নীলচে তারার আলো পর্ব -২১+২২

#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_২১

শুভ্রের মনে দুষ্ট একটা ইচ্ছে জাগতেই শুভ্র হিয়ার কোমড়ে থেকে হাতটা হালকা সরিয়ে আনলো হিয়া ব্যালেন্স হারিয়ে আরো সামনে ঝুঁকে আসতেই শুভ্রের সাথে হিয়ার ঠোঁট মিলে গেলো। হিয়ার কাছে পুরো বিষয়টা অপ্রত্যাশিত হলেও শুভ্রের কাছে এটাই প্রত্যাশিত ছিল। কয়েক মুহূর্তের জন্যে হিয়া থমকে গেলো, শুভ্রের চোখে চোখে পড়তেই পরক্ষণে সে শুভ্রের কাধ থেকে দুহাত সরিয়ে নিজেও সরে এলো।হিয়া লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। এটা কি হলো একটু আগে। যতবার চিন্তা করছে ততোবার যেনো নতুন করে সবটা অনুভব করছে সে।

এইসবের মাঝে শুভ্র নির্বিকার দৃষ্টিতে হিয়ার লজ্জায় রক্তিম চেহারাটা উপভোগ করছে। হিয়া অনেক কষ্টে নিজেকে বুঝিয়ে শান্ত করলো যে এইটা একটা অ্যাকসিডেন্ট, শুধু অ্যাকসিডেন্ট। তার মধ্যেই শুভ্র হটাৎ হিয়ার কোমড় জড়িয়ে টেবিল থেকে নীচে নামিয়ে দিতেই আবারো কেপে উঠলো হিয়া। নিচে নামতেই কোমড় থেকে শুভ্রের হাত সরিয়ে অনেকটা দূরে সরে দাঁড়ালো সে। কি করবে,কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না হিয়া। মাথাই কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে তার। শুভ্র নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করে বললো,” লাফালাফি একটু কম করতে পারো না।”

হিয়া লজ্জায় আরো লাল হয়ে গেল। এখন তার সত্যি মনে হচ্ছে এইটা তার ভুল। কি করে এমন একটা ভুল করলো সে? শুভ্রকে নিজের মুখ আর কোনোদিন দেখাবে না সে। ইস কি লজ্জা !

🦋
শুভ্র পকেটে দুই হাত ভরে হাঁটছে। হিয়া তার কিছুটা সামনে জড়সড় হয়ে হাঁটছে। হাত দুটো সামনে এনে মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। নিজেকে অদৃশ্য চাদরে মুড়িয়ে যদি লুকিয়ে ফেলা যেত, খুব ভালো হতো।

সবাই রীতিমত ব্যাস্ত হয়ে ওদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। রায়হান তখন থেকে ছুটছে। হিয়াকে দেখে হাপাতে হাপাতে এগিয়ে এলো রায়হান তারপর সামনে এসে থামলো। দুই হাঁটুতে ভর দিয়ে হাপাতে হাপাতে বলল,” কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”

হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকালো। হিয়া কিছু বুঝে উঠার আগেই পিছন থেকে শুভ্র বললো,” আমার সাথে ছিলো।”

হিয়া সঙ্গে সঙ্গে চোখ বড় বড় করে শুভ্রের দিকে তাকালো। লোকটা কি আজ তাকে বদনাম করে ছাড়বে?

রায়হান ভ্রু কুঁচকে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্রের কথাটা কেমন যেনো লাগলো তার কাছে। শুভ্র এগিয়ে এসে হিয়ার পাশে দাড়ালো। রায়হান হিয়ার দিকে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন করলো,” কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?”

হিয়ার প্রচন্ড অসস্তি হলো কি শুরু করেছে এরা! শুভ্রের কাছাকাছি থাকতেও তার লজ্জা লাগছে। হিয়া কোনো কথা না বলে হনহনিয়ে সামনে হেঁটে দিবার কাছে চলে এলো।

শুভ্র আর রায়হান একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। রায়হান তৃতীয়বারের মত প্রস্ন করলো,” কোথায় ছিলি তোরা?”

” দ্যাটস নান অফ ইউর বিজনেস।”, ভ্রু কুঁচকে বললো শুভ্র। চোখে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।

রায়হান শুভ্রের এমন ব্যাবহারে রীতিমত অবাক হয়ে বললো,” হোয়াট ননসেন্স? অ্যাম গোয়িং টু ম্যারি হার। আর তুই আমাকে বলিস এইটা আমার বিষয় না। তুই এইভাবে কথা বলছিস কেন?”

