নীলচে তারার আলো পর্ব -২৭+২৮

#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_২৭

হিয়া কুকুর ছানার নাম দিয়েছে ইউভি। ম্যারির জন্যে এখনো খারাপ লাগছে তার। ম্যারিকে চাইলেও ভুলতে পারবে না সে। ইউভি এতটাই ছোটো তাকে একটা পকেটে ভরে রাখা যাবে। এই পামেরিয়ান কুকুরগুলো এমন হয়। হিয়ার ভাবতেই অবাক লাগছে এইটা শুভ্র তার জন্যে এনেছে। তারমানে রাতে শুভ্র তার রুমে এসেছে আর পায়ে নূপুরটাও পরিয়ে দিয়েছে। ভাবতেই এক রাশ ভালোলাগা তাকে ঘিরে ধরেছে। এই গোমড়ামুখো ডাক্তারটা মাঝে মাঝে এমন সব কাজ করে যে হিয়া পারে না প্রেমেই পরে যায়। হিয়া এইবার বুঝতে পেরেছে শুভ্র তার জন্যে কতটা ভাবে।

শুভ্রের তার প্রতি ছোটো ছোট এই খেয়াল গুলো বড্ড ভালোবাসে হিয়া। লোকটা সবসময় এমন থাকতে পারে না। খালি সবসময় প্রিন্সিপাল সেজে বসে থাকা। শুভ্রকে খুব জ্বালাতে ইচ্ছে করছে। হিয়া ইউভিকে কোলে তুলে নিলো। তারপর শুভ্রের ঘরের সামনে এলো। দরজাটা হাল্কা ঠেলে দিতেই দেখলো শুভ্র তোয়ালে দিয়ে মাথার পানি নিচ্ছে। গায়ে শুধু একটা ট্রাউজার। হিয়া সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে দেওয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাড়ালো। উফ লোকটা এমন অর্ধনগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়ায় কেনো? তাও ভালো প্রথমবারের মতন তোয়ালে পড়ে নেই। এমনেই এমন সুন্দর তার উপর বডি দেখিয়ে বেড়ায়। দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকে গেলো ভালো হয়।

কি হবে? বলেছে না হাসব্যান্ড মনে রাখতে। হাসব্যান্ড এর ঘরে তো আর নক করে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।

হিয়া বেশ সাহস দেখিয়ে শুভ্রের ঘরে ঢুকলো। শুভ্র সবে সাদা একটা শার্ট গায়ে পড়েছে, বোতাম সব খোলা। হটাৎ সকাল সকাল হিয়ার এমন আগমনের কারণ সে খুঁজে পাচ্ছে না। হিয়া ঘরে ঢুকেই প্রথমে বললো,” শার্টের বোতাম সব খুলে রেখেছেন কেনো?”

শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,” কি চাই তোমার?”

” আমার আপনার সাথে কথা আছে।”, আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে বললো হিয়া।

শুভ্র বিস্ময় নিয়ে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। সকাল সকাল তার ঘরে হানা দিয়ে কি করতে চাইছে হিয়া। শুভ্র কোমরে হাত দিয়ে বললো,” যা বলার জলদি শেষ করো।”

হিয়া আবারো আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকালো। ঠিক মতন তাকানো যাচ্ছে না বার বার খোলা শার্টের দিকে চোখ যাচ্ছে। এইভাবে সে কথা গুলো বলবে কিভাবে ? কিছুক্ষণ যেতেই শুভ্র শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললো,” তোমাকে কি আমি সাড়া দিন সময় দিয়েছি? এইভাবে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”

হিয়া শুভ্রের দিকে তাকিয়ে সস্থির নিশ্বাস ফেললো। তারপর পা টিপে টিপে এগিয়ে এসে বললো,” আপনি কাল রাতে আমার ঘরে গেছিলেন কেনো?”

শুভ্র ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো হিয়ার দিকে। এই বাঁদরটা টের পেলো কি করে? শুভ্র সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” তোমার ঘরে গিয়েছিলাম মানে?”

” আপনি আমার ঘরে গিয়েছেন। আর আমি সিউর এই কুকুর ছানাও আপনি রেখেছেন আমার ঘরে।”, বলেই ইউভিকে বের করলো। শুভ্র ভ্রু কুঁচকে ইউভির দিকে তাকালো তারপর এদিক সেদিক তাকিয়ে বললো,” মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে তোমার?”

