নীলচে তারার আলো পর্ব -২৫+২৬

#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_২৫

শুভ্র তার প্রিয়দর্শিনীর লজ্জায় ভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে আরেকটু কাছে এসে বললো,” এরপর থেকে মনে রাখবে। শুভ্রনীল আহমেদ, তোমার হাসব্যান্ড।”
কথাটা শুনতেই হিয়ার শরীর শিউরে উঠলো। শুভ্র চোখে হাসলো তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,” তোমার পায়ে এমনিতেই সমস্যা আছে। তাই চুপচাপ রেস্ট নাও।”,বলেই শুভ্র তোয়ালে নিয়ে ফ্রেশ হতে গেলো।

হিয়া এতক্ষণ চুপ করে ছিলো। শুভ্র ওয়াশরুমে যেতেই ফট করে চোখে খুলে নিজের দুই গাল স্পর্শ করলো। গাল দুটো দিয়ে তাপ বের হচ্ছে। শুভ্র এই কয়েক মিনিটে যা করলো সেই ঘোর থেকে হিয়া এখনো বের হয়ে আসতে পারেনি। শুভ্র তাকে কিস করেছে? আবার বলেছে শুভ্রনীল আহমেদ তার হাসব্যান্ড মনে রাখতে। লোকটা কি তাকে পছন্দ করে? কথাটা ভাবতেই গাল দুটো আরেক দফায় লাল হয়ে গেছে। শরীরটা নিস্তেজ হয়ে আছে। যেনো অনুভূতির এক ঘূর্ণিঝড় তার মাঝে বয়ে গেলো। কিন্তু তাকে কেনো পছন্দ করবে এই বদমাইস ডাক্তার?
প্রথম থেকে তাকে দেখলেই তো রেগে আগুন হয়ে গেছে। এখন আবার বলছে হাসব্যান্ড। কথাটা কি এমনেই বললো? তাহলে কি কিস……. না না আর ভাবা সম্ভব হচ্ছে না। পালাতে হবে। আজ রাত এই ডাক্তারের সাথে থাকলে নির্ঘাৎ পাগল হয়ে যাবে সে।

হিয়া সুযোগ বুঝে নিজের রূমে চলে গেলো। গিয়েই দরজা আটকে ফেললো। হিয়া কখনো রুমে দরজা আটকায় না ভয় লাগে কিন্তু আজ সে সব কিছু পরোয়া করে না সে।

শুভ্র ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে দেখে হিয়া রুমে নেই। দরজাটাও খোলা, বাঁদরটা পালিয়েছে। হিয়ার এমন ছেলে মানুষী দেখলে সত্যি রাগ হয়। পায়ে এমনেই সমস্যা তাও একটু সাবধানে থাকতে পারে না। ঘুরে ফিরেই পায়েই বার বার চোট পেতে হয় মেয়েটার। রাগ দেখালে তো আবার সে খারাপ। কিন্তু নিজে যে সবসময় বাচ্চাদের মতন জেদ করে সেটা বুঝতে পারে না।

শুভ্র কাবাড খুলে বাদামি রঙের একটা টি শার্ট পড়লো তারপর নিজের বিছানায় তাকাতেই দেখলো একটা নূপুর পরে আছে। শুভ্র এগিয়ে এসে নূপুরটা হাতে নিলো। এই যে বাঁদরটা ফেলে গেছে পরে হারিয়ে গেলে তো আবার কেদে কেটে অস্থির হয়ে যাবে। শুভ্র নুপূরটা ট্রাউজারের পকেটে রেখে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলো।

হিয়ার ঘরের দরজা বন্ধ, শুভ্র জানে তার ভয়েই দরজা বন্ধ করে বসে আছে সে। হিয়া যে কেনো শুভ্রকে এতো ভয় করে শুভ্র ভেবে পায় না। কবে যে এই মেয়ের ভয় দূর হবে?শুভ্র চাইলে এক্ষুনি তুলে নিজের রুমে নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু কি লাভ! নিয়ে এলে তো সেই জড়সড় হয়ে বসে বসে বির বির করবে।

শুভ্র এই মেয়ের প্রতি কিভাবে যে এতটা দুর্বল সে নিজেও জানে না। হিয়া কখন যে শুভ্রের নিজের হয়ে গেছে শুভ্র টের পর্যন্ত পায় নি। নিজের কাছের মানুষদের প্রতি শুভ্রের ভালোবাসার অভিব্যক্তি আলাদা। সে পারে না অন্য সবার মতো নিজের ভালোবাসা মুখে প্রকাশ করতে। ভালোবাসা কি মুখে বলার জিনিস? সেটা তো একটা অনুভুতি। যাকে তুমি ভালোবাসো সে যদি তা অনুভবই না করে তাহলে তোমার সেই ভালোবাসা কি ব্যার্থ নয়?

