নীলচে তারার আলো পর্ব -২৯+৩০

#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_২৯

” চল চলে যাই। দেখে ফেললে তো আমরা শেষ।”, ভয়ার্ত কন্ঠে বললো হিয়া।

দিবা আড় চোখে তাকালো। তারপর বললো,” কিসের এতো ভয়? আমি আছি না। আর দেখলে কি হয়েছে? আমরা কি এইখানে আসতে পারি না?”, বলেই হিয়াকে নিয়ে সামনের দিকে গেলো। ইমনকে খুজতে হবে। আরেকটু সামনে যেতেই সামনে পড়লো আবির ভাইয়া। দিবার বাবার বন্ধুর ছেলে, ছেলে ভালো কিন্তু অনেকদিন তাদের সাথে যোগাযোগ নেই। এতদিন পর দেখা তাও দিবা ভ্রু কুঁচকে ফেললো। দুনিয়ার সব যন্ত্রণার আজই এইখানে আসার প্রয়োজন হলো।

আবির দিবাকে দেখেই সামনে এসে দাড়ালো। হেসে উঠে বললো,” কি ব্যাপার তুমি এইখানে ?” বলেই ঘাড় কাত করে হিয়ার দিকে তাকালো। তারপর আরো বললো,” আচ্ছা ফ্রেন্ডকে সঙ্গে নিয়ে সোজা কলেজ থেকে ঘুরতে চলে এসেছো?”

দিবার চোখ তো ইভানের দিকে কিন্তু আবির ভাইয়ার বক বক কে শুনবে। দিবা সৌজন্যমুলক হাসলো তারপর বললো,” ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করার ছিলো।” এতটুকু বলেই দেখলো ইভান তার ফ্রেন্ডের সাথে সেকেন্ড ফ্লোরে উঠে যাচ্ছে।

দিবা ব্যাস্ত হয়ে বললো,” ভাইয়া আপনি আমার ফ্রেন্ড হিয়ার সাথে কথা বলুন আমি এক্ষুনি আসছি।” বলেই করুন দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকালো। হিয়া বুঝতে পারলো দিবার জন্য তাকে এই লোকটার সাথে বক বক করতে হবে। হিয়া একবার চোখের পলক ফেলে আশ্বাস দিতেই দিবা কেটে পড়লো। হিয়ার চিন্তা শুধু বদমাইশ ডাক্টারটাকে নিয়ে। যদিও এইখান থেকে শুভ্রকে দেখা যাচ্ছে না।

দিবা চলে যেতেই আবির জিজ্ঞেস করলো,” কোথায় গেলো ও?”

হিয়া একটু কেশে বললো,” আমাদের একটা ফ্রেন্ড আশার কথা ছিলো। ওকেই হয়তো দেখতে পেয়ে ডাকতে গেছে।”

” আচ্ছা! তোমার নাম কি?”, প্রশ্ন করলো আবির। কতক্ষন এই লোকটার সাথে কথা বলতে হবে কে জানে? দিবারে জলদি আয়।

শুভ্র ভ্রু কুচকে ক্রিসমাস ট্রির অপরপাশে কলেজ ড্রেসে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে লক্ষ্য করছে। মেয়েটার বরাবর একটা ছেলে দাড়িয়ে আছে যার কারণে চেহারা স্পষ্ট নয়। কিন্তু শুভ্রের কেনো জানি মনে হচ্ছে মেয়েটা হিয়া। অন্তিক আর রুবাইদা কথা বলছিলো। শুভ্রের অন্যমনস্কতা খেয়াল করতেই আন্তিক বললো,” কি ব্যাপার কোন দিকে তাকিয়ে আছিস?”

” নাহ্, তেমন কিছু না। আমি একটু আসি।”, বলে উঠে দাড়ালো শুভ্র। এর মাঝেই রুবাইদা বললো,” আচ্ছা যাচ্ছিস যখন দেখিস কলেজ ড্রেসে দুটো মেয়ে এখন আছে কিনা?”

