নিবিদ্রিতা কাহন পর্ব -৩৯

#নিবিদ্রিতা_কাহন—৩৯
®মেহরুমা নূর

★নিজেকে বড্ডই গোমূর্খ মনে হচ্ছে আদ্রিতার। তাইতো নিবিড় ভাইয়া তাকে এভাবে বোকা বানালো। নিজের উপরেই চরম পরিমানে রাগ হচ্ছে তার। এত রাগ যে, নিজেকেই আচ্ছামতো চড়াতে মন চাচ্ছে তার৷ নিবিড় ভাইয়া ঠিকই বলে, আমি আসলেই একটা বলদি। নাহলে কি আর এবাভে ঠকতো। রাগ কষ্টের সংমিশ্রণে ভয়াবহ পীড়ন হচ্ছে আদ্রিতার অন্তর্দেশ জুড়ে। সবকিছু ভেঙে তছনছ করে দিতে মন চাচ্ছে তার। রেস্টুরেন্ট থেকে ফিরে সোজা নিজের রুমে ঢুকে নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছে সে। না চাইতেও চোখের অবাধ্য নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। আদ্রিতা হাতের উল্টো পিঠে বারবার মুছছে তবুও আবারও নিজ গতিতে বেড়িয়ে আসছে তা।সেই বিকেল থেকে রাতের আটটা বেজে গেছে, আদ্রিতা সেভাবেই পড়ে আছে। তানহা তাকে দু একবার ডেকে গেছে। তবুও বের হয়নি সে। এখন তার মোটেও কারো সামনে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। কারণ এখন বাইরে গেলে ওর চেহারা দেখে সবাই প্রশ্ন শুরু করে দিবে। যার সম্মুখীন হওয়ার ইচ্ছে আদ্রিতার মোটেও নেই। আর সবচেয়ে বেশি ওই লোকটার সামনে যাওয়ারতো মোটেও না। কিছুতেই না।

রাত নয়টার দিকে আবির ডাকতে এলো আদ্রিতাকে রাতের খাবারের জন্য। এবার আর না বের হয়ে থাকতে পারলোনা আদ্রিতা। কারণ এখন না বের হলে পুরো পরিবার জড়ো হয়ে যাবে। যা সে এই মুহুর্তে মোটেও চায়না। তাই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো আদ্রিতা। আবির মুচকি হেঁসে আদ্রিতার মাথায় হাত বুলিয়ে তাঁকে নিয়ে এলো সাথে করে। নিচে ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে আবির বসতেই আদ্রিতা দেখলো শুধু নিবিড়ের পাশের চেয়ার খালি আছে। যেখানে বসার তার একবিন্দু ইচ্ছেও নেই। আদ্রিতা এগিয়ে গিয়ে তানির গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“সোনা মা, আমি তোমার হাতে খাবো। আমাকে খাইয়ে দাও।”
তানি মুচকি হেঁসে বলল,
“আচ্ছা যা,সোফায় বয় আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
“আচ্ছা।”
আদ্রিতা সোফায় গিয়ে বসলো। আদ্রিতার বিহেভিয়ারে নিবিড়ের ভ্রু কুঁচকে এলো। কারণ আদ্রিতা একবারের জন্যও নিবিড়ের দিকে তাকাচ্ছে না। যেটা আদ্রিতার যথারীতি আচরণের মাঝে পড়ে না। খাবার শেষে নিবিড় উঠে যেতে যেতে আদ্রিতার উদ্দেশ্যে বলল,
“এক কাপ কফি নিয়ে আয় আমার রুমে।”
বলেই সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল নিবিড়। তখনই আদ্রিতা তানির উদ্দেশ্যে কড়া গলায় বলল,