শুভ্র সিড়ি বেয়ে নীচে এলো। সন্ধার পর থেকে রায়হানের হদিস নেই। ফোন নাকি ধরছে না এই নিয়ে রাবেয়া ফুফুর হইচই শুরু হয়েছে। ছেলেটা তার এমনই, ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে ফটোগ্রাফিতে ব্যাস্ত।মাসের পর মাস ছেলের খোজ পায়না। পাহাড় জঙ্গল ঘুরে বেড়ায়। নেটওয়ার্ক থাকে না। ছেলে বিয়ে দেওয়ার পাগলামিটা এই মায়ের ক্ষুদ্র একটা চেষ্টা ছিলো, ছেলেকে মাসে মাসে হয়তো চোখের দেখা দেখতে পারবেন এই আশায়। ছোটো ছেলেটা তার বড্ড আদরের।

শুভ্র চুপ করে আছে। গ্রিকের বিখ্যাত ফটোগ্রাফার এর পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হওয়ার সুযোগ পেয়েছে রায়হান। এইটা রায়হানের ক্যারিয়ারের বড় একটা সুযোগ সে নিশ্চয়ই সেসব ছেড়ে মিথ্যে এক খেলায় নামবে না। শুভ্রের সবটা জানা ছিলো। তাই ঠান্ডা মাথায় সবটা হ্যান্ডেল করেছে সে। কিন্তু ফ্লাইট তো দুদিন পর তাহলে রায়হান এখন কোথায়? ফুফুকে কি কিছুই জানায় নি সে?

শুভ্র ফুফুর বিপি চেক করে, আপাদত ঘুমের ওষুধ দিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। এই বয়সে তার ফুফুকে কম কষ্ট করতে হয় নি। শেষ বয়সটা মহিলা একাই কাটাচ্ছে। ছেলেমেয়েগুলো কে কাছে পাচ্ছে না। সবাই বিদেশে সেটেল হয়ে গেছে। আর ফুফার বয়স হয়েছে। তিনি তার সূর্যের হাসি ক্লাব নিয়েই ব্যাস্ত থাকার চেস্টা করেন। সকাল সকাল ব্যায়ামে বের হয় সবাইকে নিয়ে। আর ফুফুর চিন্তায় চিন্তায় দিন কাটে। শুভ্র দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেললো। ফুফুকে এইভাবে কষ্ট পেতে দেখে খারাপ লাগছে তার।


সকালে শুভ্র অনেকবার প্রভাকে কল করেছে। সেই যে অ্যামিউজডমেন্ট পার্কের দিন দেখা হয়েছে তারপর না কোনো কল না কোনো ম্যাসেজ। অসুস্থ হয়ে গেলো নাকি। মেডিক্যাল থেকে শুভ্র সোজা প্রভাদের বাসায় এলো। প্রভা খুব নরম মনের মেয়ে। অল্প কিছুতে খুব ভেঙে পরে এই মেয়ে। কি হয়েছে কে জানে?

প্রভা নিজের রুমে ঘুমিয়ে ছিল। কড়া ঘুমের ওষুধ খাচ্ছে সে। তাই এতো বেলা অবধি তার ঘুম হয়। ঘুম থেকে উঠতেই কাজের মেয়ে সুমি এসে বললো শুভ্র ভাইয়া এসেছে। প্রভা ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো। শুভ্র ড্রয়িং রুমে বসে বাহিরে তাকিয়ে ছিলো। সামনে চা নাস্তা দেওয়া। প্রভা স্বাভাবিক ভাবেই বেড়িয়ে এলো। এসে শুভ্রের সামনের চেয়ারে বসলো। প্রভার চোখ মুখের অবস্থা ভয়াবহ। শুভ্র চিন্তিত হয়ে তাকালো কিন্তু কিছু বললো না।

প্রভা হাসার চেষ্টা করলো তারপর বললো,” কি ব্যাপার? তুই হটাৎ আমার বাসায়?”