” নাহ্ আমার মাথা মোটেও খারাপ হয়নি। আচ্ছা আপনি বলুন। আমার পায়ে আপনি নূপুর পড়াননি? নূপুরটা তো আপনার হাতেই দেখেছিলাম আমি।”, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো হিয়া।

শুভ্র ভেবে পাচ্ছে না হটাৎ হিয়ার এতো সাহস এলো কোথা থেকে। আগে তো কথা বলতে গেলেই কাপতে লাগলো। শুভ্র প্রসঙ্গ ঘুরাতে বললো,” তুমি মেবি ভুলে গেছো আমি কে?”

হিয়া পায়ের পাতায় ভর দিয়ে একটু উচু হয়ে শুভ্রের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,” নাহ্ ভুলিনি। শুভ্রনীল আহমেদ, আমার বর। আমার এই উপহার অনেক পছন্দ হয়েছে। আমি ওর একটা নামও দিয়েছি ইউভি। সুন্দর না নামটা।”,বলেই লজ্জা পেয়ে হাসলো।

কথাটা শুনে শুভ্রের ঠোঁটের কোণেও হাসি চলে এলো তবে শুভ্র সেটা প্রকাশ না করে বললো,” তোমার সব ভয় উড়ে গেছে, তাই না?”

হিয়া আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে নিজের হাসি কন্ট্রোল করলো। হিয়া প্রশ্নটা না শুনার ভান করেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বদমাইস ডাক্তার একটা। শুভ্র ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। বাঁদরটা অনেক চালাক।

✨ ইউভি সারা বাড়ি তার ছোট ছোট পা ফেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবাই ভীষন অবাক। এই কুকুরছানা এলো কোথা থেকে। শুভ্র চুপচাপ ডায়নিং টেবিলে বসে জুস হাতে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। ইউভি শুভ্রের পায়ের কাছে বসে এক দৃষ্টিতে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্র সেটা খেয়াল করলো, এটাও দেখি এক দিনে মালিকের মতন হয়ে গেছে।

হিয়া নিচে নামতেই ইউভি হিয়ার কাছে চলে গেলো। হিয়া রান্না ঘরে আসতেই, ইউভি লেজ নাড়তে নাড়তে তার পিছু পিছু এলো। সাহারা খাতুন ভ্রু কুঁচকে ইউভির দিকে তাকিয়ে আছে। এইটা আবার কোথা থেকে এলো?

সাহারা খাতুন হিয়াকে প্রশ্ন করেই ফেললেন,” এইটা পেলে কোথায়?”

হিয়া একবার চোখ পিট পিট করে তাকালো। শাশুড়ির কি পছন্দ হয়নি। না হলেও ভয় নেই, ইউভিকে তো তার ছেলেই এনেছে। বকা এই লোকটাই খাবে। হিয়া একটা ঢোক গিলে শুভ্রের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো,” উনি।” এতটুকু বলেই হিয়া থামলো। সাহারা খাতুন অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন।

শুভ্র সেই মুহুর্তে কিচেনে তাকাতেই দেখলো হিয়া তার দিকে আঙুল করে দেখিয়ে দিচ্ছে। শুভ্রের বুঝতে বাকি রইলো না হিয়া তার দিকে আঙুল দেখিয়ে ঠিক কি বলতে চাইছে। রবিউল সাহেব পত্রিকা হাতে শুভ্রের বরাবর টেবিলে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর পর পত্রিকা সরিয়ে ইউভির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন।

হিয়া নাস্তা নিয়ে টেবিল পাশ কাটিয়ে চলে যেতেই রবীউল সাহেব হিয়াকে ডাকলেন। হিয়া থমকে দাড়িয়ে পিছনে ফিরলো। রবীউল সাহেব তার বউয়ের মতন একই প্রস্ন করলেন। উত্তরে হিয়া আবারো শুভ্রের দিকে আঙুল করতেই শুভ্র আড় চোখে তাকালো। সারা বাড়ি বলে বেড়াচ্ছে এই মেয়েটা। শুভ্র সরু চোখে তাকাতেই হিয়া ফিক করে হেসে ফেললো। বলেই উপরে চলে গেলো।

