা নেই।

শিহাব ব্যস্ত হয়ে বলল,
কেনো খাবেন না? সময়মতো না খেলে ইউ উইল গেট সিক।

বর্ষা চোখমুখ শক্ত করে বললো,
তাতে আপনার কোনো সমস্যা আছে?

শিহাব চুপসে গিয়ে বলল,
না।

তাহলে চুপচাপ খেয়ে উঠেন। আজাইরা জ্ঞান দিতে আসবেন না। এই মালা, তুই স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? তুই কি স্ট্যাচু অব লিবার্টি? বললাম না শুটকির বাটিটা নিয়ে যা।

মালা শুটকির বাটি নিয়ে রান্নাঘরে গেলো।
বর্ষা শান্ত গলায় শিহাবকে বলল,
খাওয়া শেষ হলে আমরা একটু বের হবো।
কোথায়?
গেলেই দেখবেন। দ্রুত খাওয়া শেষ করুন।

আমি তো দ্রুত খেতে পারি না।

বিরক্ত স্বরে বর্ষা জিজ্ঞেস করলো,
আচ্ছা আপনি পারেন টা কি বলুন তো?

সেভাবে চিন্তা করতে গেলে কিছুই পারি না। কিন্তু কর্পোরেট সেক্টরে…

বর্ষা শিহাবকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
কর্পোরেট সেক্টর এর কাহিনী বন্ধ। আপনার কিছু পারতে হবে না। দয়া করে খাবারগুলো গেলেন।

শিহাব বলল,
তাহলে স্ট্যাচু অব লিবার্টির কাহিনী বলি? অনেক ইন্টারেস্টিং কিন্তু!

স্ট্যাচু অব লিবার্টির আবার কিসের কাহিনী?

অনেকেই কিন্তু জানে না এই মূর্তিটি তামার। অথবা কেনো ফ্রান্স যুক্তরাষ্ট্রকে এটি ডেডিকেট করেছিলো।

সবাই জানে। বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে।

রাইট! ইজন্ট ইট ইন্টারেস্টিং?

কিভাবে?

ফ্রেন্ডশিপের জন্য এত বড় একটি স্কালপচার ডেডিকেট করলো। আই মিন দিস ইজ ক্রেজি!

বর্ষা হতাশ ভঙ্গিতে বললো,
মুখ বন্ধ।

শিহাব মুখ বন্ধ করে খেতে লাগলো।

রাত নয়টা।
ফার্মহাউজের প্রতিটি লণ্ঠন এক ঘন্টার জন্য নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিহাব বর্ষার সাথে একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিক একদম নিশ্চুপ। কাছে কোথাও শুকনো পাতার মড়মড় শব্দ হচ্ছে। মনে হয়, কেউ আলগোছে পাতার ওপর হাঁটছে।
শিহাব কাঁপা গলায় বললো,
বর্ষা আমার ভয় লাগছে।

কিসের ভয়?

গোস্ট ওর স্পিরিট। আমি শুনেছি এধরনের জায়গায় এসব নেগেটিভ এনার্জি এক্সিস্ট করে। মাই গড! কি স্পুকি!

বর্ষা স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
এমনও তো হতে পারে আমিই ভূত। আপনার ঘাড় মটকে খাবো বলে এদিকটায় নিয়ে এসেছি।

একে তো ঠান্ডায় শরীর জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। তার ওপর বর্ষার কথা শুনে শিহাব একদম বরফ হয়ে গেলো।
বর্ষা অন্ধকারের মধ্যেও শিহাবের ফ্যাকাসে চেহারার চিত্র মনে মনে এঁকে ফেললো। সাথে খিলখিল করে হেসে উঠলো।

শিহাব বলল,
এমন অদ্ভূত ভাবে হাসছেন কেনো?

আপনার অবস্থা দেখে।

নো রিয়েলি, আই এম স্কেয়ার্ড!