শুভ্র প্রভার এমন হাল এর আগে দেখেনি। ইমনের সাথে ব্রেকআপের পরো প্রভার এমন অবস্থা হয় নি। শুভ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,” কি হয়েছে তোর? এমন হাল করেছিস কেনো?”

প্রভা উত্তরে হাসার চেষ্টা করলো। তারপর বললো,”কিছু হয় নি। এমনেই ভালো লাগছে না। আসলে যেটা আমার না সেটা আকড়ে ধরতে চেয়েছিলাম। ভুলটা বুঝতে পেরেছি তাই নিজেকে সামলে নিচ্ছি।”

” সাহিত্যিক হয়ে গেলি কবে? যাই হোক ফোন ধরিস নি কেনো?”,রেগে বললো শুভ্র।

” আমি না একা থাকতে চাই। ভালো লাগছে না কিছু। তাই একা আছি।”, ক্লান্ত গলায় বললো প্রভা।

” আচ্ছা, তাহলে আমি আসি।”,রেগে উঠে পড়ল শুভ্র। প্রভাকে এমন অবস্থায় দেখে শুভ্র ধারণা করতে পারছে কড়া ঘুমের ওষুধ খাচ্ছে প্রভা। কি হয়েছে সেটাও বলছে না। শুভ্র জানতেও চাইলো না।

প্রভা সাথে সাথে উঠে দাড়িয়ে বললো,” রাগ করলি? এভাবে চলে যাচ্ছিস কেনো?”

” নাহ্, আসি। তুই রেস্ট নে।”,বলেই শুভ্র বেড়িয়ে গেল।

প্রভা এক দৃষ্টিতে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে থাকলো। জীবনের বড় ধাক্কাটা সে পেয়েছে। ইমনের থেকে ধোঁকা পাওয়ার পরো এতটা কষ্ট তার হয়নি। শুভ্র সেই সময়ে যেভাবে প্রভার হেল্প করেছে। এরপর শুভ্ররকে ভালো না বেসে থাকতে পারলো না।

সেদিন শুভ্র আর হিয়াকে এতটা কাছাকাছি দেখে নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছে প্রভা। যে শুভ্রের ধারে কাছে কোনো মেয়ে ঘেঁষতে পারতো না। যখন সেই শুভ্র কোনো মেয়েকে কাছে টেনে নিচ্ছে তার মানেটা অনেক আগেই হয়তো বোঝা উচিত ছিলো। ভুলটা তো তার। শুভ্র ভীষণ রাগী এই যে রাগ করে চলে গেলো। এই রাগ জমে অভিমান হবে। তারপর দুরত্ব বাড়বে।

✨ দিবার আজ ভীষণ মন খারাপ। তাকে এইবার এই বড় বাড়িতে বাবার সাথে থাকতে হবে। দিদি চলে যাচ্ছে গ্রামের বাড়িতে। এই ভয়েই ছিলো সে। হিয়া দিবার মন খারাপের কারণ জানতে চাইলো কিন্তু দিবা বললো না। হিয়া জোর করতেই দিবা কেদে ফেললো। তারপর সবটা বললো।

হিয়া সবটা শুনে চুপ করে রইলো। পরক্ষণেই মনের কোণে একটা প্রশ্ন জাগলো। প্রভা শুভ্রকে নিজের মনের কথা কেনো জানালো না? যদি জানতো তাহলে কি শুভ্র তাকে ছেড়ে দিতো? জীবনের এই গণিত সে মিলাতে পারছে না। সবটা এতো জটিল কেনো?