রবিউল সাহেব পত্রিকা সরিয়ে শুভ্রের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। বাহ্ ছেলে তো তার ভালোই লাইনে এসেছে। রবিউল সাহেবের এমন দৃষ্টিতে, শুভ্র বেশ অপ্রস্তুত হয়ে জুসটা রেখেই উঠে পড়লো। সে কি চুরি করেছে? এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো সবাই।

হিয়া সিড়িতে দাড়িয়ে সবটা দেখলো। আহ্ লোকটাকে জ্বালাতে কি যে মজা লাগছে। বেচারা কিছু বলতে পারছে না। শুভ্র নিজের মনের কথা না বললেও হিয়া ঠিকই বুঝে নিয়েছে। কিন্তু এই বদমেজাজি লোকটা কখনো কি মুখে বলবে না?

✨ শুভ্র প্রতিদিন এই সময়ে বাড়িতে আসে কিন্তু আজ এতো দেরি কেনো? হিয়া দোতলার করিডোরে পায়চারি করছে। সঙ্গে ইউভিও আছে, সে বেচারিও পায়চারি করছে হিয়ার সাথে সাথে। ইউভির উপর মায়া লাগলো হিয়ার। এমনিতেই ছোট্ট একটা বলের মতন তার উপর হিয়ার পিছু পিছু পায়চারি করছে। হিয়া হাঁটু ভাজ করে ইউভিকে কোলে তুলে নিলো। হাপিয়ে গেছে বেচারি।

হিয়া হাঁটতে হাঁটতে শুভ্রের রুমে এলো। কেনো জানি সে অকারনেই এখন শুভ্রের রুমে আসে। শুভ্রের রূমের একপাশে কিছু শোপিস আছে। দেখতে বড়ই অদ্ভূত। কাঁচের একটা পুতুলের দিকে হিয়ার নজর আটকে গেলো। সাদা এপ্রন পড়া একজন ডাক্তার, একটু কাছে এনেই দেখলো নিচে খুব সুন্দর করে ইংরেজি শব্দে লেখা ডাক্তার শুভ্রনীল আহমেদ। রহিমা খালা রুমে এলো সব শুভ্রের রূমের সব জানালা সন্ধার পর বন্ধ করার নিয়ম তাই। এসে হিয়ার হাতে পুতুলটা দেখে বললো,” এইটা কিন্তু দাদাবাবুর অনেক পছন্দের।” বলেই জানালা সব আটকে বেড়িয়ে গেলেন।

হিয়া খুব সাবধানে পুতুলটা আগের জায়গায় রাখতে গেলো। কিন্তু ইউভি হটাৎ কেমন ছটফট করে লাফিয়ে নেমে পড়তেই হিয়ার হাত থেকে পুতুলটা পরে গেলো।
মুহূর্তেই চুর্ন বিচূর্ণ হয়ে গেলো পুতুলটা। হিয়া থমকে দাড়িয়ে আছে। কি হলো এইটা! হৃদ স্পন্দন মুহূর্তেই দ্বিগুণ হয়ে গেলো। এটা তো শুভ্রের অনেক পছন্দের, কি হবে এইবার? শুভ্রের নেম প্লেটটা ছাড়া আর কিছুই নেই। হিয়ার নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে। চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো। শুভ্রের পছন্দের পুতুলটা সে ভেঙে ফেললো। হিয়া সামনে এগিয়ে এসে নেমপ্লেটটা হাতে নিতেই কাচের একটা টুকরা হিয়ার হাতে বিধলো। সেদিকে হিয়ার খেয়াল নেই। ইউভি ভয়ে এক পাশে চুপ করে বসে আছে।

শুভ্র ঘরে এসে দেখলো হিয়ার হাত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। শুভ্র সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এলো। এগিয়ে আসতেই দেখলো চারিপাশে কাচের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শুভ্র হিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে খাটে বসালো। শুভ্রকে দেখে হিয়া কেদেই ফেললো। সে কান্না আর থামছে না। শুভ্র হিয়ার হাত থেকে নেমপ্লেট টা নিয়ে ফেলে দিতেই দেখলো হাতে ভালোই ক্ষত হয়েছে। শুভ্র ভীষণ রেগে গিয়ে বললো,” আর ইউ আউট অফ ইউর মাইন্ড? কাচের টুকরো হাতে নিয়ে বসে আছো কেনো?”