“তোমার ছেলেকে বলে দিও আমি তার চাকর না। নিজেরটা নিজে নিয়ে যাক। নাহলে না খাক। আমাকে যেন না বলে।”
আদ্রিতার কথায় নিবিড় থ মেরে দাঁড়িয়ে গেল। কুঞ্চিত ভ্রু আর রাগী চোখে তাকালো আদ্রিতার দিকে।আদ্রিতাকে কিছু বলার উদ্দেশ্যে তার দিকে তেড়ে যেতে নিলেই আদ্রিতা তার আগেই উঠে দাঁড়িয়ে গটগট করে উঠে চলে গেল উপরের দিকে। আরেকদফা হতবাক হলো নিবিড়। বিভ্রান্ত চোখে তার মায়ের দিকে তাকাতেই তানির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখতে পেল সে। অপ্রস্তুত হয়ে নিবিড়ও সরে যায় তার মায়ের সামনে থেকে।

রুমে এসে আদ্রিতা দম বন্ধকর এক অনুভূতির শিকার হলো। যার প্রতিফলন স্বরুপ বিছানার বালিশ চাদর সব টেনে নিচে ছুঁড়ে ফেললো আদ্রিতা। মেঝেতে বসে ওড়না মুখে ঢুকিয়ে দাঁতের নিচে কামড়ে ধরে গুমরে আর্তনাদ করে নিজের গুমোট যন্ত্রণা জাহির করলো আদ্রিতা। চোখ মুখ লাল হয়ে উঠলো। যেন গরম ভাপ বের হচ্ছে মুখমণ্ডলে। চোখ ভরে উঠলো আবারও। নিজের অসহ্য যন্ত্রণার মাঝেই আদ্রিতার নজর গেল তার পায়ের জ্বলজ্বল করে চকমকা নূপুরের দিকে। এতদিনে আদ্রিতা বুঝে গেছে এই নূপুর কোনো পরা নয় বরং নিবিড় নামক পরা দিয়েছে ওকে।নিবিড়ের উপর রুষ্ট হওয়া আদ্রিতার ক্ষোভের শিকার হলো এবার এই নিষ্প্রাণ বস্তুটা। আদ্রিতা রাগের বশবর্তী হয়ে পায়ের নূপুর জোড়া এক টানে ছিঁড়ে ফেললো। তারপর সেটা হাতে নিয়ে বেলকনিতে গিয়ে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। তারপর রুমের সকল দরজা জানালা ভেতর থেকে সিটকানি লাগিয়ে দিলো, যাতে নিবিড় চাইলেও ওর রুমে ঢুকতে না পারে।
এভাবেই চলতে থাকলো। পরদিনও আদ্রিতা রুম থেকে বের হলোনা।একবারে কলেজের জন্য রেডি হয়ে বের হলো। তানি তাকে ডাকলো নাস্তার জন্য। আদ্রিতা দেখলো এখনো শুধু নিবিড়ের পাশের চেয়ারটাই খালি আছে। আদ্রিতা টেবিলের উপর থেকে খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে সোফার উপর এসে বসলো। সোফায় বসেই নাস্তা করলো। নিবিড়ের দিকে তাকালে হয়তো আদ্রিতা দেখতে পেত তার আচরণে রাগে শক্ত কঠিন হয়ে থাকা নিবিড়ের মুখমণ্ডল।অল্প একটু খেয়েই আদ্রিতা কলেজের উদ্দেশ্যে বের হতে নিলেই নিবিড়ও উঠে বের হতে হতে আদ্রিতার উদ্দেশ্যে গম্ভীর সুরে বলল,
“চল, আমি তোকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে যাবো।”
নিবিড়ের কথায় থেমে গেল আদ্রিতা। তার থেমে যাওয়া দেখে নিবিড়ও ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো তার দিকে। আদ্রিতা ফট করে আবিরের সামনে এসে বলল,
“চাচ্চু আজ আমি তোমার সাথে কলেজে যাবো। নিয়ে যাবে না আমাকে?”
