নীলচে তারার আলো পর্ব -৩১+৩২

#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_৩১

” তার মানে কি তুমি আমার সাথে আমার ঘরে থাকতে চাইছো?”,একটা ভ্রু তুলে কথাটা বলতে বলতে এগিয়ে আসতেই হিয়া জড়সড় হয়ে বসলো। আজ ভূতের ভয়ে সিংহের গুহায় হানা দেওয়াটা কি ঠিক হয়েছে তার?

হিয়া একটা ঢোক গিলে দুবার পলক ফেলেই চোখ সরিয়ে নিলো। হিয়া এইবার কি করবে?
আজব মানুষ,নিজের বউ ভয় পাচ্ছে কোথায় সাহস দিবে তা না লোকটা প্রস্ন করছে তুমি কি আমার সাথে আমার ঘরে থাকতে চাইছো? এবার উত্তরে সে কি বলবে? হুম চাইছি। যত্তসব! নিজে থেকে এসে বসে আছি তারপরও জিজ্ঞেস করা লাগবে তার।
কিছু করার নেই আজ রাতে সে একা নিজের ঘরে কিছুতেই থাকতে পারবে না। তাই নিলজ্জের মতন হিয়া হ্যা সূচক মাথা নাড়লো।

শুভ্র ঠোঁট চেপে নিজের হাসি থামলো। তারপর মাথা নেড়ে বললো,” ওকে বাট একটা কন্ডিশন আছে।”

হিয়া চোখ বড় বড় করে তাকালো। কন্ডিশন মানে কি? নিজের বউকে নিজের ঘরে থাকতে দিবে এতেও কন্ডিশন! কেমন জামাই এইটা? এমন দিনও তাকে দেখতে হলো। লোকটা কি তাকে পছন্দ করে না ? একটুও না? এখণ তো তার সন্দেহ হচ্ছে। হয়তো সবটাই তার ভুল ধারণা ছিল এতো দিন। হিয়া সেসব প্রকাশ না করেই বলল,” কি কন্ডিশন?”

” আমার রুমে যদি তোমার আজ রাত থাকতে হয়,,” কথাটা বলেই শুভ্র ঝুকে এসে হিয়ার দুপাশে হাত রেখে হিয়ার চোখের দিকে তাকালো। হিয়া মলিন চোখে তাকিয়ে আছে। কি কন্ডিশন দিবে কে জানে। শুভ্র সিরিয়াস হয়ে বললো,” সারা জীবনের জন্যে আমার ঘরে থাকতে হবে।”

শুভ্রের কথার ইঙ্গিত হিয়া ধরতে পারলো না। এমন ডাবল মিনিং কথাবার্তা তার মাথার উপর দিয়ে যায়। হিয়া কি বলবে? উনার ঘরে সারাজীবন থাকা মানে কি ? নিঃশ্বাস নিতে শব্দ করা যাবে না, হাঁটার সময় নূপুরের আওয়াজ করা যাবে না, লাইট বন্ধ করে ঘুমাতে হবে যার মানে পুরো জীবনটাই ধ্বংস। হিয়া ভেবে কোনো কুল পাচ্ছে না।

শুভ্র উঠে দাড়ালো। এই মেয়ে এখন ভাবতে বসেছে। সারারাত ভাবার সময় দিলেও সকালে উঠে সে আবার ভাবতে বসবে। তাকেই কিছু করতে হবে।

” তোমাকে ভাবার জন্যে আমি সারারাত দেই নি। পাঁচ সেকেন্ড সময় দিবো এরপর আমি লাইট বন্ধ করে ঘুমাবো। উত্তর যদি না হয় পাঁচ সেকেন্ডে পর নিজের রূমে ফেরত যাবে।”, কঠিন গলায় বললো শুভ্র।

” কি আজব!পাঁচ সেকেন্ড? মাত্র পাঁচ সেকেন্ডে সারা জীবনের সিদ্ধান্ত নিবো কি করে?”,বলেই লাফিয়ে উঠলো হিয়া।