শুভ্রের ধমকে হিয়া চুপ করে রইলো। চোখ দিয়ে শুধু পানি পড়ছে। শুভ্র নিজের এপ্রনটা একপাশে রেখে শার্টের হাতা ভাজ করে ড্রয়ার থেকে ফাস্ট এইড বক্সটা নিয়ে হিয়ার সামনে বসে হাতটা ভালো করে দেখলো। শুভ্রের মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। রুমটার দিকে তাকিয়ে রহিমা খালাকে ডেকে রুমটা পরিষ্কার করতে বললেন। রূমে হাঁটতে গেলেই এখন কাচের টুকরো বিধবে। হিয়া নিশ্চুপে কেঁদেই যাচ্ছে, শুভ্রের ধারণা হিয়া হয়তো ব্যথায় কাদঁছে। শুভ্র অনেকটা সময় নিয়ে হাতের ব্যান্ডেজটা করলো। ব্যান্ডেজ শেষ হতে হতে রুমটাও খালা পরিষ্কার করে ফেলেছে। শুভ্র ফাস্ট এইড বক্স রেখে এসে দেখলো হিয়া এখনো কাদছে।

শুভ্র চিন্তিত হয়ে হিয়ার পাশে এসে বসলো। হিয়ার দুই গাল স্পর্শ করে মুখটা উপরে তুলতেই দেখলো। হিয়া কেদে কেঁদে গঙ্গা যমুনা এক করেছে। শুভ্র খুব কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলো,” হাতে কি বেশি ব্যাথা করছে ?” হিয়া না সূচক মাথা নাড়তে। শুভ্র একটু ভ্রু কুচকে শান্ত গলায় বললো,” তাহলে তুমি কাদঁছো কেনো স্টুপিড?”

” আমি ওই পুতুলটা ভেঙে ফেলেছি।”, বলেই ফুপিয়ে উঠলো হিয়া।

পুতুলটা শুভ্রের পছন্দের ছিলো ঠিকই কিন্তু এতটা না যে তার মূল্য হিয়ার চোখের জলে ফেলতে হবে। শুভ্র একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললো।

” আমার হাত থেকে পড়েগেছে। সরি……”, আর বলার আগেই শুভ্র হিয়ার ঠোঁটের সামনে আঙ্গুল ধরে বললো,” একদম চুপ। আর কাদবে না তুমি।”
#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_২৮

” আমার হাত থেকে পড়েগেছে। সরি……”, আর বলার আগেই শুভ্র হিয়ার ঠোঁটের সামনে আঙ্গুল ধরে বললো,” একদম চুপ। আর কাদবে না তুমি।”

হিয়া বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো শুভ্রের দিকে। শুভ্র কি তার উপর রাগ করেনি? যে কিনা নিজের রুমে কারোর আসা পছন্দ করে না আর আজ তার প্রিয় জিনিস ভেঙে ফেলায় সে এতো স্বাভাবিক আছে কি করে? হিয়া কিছু বলতে যাচ্ছিল তখনই ঘরে মোহনা আসতেই হিয়া ফট করে শুভ্রের কাছ থেকে সরে এলো। শুভ্র হিয়ার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে নিতে বলল,” চোখের পানি মুছো।”

হিয়া চোখের পানি মুছতেই মোহনা হিয়ার পাশে এসে বসলো চিন্তিত স্বরে বললো,” ঠিক আছো?”

হিয়া হ্যা সূচক মাথা নাড়লো। শুভ্র উঠে পড়লো। যাক কান্না থামিয়েছে এই বাঁদরটা। তারপর শার্টের হাতা নীচে নামাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল।

মোহনা শুভ্রের দিয়ে ঈশারা করে কোনো শব্দ ছাড়া ঠোঁট নেড়ে জিজ্ঞেস করলো,” বেশী বকেছে?”
হিয়া মোহনার দিকে তাকিয়ে না সূচক মাথা নাড়লো। না উক্তটি শুনে সুমনা ভ্রু কুঁচকে ফেললো।