আবির মুচকি হেঁসে বলল,
“হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই। আমার অরি মামুনির কথা ফেলার সাহস আছে নাকি আমার। চলো যাই।”
আদ্রিতা আবিরের হাত ধরে বাইরে বেড়িয়ে গেল। তা দেখে রাগে নিবিড়ের চোয়াল যেন আরও শক্ত হলো। রাগে পায়ের কাছে থাকা সু র‍্যাকটায় একটা লাথি মেরে ফেলে দিয়ে হনহন করে সেও বেড়িয়ে গেল।

আদ্রিতা পড়তে বসেছে। তবে আজকে টিচার ভিন্ন। আদ্রিতা আজই অন্য একটা টিউটরকে আসতে বলেছে। নিবিড়ের সামনাসামনি হওয়ার কোনো পথই সে খোলা রাখতে চায়না। তাইতো আজই অন্য টিচার খুঁজে বের করে বাড়িতে বলেও দিয়েছে তা। আদ্রিতার পড়ানোর মাঝেই রোজকার অভ্যাস অনুযায়ী নিবিড়ও চলে এলো ওর রুমে। টিচার থাকায় রুমের দরজা খোলাই ছিলো। নিবিড় দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই আদ্রিাতার সামনে অন্য টিচার দেখে কদম থেমে গেল তার। দরজা খোলার শব্দে আদ্রিতার টিচার তার দিকে ফিরে তাকালো। তবে আদ্রিতা তাকালোনা। সে না দেখেও বুঝতে পারছে কে এসেছে। আদ্রিতার টিচার নিবিড়ের উদ্দেশ্যে বলল,
“জি, কিছু বলবেন! ”
নিবিড় যেন চরম অস্বস্তি বোধ করলো। সাথে ক্রোধ হলো মাত্রাতিরিক্ত। সে কিছু না বলে উল্টো ঘুরে বেড়িয়ে গেল।”
আদ্রিতা তখন স্যারকে বলল,
“উনি আমার চাচাত ভাই।হয়তো এমনিই এসেছে। ”
“ও আচ্ছা।”
এর কিছুক্ষণ পরই নিবিড়ের রুম থেকে ভাংচুরের শব্দ এলো আদ্রিতার কানে৷ আদ্রিতা তাতে ভ্রুক্ষেপ না করে পড়ায় মন দিলো।

এভাবেই তিনদিন কেটে গেল। আদ্রিতা কোনভাবেই নিবিড়ের সামনে যায়না৷ কাজ ছাড়া রুমের বাইরেই বের হয়না সে। নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখে। এমনকি ফোন থেকেও নিবিড়ের নাম্বার, ফেসবুক আইডি সব ব্লক করে দিয়েছে। একই ছাদের নিচে থেকেও হাজার হাজার মাইল দূরত্ব করে ফেলেছে নিজেকে সে।

রাত তখন বারোটা প্রায়। আদ্রিতা পড়াশোনা শেষ করেছে মাত্রই। হঠাৎ ভীষণ পানির পিপাসা পেল তার৷ ঘরের পানির বোতলটাও খালি হয়ে আছে৷ অগত্যা আদ্রিতা দরজা খুলে নিচে গেল পানি আনতে। নিচে রান্নাঘরে এসে ফ্রিজ থেকে পানি বের করে খেল। তারপর ঘরের বোতলটা ভরে ফিরতে নিলেই হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা খেল সে। মাথা তুলে দেখলো সে নিবিড়। তার ভয়ানক অগ্নি দুটি চোখ দেখে ভয়ে আদ্রিতার হাত থেকে পানির বোতল পড়ে গেল নিচে। আদ্রিতা কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিবিড় এক হাতে তার মুখ চেপে ধরে অন্য হাতে আদ্রিতাকে পেঁচিয়ে ধরে