” কেনো? ভরসা নেই আমার উপর।”,বলেই হিয়ার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকালো। শুভ্র জানে এই মুহূর্তটা একনিমিষেই ” কি?, মানে, কেনো”, এ জাতিয় কথা বলে হিয়া নষ্ট করে ফেলবে। এসব কথা হিয়ার মগজে ঢুকবে না।

শুভ্রের ধারণা সত্যি করে দিয়ে হিয়া ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,” মানে?” শুভ্র হালকা হেসে একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,” কিছু না। আমার ঘুম পাচ্ছে। তুমি কি করবে জলদি সিদ্ধান্ত নেও।”

কি সিদ্ধান্ত নিবে সে? আশ্চর্য..! হিয়া তাকিয়ে রইলো। শুভ্র লাইটা অফ করে দিলো। হিয়ার ভয়ে ঘাম ছুটছে, চিৎকার করতে গিয়েও চুপ করে গেলো। হিয়া অপেক্ষায় আছে শুভ্র কখন তার পাশে এসে বসবে। হিয়া ভয়ার্ত গলায় অন্ধকার রুমে বললো,” আপনি কোথায়?”

শুভ্র যে তার ঠিক পাশে শুয়ে আছে সেটা হিয়ার খেয়াল করেনি। অন্ধকারে বোঝাও মুশকিল। কিছুক্ষণ যেতেই যদিও সেটা সে অনুভব করেছে শুভ্র তার পাশেই আছে। কিন্তু তাও ভয় লাগছে। শুভ্র কি তার পাশে আছে? হিয়ার কয়েকবার ডাকার পরও শুভ্র উত্তর দিলো না। হিয়ার ভয় বাড়তেই আস্তে আস্তে হাত দিয়ে শুভ্রকে খুঁজতে লাগলো। হাত বাড়াতেই প্রথমে শুভ্রের মুখের উপর হাত রাখতেই শুভ্র চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। ভয়ের চোটে কি পাগল হয়ে গেছে মেয়েটা? হিয়ার শুভ্রের হার্টবিট চেক করতে করতে আস্তে আস্তে গলা তারপর বুকের দিকে হাত নিতেই শুভ্র হাতটা ধরে ফেললো, হিয়া চেঁচিয়ে উঠলো।

শুভ্র টেবিল ল্যাম্প জেলে দিতেই দেখলো হিয়ার চোখ মুখের অবস্থা ভয়বহ। শুভ্র বিরক্তি নিয়ে তিক শব্দ করে বললো,” কি করতে চাইছো? হ্যাভ ইউ গন ম্যাড?।”

” আ….. সরি, সরি আমি আসলে আপনার হার্ট বিট…….”, বলেই নিচের ঠোঁট কামড়ে থেমে গেলো।
” এই লাইটটা থাকুক। আমার ভয় লাগে। আমি কখনো অন্ধকারে ঘুমাই নি।”, বলেই আবারো ঠোঁট কামড়াতে লাগলো হিয়া।

শুভ্র হিয়ার ঠোঁটের দিকে আঙ্গুল করে বললো,” হিয়া.. জাস্ট স্টপ ইট.., নাও ইউ আর ড্রাইভিং মি ক্রেজি।”

হিয়া হতভম্ব হয়ে তাকালো। শুভ্র এই প্রথম তাকে নাম ধরে ডাকলো কিন্তু কি বললো এইটা? থামাতে বললো,কি থামাবে সে? শুভ্রকে পাগল করে দিচ্ছে মানে? হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকালো।

শুভ্র হিয়ার হতভম্ব চেহারা দেখে বললো,” বোঝনি তাই তো? তোমার বুঝতেও হবে না, ঘুমাও। কিন্তু তার আগে ঠোঁট কামড়ানো বন্ধ করো।”

হিয়া সঙ্গে সঙ্গে হাত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলো। লোকটার নজর তাহলে তার ঠোঁটের দিকে..? কি সাংঘাতিক!