এ কোন শুভ্র! ভাবতেই অবাক লাগছে। এই পিচ্চি মেয়েটাকে এতো ভালোবাসে তার ভাই। মোহনা ঝেড়ে কাসলো তারপর বললো,” আচ্ছা চলো। তোমাকে রুমে দিয়ে আসি।” চলে যাওয়ার কথা শুনে শুভ্র আড় চোখে হিয়ার দিকে একবার তাকালো তারপর বললো,” পাকনামি করে হাতের ব্যান্ডেজ খোলার একদম চেষ্টা করবে না।” রীতিমত যেনো হুকুম দিচ্ছে এমনভাবে বললো শুভ্র।

মোহনা ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বললো,” আরে, আমি আছি তো। বউয়ের জন্যে এতো চিন্তা করতে হবে না।” মোহনার এমন রসিকতায় হিয়া লজ্জা পেয়ে গেলেও শুভ্র তা কানেই নিলো না। নিজের কাজে সে ব্যাস্ত।

মোহনা যেতে যেতে হিয়ার কানে কানে বললো,” ওর প্রিয় জিনিসটা ভেঙে ফেলেছ যে সরি বলেছো?”

হিয়া মাথা নিচু করে আবারো হা সূচক মাথা নাড়ল। মোহনা ফিসফিসিয়ে বলল,” শুধু সরি বললে কি হবে? একটু জরিয়ে ধরে বলতে পারলে না।”

হিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,” উনি তো আমাকে গায়ে পড়া ভাববেন।”

” ধুর, নিজের বউ একটু গায়ে পরা হলে বররা খুশিই হয়।”, বলেই মোহনা ঠোঁট চেপে হাসলো।

হিয়া নির্বুদ্ধির মতো তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন জানি গা শিউরে উঠছে কিন্তু শয়তান মন তো বলছে জড়িয়ে ধরা যায়। মোহনা হিয়াকে আরো অনেক কিছু বললো। সেসব শুনে হিয়ার মস্তিষ্ক যেনো উল্টা পাল্টা চলতে শুরু করলো। মোহনা দুষ্টু হাসি দিয়ে হিয়ার ঘর থেকে বের হলো। বের হয়ে শুভ্রের ঘরের সামনে এসে রহস্যময় হাসি দিতেই শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালো।

মোহনা একগাল হাসি দিয়ে বললো,” তুই তো দেখি একে বারে প্রেমের সাগরে তলিয়ে গেছিস।”

শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো। মোহনা আরো বললো,” এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো? হিয়াকে কি তোর রুমে শিফট করে দিবে?”

” দিদি তোর কাজ নেই?”, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো শুভ্র।

” ভালোর জন্য বলছি তো ভালো লাগছে না?”, ভ্রু কুঁচকে বললো মোহনা।

” প্লীজ আমার তোর জন্যে ভাবতে হবে না। আই ক্যান ডিল উইথ ম্যাই প্রবলেম। যত্তসব আজগুবি চিন্তা ভাবনা তোর।”,

মোহনা হেসে উঠে বললো,” হেহে, আর তুই কি করছিস? মনে আছে আমি একটা টিয়া পুষতাম। তোর তো সেইসব একদম পছন্দ ছিলো না। সেদিন তো তুই সুযোগ বুঝে পাখিটা ছেড়ে দিয়েছিস। আর এখন তো বাড়িতে কুকুরছানাও নিয়ে এসেছ।” বলেই ইউভির দিকে তাকালো।

ইউভি যে এতক্ষণ ধরে শুভ্রের ঘরে পায়চারি করছিলো শুভ্র সেটা ঠিক খেয়াল করেনি, অন্যমনস্ক হয়ে ছিলো। ইউভির জন্যে এত কিছুর মুখোমুখি হতে হবে কে জানতো। শুভ্র আর কিছু বললো না। টিয়া পাখিটা বড়ই বিরক্তিকর ছিলো সারাদিন কথা বলতো। তাই সে ছেড়ে দিয়েছিলো আর তার খোঁটা এখন শুনতে হচ্ছে।

শুভ্রের চুপ করে থাকায় বেশ মজা পেলো মোহনা তারপর যেতে বললো,” সেদিন এমন করেছিলি বলেই আজ শুনতে হচ্ছে।”

শুভ্র একরাশ বিরক্তি নিয়ে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেললো। এরা সবাই জোট বেধে তার পিছু লেগেছে।

রাতে হিয়া ডান হাতে ইউভির বিছানা করে দিলো। ইউভির মনে হয় ঘুম পায় নি। খালি লাফাচ্ছে এদিক সেদিক।