শুভ্র ভ্রু কুঁচকে বললো,”কেনো?”

” মনে হলো প্রভার বোনকে দেখলাম। প্রভা কোথায় সেটা ওর বোনকে জিজ্ঞেস করতাম। এমনিতেও মহারানী আমাদের কল ধরছে না। “, এতটুকু শুনেই শুভ্রর বুঝতে বাকি রইলো না যে তার ধারণাই ঠিক।

সকালে কলেজে আসার সময় মোহনা আর হিয়ার কথাবার্তার অংশবিশেষ শুনেছে শুভ্র। শুভ্র তখন পাশেই ছিলো।

মোহন হিয়াকে জ্বালাতে বলেছিলো,” তোমার বর না তোমার একদম খেয়াল রাখে না। একটু কলেজেও দিয়ে আসে না।”

উত্তরের হিয়া মুখ কালো করে বলেছিলো,” উনাকে আমি বর আমি মানি না। সারাদিন তুমি বর বর করো কেনো?” কথাটা শুভ্র স্পষ্ট শুনেছে। হিয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই হিয়া মুখ ঘুরিয়ে চলে গেছে।

মোহনা নিজে থেকেই বানিয়ে কিছু কথা শুভ্রের কানেও দিয়েছে। কিছু কথাগুলো এমন যে বউকে এভাবে ছেড়ে দিয়েছো যদি উড়ে কোথাও চলে যায়। এমনিতেও হিয়া তোর মাঝে জামাই জামাই ভাবটা খুঁজে পায় না। জামাইরা তো বউকে আগলে রাখে, যত্ন নেয় অ্যান্ড মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট এতটা ভালোবাসে। তোর মধ্যে সব আছে কিন্তু শেষেরটা নেই।

এই বানিয়ে বলা কথা গুলোর মধ্যে শুধু একটা কথা বলেছে হিয়া সেটাও মোহনাকে চুপ করাতে। সেগুলো যে সুধে আসলে শুভ্রের কানে তোলা হবে কে জানতো। কথাগুলো শুভ্র দিদির বানানো বলে ধারণা করলেও হিয়ার মুখ থেকেই সে একবার শুনেছে এমন কথা। তাই একটু হলেও খটকা আছে। অবশ্য সবই তার দিদির সঙ্গদোষে হয়েছে বলেও ধারণা ছিল তার।

হিয়া আবিরের সাথে কথা বলছিলো। হটাৎ মনে হলো শুভ্র তার দিকে আসছে। কিছুটা আন্দাজ করে হিয়া একদম ক্রিসমাস ট্রির সাথে ঘেঁষে দাড়িয়ে পড়লো। আবির হিয়ার হাত ধরে সরিয়ে আনলো আরেকটু হলেই ইলেকট্রিক তারের সাথে জড়িয়ে যেতো। হিয়াকে সরিয়ে আনতেই শুভ্র স্পষ্ট হিয়াকে দেখতে পেলো। শুভ্রের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি গেলো আবিরের দিকে। কে এই ছেলে? আবার হাত ধরেছে হিয়ার।

হিয়ার চুলেও গাছের ময়লা লেগেছিল। আবির সেগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে বললো,” আরেকটু হলেই তো সর্বনাশ হয়ে যেতো। আমার ছোট বোনটাও তোমার মতন। কোনদিকে তাকায় না। দিবা কোথায় গেলো বলো তো? আসার নাম নেই।”

” এসে পড়বে। আপনার কোনো জরুরি দরকার ছিলো?”, একটা ঢোক গিলে বললো হিয়া।

” হ্যা “,বাকিটা বলার আগেই শুভ্র এসে হিয়ার হাত ধরে এক টান দিয়ে হিয়াকে পিছনে এনে ছেলেটার সামনে দাড়াতেই দুজনেই চমকে গেলো। হিয়ার বুকের ভিতরটা ধুক ধুক করছে। আবির ভীষণ অবাক হয়ে তাকালো। কিছু বলার আগেই হিয়ার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলো,” কে এই ছেলে? কলেজ শেষে এইখানে কি করছো তুমি?”