শুভ্র বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে ল্যাম্পের আলো কমিয়ে শুয়ে পড়লো। হিয়া স্তব্দ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে তারপর একপাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো। তারপর অনেক সাহস করে হাত বাড়িয়ে শুভ্রর টি শার্টের এক প্রান্ত মুষ্টিবদ্ধ করতেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লো সে।

শুভ্র ওপাশ ফিরতে যাবে,শার্টে টান অনুভব করতেই চোখ খুলে তাকালো। তারপর বিমোহিত হয়ে তাকিয়ে রইলো হিয়ার ঘুমন্ত মুখটার দিকে। তার শার্টের প্রান্ত ভাগ হিয়ার মুষ্টিবদ্ধ দেখে হালকা হাসলো। তারপর যেভাবে ছিলো ঐভাবেই শুয়ে রইলো।

ভোর হতেই হিয়ার ঘুম ভাঙলো। চোখ খুলতেই প্রথমে শুভ্রের দিকে নজর গেলো। লোকটা ঘুমিয়ে থাকলে কতই না মায়া লাগে, অথচ চোখ মেললেই কড়া চোখে তাকিয়ে থাকে।

হিয়া আস্তে করে শুভ্রের শার্টের প্রান্তভাগ ছেড়ে দিয়ে উঠে বসলো। ভাগ্যিস লোকটার আগে জেগে গেছে সে। এইবার কেটে পড়া যাবে।

হিয়া বেড়িয়ে এসে দেখে ইউভি প্রতিদিন যেই জায়গায় ঘুমায় সে সেইখানেই বসে আছে। ভালোয় ভালোয় আজ সবাই ফিরে এলেই সে বেচে যায়।

⭐ শুভ্র সবে গোসল সেরে বেরিয়েছে, তোয়ালেটা গলায় ঝোলানো। চুল থেকে পানি টপ টপ করে পড়ছে। মাথার পানি নিতে নিতে ফোন বেজে উঠলো। শুভ্র তোয়ালেটা নামিয়ে রেখে কলটা রিসিভ করল। মা কল করেছে। কথা বলে সে যা বুঝলো সেটা হলো আজ তাকে নরসিংদী যেতে হবে। শুধু তাকে যেতে হলে একটা কথা ছিলো, হিয়াকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। শুভ্রের মা, কথার এক পর্যায়ে হিয়ার খোঁজ করলেন। শুভ্র বেড়িয়ে আসতেই দেখলো হিয়া কলেজের জন্যে রেডি হয়ে বেরুচ্ছে।

শুভ্র কোনো কথা না বলে ফোনটা হিয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে এলো। হিয়া হতবুদ্ধির মতন তাকিয়ে রইলো। ফোনটা তাকে ধরিয়ে দিয়েছে কেনো? সে কি করবে? হিয়া ফোনের স্ক্রিনে মা লেখা দেখেই ঘাবড়ে গিয়ে ফোনটা কানে ধরলো।

ওপাশ থেকে সাহারা খাতুন বললেন,” তুমি কি কলেজের জন্যে রেডি হয়েছো?”

উত্তরে হিয়া কিছু বলার আগেই সাহারা খাতুন বলেন,” আজ কলেজে যেতে হবে না তোমার। শুভ্রের সাথে এইখানে আসবে। শুনো, মেরুন রঙের যেই শাড়িটা তোমাকে দিয়েছি ঐটা পরেই আসবে। বুঝতে পেরেছো কি বললাম?”

হিয়া পর পর দুইবার জ্বি বললো উত্তরে। শাশুড়ির সাথে কথা বলতে গেলে কেনো জানি তার বুক কাপে। সাহারা খাতুন তারপর শুভ্রকে ফোনটা দেওয়ার কথা বলতেই হিয়া সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা এনে শুভ্রের সামনে ধরলো। হিয়ার মাথায় এখন একটাই চিন্তা শাশুড়ি তাকে শাড়ী পড়তে বলেছে কিন্তু সে তো পারে না শাড়ি পড়তে। তাহলে এবার উপায়? ভয়ের চোটে তো ঠিকই জ্বি জ্বি বলে ফেলেছে। এই ভাবনায় হিয়া অন্যমনস্ক হয়ে দাড়িয়ে রইলো।

