নীলচে তারার আলো পর্ব -২৩+২৪

#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_২৩

“তোমার এতো সমস্যা কেনো হচ্ছে সেটাই তো বুঝতে পারছি না। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই যাও ঘুমাও।”, নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন রবীউল সাহেব।

” তার মানে এইসবে তোমার সায় আছে। আমার শুধু এইটাই জানবার ছিলো। তুমি ভুলে যেও না আমি কিন্তু তোমারই ছেলে। যা হবে তার জন্যে প্রস্তুত থেকো।”, বলেই শুভ্র বেড়িয়ে গেলো।

রবীউল সাহেব গা ছাড়া ভাব নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে বিছানায় শুতে এলেন। সাহারা খাতুন আড় চোখে সবটা দেখছেন। রীতিমত গা জ্বালা করছে তার। এমন মানুষ সে তার জিবনে দেখেনি।

🦋 রবীউল সাহেব হিয়ার ঘরে এলেন।হিয়ার ঘরের বাইরে দাড়িয়ে দরজার নক করলেন। যাকে নিয়ে এতো কিছু তাকে তো সবটা জানাতে হবে। হিয়া পড়ার টেবিলে বসেছিল। দরজায় টোকা পড়তেই সে পিছনে ফিরে রবীউল সাহেবকে দেখে এগিয়ে এসে রবীউল সাহেবকে এনে ঘরে বসালো।

রবীউল সাহেব পড়ার টেবিলের দিকে তাকিয়ে বললো,” পড়ছিলি বুঝি? ডিস্টার্ব করলাম নাকি?”

” না, না কিসের ডিস্টার্ব। সারাক্ষণ পড়তে কি আর ভালো লাগে?”,

” আচ্ছা। কিছু কথা বলতাম তোকে। কিভাবে যে শুরু করি।”, রবীউল সাহেব ইতস্তত বোধ করলেন।

” এতো ভাবা লাগবে না। আমি না তোমার মেয়ে,তুমি বলো আমাকে।”

” আমার বোন মানে তোর ফুফু।”,এতটুকু বলেই তিনি থামলেন।

“হ্যা, কি হয়েছে ফুফুর?”, চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করলো হিয়া।

রবীউল সাহেব সবকিছু খুলে বললেন। হিয়া প্রথমে ঠিক বুঝলো না। রবীউল সাহেব সবটা বুঝিয়ে বলতেই হিয়া রীতিমত চমকালো। এতকিছু হয়ে গেলো অথচ সে কিছুই জানে না। হিয়া করুন দৃষ্টিতে রবীউল সাহেবের দিকে তাকালো। কি বলবে সে কিছুই বুঝতে পারছে না।

রবীউল সাহেব হিয়ার এমন অবস্থা দেখে বললেন,” এতো চিন্তা করতে হবে না। তোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু হবে না। এই বিয়েতে তুই রাজি থাকলে তবেই হবে। আর রইলো ডিভোর্স। সেইটা তো একদিন হবার কথাই ছিলো।” বলেই তিনি থামলেন।

হিয়া গভির চিন্তায় পরে গেলো। কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,” এইসব আমার ভালো লাগছে না। এগুলো কি বন্ধ করা যায় না। এই বিয়েটা আমি করতে চাই না।”

” হুম্ তাহলে তো হয়েই গেলো। কিন্তু তোকে একটা কষ্ট করতে হবে। এই কথাটা নিজের মুখে রায়হানকে বলতে হবে। রায়হান বিয়ে থেকে সরে এলেই তোর ফুফু শান্ত হবে।”,

হিয়া সবটা শুনে ভাবনায় পরে গেলো। এই কঠিন কাজটা তাকেই কেনো করতে হবে? হিয়া ভয়ার্ত গলায় বললো,” আমাকেই বলতে হবে?”