প্রভা ট্রেনে বসে, জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। এই শহরে সে আর ফিরবে না। শেষবারের মত শুভ্রের সাথে আর দেখা করা হলো না। শুভ্রের সাথে তার আর দেখা হবে না কোনোদিন। এই শহরে থাকলে সে আরো অসুস্থ হয়ে যাবে। একা থাকা প্রয়োজন, সবটা ভুলে যেতে হবে।

গ্রামে গিয়ে সেইখানে একটা ক্লিনিক খুলবে গরীব মানুষগুলোর সেবা করেই সে কাটিয়ে দিবে বাকিটা জীবন। শুভ্রের কন্ঠটা শেষবারের মতন খুব শুনতে ইচ্ছে হলো। কাপাকাপা হাতে প্রভা শুভ্রের নাম্বারে কল করলো। তিনবার রিং হতেই শুভ্র ফোনটা ধরলো। ধরে হেলো বলতেই প্রভা ফোনটা কেটে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে শুভ্র আবার কল ব্যাক করলো। কিন্তু প্রভা তা কেটে দিয়ে সিমটা খুলে ফেললো।

তারপর ট্রেনের জানালা দিয়ে সেটা বাহিরে ফেলে দিলো। অঝোরে কান্না করতে লাগলো সে। শুভ্রকে তো বলাই হলো না সে তাকে কতটা ভালোবাসে। অবশ্য এখন বলার সুযোগটাও সে হারিয়ে ফেলেছে। হয়তো আরো আগে বলা উচিৎ ছিলো। কিন্তু সময় যে তাকে ফেলে অনেকটা পথ পার করে এসেছে।

প্রভার ফোন না ধরায় শুভ্র রেগে ফোনটা একপাশে রেখে দিলো। কিন্তু এই রাগী শুভ্রের তো জানাই হলো না, শান্ত নিশ্চুপ এই মেয়েটি তাকে কতোটা ভালোবেসেছিলো।

শুভ্রের তো এমনটাই পছন্দ যে, ভালোবাসা অনুভবে রবে। তবে কি এটা প্রভার ব্যার্থতা যে সে শুভ্রকে বোঝাতে পারে নি। সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না। কিন্তু অপূর্ণ ভালোবাসার গল্পগুলো আমাদের কারোর জানা হয় না। সেগুলো শুধু অনুভবেই রয়ে যায়।
#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_২৬

নূপুরটা কয়দিন হলো হিয়া খুজেই পাচ্ছে না। আজ নিজের পুরো রুমটা ওলোট পালোট করে ফেলেছে সে। নূপুরটা তার বাবার দেওয়া। এটা সে হারিয়ে ফেললো কিভাবে? হিয়া ব্যাস্ত হয়ে সব জায়গায় খুঁজছে। আর ম্যারি চারিদিকে লাফাচ্ছে।

শুভ্র বইয়ের জন্যে সবে মাত্র রুমটায় ঢুকেছে। রূমের অবস্থা দেখেই থমকে গেছে। এই অবস্থা কেনো তার লাইব্রেরী রূমের। হিয়া ফ্লোরে শুয়ে বুকশেলফের নিচে নূপুরটা পড়েছে কিনা সেটা দেখতে ব্যাস্ত,হাতে ফোনের টর্চ।

শুভ্র ভ্রূ কুচকে বললো,” ফ্লোরে শুয়ে কি করছো তুমি?”

হটাৎ শুভ্রের আওয়াজ শুনে হিয়া ধড়ফড়িয়ে উঠতে গিয়ে কাঠের সাথে ঠাস করে একটা বাড়ি খেয়ে মাথায় হাত দিয়ে ব্যাথায় নিচেই শুয়ে রইলো। শুভ্রের উপর এইবার রাগ লাগছে। এখনই আসতে হলো এই হনুমানটাকে? মাথাটা মনে হচ্ছে ফেটে গেছে।

ব্যাথা পেয়েছে কোথায় উঠে বসবে তা না মুখ ফুলিয়ে ফ্লোরে শুয়ে আছে। শুভ্র হিয়ার সামনে এসে বুকের কাছে হাত ভাজ করে দাড়ালো। হিয়া আড় চোখে একবার শুভ্রের দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ফেললো।
শুভ্র হাত বাড়িয়ে মাথার উপর রাখা হিয়ার হাতটা ধরে ওকে টেনে দাঁড় করিয়ে প্রথমে মাথাটা ধরে কাছে আনলো। তারপর মাথাটা এপাশ ওপাশ করে দেখলো ঠিক আছে কিনা।

হিয়া মুখ কালো করে শুভ্রের দুই হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,” মাথাটা কি ঘাড় থেকে খুলে নিতে চাচ্ছেন?”