আবির ঘটনাটা আন্দাজ করে বললো,” আই থিঙ্ক কোনো মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হচ্ছে।”

সঙ্গে সঙ্গে শুভ্র বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললো,” ডিড আই আস্ক ইউ? জাস্ট কিপ ইউর মাউথ শাট।”

হিয়ার ভীষন ভয় লাগছে। মোহনার কথায় এই কয়েকদিন সে শুভ্রকে অকারনেই ইগনোর করেছে। তারপর আজেবাজে যা শিখিয়েছে সব বলেছে। এরপর এই লোকের সাথে দেখে আবার কি না কি ভেবেছে। ভয়ে আত্তা কাপছে হিয়ার।

আবির কিছু বলার আগেই শুভ্র হিয়ার হাত ধরে টেনে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নিয়ে এলো। সিড়ি দিয়ে নামতেই নিচে সবগুলো গাড়ি দেখতে পেলো হিয়া। জায়গাটা আবদ্ধ করা, হয়তো গাড়ি পার্কিং এর জন্যে এই জায়গা। শুভ্রের রাগ হিয়ার জানা আছে। শুধু শুধু তাকে আরো রাগিয়ে দিয়ে লাভ নেই। হিয়া শুভ্রকে থামাতে বললো,” আমার কথা একবার শুনুন।”, বলতে বলতে শুভ্র গাড়ির সামনে এসে দাড়ালো। তারপর একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে হিয়ার হাত ছেড়ে গাড়ির সাথে পিঠ ঠেকিয়ে কড়া চোখে হিয়ার দিকে তাকালো। পুরো ঘটনাটা শুভ্রের কাছে পরিষ্কার।

হিয়া শুভ্রের সেই দৃষ্টিতে জমে বরফ হয়ে গেছে। হিয়া আমতা আমতা করে বলল,” দেখুন উনি দিবার পরিচিত আমি ওনাকে চিনি না। আমি দিবার সাথে এসেছিলাম পরে দিবা ওর ফ্রেন্ডের কাছে গেলো………… তাই আমি ওনার সাথে কথা বলছিলাম।” শুভ্রের মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে সবটাই জানে। হিয়া বোকা হয়ে তাকালো। লোকটা কোনো কথাও বলছে না। কি করে বুঝবে শুভ্রের মনে কি চলছে। হিয়া আরেকটু এগিয়ে এসে ভয়ার্ত বললো,” আপনি কি রাগ করেছেন?”

শুভ্র উত্তরে কিছু বললো না। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে সে খুব রেগে আছে। শুভ্র হাত বাড়িয়ে এক হাতে হিয়ার কোমড় জড়িয়ে একদম নিজের কাছে নিয়ে এলো। হিয়ার হৃদ কম্পন বেড়ে গেলো। শুভ্র অন্য হাত হিয়ার গালে ডুবিয়ে দিয়েই শরীরে এক শীতল শিহরণ বয়ে গেলো তার। শুভ্র এগিয়ে এসে ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দিয়ে গভীর ভাবে কিস করলো। হিয়া শুভ্রের হটাৎ এমন কাণ্ডে হকচকিয়ে উঠে কাধের শার্টের অংশ শক্ত করে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললো। মুহূর্তেই দুজনের মধ্যকার সব দুরত্ব চলে গেলো।

অনেক্ষন পর শুভ্র সরে এলো কিন্তু কোমড় জড়িয়ে এখনো হিয়াকে নিজের কাছে রেখেছে। এমন একটা জায়গায় শুভ্র তাকে এইভাবে…… ভেবেই রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে হিয়ার সারা মুখে। আরেকটু হলেই দম আটকে মারা যেতো সে। অথচ শুভ্রের চোখে মুখ স্বাভাবিক। শুভ্র একদৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,” হুম্, নাও অ্যাম ফিলিং বেটার। কি বলছিলে এইবার বলো।”

হিয়া মাথা নিচু করে রইলো। নাও অ্যাম ফিলিং বেটার মানে কি? এমন একটা জায়গায় এইসব করে খুব ভালো লাগছে উনার। নিলজ্জ একটা লোক, তার মুখটা বন্ধ করে বলছে এইবার বলো।

হিয়াকে চুপ কর থাকতে দেখে শুভ্র বললো,” আমার সাথে এইসব ট্রিকস খেলার বুদ্ধি তো তোমার মাথায় নেই। এইসব তো দিদির কথায় করেছো তাই না?”