” হ্যা, তোকেই বলতে হবে। আর ডিভোর্সের কি করবো?”,বলেই হিয়ার দিকে তাকালো।

হিয়া রীতিমত চিন্তার গভির সাগরে পরে গেলো। এ কোন দ্বিধায় পরলো সে। হিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,” আমি জানি না।”

হিয়ার মধ্যে কেনো অনুভূতি কাজ করছে না কেনো জানি। যা হবার হবে। বেশি ভাবতেও পারছে না। ভাবতে গেলেই কেমন অদ্ভূত খারাপ লাগা কাজ করছে। হারিয়ে ফেলার ভয় তার নেই, কিন্তু তাও কেনো এমন লাগছে। হিয়া চুপ করে রইলো। রবীউল সাহেব আর কিছু বললেন না। হিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন।

হিয়া নিশ্চুপে বসে রইলো। ডিভোর্স হলে কি হবে? শুভ্র আবার বিয়ে করবে? এমনিতেও সে শুভ্রের বউ ছিলো কবে? যা হবার হবে। সে আর ভাববে না। ভেবেও যে সে কিছু করতে পারবে তা তো না।

✨ সকালে ঘুম থেকে উঠে রাবেয়া ফুফুকে নিজের ঘরে দেখে বেশ চমকালো। উনি এই সকালে তার ঘরে কি করছেন। ম্যারিকে রায়হানের কাছ থেকে নিয়ে নিজের কাছে রেখেছে। ম্যারিকে খাটের পাশেই বিছানা করে ঘুমাতে দিয়েছিল হিয়া কিন্তু ম্যারি উঠে হিয়ার মাথার কাছে নাচানাচি করছে। হিয়া চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসলো।

কিছুক্ষণ পর পুরো ব্যাপারটা হিয়ার কাছে পরিষ্কার হলো। ফুফু কিছু শাড়ি সঙ্গে করে এনেছেন। হিয়াকে শাড়িগুলো থেকে একটা পড়তে হবে। কি যন্ত্রণা!রাবেয়া ফুফুর মতন এমন গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ এমন ছেলে মানুষী কেনো করছে তার সঠিক কারণ হিয়া বুঝতে পারছে না।

হিয়া মলিন চোখে শাড়ী পড়তে না জানার অক্ষমতা জানিয়ে ভেবেছিল বেচেঁ যাবে। কিন্তু না ফুফু নিজেই হিয়াকে শাড়ি পরিয়ে দিল। নিজের মুখে কিছু বলতেও পারছে না হিয়া। সকালে ঘুম থেকে উঠে এমনভাবে তাকে শাড়ি পড়তে হবে কোনোদিন চিন্তাও করেনি সে।

ফুফু ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই হিয়া যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। এই বিয়ে ভাঙতেই হবে। এই এলিয়েনটাকে সে কই পাবে। হিয়া ঘর থাকে বেড়িয়ে এলো শাড়ী পড়ে। এলিয়েনটাকে কোথায় যে পাবে? রায়হানকে না পেয়ে হিয়া নিজের রুমে ফিরে যাচ্ছিল। শুভ্রের রুম পেরিয়ে যেতেই হিয়ার একটা ইচ্ছা জাগলো মনে। হিয়া দেওয়াল ঘেঁসে দাড়িয়ে আস্তে করে দরজার পাশ থেকে ঘাড় কাত করে শুভ্রের রূমে উকি দিলো। সে জানে শুভ্র তাকে দেখলেই রেগে উঠবে কিন্তু সকাল সকাল শুভ্রকে রাগিয়ে দিতে খুব ইচ্ছে হলো তার।

শুভ্র টেবিলের থেকে সবেমাত্র নিজের চশমাটা নিয়ে চোখে পড়েছে এর মাঝেই হিয়ার কাত করে থাকা মাথাটা তার চোখে পড়লো। হিয়ার দৃষ্টি বারান্দার দিকে, শুভ্র উঠে এসে একদম হিয়ার সামনে এসে দাড়াতেই হিয়া ভয় পেয়ে ছিটকে সরে দাঁড়ালো। শুভ্র হিয়াকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সাত সকালে এমন শাড়ী পরে ঘুর ঘুর করছে কেনো এই মেয়ে। শুভ্র হিয়ার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে বললো,” এই ভাবে বউ সেজে সকাল সকাল আমার ঘরে উকি মারছ কেনো? বউ হতে ইচ্ছে করছে?”