মোহনার কথা গুলো এখনো হিয়ার মাথায় ঘুরছে। হাতের ব্যান্ডেজটার উপরে রক্ত ভেসে উঠছে। বদলাতে পারলে ভালো হতো। হিয়া আর ভাবলো না, ঘুম পাচ্ছে অনেক। হিয়া সবে ঘুমাতে যাবে এই সময়ে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো শুভ্র দাড়িয়ে আছে দরজার কাছে। হিয়া মাথা নুইয়ে রাখলো, এতো রাতে শুভ্র তার ঘরে কেনো?

শুভ্র হিয়ার দিকে এগিয়ে আসতেই হিয়া পিছাতে লাগলো। শুভ্র শান্ত গলায় বললো,” খাটে বসো।”

হিয়া চোখ তুলে একটু তাকাতেই দেখলো শুভ্র স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। হিয়া চুপচাপ বসে পড়লো বিছানায়। শুভ্র শান্ত ভঙ্গিতে হিয়ার সামনে বসে মুষ্টিবদ্ধ হিয়ার হাতটা সামনে আনলো তারপর ব্যান্ডেজটা খুলতে খুলতে বললো,” ব্যাথা করছে ?”

হিয়া অন্যমনস্ক হয়ে মোহনার কথাগুলো ভাবছিল। শুভ্রের কথাগুলো শুনতে পেলো না। শুভ্র উত্তর না পেয়ে আবার হিয়ার দিকে তাকালো তারপর শুভ্রের চোখে চোখ পড়তে, হিয়ার হুস ফিরল। হিয়া একটা ঢোক গিলতেই শুভ্র ভ্রু কুচকে বললো,” কি ভাবছো এতো? ব্যাথা করছে কিনা জিজ্ঞেস করেছি।”

হিয়া ঘন ঘন দুবার না সূচক মাথা নাড়ল। শুভ্র ব্যান্ডেজ টা বদলাতে ব্যাস্ত হয়ে পরলো। হিয়া পলকহীন দৃষ্টিতে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্রের সামনের চুলগুলো কপালে এসে বিধেছে। চোখে চশমাতে চোখ আবদ্ধ হয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর পর লালচে ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নিচ্ছে সে। মুগ্ধতা নিয়ে হিয়া তাকিয়ে আছে।

শুভ্র ব্যান্ডেজ শেষে হিয়ার দিকে তাকাতেই হিয়ার পলকহীন দৃষ্টি চোখে পড়লো তার। শুভ্র চোখে হাসতেই, হিয়া দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। লজ্জায় লাল বর্ন ধারণ করেছে সমস্ত চেহারা।

শুভ্র নীচের ঠোঁট কামড়ে কিছু বলতে গিয়েও বললো না। থাক এমনিতেই লজ্জায় লাল হয়ে গেছে পরে আবার কিছু বললে নীল হয়ে যাবে। শুভ্র উঠে দাড়ালো,চলে যেতেই হিয়া কিছু একটা বলবে বলে সেও উঠে দাড়ালো। শুভ্র সেটা খেয়াল করে পিছিয়ে এসে হিয়ার সামনে দাড়ালো। তারপর একটা ভ্রু তুলে জিজ্ঞেস করলো,” কিছু বলবে?”

হিয়া ঘন ঘন মাথা নেরে বললো,” হুম্ ”

শুভ্র পকেটে হাত ভরে বললো,” আচ্ছা, বলো।”

হিয়া অনেক সময় চুপ করে রইলো, তারপর শুভ্রকে অবাক করে দিয়ে শুভ্রের বুকে মাথা রেখে শুভ্রকে জড়িয়ে ধরেই চোখ বন্ধ করে বললো,” সরি।”

শুভ্র যতটাই অবাক হয়েছে ততটাই খুশি হয়েছে। হিয়া আর তার সম্পর্কটা হয়তো ঠিক হচ্ছে। শুভ্র কখনোই জোর করে কাছে পেতে চায় নি হিয়াকে। কারণ সে নিজে থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল তাই তাকে মেনে নেওয়ার সময়ও দিয়েছে হিয়াকে। শুভ্র পকেট থেকে হাত বের করে হিয়ার মাথায় রাখার আগেই হিয়া ফট করে কি যেনো ভেবে সরে এসে দাঁড়ালো।