হিয়া কিছু বললো না তবে একটু সস্থি পেলো যে লোকটা তাকে বুঝেছে। শুভ্র পরক্ষণেই বললো,” ডোন্ট বি হ্যাপি। দিদি বললে কি হবে? কাজগুলো তো তুমি করেছো। আমাকে ইগনোর করেছো। আজ সকালেই তো বললে যে আমাকে তুমি বর মানো না। ওকে তাহলে আজ থেকে তুমি তোমার পথে আর আমি আমার। এমনিতেও এই কয়দিনে তুমি যা করেছো তার জন্যে এতো সহজে তো তোমাকে আমি ক্ষমা করছি না।” বলেই হিয়ার কোমড় থেকে হাত সরিয়ে, সরে দাঁড়ালো। ইগনোর কি জিনিস এইবার হিয়া বুঝবে।

কথাগুলো শুনে হিয়া চমকে তাকালো। ক্ষমা করছে না মানে? আবার বললো আজ থেকে আলাদা আলাদা পথে…. মানে? শুভ্রের এমন রাগের সাথে তো হিয়ার পরিচয় নেই। তাহলে কি তাকে এইবার শুভ্রের এই রাগ ভাঙাতে হবে?
#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_৩০

শুভ্র পরক্ষণেই বললো,” ডোন্ট বি হ্যাপি। দিদি বললে কি হবে? কাজগুলো তো তুমি করেছো। আমাকে ইগনোর করেছো। আজ সকালেই তো বললে যে আমাকে তুমি বর মানো না। ওকে তাহলে আজ থেকে তুমি তোমার পথে আর আমি আমার। এমনিতেও এই কয়দিনে তুমি যা করেছো তার জন্যে এতো সহজে তো তোমাকে আমি ক্ষমা করছি না।” বলেই হিয়ার কোমড় থেকে হাত সরিয়ে, সরে দাঁড়ালো। ইগনোর কি জিনিস এইবার হিয়া বুঝবে।

কথাগুলো শুনে হিয়া চমকে তাকালো। ক্ষমা করছে না মানে? আবার বললো আজ থেকে আলাদা আলাদা পথে…. মানে? শুভ্রের এমন রাগের সাথে তো হিয়ার পরিচয় নেই। তাহলে কি তাকে এইবার শুভ্রের এই রাগ ভাঙাতে হবে? হিয়া কি বলবে কি করবে বুঝতে পারছে না। কোনোভাবে কি সে নিজেই ফেঁসে গেল? শুভ্রকে এই মুহুর্তে প্রস্ন করার সাহস তার নেই তাই সে নিশ্চুপে দাড়িয়ে রইলো।

শুভ্র গাড়ির একটা দরজা খুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকালো। কিন্তু হিয়া তো নিচের দিকেই তাকিয়ে আছে।

” গাড়ীতে বসো।”, শুভ্রের শীতল কণ্ঠে হিয়া সামনে তাকালো। কোনো কথা না বাড়িয়ে সে চুপচাপ গিয়ে বসে পড়লো। একটু আগে যা হয়েছে এরপর শুভ্রের সাথে কথা বাড়ানো তো দূরে থাক চোখের দিকে তাকালেও তার বুকটা ধুক ধুক করে উঠছে।