বর্ষা এগিয়ে এসে শিহাবের হাত ধরে বললো,
আপনি আমার হাত ধরে থাকুন। তাহলে ভয় লাগবে না।

শিহাব কোনো কথা বললো না। শক্ত করে নিজের আঙুলগুলো বর্ষার আঙ্গুলের মাঝে চেপে ধরলো।

মিনিট পাঁচেক পর, কোথা থেকে যেনো একটি দুটো করে জোনাকি পোকারা আসতে শুরু করলো। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ এমন করে করে শত শত জোনাকি পোকা চলে এলো। এরা ফার্মহাউজের সর্বত্র ছড়িয়ে গেলো।
জ্বলতে আর নিভতে লাগলো।

শিহাব এমন দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়ে গেলো। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,
বিউটিফুল!
বর্ষা হেসে বললো,
এই দৃশ্য দেখে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেয়া যাবে।
শিহাব বললো,
সত্যিই তাই।

শিহাব এবং বর্ষা একসাথে হাঁটছে। জোনাকিপোকা গুলো এদিক সেদিক উড়ছে। হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে শিহাব বলে উঠলো,
বর্ষা, আমরা কি কোনোভাবেই একসাথে থাকতে পারি না?
বর্ষা থমকে দাঁড়ালো। বললো,
না পারি না।
কিন্তু কেনো?
বর্ষা হেসে বললো,
অনেক কারণ আছে। কোনটা রেখে কোনটা বলি বলুন তো?

আমি সত্যি কারণটা জানতে চাই। আপনাকে নিয়ে অবশ্য ছোটখাটো রিসার্চ করেছি।

রিসার্চ করে কি পেলেন?

অনেক ইম্পোর্ট্যান্ট কিছু ইনফরমেশন পেয়েছি।

কেমন ইনফরমেশন?

শিহাব নিষ্ক্রিয় স্বরে বললো,
ফর এক্সামপল, আপনি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন? কথাটা কি সত্যি?

হু।

কেনো?

বর্ষা সহজ গলায় বললো,
কেনো আবার? প্রেম করতাম। বাসা থেকে অন্য কোথাও বিয়ে দিতে চেয়েছিলো। তাই পালিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেই ছেলে আমার সাথে প্রতারণা করেছে। বিষয়টাকে এখনো এলাকার মানুষজন নানাভাবে রসিয়ে বর্ণনা করে বেড়ায় আর আমার বিয়ে ভেঙ্গে যায়।

আই সি।

এখন বলুন। এমন মেয়েকে বিয়ে করাটা কি বুদ্ধিমানের মত কাজ হবে?

না।

হু। আপনাকে যতটা বোকা ভেবেছিলাম ততটা বোকা আপনি না। এক্ষেত্রে বুদ্ধিমান আছেন। অবশ্য সব ছেলেরাই এসব ক্ষেত্রে বুদ্ধিমান হয়।

শিহাব দেখলো বর্ষা হাসছে। কিন্তু তার মনে হচ্ছে এই হাসির মাঝে হাজারো কষ্ট লুকিয়ে আছে। মেয়েরা হাসির আড়ালে কষ্ট লুকাতে জানে।

জোনাকি গুলো এখন প্রস্থানের পথে। শিহাব বর্ষার হাত ছেড়ে দিয়েছে। বর্ষা মনে মনে হাসছে। সে জানে শিহাবের মনে এখন হাজারো প্রশ্ন খেলা করছে।
সেদিন রাতে বর্ষা আর তার প্রাক্তনের মাঝে কিছু হয়েছিলো কিনা, বর্ষা ভার্জিন কিনা – ইত্যাদি।

হয়েছিলো। সেদিন অনেক কিছুই তাদের মাঝে হয়েছিলো।
আষাঢ়ে রাত। চারিদিকে ছিলো প্রচন্ড বৃষ্টি। বর্ষা কালো চাদরে মুখ লুকিয়ে কাক ভেজা হয়ে প্রাক্তনের বাড়ির দুয়ারে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ছিলো। ঠক ঠক! ঠক ঠক!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here