আদ্রিতাকে নিয়ে বাইরের দিকে এগুলো সে। আদ্রিতা ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগলো। মুখ দিয়ে, “উম উম” শব্দ বের হলো তার। তবে ছাড়া পেলনা সে। নিবিড় তাকে নিয়ে বাইরে এসে সুইমিং পুলের পাশে রাখা ছাতা বিশিষ্ট লম্বা চেয়ারে ঠাস করে বসিয়ে দিলো তাকে। তারপর নিজেও তার সামনে বসলো। আদ্রিতার চুলের মুঠি চেপে ধরে আদ্রিতার মুখটা কাছে এনে ক্রোধে বিধ্বংসী কন্ঠে বলল,
“অনেক সাহস বেড়ে গেছে তোর তাইনা! মনে হচ্ছে কয়েকদিন আদর করায় মাথায় উঠে গেছিস তুই। তাইতো এত বাড় বেড়ে গেছে তোর। এত সাহস কি করে হয় তোর! কি করে তুই আমাকে এভয়েড করিস! আমার দেওয়া উপহার ফেলে দেওয়ার সাহস কি করে হলো তোর! বল! আজ তোকে আমি মেরেই ফেলবো। রোজ রোজ পোড়ার আর ক্ষমতা নেই আমার। একদিনেই সব শেষ করে দিবো আমি। সারাজীবনের জ্বলা একদিনেই জ্বলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো আজ।”

অন্য সময় হলে আদ্রিতা ভয়ে কেঁদে কেটে নদী বানাতো। তবে আজ যেন আদ্রিতার কোনো অনুভূতিই কাজ করছেনা। আদ্রিতা নির্বাক শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে নিবিড়ের দিকে। যেন সে কোন রোবট। কোনো কথা বা প্রতিক্রিয়া কিছুই দেখাচ্ছে না সে। আর এতে যেন নিবিড়ের রাগ আরও তরতর করে বাড়ছে। এবার সে ক্রোধে উন্মাদের মতো করে বলল,
“কি হলো,কথা বলছিস না কেন? কথা বল, কথা বল বলছি। দেখ অরি রাগ এমনিতেই অনেক আছে আর বাড়াস না আমার। নাহলে কিন্তু সত্যি সত্যিই গলা টিপে মেরে ফেলবো তোকে আমি।”
এই পর্যায়ে আদ্রিতা মুখ খুললো। শুন্য চোখে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“প্লিজ,গো এহিড।”
এবার যেন চমকালো নিবিড়। তার চোখে মুখে রাগের পরিবর্তে করুন বিস্ময় আর অদ্ভুত ভীতি দেখা গেল। নিবিড় এবার আদ্রিতার চুল ছেড়ে দিয়ে দুই হাতে আদ্রিতার মুখটা ধরে কপালে কপাল ঠেকিয়ে করুন সুরে বলল,
“এমন করছিস কেন? কি হয়েছে তোর বলনা!তুইতো আমার মিষ্টি পুতুল ছিলি। এমন কঠোরতা কেন দেখাচ্ছিস! কেন এভাবে পুড়িয়ে মারছিস আমাকে! অপরাধী কোন অপরাধের দায়ে এভাবে দন্ডিত সেটাতো জানার অধিকার তার আছে। তাহলে আমার অপরাধ কি!”
আদ্রিতার ভেতরটা গুমরে উঠছে। সে নিজেকে শক্ত রাখতে পারছেনা। অনেক কষ্টে শুধু বলল,
“আপনি কেন অপরাধ করতে যাবেন! অপরাধতো আমি করেছি। আপনার আর আপনার প্রেমিকার মাঝে এসে। তাইতো আপনাকে কষ্ট করে মিথ্যে বলে চুরি করে রেস্টুরেন্টে দেখা করতে হচ্ছে আপনার প্রেমিকার সাথে। তাহলে অপরাধীতো আমিই তাইনা!”