হিয়া চোখ কপালে তুলে ঘন ঘন না সূচক মাথা নেড়ে বললো,” ভুল ভাল কথা বলবেন না। আমি তো ম্যারিকে খুঁজছিলাম।”

শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালো তারপর বললো,” শাড়ী পড়েছো কেনো?”

হিয়া উপহাস মুলুক হেসে বললো,” কিছু না এমনি। ফুফু বলেছে পড়তে।” এতটুকু বলতেই শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

হিয়ার ভয় লাগলো সে আমতা আমতা করে বলল,” আমি যাই আমার খুব খিদে পেয়েছে। ম্যারিকে দেখলে আমার রুমে যেতে বলবেন।” বলেই কেটে পড়তে নিলো।

শুভ্র রাগী গলায় বললো,” তোমার খরগোশ কি তোমার সাথে থেকে থেকে কথা বলাও শিখে গেছে?”

হিয়া চলে যেতে গিয়েও থামলো তারপর আড় চোখে একবার তাকিয়ে বললো,” ঈশারা করে দিবেন তাহলেই হবে, ও বুঝে যাবে।”

শুভ্র কিছুক্ষণ কঠিন দৃষ্টিতে হিয়ার চলে যাওয়ার দিকে তাকালো।তারপর সজোরে ঘরের দরজা লাগিয়ে দিল। সিড়ি দিয়ে নেমে যেতেই সেই শব্দে হিয়া চোখ বড় বড় করে পিছনে তাকালো। এই লোকের রাগের চাপে কোনদিন দড়জাটা ভেঙে পড়ে।

হিয়া রান্না ঘরে মোহনার সাথে কথা বলছিলো। রায়হান একটা গাজর খেতে খেতে এগিয়ে আসলো। তারপর মোহনার দিকে তাকিয়ে বললো,” আপু আমার বেবিকে দেখেছো?”

মোহনা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বদমাইস ছেলে বলে কি? হিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,” বেবি? আপনার বাচ্চা আছে?”

রায়হান হিয়ার দিকে খেয়াল করতেই হিয়ার পরনে শাড়ি দেখে বিমোহিত হয়ে গেলো। মোহনা সজোরে পিঠে একটা থাপ্পর দিয়ে বললো,” আমি তোর বড় না? আমাকে তুই কী জিজ্ঞেস করিস?”

রায়হান পিঠের সে জায়গা ডলতে ডলতে বললো,” আরে, আমি ম্যারির কথা জিজ্ঞেস করেছি।”

হিয়া খিল খিল করে হেসে উঠে বললো,” ও আমার ঘরে আছে।”

রায়হান হিয়ার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললো,” তোমাকে কিন্তু শাড়িতে সুন্দর লাগে। আই মিন বাচ্চা লাগে না।”

হিয়া রায়হানের এমন মন্তব্যে মোহনার সামনে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। মোহনা আস্তে করে হিয়ার কানের কাছে এসে বললো,” তোমার বরের মনে হয় অনেক হিংসে হচ্ছে।”

হিয়া ভ্র কুচকে মোহনার দিকে তাকালো তারপর ফিসফিসিয়ে বললো,” কে বর? কার কথা বলছো?”

মোহনা ফ্রিজের দিকে ঈশারা করতেই হিয়া আড় চোখে তাকিয়ে দেখলো। শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে রায়হানের দিকে তাকিয়ে আছে। হিয়া মোহনার কানে কানে বললো,” আমি তো ভুলেই গেছিলাম উনি আমার বর।” বলেই হিয়া হেসে ফেললো। রায়হান মোহনা আর হিয়ার এমন ফিসফিস করে কথা বলার মাঝে বললো,” আচ্ছা আমি ম্যারির কাছে গেলাম। তোমাদের ফিসফিসিয়ে কথা ততক্ষনে শেষ করো।”

এর মাঝে শুভ্র রেগে নিজের ঘরে চলে গেল। নিজের বাড়িটা এখন অসহ্যকর লাগছে।

শুভ্র চলে যেতেই মোহনা বলল,” তুমি রায়হানকে বলবে কখন?”

মোহনার প্রশ্নে হিয়া চিন্তিত গলায় বললো,” বুঝতে পারছি না। কিভাবে বলবো?”