শুভ্র হাত দুটো পকেটে ভরে একবার পুরো রুমটায় নজর দিতেই হিয়ার টনক নড়লো। এইবার তো তার খবর আছে। এই লোকটা তাকে একশো একটা কথা শুনাবে রূমের এই অবস্থার জন্য। শুভ্র কিছু বলার আগেই হিয়া ফট করে বলে উঠলো,” আমি আপনার বুকশেলফের একটা বই ও কিন্তু সরাই নি। একদম আমাকে রাগ দেখাবেন না।”

শুভরে মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে রুমটার এই অবস্থায় সে খুবই বিরক্ত। শুভ্র সে সব বাদ দিয়ে বললো,” এতো ব্যাস্ত হয়ে কি খুঁজছো?”

প্রশ্নটা শুনেই হিয়ার মন খারাপ হয়ে গেলো। হিয়া মন খারাপ করে বললো,” আমার নূপুর হারিয়ে ফেলেছি। এক পায়ে আছে অন্য পায়ের টা খুজে পাচ্ছি না।”

শুভ্র জানতো নূপুর হারিয়ে এই বাঁদরটা এমনই করবে। সে ইচ্ছে করেই নূপুরটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। এবার সাড়া বাড়ি খুঁজে বেড়াও। হিয়া আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকালো। দেখে তো মনে হচ্ছে নুপূর হারিয়ে ফেলায় লোকটা খুব খুশি হয়েছে। হিয়া কড়া চোখে তাকিয়ে বললো,” আমি নুপূর হারিয়ে ফেলায় আপনি খুব খুশি হয়েছেন তাই না? এটাই তো আপনি চেয়েছিলেন। আপনার কারণে আমি নুপূরটা হারিয়েছি। আপনার…আপনার নজর লেগেছে।”

শুভ্র এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,” শাট আপ। জলদি এই রুমটা ঠিক করো। দেখে তো মনে হচ্ছে এই রুমে গরিলা অ্যাটাক করেছে।” বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে নিজের রুমে চলে এলো শুভ্র। হিয়ার নুপূরটা যেই প্যান্টের পকেটে ছিলো মা কোনো ভাবে সেই প্যান্ট ধোপার কাছে দিয়ে দেয় নি তো? শুভ্র ব্যাস্ত হয়ে নিজের কাবাড খুললো।

হিয়ার কেনো জানি মনে হচ্ছে নুপূরটা সে শুভ্রের রুমেই হারিয়েছে। তার সব জিনিস তো এই হনুমানের রুমেই হারায়। এই দুষ্টু ম্যারিটা সুযোগ পেলেই হনুমানের ঘরে হানা দেয়। ভেবেই কড়া চোখে ম্যারির দিকে তাকালো। ম্যারির কি? সে তার ছোট্ট লেজটা দেখিয়ে বসে আছে।

হিয়া আস্তে করে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে শুভ্রের রুমে উকি দিলো। শুভ্র নিজের কাবাডে কি করছে এতো মনোযোগ দিয়ে। অনেক খোজার পর শুভ্র সেই প্যান্টটা খুজে পেলো। পকেটে খুঁজতেই নুপূরটাও পেলো। নুপূরটা হাতে নিতেই হিয়া দরজার বাইরে থেকে দেখলো। দেখেই সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে বললো,” এইটা আমার নুপূর।” বলেই ছুটে রূমের ভিতরে চলে এলো।

হিয়ার আওয়াজ কানে আসতেই শুভ্র সঙ্গে সঙ্গে কাবাডটা বন্ধ করে ফেললো। ততক্ষনে হিয়াও রূমের ভিতরে হাজির। হিয়ার মেজাজ ভালোই গরম হয়েছে। লোকটা তার নূপুর লুকিয়ে রেখেছে কেনো? সমস্যা কি তার।

শুভ্র কড়া গলায় বললো,” তুমি আমার রুমে এসেছো কেনো?”

” আপনি আমার নূপুর নিয়েছেন কেনো?” প্রশ্নের জবাবে প্রশ্ন ছুড়লো হিয়া। শুভ্র এগিয়ে আসতে আসতে বললো,” হোয়াট ননসেন্স? তোমার নূপুর আমি নিতে যাবো কেনো?”