শুভ্র ঘুরে এসে ড্রাইভিং সীটে বসলো। শুভ্রকে সিটবেল্ট পড়তে দেখে হিয়া নিজে নিজেই সিটবেল্ট পরে নিলো। যতটা ভদ্র থাকা যায় তার চেষ্টা করে যাচ্ছে হিয়া। শুভ্র গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার কিছুক্ষণ পর দিবার কথা মনে পড়লো হিয়ার। একা একা তাকে এই জায়গায় ফেলে চলে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? যদি কিছু হয়? হিয়া আড় চোখে একবার শুভ্রের দিকে তাকালো শুভ্রের চোখ মুখ গম্ভীর। হিয়া নিচু গলায় বললো,” গাড়িটা একটু থামাবেন?” শুভ্র হিয়ার দিকে তাকালো পর্যন্ত না। শুভ্রের দৃষ্টি সামনে স্থির।

হিয়া দ্বিতীয় বারের মতন বললো,” এইযে শুনছেন? গাড়িটা থামান একটু।” কিন্তু শুভ্র কোনো কথাই কানে নিচ্ছে না। হিয়া বিরক্ত হয়ে ফোনটা বের করে নিজেই দিবাকে কল দিলো। দিবা ঠিক আছে, আবির ভাইয়া তার সাথেই আছে। আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলো ইভানের ব্যাপারে কিন্তু হিয়া থামিয়ে দিয়ে বললো,” আচ্ছা, পরে শুনবো। রাখি।” বলেই ফোনটা রেখে দিলো হিয়া। শুভ্রের এমন ব্যাবহারে রাগ লাগছে তার। লোকটা কেমন জানি গোলক ধাঁধার মতন। কখন কি করে বসে কিছুই বুঝা যায় না।

সাড়া রাস্তা দুজনে একটি কথাও বললো না। হিয়া বলতে চেয়েছিল কিন্তু শুভ্রের নিরবতায় সে নিজেও চুপ ছিলো। বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়ায় সবার চিন্তা করার কথা হিয়াকে শুভ্রের সাথে ফিরতে দেখে কেউ কোনো প্রশ্ন করলো না।

দুপুরে মোহনা নিজের ফ্ল্যাটে চলে গেছে। তাই বাড়িতেও ভাল্লাগছে না হিয়ার। তারপর এই হনুমানটা কেমন এড়িয়ে এড়িয়ে যাচ্ছে। হিয়ার অসহ্য লাগছে রীতিমত। অনেক্ষন ভাবলো কি করে কিভাবে শুভ্রের সাথে কথা বলবে কিন্তু কোনো লাভ নেই। এইসব তার দ্বারা হবে না। হনুমানের রাগ করতে ইচ্ছে করেছে রাগ করে বসে থাকুক। কে রাগ ভাঙাতে যাবে তার? হিয়া ইউভিকে কোলে তুলে নিলো। ওকে আজ ভালো করে গোসল করিয়ে একদম ঝকঝকে সাদা করে ফেলতে হবে।

রাতে সাহারা খাতুন ছেলের ঘরে এলেন। শুভ্রের ঘরে তিনি কমই আসেন। মাকে দেখে শুভ্র টেবিল ছেড়ে এগিয়ে এসে তার মায়ের পাশে বসতেই সাহারা খাতুন ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” তোমার দাদীর অবস্থা বেশি ভালো না। কালকে আমি আর তোমার বাবা যাবো ওনাকে দেখে আসতে। জানি তুমি অনেক ব্যাস্ত কিন্তু যদি অবস্থা খারাপ হয় তাহলে তো যেতে হবে তাই না?”