” এইসব শেষ করো যত তাড়াতাড়ি পারো। ভাল্লাগছে না আর।”, বিরক্তি প্রকাশ করে বললো মোহনা।

হিয়া হ্যা সূচক মাথা নাড়ল। আজকেই এই বিয়ের কথা শেষ করতে হবে।

সন্ধায় হিয়া ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে। রায়হানকে কি বলবে সেটাই মাথায় গুছিয়ে নিচ্ছে। কি অপ্রীতিকর একটা অবস্থা! রায়হান ম্যারিকে কোলে করে ছাদে উঠলো। আকাশটা আজ তারায় ভরা। রায়হান এগিয়ে এসে হিয়ার পাশে দাঁড়ালো তারপর বললো,” কি ব্যাপার? শুনলাম স্ট্রবেরি আমার খোঁজ করছে?”

হিয়া অন্যমনস্ক ছিলো, রায়হানের কণ্ঠে পাশে তাকাতেই দেখলো রায়হান রেলিংয়ে হাতের ভার দিয়ে দাড়িয়ে আছে। হিয়া ইতস্তত করে বললো,” আমার আপনাকে কিছু বলার ছিলো।”

রায়হান ম্যারিকে ছাদের ছেড়ে দিয়ে বললো,” হুম্, তোমার কথা শুনতেই তো আমি এসেছি।”বলেই পলকহীন দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।

হিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,” আসলে এই বিয়েটা! মানে….. আপনাকে আমি বিয়ে করতে চাই না।”

রায়হান নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
” কারণটা কি জানতে পারি?”

হিয়া একবার রায়হানের দিয়ে তাকালো। তারপর এদিক সেদিক তাকিয়ে বললো,” আমি না সবটা হারিয়েছি। বাবা, মা আমার ছোট ভাইটা সব হারিয়েছি। আমার জীবনে অনেক শুন্যতা ছিলো। কিন্তু এই বাড়িতে আসার পর সেই শুন্যতা ধীরে ধীরে যেনো হারিয়ে গেছে। আর বিয়ে নামক এই সম্পর্কটাতে আমি একবার জড়িয়েছি দ্বিতীয়বার আর জড়াতে চাই না। আর নতুন কাউকেও নিজের জীবনে চাই না।”

” আর যে তোমার জীবনে জড়াতে চায় তার কি হবে?”, সহজ গলায় প্রশ্ন করলো রায়হান।

” মানে?”, ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো হিয়া।

রায়হান সিরিয়াস হয়ে বললো,” আমি কিন্তু তোমাকে ভালোবাসি।”

হিয়া বিস্ময় নিয়ে তাকালো। রায়হানের এমন ভাবহীন ভাবে ভালোবাসার অভিব্যাক্তি হিয়াকে বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে নিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ নিরবতা থাকলেও রায়হান নিরবতা ভেঙে বললো,” তুমি আমায় ভালোবসো?”

হিয়া অবাক হয়ে তাকালো। রায়হান হটাৎ এমন প্রস্ন করছে কেনো? হিয়া গম্ভীর গলায় বললো,” নাহ্।”

” শুভ্রকে ভালোবাসো?”, আবারো কঠিন গলায় বলল রায়হান।

হিয়া দৃষ্টি সামনে রেখে অস্পষ্ট গলায় বললো,” জানি না।”

রায়হান ব্যাথিত সুরে হাসলো তারপর বললো,” হুম। আমার আর শুভ্রের মধ্যে পার্থক্য শুধু একটা শব্দের। এই একটা শব্দের জন্যে আমি আজ হেরে গেলাম।”

হিয়া চুপ করে আছে। এই মুহূর্তে কি বলবে সে সেটা জানে না। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে জানলে হয়তো সে আসতো না।

রায়হান নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,” আমি তাহলে একটাও সুযোগ পাচ্ছি না।” বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

হিয়া শাড়ির আঁচল মুষ্টিবদ্ধ করে বললো,” আপনি আমাকে যেই কথাটা বলেছেন সেটা আর কাউকে, বলবেন না। আপনার কাছে অনুরোধ রইল।”