মাথা তুলে তাকালো এবার নিবিড়। ভ্রু কুঁচকে তাকালো সে। বিস্মিত গলায় বলল,
“হোয়াট! কি আবোলতাবোল বকছিস তুই! আমার প্রেমি……
এতটুকু বলতেই হঠাৎ যেন কিছু মনে পড়লো নিবিড়ের। সে বলল,
” এক মিনিট! তুই কি জেরিনের কথা বলছিস!”
আদ্রিতা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“কেন, আরও আছে নাকি!”
নিবিড়ের দমে যাওয়া রাগটা যেন আবার ফিরে এলো তার মুখয়বে। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“তোকে আসলেই অনতিবিলম্বে মেরে ফেলা অবশ্যক হয়ে গেছে।তানা হলে তোর মতো বলদি এই পৃথিবীকে আবারও আদি-মানবের যুগে ফেরত নিয়ে যাবি। মানে কেউ কতটা ইডিয়ট হলে বিষয়ের সত্যতা না জেনে এতো আবাল্যপনা করতে পারে! তুই শুধু জেরিনকে আমার সাথে বসা দেখেই সব খেয়ালখুশি কাহিনি বানিয়ে নিলি! ওই ব্যাপারে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করার নূন্যতম সেন্সটুকুও নেই তোর!”
আদ্রিতা অভিমানী সুরে বলল,
“কি জিজ্ঞেস করবো! আপনাদের সিক্রেট ডেট কেমন হলো তাই!”
নিবিড় ধমকের সুরে বলল,
“শাট আপ ইডিয়ট! তোর স্টুপিডিটির লেভেল আর নামাস না। আরে আমি ওখানে মিটিং এর জন্যই গিয়েছিলাম। আউটডোর মিটিং ছিলো। মিটিং শেষে ক্লাইন্ট চলে যেতেই হঠাৎ জেরিন কোথাথেকে যেন এসে বসে পড়ে। এখন রেস্টুরেন্টের সবার সামনে একজন নারীর সামনে তাকে কিছু না বলে উঠে আসাটা নিশ্চয় মানবকিতার মাঝে পড়ে না। ভদ্রতার খাতিরে আমারও অনিচ্ছা সত্ত্বেও থাকতে হয়েছে। তবে হ্যাঁ, এটা সত্যি যে সে তার কথার মাধ্যমে আমাকে বুঝাতে চাইছিলো সে এখনো আমার প্রতি দূর্বল। তবে সেটা একান্তই তার বিষয়। সেটাকে বদলানো আমার হাতে নেই। আমার হাতে শুধু আমার নিজের মনোভাবের দায়িত্ব আছে। অন্য কারো না। আর আমার মনোভাব তাকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়ে উঠে এসেছিলাম ওখান থেকে। ব্যাস এতটুকুই।”

সব শুনে আদ্রিতা সত্যি সত্যিই বোকা হয়ে গেল। নিজের বোকামির জন্য নিজেরই রাগ হচ্ছে তার। সাথে ভয়ও হচ্ছে। না বুঝে যে কান্ড করেছে। নিবিড় তাকে এখন সত্যি সত্যিই না মেরে ফেলে। নিবিড় আবার বলল,
“তোর বিশ্বাস না হলে আমি আমার ক্লাইন্টকে ফোন করছি।”
বলেই নিবিড় ফোন বের করতে নিলেই আদ্রিতা নিবিড়ের হাত ধরে আঁটকে দিলো। আস্তে করে বলল,
“লাগবেনা।”

নিবিড় দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“কেন লাগবেনা! এই সামান্য কারণে তুই গত তিনদিন হলো আমাকে যে দহনে ঝলসে দিচ্ছিলি তার কি হবে!”