শুভ্র ফোনটা কান থেকে নামিয়ে ভ্রু কুঁচকে হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,” দাড়িয়ে আছো কেনো এইভাবে? যাও রেডি হও।”

হিয়া আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকালো। ইচ্ছে করছে এতো গুলা কথা শুনিয়ে দেয়। যাও রেডি হও বললেই হলো? নিজের কি ? নিজে তো ঠিক শার্ট, প্যান্ট আর হাতে একটা ঘড়ি পড়লেই হলো। কিন্তু তাকে তো শাড়ী পড়তে হবে। ইয়া লম্বা একটা শাড়ী, ভেবেই ঘাম ছুটছে তার। এইসব ভাবতে ভাবতে মুখ বাঁকিয়ে শুভ্রের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো হিয়া।

ইউটিউবে এই পর্যন্ত কয়েকটা ভিডিও দেখা শেষ। টাইটেল লেখা শাড়ী পড়ার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতিতে অথচ ভিতরে এত এত কঠিন সব নিয়ম। প্রায় দুই ঘণ্টা নিয়ে শাড়িটা পড়লো হিয়া। কিন্তু কুচিগুলো নিচের দিকে এলোমেলো হয়ে আছে। ধুর সে আর পারবে না যা হয়েছে, হয়েছে।

শুভ্র এই নিয়ে তিনবার হিয়ার দরজার টোকা দিলো।দরজা আটকে কি এমন সাজছে। মেজাজ ভালোই খারাপ হয়ে আছে তার। শুভ্র চতুর্থ বারের মতন দরজার নক করে বললো,” হিয়া পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি বের হও আদারওয়াইজ লকের চাবি কিন্তু আমার কাছে আছে।”

বলতে বলতে হিয়া দরজা খুললো। শুভ্রের এমন হুমকি শুনে সে দৌড়ে এসেছে। শুভ্র মুগ্ধতার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। খোলা চুল আর মেরুন রঙের শাড়িটায় এই পিচ্চি মেয়েটাকেও মিষ্টি বউয়ের মতন লাগছে। কিন্তু কুচির দিকে তাকাতেই শুভ্রের ভ্রু কুঁচকে গেলো। এমন এলোমেলো অবস্থা কেনো? শুভ্র হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,” দুঘন্টা লাগিয়ে তুমি এই করেছো?”

” শুনুন, যা করেছি এটাই অনেক। শাড়ী পড়াটা কত কঠিন আপনি জানেন? আপনি পারবেন শাড়ী পড়তে?”, বিক্ষোভ নিয়ে বললো হিয়া।

” পড়তে না পারলেও, পড়াতে পারতাম। যাই হোক। দেখি এই দিকে আসো।”, কথাটা বলতেই হিয়া দু পা পিছিয়ে গিয়ে বললো,” না না, ছি! আমি আপনার কাছে শাড়ি পড়বো না।” বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে হিয়া।

মেয়েটা এত বেশি বুঝে কেনো? যেটা বোঝার প্রয়োজন সেটা বুঝবে না বাকি সবকিছু বেশি বেশি বুঝে বসে থাকবে। শুভ্র কড়া চোখে তাকিয়ে বললো,”এইদিকে আসো। কুইক।”

হিয়া ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,” আমি কিন্তু যা বলার বলে দিয়েছি..” এতটুকু বলতেই শুভ্র হিয়ার হাত ধরে টেনে হিয়াকে নিজের সামনে দাড় করাতেই হিয়া আড় চোখে তাকালো। শুভ্র শার্টের হাতা একটু উপরে তুলে হিয়ার পায়ের কাছে এক হাঁটু ভাজ করে বসতেই হিয়া অবাক চোখে তাকালো। শুভ্র হিয়ার শাড়ির কুচিগুলো গুছিয়ে দিচ্ছে।