রায়হান রহস্যময় হাসি হাসলো তারপর বললো,” তোমাকে যে আমি ভালোবাসি এই কথাটা কেউ জানবে না। শুধু আমি আর আমার এই আকাশ জানবে।” তারপর আকাশের নীল তারাটা দেখিয়ে বললো,” তবে আজ থেকে আকাশের ওই নীল তারাটা আমার।”

হিয়া হকচকিয়ে তাকালো। নীল তারার কথা রায়হান কিভাবে জানে। রায়হানের তো এই গল্পটা জানার কথা না। হিয়া বিস্ময় নিয়ে বললো,” আপনি কিভাবে….?” বাকিটা বলার আগেই রায়হান রহস্যময় হাসি দিয়ে চলে গেলো। হিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

রায়হান সেদিন হিয়ার ঘরে হিয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে গিয়ে হিয়ার ছোট্ট ডায়রিটা পড়েছে। সেখানে হিয়া লিখেছিলো। ছোটো বেলায় যখন সে কাঁদতো তখন তার বাবা আকাশের নীল তারাটা দেখিয়ে তার কান্না থামাতো। সেই ছোটবেলা থেকে ওই নীল তারাটাকে নিজের বলে দাবি করে হিয়া। ময়মনসিংহে নিজের ঘরটা তাইতো এতো নীল তারা দিয়ে সাজিয়েছে সে। রাতের অন্ধকারে এই তারাগুলোই তার কান্না থামাতো।
#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_২৪

হিয়া ছাদ থেকে নামছিলো। নামার সময় শাড়িতে পেঁচিয়ে পরে গিয়ে ভীষণভাবে পায়ে ব্যাথা পেলো। হাঁটতে গেলেই ব্যাথা হচ্ছে পায়ে। নিজের উপরেই এখন রাগ লাগছে। কোনোভাবে নিজের রুমে যেতে পারলেই হলো। কিন্তু হটাৎ নিজেকে শূন্যে আবিষ্কার করতেই দেখলো শুভ্র তাকে কোলে তুলে নিয়েছে। হিয়া চোখ বড় বড় করে শুভ্রের দিকে তাকালো। শুভ্র রাগী গলায় বললো,” লাফালাফি একটু কম করতে পারো না।”

হিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। শুভ্র কখন এলো। হিয়া বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো যখন শুভ্র তাকে কোলে করে নিজের রূমে ঢুকলো। হিয়া চোখ পিট পিট করে শুভ্রের দিকে দুইবার তাকালো। তারপর ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,” আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন।” বলতে বলতে শুভ্র হিয়াকে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো।

হিয়া হা করে তাকিয়ে আছে। এইটা কি স্বপ্ন? এই বনমানুষ তাকে নিজের ঘরে এনেছে তাও আবার নিজের বিছানায় এনে বসিয়েছে। হিয়া ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। পা টা কি ভেঙে গেলো নাকি? কয়েকবার আর্তনাদ করতেই শুভ্র এগিয়ে এসে হিয়ার পায়ে স্পর্শ করলো। হিয়া পা সরিয়ে ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে বললো,” কি করছেন? পায়ে হাত দিচ্ছেন কেনো?”

শুভ্র ভ্রু কুঁচকে বললো,” স্টুপিডের মতোন কথা বলবে না। দেখি পা এইদিকে আনো।”

হিয়া রাগী গলায় বললো,” না।” শুভ্র বিরক্ত হয়ে নিজেই এগিয়ে এসে হিয়ার পা থেকে শাড়িটা হালকা উপরে তুলতেই হিয়া ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। হিয়া সঙ্গে সঙ্গে শাড়ী নামিয়ে বললো,” আমি আপনাকে দেখাবো না। আপনি কোনো মহিলা ডাক্টারকে ডাকুন।”

শুভ্র ভীষন রেগে গিয়ে বললো,” শাট আপ। একটাও কথা যদি আর বলেছো।”