নিবিড় এক হাতে আদ্রিতার থুতনি চেপে ধরলো। যার দরুন আদ্রিতার ঠোঁট দুটো পাউটের মতো চোখা হয়ে গেল। নিবিড় রাগী সুরে বলল,
“এখন বল, তোকে কি করা যায়! এই পানিতে চুবিয়ে মারবো,নাকি ছাঁদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে মারবো! চয়েস ইজ ইউর। বল কি করা যায়! ”
আদ্রিতা ঠোঁট চোখা অবস্থায়ই অস্পষ্ট স্বরে বলল,
“ছেড়ে দেওয়া যায়। মাছুম বালিকার নাদানি ভেবে মাফ করাও যায়।”
আদ্রিতার এভাবে কথা বলা দেখে নিবিড়ের রাগ হঠাৎ গায়েব হয়ে গেল। সে ফট করে আদ্রিতার বাচ্চাদের মতো চোখা হয়ে থাকা ঠোঁটে আলতো করে হালকা কামড় দিয়ে দিলো। তারপর বলল,
“যা,এবারের মতো ছেড়ে দিলাম। কারণ তোর জায়গায় আমি থাকলে আমিও হয়তো তোর থেকে বেশি ক্ষেপে যেতাম। যেখানে তোর প্রতিচ্ছবিও অন্য কারোর নজরে থাকা আমার বরদাস্ত হয় না। সেখানে আমাকে অন্য কারোর সাথে দেখে তোর রাগটাও জায়েজ। কিন্তু তোকে আগেও বলেছি, আজ আবারও বলছি। নিবিড়ের র,ক্তে তুই নামক বিষাক্ত বি,ষ মিশে আছে। সেই ঘাতক বি,ষের থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় নেই আমার। এই বি,ষেই নিজেকে বিসর্জিত করেছি আমি। তাই অযথা নিজেকে আর আমাকে কষ্ট দিসনা।”
আদ্রিতা অপরাধী সুরে বলল,
“সরি।”
নিবিড় বুকে জড়িয়ে নিলো তার প্রাণভোমরাটাকে।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ঝট করে মাথা তুলল আদ্রিতা। যেন আচমকা কোনো কিছু মনে পড়েছে তার। আদ্রিতা নিবিড়কে ছেড়ে ফট করে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড় দিলো সামনের দিকে। নিবিড় কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে সেও আদ্রিতার পেছনে যেতে যেতে বলল,
“কি হলো? কোথায় যাচ্ছিস তুই? পুতুল, দাঁড়া বলছি।”
আদ্রিতা থামলোনা। দৌড়ে বাসার পেছন সাইডে এলো। সেখানে এসে বিভ্রান্তের মতো হন্যে হয়ে ঘাসের মাঝে কিছু খুঁজতে লাগলো। সেদিন বেলকনি থেকে এখানেই নূপুর জোড়া ফেলেছিল সে। কিন্তু এখন নেই কেন? কেউ কি পেয়ে, নিয়ে গেল তাহলে? আদ্রিতা পাগলের মতো ঘাসের মাঝে হাতিয়ে হাতিয়ে খুঁজতে লাগলো। নিবিড় এসে দাঁড়াল ওখানে। আদ্রিতার খোঁজা দেখে যেন সে বুঝতে পারলো সবটা। তাই গম্ভীর গলায় বলল,
“অরি,চল এখান থেকে।”
আদ্রিতা উঠলোনা। সে পাগলের খুঁজেই যাচ্ছে। খুঁজে না পেয়ে একসময় কান্না এসে গেল তার। সে কাঁদছে আর এলোমেলো ভাবে খুঁজছে। নিবিড় আবারও বলল,
“অরি চল। এখানে কিছু নেই।”