অজানা এক ভালোলাগা ঘিরে ধরলো তাকে। কলেজ থেকে ফেরার সময় একবার সে এমন এক দৃশ্য দেখেছে। ঘটনা তার মনে গেথে গিয়েছিল। কিন্তু কখন শুভ্র এইভাবে তার শাড়ির কুচি ঠিক করে দিবে কল্পনাও করেনি সে। শুভ্র ছোট ছোট এই কাজগুলো তার মনে বিশাল এক জায়গা দখল করে নিয়েছে।
#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_৩২

অজানা এক ভালোলাগা ঘিরে ধরলো তাকে। কলেজ থেকে ফেরার সময় একবার সে এমন এক দৃশ্য দেখেছে। ঘটনা তার মনে গেথে গিয়েছিল। কিন্তু কখন শুভ্র এইভাবে তার শাড়ির কুচি ঠিক করে দিবে কল্পনাও করেনি সে। শুভ্র ছোট ছোট এই কাজ গুলো তার মনে বিশাল এক জায়গা দখল করে নিয়েছে। হিয়া নিজের অজান্তেই শুভ্র নামের এই চশমা পড়া, গম্ভীর, চুপচাপ ছেলেটার প্রেমে পড়ে গেছে। যে ছেলে হিয়ার ছোট ছোট অনুভূতিগুলোর খুব খেয়াল রাখে তার আড়ালে।

শুভ্র শাড়ির কুচিগুলো ঠিক করে উঠে দাড়িয়ে শার্টের হাতা ঠিক করে নিলো। শুভ্র তাকানোর আগেই হিয়া তার বিমোহিত দৃষ্টি সরিয়ে নিচের দিকে তাকালো। সামনের চুলগুলো অকারনেই কানের পিছে গুঁজে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,” আমার আর কিছুক্ষণ লাগবে। চুলটা বেধেই চলে আসবো।”

শুভ্র কোমরে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে। হিয়াকে খোলা চুলেই অনেক মায়াবতী লাগছে। শুভ্র চাইলে হিয়াকে আটকাতে পারে কাছে এনে বলতেই পারে যে, আমার ভালো লাগে তোমার এই খোলা চুল। কিন্তু হিয়ার এই মায়াবতী রূপ দেখার একমাত্র অধিকার শুধু তারই আছে। অন্যকেউ তা দেখে বিমোহিত হোক, সে সেটা চায় না। নিজের প্রিয় মানুষদের ক্ষেত্রে সে হিংসুটে তো বটেই।
শুভ্র হাতে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকালো তারপর বললো,” আমি গাড়িতে গিয়ে বসছি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নীচে আসবে, নয়তো তোমাকে রেখেই আমি চলে যাবো।”

হিয়া ভ্রু কুঁচকে শুভ্রের দিকে তাকালো। লোকটা কি একটু মিষ্টি করে কথা বলতে পারে না? সবসময় খালি হুকুম দিয়ে বেড়ায়। হিয়া মুখ কালো করে নিজের রুমে এলো। চোখের নিচে হালকা একটু কাজল দিয়ে, চুলে একটা খোঁপা করেই বেড়িয়ে এলো সে। ইউভিকে দারোয়ানের কাছে রেখে যেতে হচ্ছে। বদমাইশ ডাক্তার তো আর সঙ্গে করে নিয়ে যাবে না। নিজেই এনে দিয়েছে অথচ এমন ভাব ইউভি যেনো তার চিরো শত্রু।