শুভ্র হাত বাড়িয়ে হিয়ার পা মচকে গেছে কিনা দেখছে। হিয়া শাড়ির আঁচলটা শক্ত করে ধরে নাক মুখ কুচকে আছে। পায়ে তার ভীষন সুড়সুড়ি কিন্তু এই লজ্জার কথা এই বনমানুষটাকে বলবেই বা কি করে? লোকটা কিছুই বুঝে না। হিয়া কিছুক্ষণ পর হটাৎ ব্যাথাটা আর অনুভব করছে না। শুধু পা নাড়াতেই রগে ব্যাথা হচ্ছে। হিয়া আস্তে করে শাড়ী দিয়ে নিজের পা ঢেকে ফেললো। শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো ,” চুপচাপ এইখানে বসে থাকো আমি আসছি।” বলেই শুভ্র বেড়িয়ে গেলো।

হিয়া বসে আছে, শুভ্রের ঘরটা দেখছে। দেওয়াল গুলো একদম সাদা। শুধু একটা দেওয়াল ধূসর রঙের। আর পর্দাগুলো হালকা নীল রঙের। খুব গুছানো একটা ঘর। মেয়ে হয়েও তো সে নিজের ঘর এমন সুন্দর করে গুছিয়ে রাখে না। হটাৎ কেনো জানি তার এই ঘরে থাকতে ইচ্ছে করছে। ঘর সাজানো হিয়ার তেমন পছন্দ হয়নি কিছু ওয়ালম্যাট থাকলে ভালো হতো। কিন্তু তাও শুভ্রের সাথে থাকটে ইচ্ছে করছে। অদৃশ্য হওয়ার ক্ষমতা থাকলে সে এই ঘরে থেকে দেখতো লোকটা সারাদিন এই ঘরে কি করে।

শুভ্র কিছুক্ষণ পর আইস কিউব নিয়ে ঘরে ঢুকলো। তারপর হিয়ার পাশে বসে হিয়ার পা নিজের কোলে নিতেই হিয়া বেশ চমকালো। শুভ্র খুব যত্ন করে লাল হয়ে যাওয়া জায়গায় বরফ দিচ্ছে। ছোটো বেলা থেকে একটু পরে গেলেই হিয়ার ফর্সা গায়ে সেটা রক্তিম বর্ন ধারণ করতো। শুভ্র একবার হিয়ার দিকে তাকিয়ে ব্যাথা কমেছে কিনা জানতে চাইলো। হিয়া বললো ব্যাথা কমেনি কিন্তু ব্যাথাটা অল্প আছে। মিথ্যে বলেছে কেনো সে জানে না। হয়তো শুভ্রের তার প্রতি এই যত্ন তার ভালোলাগছে।

শুভ্র আবারো জিজ্ঞেস করলো,” একটুও ব্যাথা কমেনি?” শুভ্রের ধারণা অনুযায়ী ব্যাথাটা কমে যাওয়ার কথা।

হিয়া না সূচক মাথা নাড়লো। তারপর ব্যাথাতুর মুখভঙ্গি করলো। শুভ্র কয়েকবার পলক ফেলতেই রবীউল সাহেব আর সাহারা খাতুন ঘরে ঢুকলেন। দুজনেই হিয়াকে শুভ্রের ঘরে দেখে চমকালেন। হিয়ার তাদের চেহারার সে চমক দেখতে পাচ্ছে।

সাহারা খাতুন অবাক ভঙ্গিতে বললেন,” ওর পায়ে কি হয়েছে?”

শুভ্র বরফের বাটিটা একপাশে রাখতে রাখতে বললো,” সিড়িতে পড়ে গেছে।”

রবিউল সাহেবের সেইদিকে কোনো চিন্তা নেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো,” হিয়া এইঘরে কি করে এলো?” এই প্রশ্নে হিয়া বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। ইস নিজের রুমে চলে যাওয়া উচিৎ ছিলো।

শুভ্র নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,” আমি এনেছি। কেনো তোমার কোনো সমস্যা?”