শুভ্র বুঝতে পারছে তার মা কি বলছে। আগের বার সে যায়নি এবার তো তাকে যেতেই হতে হবে। শুভ্র হা সূচক মাথা নেড়ে বললো,” আচ্ছা যাবো। চিন্তা করো না তুমি।”

” চিন্তা না করে থাকি কিভাবে?”,বলেই একটা নিঃশ্বাস ফেললেন সাহারা খাতুন।

” কিসের এতো চিন্তা তোমার?”, ভ্রু কুঁচকে বললো শুভ্র।

” তোমরা আমাকে চিন্তামুক্ত থাকতে দিচ্ছো? এইভাবে আর কতদিন? বিয়ে তো হয়েছে, মেনেও নিয়েছ তাও এতো দুরত্ব কিসের? মেয়েটাকে নিজের ঘরে নিয়ে এলেই পারো। এই কাজটা তো তোমাকেই করতে হবে।”,বলেই ছেলের দিকে তাকাতেই দেখলো শুভ্র হাসছে তার মায়ের কথায়।

শুভ্র হাসি থামিয়ে বললো,” তোমার এতো চিন্তা করতে হবে না। তুমি যা চাইছো তা হয়ে যাবে। যাও গিয়ে রেস্ট নাও।” শুভ্র হিয়াকে আনবে না। হিয়া নিজে থেকেই আসবে। বাঁদরটাকে তুলে আনলে তো তাকে অতিষ্ট করে ছাড়বে।

” হলেই ভালো।”,বলেই সাহারা খাতুন বেড়িয়ে গেলেন।

শুভ্র নিজের বিছানায় গা হেলিয়ে দিতেই দেখলো। ইউভি লেজ নাড়তে নাড়তে তার ঘরে ঢুকছে। শুভ্র হাতের ঈশারায় ইউভিকে ডাকতেই সে ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে আসলো। শুভ্র হাত বাড়িয়ে ইউভিকে কোলে তুলে নিলো। ইউভি চোখ পিট পিট করে শুভ্রের দিকে তাকালো। হটাৎ শুভ্রের তার প্রতি এমন কোমল আচরণ সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। শুভ্র ইউভিকে কোলে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,” আই সি নো ডিফরেনসেন্স।”

ইউভির চোখ মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে তার শুভ্রের কথা ভালো লাগে নি। হিয়া ইউভিকে খুঁজতে খুঁজতে শুভ্রের রুমে তাকালো। হাল্কা মাথাটা কাত করে তাকাতেই দেখলো ইউভি শুভ্রের কোলে।

হিয়ার চোখ কপালে উঠে গেলো। ইউভিকে কি লোকটা ফেলে দিবে নাকি? শুভ্রের দরজার দিকে তাকাতেই দেখলো হিয়া মাথা বের করে তাকিয়ে আছে। শুভ্র ইউভিকে বিছানায় রেখে এগিয়ে আসতেই হিয়া সোজা হয়ে দাড়ালো। কি বলবে মনে মনে গুছিয়ে নিতেই শুভ্র দরজার সামনে এসে ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দিলো।

হিয়া হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। কি বদমাইস লোক ! মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো। তারমানে কি ইউভিকে দিবে না? হিয়া দরজায় নক করলো কয়েকবার। শুভ্র ওপাশ থেকে কোনো জবাব দেয় নি। কি আশ্চর্য ব্যাপার!

ইউভি মুখে শব্দ করে দরজার সামনে এসে দাড়িয়ে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে আছে ক্ষোভ নিয়ে। শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। সবগুলোকে নিজের মতন বানিয়ে ফেলে এই মেয়ে।

হিয়া আরো কয়েকবার নক করতেই শুভ্র আস্তে করে দরজা খুলে ইউভিকে বের করে দিলো। হিয়াকে দেখে সে ছুটে এলো। হিয়া ইউভিকে কোলে তুলে শুভ্রকে কিছু কঠিন কথা বলার আগেই শুভ্র দরজা লাগিয়ে দিলো। রাগে হিয়ার গা জ্বালা করছে। জীবনেও এই লোকটার সাথে কথা বলবে না সে।
মনে মনে সে এতোগুলো কথা শুনলো শুভ্রকে।