শুভ্রের সাথে গাড়ি করে কোথাও যেতে হিয়ার একদম ভালো লাগে না। সারা রাস্তা কোনো কথা নেই চুপ চাপ বসে থাকা। কতটা বিরক্তিকর! তাই প্রতিবারের মতন এবারো বসে বসে হিয়া ঘুমিয়ে পরেছে। গাড়ি জ্যামে আটকা পড়তেই শুভ্র হিয়ার দিকে তাকালো। হিয়া ঘুমে তলিয়ে আছে। ঘাড় কাত হয়ে আছে। শুভ্র সিটবেল্ট খুলে এগিয়ে এসে হিয়ার ঘাড় সোজা করে দিতে দেখলো হিয়া ঘুমের মাঝেও নিজের ঠোঁটটা কামড়ে আছে। শুভ্র নিজেকে সামলে সরে এসে নিজের সিটে বসে পড়লো। চশমাটা চোখ থেকে খুলে মাথার চুল গুলো হাত দিয়ে পিছনে নিয়ে মুখ দিয়ে তিক শব্দ করে চশমাটা আবার পড়ে নিলো। ধীরে ধীরে নিজের উপর থেকে কন্ট্রোল যেনো সে হারিয়ে ফেলছে। আরো দুর্বল হয়ে পড়ছে হিয়ার প্রতি।

শুভ্রের দাদাবাড়ি হিয়ার বেশ পছন্দ হয়েছে বিশেষ করে সরিষার মাঠগুলো। অর্ধেক রাস্তা এসে তার ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম ভেঙে ভালোই হয়েছে এতো সুন্দর দৃশ্যগুলো নাহলে মিস করতো।

শুভ্র বাড়িতে এসেই প্রথমে নিজের দাদীর ঘরে এলো। তার দাদী প্রায় অসুখের এমন বাহানা দিয়ে সবাইকে একসাথ করে। এইবারের ঘটনা কি সেটাই শুভ্রর জানতে হবে। সবাই এলে মাইনুর শিক্ষকের এই বাড়ি যেনো তখন হৈ হৈ করে উঠে। তার দাদা শিক্ষক হলেও সেকালে তার এমন দোতলা বাড়ি যেমন সবার নজর কাড়তো এখনো সবার নজর আকর্ষণ করে বাড়িটি।

শুভ্র তার দাদী আকলিমা আক্তারের ঘরে ঢুকলো। ছেলের বউগুলো তাকে ঘিরে বসে আছে। তাদেরও বয়স কম হয়নি। তাদের মধ্যে শুভ্রের মা আকলিমা আক্তারের মাথার কাছে বসে আছেন। শুভ্রকে দেখেই তিনি হাতের ঈশারায় ডাকলেন। দাদীর পাশে বসেই শুভ্র এই নাটকটা ধরে ফেললো। তার দাদির ঠোঁটে হাসি, শুভ্রকে দেখে সে হাসি আরো প্রশস্ত হলো। আকলিমা আক্তার ভাঙ্গা গলায় ডাকলেন,” কি গো ডাক্তার সাহেব.., নতুন বউরে লগে আনো নাই?”

এখন যেনো ঘটনাটা আরো পরিষ্কার হলো তার কাছে। শুভ্র কিছু বলার আগেই তার তার ছোটো চাচার মেয়ে নিধি হিয়াকে নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,” এইযে আমাদের ডাক্তার সাহেবের বউ।”

হিয়া বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। কারণ রুমে উপস্থিত সব মহিলারা আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্রের দাদী আস্তে করে উঠেতে চাইলেই শুভ্র তার হাত ধরে তাকে বসালেন। আকলিমা আক্তার উঠে বসে হাতের ঈশারায় হিয়াকে নিজের কাছে বসতে বললেন। হিয়া এগিয়ে গেলো। একবার শুভ্রের দিকে তাকাতেই দেখলো শুভ্রর দৃষ্টি তাকেই দেখছে। হিয়া একপাশে এসে বসলো। শুভ্রের দাদী অনেক কথা বললো তার সাথে। তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না সে অসুস্থ। কথোপকথনের এক পর্যায়ে তিনি শুভ্রকে বললেন,” ডাক্তার সাহেব, ঘরে ছোট ডাক্তার কবে আসবো?”