শুভ্রের এমন প্রশ্নে রবীউল সাহেব রেগে গিয়ে বললেন,” সামনে ওর বিয়ে আর তুমি ওকে কেনো তোমার ঘরে এনেছো? এই রহিমা, রহিমা।” বিয়ের প্রসঙ্গটা শুধু শুভ্রকে রাগাতে বলেছেন তিনি। ঈশারায় হিয়াকে বুঝ দিলেন। খালা রীতিমত ছুটে আসতেই রবীউল সাহেব বললেন,” হিয়াকে ধরে নিজের রুমে দিয়ে আয়।” আর কিছু বলার আগেই শুভ্র কঠিন গলায় বললো,” হিয়া কোথাও যাবে না।”

শুভ্রের মুখে নিজের নাম শুনে হিয়া ভীষন অবাক হলো। কিন্তু ছেলের এমন উক্তিতে রবীউল সাহেব বললেন,” হিয়াকে তোমার ঘরে রাখার অনুমতি আমি কখনোই দিবো না।”

শুভ্র একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,” তোমার কাছে অনুমতি চেয়েছে কে?”

সাহারা খাতুন কঠিন গলায় তার স্বামীকে বললেন,” বুড়ো হয়েছো। কিন্তু বুদ্ধি জ্ঞান সব কি দিন দিন হারাচ্ছো? চুপ চাপ নিজের ঘরে এসো। হিয়া এখন থেকে এই ঘরেই থাকবে।” বলেই রবীউল সাহেবকে টেনে ঘর থেকে বের করে আনলেন। তারপর বেড়িয়ে এসে আরো বললেন,”এই বিয়ের চ্যাপ্টার বাদ। এই নিয়ে যদি আর কোনো বাড়াবাড়ি তুমি করেছো। আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। তুমি আর তোমার বোন থেকো।” সাহারা খাতুনের এমন রূপ রবীউল সাহেব এর আগে দেখেনি।

হিয়া শেষের কথাটা শুনেই লাফিয়ে খাট থেকে নেমে পড়লো। লাফাতে গিয়ে পায়ে একটু ব্যাথা অনুভব হলো। অ্যহায় শাশুড়িটা বলে কি? হিয়া শুভ্রের ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজার সামনে আসতেই শুভ্র দরজা লাগিয়ে দিয়ে কড়া চোখে হিয়ার দিকে তাকালো।

হিয়া ভয়ার্ত গলায় বললো,” আমার পা ঠিক আছে। আমি হেঁটে হেঁটে নিজের রুমে যেতে পারবো। আমার প্রতি এতো সহমর্মিতা দেখানোর জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।” শেষের কথাটা শুনে শুভ্র ভ্রু কুঁচকে ফেললো তারপর বললো,” চুপচাপ গিয়ে বিছানায় বসো। একদম দরজা খোলার চেষ্টা করবে না।”

” মানে? কি আশ্চর্য। আমাকে যেতে দিন।”,বলেই এগিয়ে এসে দরজা খোলার চেষ্টা করলো। শুভ্র এক হাত পকেটে ভরে অন্যহাতে দরজার লক ধরে আছে। হিয়া নিজের সর্ব শক্তি দিয়েও পারছে না। এতক্ষণ এই ঘরে থাকার ইচ্ছে হলেই শাশুড়ির শেষ বাক্যটি কানে আসতেই সে ইচ্ছে কর্পুরের মতন উড়ে গেছে।

শুভ্র স্থির দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। পায়ে ব্যাথা নিয়েও কিভাবে দরজা খোলার জন্য এই মেয়ে লাফাচ্ছে। শুভ্র তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,” তুমি নিজে গিয়ে বিছানায় বসবে নাকি আমায় নিয়ে যেতে হবে। তোমার পায়ের ব্যাথা কি উড়ে গেছে?”

” আমি এই ঘরে থাকবো না।”, রেগে বললো হিয়া।

শুভ্র দরজার লক থেকে হাত সরিয়ে শার্টের হাতা ভাজ করে বললো,” আমাকে বলছো কেনো? সাহস থাকে তো আমার মাকে গিয়ে বলো।”

শুভ্র লক থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছে, চোখ পড়তেই হিয়া দরজা খুলে পালাবে তার আগেই শুভ্র হিয়াকে কোলে তুলে নিলো। হিয়া পরাজয় মেনে নিলো কারণ তার পায়ে এবার সত্যিই ব্যাথা হচ্ছে। শুভ্র হিয়াকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললো,” এবার তো তুলে এনেছি এইখান থেকে নামবে তো পরের বার বেধে রাখবো।”