আদ্রিতার কানে যেন নিবিড়ের কথা যাচ্ছেই না। সে নিজের মতো নূপুর খুঁজছে আর কাঁদছে। ঘাসের মাঝে এলোমেলো হাতরাতে গিয়ে আদ্রিতার হাতে একটা ভাঙা কাচের টুকরো ঢুকে গেল। সে ব্যাথা পেয়ে হালকা আর্তনাদ করে ঝাকাতে লাগলো। এবার আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা নিবিড় । ঝট করে আদ্রিতাকে কোলে তুলে নিয়ে চলে আসতে লাগলো। আদ্রিতা ছাড়া পাওয়ার জন্য হাত পা ছোটাছুটি করতে করতে বলল,
“ছাড়ুন, আমার নূপুর। ছাড়ুন।”
নিবিড় আদ্রিতাকে কোলে নিয়ে এসে সুইমিং পুলের পাশে বসলো।আদ্রিতার হাতটা ধরে সামনে এনে দেখলো হাত থেকে র,ক্ত বের হচ্ছে। নিবিড় চোয়াল শক্ত করে ক্রুদ্ধ চোখে তাকালো আদ্রিতার দিকে। সুইমিং পুলের পানি দিয়ে হাতের র,ক্ত ধুয়ে দিলো। তারপর পকেট থেকে রুমাল বের করে আদ্রিতার হাত বেঁধে দিলো। আদ্রিতা আবারও উঠে যেতে চাইলো সেখানে। এবার নিবিড় তাকে উচ্চস্বরে ধমক দিয়ে বলল,
“অরি,বললাম না ওখানে কিছু নেই।”
আদ্রিতা অবাক সুরে বলল,
“আপনি কীভাবে জানলেন? এক মিনিট, আপনি তখনও বলেছিলেন, ” আমার দেওয়া উপহার ফেলে দেওয়ার সাহস কি করে হলো তোর।” তারমানে নূপুর আপনার কাছে তাইনা! প্লিজ দিয়ে দিন আমাকে।”
“আমার কাছে কেনো নূপুর টুপুর নেই।”
“দেখুন মিথ্যে বলবেন না। আমি জানি নুপুর আপনার কাছেই আছে। প্লিজ দিয়ে দিন না আমাকে।”
“দেখ, প্রথমত তোর নূপুর টুপুরের খবর আমি জানি না। দ্বিতীয়ত, যখন কেউ কারোর দেওয়া উপহারের অবজ্ঞা করে তখন তার সেটা ফিরে পাওয়ার কোনো অধিকার নেই।”
আদ্রিতা কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,
“সরি না,আর কখনো ভুল হবেনা। এমন করছেন কেন? প্লিজ দিয়ে দিন না। দরকার হলে কান ধরে উঠবস করবো আমি। তাও দিন প্লিজ।”
“ঠিক আছে। আগে উঠবস কর। তারপর ভেবে দেখবো।”
আদ্রিতা উঠে দাঁড়িয়ে সত্যি সত্যিই কান ধরে উঠবস করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ক্লান্ত হয়ে বলল,
“এখন দিন প্লিজ।”
“কি দিবো! আমার কাছে দেওয়ার মতো কিছুই নেই।”
“দেখুন,এটা কিন্তু চিটিং। আপনি বলেছিলেন কান ধরে উঠবস করলে নূপুর দিবেন।”
“কখন বললাম! আমার কথার মাঝে নূপুর নামের শব্দ একবারও উচ্চারণ করেছি আমি! আমি বলেছি ভেবে দেখবো। তো ভেবে দেখার বিষয় কোনটা সেটাতো আর বলিনি।”
“তাহলে দিবেন না, আপনি! ”
“আরে থাকলেনা দিবো!”
“দিবেন নাতো! ঠিক আছে না দিলেন। আপনার কলিজার ভেতর ঢুকিয়ে রাখুন।”
বলেই আদ্রিতা কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে বাড়ির ভেতর চলে গেল। তা দেখে মাথা নেড়ে হাসলো নিবিড়।

রাতে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমালেও পরদিন সকালে আবারও নিজের পায়ে নূপুর জোড়া শোভা পেতে দেখলো আদ্রিতা। খুশিতে লাফিয়ে উঠলো সে। মনে মনে বলল,”দৈত্য দানবটা এতটাও খারাপ না।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here