সে কি করলো এটা? কেনো করলো? ভেবেই ইচ্ছে করছে গর্ত খুঁড়ে মাটিয়ে লুকিয়ে পরে। লজ্জায় শুভ্রের চেহারার দিকে আর তাকালো না হিয়া। তার জন্যেই হয়তো শুভ্রের ঠোঁটের কোনায় হাসিটা তার দেখা হলো না।

শুভ্র যাওয়ার সময় হিয়ার সামনের চুলগুলো একটু এলোমেলো করে দিয়ে গেলো। বাঁদরটা লজ্জায় একদম টমেটো হয়ে গেছে। শুভ্র চলে যেতেই হিয়া লাইট অফ করে চাঁদর মুড়িয়ে শুয়ে পড়লো। লজ্জায় নিজের মুখ নিজেরও দেখতে ইচ্ছে করছে না। যত্তসব উল্টা পাল্টা চিন্তা তার মাথায় কেনো আসে। এই লোকটা কি ভাবলো তাকে?

🌟 দিবা সারাদিন একা একা থাকে। কোথাও একা একা গিয়েও কোনো লাভ নেই কোনো কিছুই ভালো লাগে না। তাই আজ ধরে বেধে হিয়াকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। হাঁটতে হাঁটতে অনেক জায়গা ঘুরেছে তারা। হটাৎ করে দিবা ইভানকে দেখতে পেলো। সঙ্গে আরেকটি ছেলে মিলে কোথায় যেনো যাচ্ছে।

হিয়া ভেলপুরি খাচ্ছিল দিবা হিয়াকে টেনে নিয়ে এলো। হিয়া মুখের খাবার শেষ করে বললো,” এমন করেছিস কেনো?”

” বদমাইশটাকে দেখেছি। আয় দেখি তো কোথায় যাচ্ছে।”,বলেই আরো জোরে জোরে হাঁটতে লাগলো দিবা। বাদ্য হয়ে হিয়াকেও হাঁটতে হচ্ছে। হিয়া আর কিছু জিজ্ঞেস করছে না। কারণ দিবার কানে আর কোনো কথা যাবে না, সে তার ইভানকে দেখতেই ব্যাস্ত। কিছুক্ষণ পর পর দিবা গাছের পিছনে গিয়ে লুকাচ্ছে। হিয়াকেও লুকাতে হচ্ছে। কি যন্ত্রণা!

ইভান আর তার সাথের ছেলেটা একটা গেম কোডের মতন জায়গায় ঢুকলো। দিবাও হিয়াকে টেনে টেনে ভিতরে নিয়ে এলো। ভিতরে যদি অসভ্য ছেলেপুলে থাকে তখন? এই প্রশ্নের উত্তরে দিবা বললো আরে এইটা অনেক উন্নত একটা জায়গা মেয়েরাও আসা যাওয়া করে। আর বখাটে ছেলেদের এইখানে ঢুকতে দেয় না। ফ্রেন্ডরা মিলে আড্ডা দেওয়ার জন্যে আসে সবাই। ভয় পাওয়ার কারণ নেই।

কলেজ ড্রেসে এইখানে ঢুকতে কেমন জানি অদ্ভুত লাগছে হিয়ার। সবাই তাকিয়ে আছে। গোল গোল করে কেউ গল্প করছে আবার কেউ কেউ খেলছে। এর মাঝেই হটাৎ কেনো জানি মনে হলো হিয়া শুভ্রকে দেখেছে মাত্র। দেখেই আত্তা কেপে উঠলো। হিয়া ফট করে একটা ফুড মেনু মুখের সামনে ধরে দিবাকে টেনে নিজের কাছে এনে বললো,” বাম দিকের শেষের টেবিলে দেখতো ডাক্টারটা বসে আছে নাকি?”

দিবা চোখ বড় বড় করে তাকালো। তারপর খুঁজতে লাগলো, হিয়ার কথাটা সত্যি। শুভ্র ভাইয়ার সঙ্গে অন্তিক আর রুবাইয়া আপুও আছে। কি ভয়াবহ অবস্থা! দেখে নিলেই তো সমস্যা। লুকাবে কি করে? কলেজ ড্রেস দেখলেই তো চিনে যাবে?

[ #চলবে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here