” আপনি তো আমাকে আপনার রুমে এলেই গেট আউট গেট আউট করতেন এখন আবার আপনি আমাকে যেতে দিচ্ছেন না কেনো?”, বিস্ময় নিয়ে বললো হিয়া।

শুভ্র উত্তরে কিছু বললো না। হিয়া গভির চিন্তায় পড়ে গেলো। শুভ্র কি তাহলে নিজে থেকে চাইছে সে তার কাছে থাকুক। এই বনমানুষটা এমন কিছু চাইতে পারে বলে তো মনে হচ্ছে না। একটু বাজিয়ে দেখলে কেমন হয়। হিয়ার এইবার রবীউল সাহেবের ঈশারা আন্দাজ করতে পারছে।

হিয়া একটু সাহস জুগিয়ে বললো,” দেখুন কিছুদিন পর আমার বিয়ে আপনি এইভাবে আমাকে আপনার ঘরে রাখতে পারেন না। আর এমনিতেও আপনি আমাকে জোর করতে পারেন না।”

হিয়ার এমন উক্তিতে শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে হিয়ার দিকে এগিয়ে এসে বললো,” বিয়ে… তোমার? ভেরি গুড। স্টে ইন ইউর ড্রীমস।”

হিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,” মানে। কি বলতে চান আপনি?”

শুভ্র পকেটে হাত ভরে শান্ত দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,” হু ইজ স্ট্যান্ডিং ইন ফ্রন্ট অফ ইউ?”

হিয়া দুইবার পলক ফেললো এইটা আবার কেমন প্রশ্ন? এই লোকটা কি নিজের নাম ভুলে গেছে? হিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,” শুভ্রনীল আহমেদ।” অনেকটা খাপ ছাড়া ভাবেই বললো হিয়া।

” নো। অ্যাম ইউর হাসব্যান্ড।”, গম্ভীর গলায় বললো শুভ্র। চোখে মুখেই শুভ্রের কথাটার গাম্ভীর্য টের পাচ্ছে হিয়া।

হিয়া এক মুহূর্তের জন্যে থমকে গেলো। শীতল শিহরণ বয়ে গেলো হিয়ার মাঝে। হিয়া জড়ানো গলায় বললো,” আচ্ছা, আমার তো মনেই ছিলো না। অবশ্য মনে থাকার মতো কিছু আপনি করেছেন বলে মনে হয় না।” হিয়া নিজে নিজেই বির বির করছিল।

শুভ্র সবটা শুনে পকেট থেকে হাত বের করে হিয়ার দুপাশে রেখে ঝুকে আসতেই হিয়া হকচকিয়ে উঠে বললো,” কি করছেন আপনি?”

শুভ্র শীতল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ হিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। যে দৃষ্টি হিয়াকে অনায়াসে কাবু করে ফেলে। ছটটফট হিয়া তখন শান্ত হয়ে সেই দৃষ্টিতে হারিয়ে গেলো। হিয়ার আঁচলে মুষ্টিবদ্ধ হাত দুটো নিজের হাতের ভাজে আটকে পরক্ষণেই হিয়ার ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে দিলো। তারপর গভীরভাবে কিস করলো। শুভ্রের হটাৎ এমন আচরনে হিয়া পরক্ষনেই চোখ বন্ধ করে ফেললো। প্রতি মুহুর্তে হৃদ কম্পন যেনো কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে।শুভ্রকে সরিয়ে দেওয়ার কোনো উপায়ও তার কাছে নেই।

কিছুক্ষণ পর শুভ্র সরে আসতেই হিয়া মাথা নিচু করে জোরে জোড়ে নিশ্বাস নিতে লাগলো। লজ্জায় গাল দুটোয় রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে।

শুভ্র এক হাত দিয়ে হিয়ার চিবুক ছুঁয়ে মুখটা উপরে তুলেতেই হিয়া চোখ বন্ধ করে ফেললো। শুভ্র তার প্রিয়দর্শিনীর লজ্জায় ভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে আরেকটু কাছে এসে বললো,” এরপর থেকে মনে রাখবে। শুভ্রনীল আহমেদ, তোমার হাসব্যান্ড।” কথাটা শুনতেই হিয়ার শরীর শিউরে উঠলো।

[ #চলবে ]
[ #চলবে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here