শুভ্রের এইভাবে এগিয়ে আসতে দেখে হিয়া পিছাতে পিছাতে বললো,” আমি নিজের চোখে দেখেছি আপনার হাতে আমার নূপুরটা ছিলো।”

” তুমি কি চোখে দূরবীণ লাগিয়ে ঘুরে বেড়াও?”, ভ্রূ কুচকে বললো শুভ্র।

” হ্যা, আমার চোখ দূরবীণ। আপনার মতন চশমা পড়া লাগে না আমার।”,মুখ বাঁকিয়ে বললো হিয়া।

” তোমার মনে হচ্ছে না তুমি বেশি কথা বলছো?”, কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো শুভ্র।

” আমি জানি না। আমার নুপূর আমাকে ফেরত দিন।”, কথাটা শেষ না করতেই হিয়া পিছনের বিছানায় পরে যেতে নিলে শুভ্রের শার্টের কলার চেপে ধরে নিজেকে সামলে নিলো। পরক্ষণেই দেখলো শুভ্র হিয়ার দুই হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। পড়ে যাওয়ার ভয়ে হিয়া যে শুভ্রের শার্ট চেপে ধরেছে সেটা বুঝতেই পারে নি। শুভ্রের চোখে চোখ পড়তেই হিয়ার বুকের ভিতরটায় ড্রাম বাজাতে লাগলো। হিয়া চোখ বন্ধ করে শার্টের কলার ছেড়ে দিতেই সঙ্গে সঙ্গে ধপাস করে বিছানায় পড়ে গেলো। পড়েই হিয়া চোখ বন্ধ করে রাখলো। তারপর চোখ খুলতেই দেখলো শুভ্র স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

কেমন জামাই এইটা? আবার বলে আমি তোমার হাসব্যান্ড মনে রাখবে। পড়ে গেছি একে তো ধরলো না এখন আবার তাকিয়ে আছে হাত টা বাড়িয়ে দিবে তা না। হিয়া রেগে বললো,” আপনি আমাকে ধরলেন না কেনো?”

শুভ্র হিয়ার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলাতেই হিয়া চটপট উঠে পড়লো। অসভ্য একটা লোক। হিয়া রাগে ফুলতে ফুলতে বললো,” এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো? আমার নুপূরটা আমাকে ফেরত দিন।”

” তোমার নুপুর আমি কেনো আমার কাছে রাখবো? আর ইউ ম্যাড?”, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললো শুভ্র।

হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকালো তারপর বললো,” তবে যে আমি আপনার হাতে নুপুর দেখলাম?”

” ভুল দেখেছো।”, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো শুভ্র। হিয়া এইবার সত্যি কনফিউজড হয়ে গেছে। তাহলে কি সে ভুল দেখেছে? নূপুর দেখলো তো সে। ধুর বাবা! কি একটা অবস্থা।

হিয়া আড় চোখে একবার তাকিয়ে বললো,” আমি আপনার কাবাডটা একবার খুলে দেখি।” সহজ মনে প্রশ্ন করতেই শুভ্রের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নজরে পড়লো। হিয়া ফট করে উঠে পড়ল তারপর ঘাবড়ে গিয়ে বললো,” থাক। থাক, চলে যাচ্ছি এইভাবে তাকাতে হবে না। তবে আমি নুপুর দেখেছি আপনার হাতে আর আমি সিউর ঐটা আমার নূপুর। আমি তো ঐটা নিয়েই ছাড়বো।”

শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সে কি বলেছে সে নূপুর তাকে কোনোদিন দিবে না। সবকিছুতেই ঝগড়া করতে হবে এই মেয়ের।

✨ দুপুরের পর রায়হানের হটাৎ এমন আগমন সবাইকে অবাক করলো। সবচেয়ে বেশি অবাক করলো শুভ্রকে। আজকে তো রায়হানের ফ্লাইট ছিলো কিন্তু সে এইখানে কেনো? রায়হান প্রথমে এসেই এই বিয়েটা ভেঙে দিলো। তখন থেকে তার মায়ের সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। হিয়া এইসব থেকে দূরে সরে আছে।