🌟 কলেজ থেকে ফিরে, পুরো বাড়ি এমন ফাঁকা দেখে বেশ ভয় পেলো হিয়া। সবাই কোথায় গেছে? কিছুক্ষণ পর মনে পড়লো যে সবাই তো শুভ্রের দাদুর বাড়িতে গেছে। কালকেই তো শাশুড়িটা বললো সব। তারই মাথায় ছিলো না। কিন্তু এতো বড় বাড়িতে সে একা একা কি করে থাকবে? রহিমা খালাকেও তো সঙ্গে নিয়ে গেছে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে অথচ শুভ্র ফিরেনি। ইউভি আর সে একা এই বাড়িতে।

হিয়ার হটাৎ হটাৎ কেনো জানি মনে হচ্ছে কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে। একা থাকলে তার এমন সব চিন্তা মাথায় আসে। তারওপর ইউভি কিছুক্ষণ পর পর আওয়াজ করছে এতে আরো ভয় লাগছে। ইউভি কি অশরীরী কিছু দেখতে পাচ্ছে? ভেবেই শিউরে উঠলো সে। হিয়া সারা বাড়িতে আলো জ্বেলে বসে আছে ভয়ে। গলা শুকিয়ে গেছে কিন্তু রান্না ঘরেও যেতে ভয় লাগছে।

হিয়া ভয়ে ভয়ে উঠে এলো ইউভিকে সোফায় বসিয়ে। জগ থেকে পানি ঢেলে গ্লাসটা হাতে নিয়ে সব চুমুক দিয়েছে ইউভি আবারো শব্দ করতেই হার্ট বিট দ্বিগুণ হয়ে গেলো তার। কার যেনো পায়ের আওয়াজ কানে ভেসে এলো তার। হিয়া ভয়ে জড়সড় হয়ে পিছনে ফিরে হটাৎ শুভ্রকে দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠে দু পা পিছিয়ে গেলো।

হিয়ার এমন শব্দে শুভ্র রান্না ঘরের দিকে ব্যাস্ত হয়ে তাকিয়ে দেখলো হিয়া বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে। শুভ্রকে দেখে হিয়া বুকে হাত দিয়ে প্রশান্তির নিশ্বাস ফেললো। শুভ্র বুঝতে পারছে না কি বলবে? এইভাবে কি কোনো মানুষ চিৎকার করে? শুভ্র বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,” আনবেলিভএবেল ” বলেই নিজের ঘরে চলে গেল।

হিয়া বড় রকমের একটা শক খেয়ে এখন বুকে হাত দিয়ে সোফায় বসে আছে। কিছুক্ষণ পর উঠে গিয়ে খাবার গরম করলো। সব কিছু ফ্রিজেই ছিলো তাই ওভেনে গরম করেছে সে। কিন্তু শুভ্র কি এখন খাবে? যা ইচ্ছে করুক। সে যে এতো জোরে চিৎকার করেছে তখন একটিবার জানতে চেয়েছে কি হয়েছে? বনমানুষ কোথাগার..! ইগনোর করে যাচ্ছে রীতিমত তাকে।

হিয়া নিজের খাবার প্লেট নিয়ে টিভির সামনে বসলো। ইউভিও নিজের খাবার খাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর শুভ্র পকেটে এক হাত ভরে নিচে নামলো। টিভির দিকে তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে ফেললো সে। টম অ্যান্ড জেরি চলছে। এই বয়সে টম অ্যান্ড জেরি দেখছে, অবিশ্বাস্য..!

হিয়া ভয় দূর করতেই এই চ্যানেল অন করেছে। হটাৎ রান্না ঘরে বাসনের আওয়াজ পেয়ে হিয়া হুট করে তাকালো। আবারো শুভ্রকে দেখলো। লোকটা আস্তে ধীরে কাজ করতে পারে না? খালি ভুতুড়ে আওয়াজ করে বেড়ায়।