” যার যখন আসার সময় তখন সে ঠিক আসবে।”, বলেই শুভ্র উঠে দাড়ালো। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় একবার হিয়ার দিকে তাকালো দাদীর কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে চোখ গুলো রসগোল্লার মতন করে ফেলেছে সে।

শুভ্র এইখানে এসে যে কয়েকদিনের জন্য আটকে গেছে সেটা ভালোই টের পাচ্ছে। তার বাবা আর চাচাদের দেখো। কারো মা অসুস্থ থাকলে এমন নিশ্চিন্তে আড্ডা দেয়, মানুষ? শুভ্র ধারণা প্রতিবছর এই নাটকের সূত্রপাত তার বাবার বুদ্ধিতেই হয় সঙ্গে তার দুই ভাই। নাহলে মায়ের অসুস্থতায় কেউ ক্যাপ সঙ্গে নিয়ে আসে? তিন ভাই ক্যাপ মাথায় উঠানে বসে আলাপ করছে। শুভ্রের চাচাতো ভাই বোন গুলো এখনো এসে পৌঁছায় নি। ছোট ছোট কয়েকটা এসেছে ঐগুলো এদিক সেদিক ছুটছে।

হিয়া প্রায় অনেক্ষন পর দাদীর ঘর থেকে বের হতে পেরেছে। প্রথম প্রথম ভালোই লাগছিল তারপর বৈবাহিক জীবন নিয়ে এমন আলোচনা তাকে শুনতে হয়েছে যে লজ্জায় তার অবস্থা খারাপ। হিয়া খেয়াল করলো সবাই এইখানে শুভ্রকে ডাক্তার সাহেব বলে ডাকে। ডাক্তার সাহেব ডাকটা তারা এক রাশ ভালোবাসা নিয়ে বলে। হিয়া বাড়ির নিচে পুরোটা খুঁজলো কিন্তু এই ডাক্তার সাহেবকে পেলো না। শুভ্র কি ঘুরতে বেরিয়েছে? গেটের বাহিরে আরো কয়েকটা গাড়ি এসে থেমেছে মনে হলো।

হিয়া হাঁটতে হাঁটতে দোতলায় উঠলো। শুভ্র দোতলার লম্বা করিডোরে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলো। রিমি হুট করে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য কিছু বুঝলো না সে। রিমিকে নিজের থেকে সরিয়ে দিতেই রিমি হেসে উঠে বললো,” আহ্, কতো দিন পর তোকে দেখলাম। আমি একমাস হলো দেশে ফিরেছি অথচ তোর দেখা পাই নি।”

রিমি এইখানে কি করে এলো। শুভ্র ভ্রু কুঁচকে বললো,” তুই চলে এসেছিস আমেরিকা থেকে?”

” এভাবে বলছিস কেনো আমি ফিরে আসায় তোর ভালোলাগে নি?”,

শুভ্র না সূচক মাথা নাড়ল। তারপর বললো,” তুই ফিরে এসেছিস তাতে আমার খুশি হওয়ার কি আছে বলতো? স্টুপিডের মতন প্রশ্ন।”

রিমি রেগে গিয়ে বললো,” তুই এত খারাপ কেনো বলতো? মুখের উপরে এভাবে বলে দিলি।” শুভ্র রিমির কাধেঁর উপর হাত রেখে বলল,” আমি তো এমনই।”
রিমি ফট করে হাতটা সরিয়ে মুখ কালো করে বললো,” তুই অনেক নিষ্ঠুর।”

শুভ্র রিমির মাথায় চুল টেনে বললো,” বেশি কথা বলিস। হটাৎ দেশে ফিরে এলি কেনো?”

রিমি শুভ্রের ছোট চাচার বড় মেয়ে। আমেরিকায় এতো বছর থেকেছে বলে তার জামাকাপড় ও সেইরকম। হিয়া শুভ্র আর রিমির এমন জড়িয়ে ধরার দৃশ্য দেখে বড় রকমের একটা শক খেলো। রিমির এমন পোশাক দেখেও হিয়ার মাথা ঘুরছে। সিভলেস কোমড় পর্যন্ত একটা টপ আর নিচে জিন্স প্যান্ট সঙ্গে হাই হিল। কে এই মেয়ে? শুভ্রকে জড়িয়ে ধরেছে কেনো। কিভাবে কাছে কাছে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে দেখো। হিয়ার বুকের ভিতরে ধক করে উঠলো।