রায়হানকে দেখে সে নিজের রূমে চলে এসেছে। নিচে কি হচ্ছে না হচ্ছে তার কোনো ধারণা নেই। কেনো জানি অকারনেই হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে তার। ম্যারিকে কোলে করে বসে আছে সে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই হিয়ার দরজায় নক পড়লো। হিয়া চমকে তাকালো। রায়হান দাড়িয়ে আছে মুখে সূক্ষ্ম একটা হাসি। হিয়া একটা ঢোক গিললো। রায়হান এগিয়ে এসে বললো,” ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বিয়েটা ভেঙে গেছে। আমাকে তোমার বিয়ে করতে হবে না।”

হিয়া কি করবে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। হিয়া ম্যারিকে কোলে করে উঠে দাড়ালো। তারপর চুপ করে রইলো। রায়হান হাসলো, তারপর বললো,” আমি কিন্তু তোমার থেকে একটা জিনিস ফেরত নিতে এসেছি।”

হিয়া একটা ঢোক গিললো। কাপা কাপা কণ্ঠে বললো,” মানে?”

রায়হানের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,” আমার নিজেকে বড্ড একা লাগছে। কাউকে খুব প্রয়োজন।”, এতটুকু শুনেই হিয়ার মুখ শুকিয়ে গেছে।

রায়হান থেমে বললো,” তোমাকে তো আমি আর চাইতে পারবো না। ম্যারিকে নিতে এসেছি।”
বলেই ম্যারির দিকে ঈশারা করতেই ম্যারি হিয়ার কোল থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়লো। হিয়া ম্যারিকে আটকানোর সুযোগও পেলো না। হিয়া ছল ছল চোখে বললো,” আমি কি ওকে রাখতে পারবো না?”

রায়হান মায়ার চোখে তাকালো। তারপর বললো,” অ্যাম সরি , ভালো থেকো।” বলেই রায়হান ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। যেতে যেতে তপ্ত নিশ্বাস ফেললো সে। একটু এগিয়ে যেতেই সামনে শুভ্রের মুখোমুখি হলো। শুভ্রকে দেখে থেমে গিয়ে বললো,” কেমন আছিস?”

শুভ্র সেই প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে বললো,” তুই ফ্লাইট ছেরে কি করছিস এইখানে?”

” ফ্লাইট? ছেড়ে দিতাম। যদি হিয়া তোকে ছেড়ে দিতো।”, ব্যাথিত সুরে হাসি মুখে কথাটা বললো রায়হান। তারপর আরো বললো,” আজ রাতেই ফ্লাইট।”

“ফুফু জানে?”, গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো শুভ্র।

” নাহ্, মাকে জানাই নি। পৌঁছে কল করবো।”

শুভ্র ভ্রু কুঁচকে ম্যারির দিকে তাকালো। তারপর বললো,” ওকে নিয়ে যাচ্ছিস?”

” হ্যা, কেনো রেখে যাবো? তাহলে তুই ওকে রেখে দে। আমি হিয়াকে নিয়ে যাই। রাজি তুই?”,বলেই হাসতে লাগলো রায়হান। শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো। রায়হান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,” ভালো থাকিস।”,বলেই শুভ্রকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। তারপর শুভ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।

রাতে হিয়া কিছু খেলো না। কিছুক্ষণ পর পর শুধু কাদঁছে। ম্যারির জন্যে খারাপ লাগছে তার। কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। অনেক জোর করেও কেউ কিছু খাওয়াতে পারেনি তাকে।

সকালে ঘুম ভেঙে এমন এক চমক দেখতে পাবে হিয়া ভাবতেও পারে নি। তার ঘরে ছোট্ট এক কুকুরছানা। একদম সাদা পমেরিয়ান। এমন কুকুর নিয়ে সে অনেক পড়েছে, খুব আগ্রহ ছিলো তার এই কুকুর নিয়ে। হিয়ার বিস্ময়ের সীমা রইল না। ঘুম থেকে উঠে এমন কিছু সে আশা করেনি। হিয়া লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়লো। এটা কোথা থেকে এলো। কুকুরছানা কে কোলে নিতেই আরেকটা জিনিস চোখে পড়লো তার। অন্য পায়ে নুপুর এলো কোথা থেকে তার? তাহলে কি শুভ্র রাতে তার রুমে এসেছিল?

[ #চলবে ]
[ #চলবে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here