চ্যানেলে অ্যাড আসতেই হিয়া চ্যানেল পাল্টে ফেললো। চ্যানেল বদলাতে বদলাতে হটাৎ হরর মুভি ” ইট ” এর ক্লাউনের চেহারা ভেসে উঠলো একটা চ্যানেলে। হিয়া ভয় পেয়ে চোখ মুখে হাত দিয়ে ফেললো। তারপর আস্তে করে টিভিটা অফ করে দিলো। ভয়ে আত্তা কাপছে তার। তার সাথেই কেনো এইসব হয়? হিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে শুভ্রের দিকে তাকালো। শুভ্র নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দিচ্ছে। হিয়া হাত পরিষ্কার করে আস্তে করে এসে শুভ্রের পাশের চেয়ারে বসতেই শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালো। শুভ্র আরো অবাক হলো যখন দেখলো হিয়ার মুখে অনিচ্ছাকৃত হাসি। চাইছে টা কি মেয়েটা? শুভ্র আবার নিজের খাওয়ায় মন দিলো।

শুভ্রর প্লেট ধোওয়ার সময়েও হিয়ার তার পাশে দাড়িয়ে রইলো। পানি খাওয়ার সময়েও তার পাশেই ছিলো। এতোক্ষণে হিয়ার অদ্ভূত ব্যাবহারের কারণ শুভ্র ধরতে পেরেছে।
শুভ্র সিড়ি বেয়ে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে,হিয়া তার ঠিক পিছন পিছন আসছে। শুভ্রের ধারণা ছিলো হিয়া নিজের ঘর পর্যন্ত তার পিছন পিছন আসবে কিন্তু তার ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে থাকবে এইটা শুভ্র ভাবেনি। শুভ্র যথাসাধ্য হিয়াকে ইগনোর করার চেষ্টা করছে।

হিয়া ভয়ের চোটে শুভ্রের ঘরে এসেছে, নিজে নিজে কোনো মনের আনন্দে সে আসেনি। এই লোকটা তো অশরীরী আত্তার মতন আছে। কোনো কথা বলছে না।একা একা আজ সে নিজের ঘরে কিছুতেই থাকবে না। দরকার পড়লে শুভ্রের দরজায় বসে থাকবে। হিয়া যে বিছানায় বসেছে শুভ্রকে জ্বালাতে এমন করছে। বিরক্ত হয়ে নিশ্চয়ই লোকটা কথা বলবে নিজে থেকে সে কথা বলতে চাইছে না।

হিয়া প্রায় আধঘন্টা হলো শুভ্রের বিছানায় বসে আছে। শুভ্র টেবিলে বসে নিজের কাজ করছে। তারপর চশমাটা খুলে রেখে উঠে দাড়ালো। বিছানায় তাকাতেই হিয়াকে দেখলো। হিয়া ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। ইউভি মেঝেতে বসেই ঝিমুচ্ছে। শুভ্র এগিয়ে এসে লাইটা অফ করতেই হিয়া তড়িঘড়ি করে করে নড়েচড়ে চিৎকার করে উঠে বললো,” লাইট জ্বালান, বন্ধ করেছেন কেনো?” হিয়ার চিৎকারে ইউভি গা ঝাড়া দিয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ল। শুভ্র ভাবতেও পারেনি হিয়া এতো জোরে চিৎকার করবে!

শুভ্র লাইট অন করে জিজ্ঞেস করলো,” আমার ঘরে কি চাও?”

হিয়া আমতা আমতা করে বলল,” আমি এই ঘরে থাকবো।” বলেই মাথা নুইয়ে ফেললো।

শুভ্র এগিয়ে এসে বলল,” তুমি আমার ঘরে থাকলে, আমি কি করবো?”

” আপনিও থাকুন। আমি কি আপনাকে না করেছি। আমার ভয় লাগছে আমি একা একা থাকতে পারবো না।”,এক নিঃশ্বাসে বললো হিয়া।

” তার মানে কি তুমি আমার সাথে আমার ঘরে থাকতে চাইছো?”,একটা ভ্রু তুলে কথাটা বলতে বলতে এগিয়ে আসতেই হিয়া জড়সড় হয়ে বসলো। আজ ভূতের ভয়ে সিংহের গুহায়হানা দেওয়াটা কি ঠিক হয়েছে তার?

[#চলবে]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here