হিয়া কিছু না ভেবে এগিয়ে এসে শুভ্রের পাশে দাঁড়ালো। রিমি আর শুভ্র দুজনেই হটাৎ হিয়ার এমন আগমনের জন্যে প্রস্তুত ছিলো না। হিয়াকে দেখে রিমি হেসে তাকালো। হিয়া এসেই শুভ্রের পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো। শুভ্র সেটা খেয়াল করলো। রিমি হেসে প্রশ্ন করলো,” হাই, তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না।”

শুভ্র কিছু বলার আগেই হিয়া অনিচ্ছাকৃত হাসি মাখা মুখ নিয়ে বললো,” আমি ওনার ওয়াইফ।” বলেই একটা ঢোক গিললো। রিমি কথাটা শুনে যতটা অবাক হয়েছে শুভ্র তার থেকে বেশি অবাক হয়েছে। শুভ্র ভ্রু কুঁচকে হিয়ার দিকে তাকালো। বাহ্ ভালোই বুদ্ধি হয়েছে এই পিচ্চির।

রিমি বেশ অবাক হয়ে বললো,” বাহ্ কনগ্রাচুলেশনস।” বলেই আবার শুভ্রকে জড়িয়ে ধরতেই হিয়ার শাড়ির আচল শক্ত করে ধরলো। রাগে পুরো গা জ্বলছে। কথায় কথায় খালি জড়িয়ে ধরে। শুভ্রের থেকে সরে এবার হিয়াকে জড়িয়ে ধরে বললো,” আমি তো জানতামই না। ইস বড় কিছু মিস করে ফেললাম।”

হিয়া অনেক কষ্ট নিজেকে আটকে রেখেছে। ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে এক ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়। শুভ্র হিয়ার চোখ মুখ দেখে অনেকটা আন্দাজ করে, মনে মনে হাসলো। রিমির ডাক পড়তেই রিমি পড়ে কথা হবে বলে চলে গেলো, হিয়ার মুখটা কালো হয়ে গেলো।

শুভ্র রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে হিয়ার রাগে ফুলে ওঠা মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো। হিয়া শুভ্রের দিকে মুখ ফুলিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। আজ পর্যন্ত সে কোনোদিন শুভ্রকে জড়িয়ে ধরলো না, এর এই মেয়ে একবারে তার সামনে দুই দুবার জড়িয়ে ধরলো। হিয়ার রীতিমত কাদতে ইচ্ছে করছে। কেনো জড়িয়ে ধরবে শুভ্রকে এই মেয়ে?

শুভ্র একটা ভ্রু তুলে বললো,” কি হয়েছে কাদঁছো কেনো?”

শুভ্রের এমন রসিকতা শুনে হিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” ভালো; ভালো, চালিয়ে যান।”

শুভ্র নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসি থামিয়ে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই হিয়া রেগে চলে যেতে নিলো। শুভ্র হিয়ার হাতটা ধরে নিজের কাছে আনতেই। হিয়া রেগে উঠে বললো,” ছাড়ুন, আমার হাত।”

” এতো রাগ করছো কেনো? আমার কথা আছে তোমার সাথে।”,বলেই শীতল দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকালো।

হিয়ার রাগে কিরমির করেছে তাও একটু শান্ত হয়ে বললো,” কি কথা?”

শুভ্র হিয়ার হাতটা ছেড়ে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বললো,” এটা একটু নিয়ে যাও।”

হিয়া রাগে বিস্ফোরিত হয়ে তাকালো। ইচ্ছে তো করছে কাপটা শুভ্রের মাথায় ভাঙ্গে। কি খারাপ…! মজা করছে তার সাথে। হিয়া কঠিন গলায় বলল,” পারবো না। কাপ মাথায় রেখে বসে থাকুন আপনি।” বলেই হনহনিয়ে হেঁটে চলে গেলো হিয়া। শুভ্র হিংসুটে হিয়ার রাগান্বিত চেহারা দেখে হেসে ফেললো।

[ #চলবে ]
[ #চলবে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here