শুভ্র তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসলো তারপর বললো,” এভাবে কেনো বলছি সেটা খুব তাড়াতাড়ি তুই বুঝতে পারবি।” বলেই শুভ্র রায়হানকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।

শুভ্রের এমন ব্যাবহারের কারণ রায়হান ঠিক ধরতে পারছে না। খুব অদ্ভুত লাগছে সত্যি কিন্তু রাগও হচ্ছে প্রচুর। রায়হানের মনে ক্ষীণ এক সন্দেহ জাগলো।

তার মা যখন হিয়াকে বিয়ের কথা বলেছিল রায়হান সময় চেয়েছে কিছুদিন। কারণ হিয়াকে সে নিজের মনের কথা বলতে চায় কিন্তু তার আগে হিয়ার মনের কথাও তার জানা দরকার।

রায়হান বাড়ি ফিরে সোজা নিজের মায়ের ঘরে গিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ের আয়োজন করতে বললো।

এতো রাতে ছেলের মুখে বিয়ের কথা শুনে তিনি কিছুটা চমকালেন। এতকাল বিয়ে করতে চায় নি হটাৎ এতোই বিয়ে করতে ইচ্ছে হলো যে এত রাতে এসে বলছে তাড়াতাড়ি বিয়ের আয়োজন করতে।

সকালে উঠে রবীউল সাহেব এমন একটা পরিস্থিতির স্বীকার হবেন ভাবতে পারেন নি। হটাৎ করেই তার বোন উঠে পড়ে লেগেছে বিয়ের আয়োজন করতে। হিয়ার মামাকে ফোন করাতে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছেন। হিয়ার মামা এমন একটা খবর শুনলে কি মনে করবে সেটা ভেবেই রবীউল সাহেব কিছু বলছেন না। নিজের বোনকে ম্যানেজ করছেন নানা রকমে।

হিয়া আর শুভ্রের বিয়ের কথাটা জানানো বাকি। বোনকে শান্ত করতে কথাটা বলেই দিলো রবীউল সাহেব।

হিয়া আর শুভ্রের বিয়ে হয়েছে কথাটা শুনে ঘণ্টা খানেক চুপ থেকে আবার রেগে উঠে বললেন,” বিয়ে কিসের বিয়ে? আলাদা আলাদা থাকে এইটা কোনো বিয়ে হলো নাকি? কবে না কবে ডিভোর্স হবে ততদিন অপেক্ষা করবে আমার ছেলে? শোন তুই জলদি লয়ার সাথে কথা বল। দুদিনেই ডিভোর্সের ব্যাবস্থা হবে, যত টাকা লাগে আমি দিবো।”

সবক্ষেত্রেই তার বোনের এমন বাড়াবাড়ি। তবে মনটা খারাপ না তার বোনের, হিয়াকে যত্নেই রাখবে যদি হিয়া তার বউ হয়। এ বাড়ির মানুষগুলোর মতন ওকে হেলাফেলা করবে না। নিজের বলা কথায় নিজেই এতো বাজে ভাবে ফেঁসে যাবেন রবীউল সাহেব চিন্তাও করতে পারেন নি। কি বলে হিয়ার মামাকে বুঝ দিবেন। সেই লোকটাকে মুখ দেখাবেন বা কি করে?

সাহারা খাতুন ভেবেই রেখেছেন। এই নাটক তিনি বেশিদিন চলতে দিবেন না। তার ছেলের সংসার তিনি ভাঙতে দিবেন না। রাবেয়া আক্তার বেশি বাড়াবাড়ি করলে কাজী ডেকে দরকার প্রয়োজনে হিয়া আর শুভ্রের আবার বিয়ে দিয়ে দিবেন। তখন এই বিয়ে সবাইকে মানতে হবে। লোকে শুনলে কি বলবে এইটা কি সিনেমা? সিনেমাতেও এতো নাটক হয় না। আর এরা ভাই বোন যা শুরু করেছে।

যাকে নিয়ে এতো কিছু সে গালে হাত দিয়ে কলেজে ধর্ম স্যারের কথা শুনছে। ক্লাস শেষের বেল পড়তেই হাসান স্যার চলে গেলো। দিবা হিয়ার এমন হাল দেখে বললো,” কি রে কি হয়েছে তোর?”

হিয়ার ভীষন লজ্জা লাগছে। কালকের ঘটনা তো হলোই সকালে শুভ্রকে স্বপ্নে দেখছে সে। সেই স্বপ্ন কাউকে বলার মতন না। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে হিয়ার।

কালকে হটাৎ কোথায় হারিয়ে গেছে জানতে চাইলে হিয়া অনেক কিছু বলে সবাইকে বুঝ দিয়েছে। কিন্তু সত্যিটা দিবা থেকে আর লুকিয়ে রাখতে পারলো না সে। নিচু স্বরে আস্তে আস্তে দিবার কানে কানে বলতেই দিবা রসগোল্লার মতন চোখ করে বললো,” কি? তুই আর শুভ্র ভাইয়া…..! এই তুই আমাকে আগে বলবি না আমি একটা ছবি তুলে আমার বোনটাকে দেখতাম।”

হিয়া আড় চোখে তাকিয়ে বললো,” আগে বলবো মানে? আমি কি ইচ্ছে করে করেছি নাকি?”

দিবা কান্নার ভান করে বললো,” আমার বিয়ে হবে কবে? একটা জামাই পেলে আমিও রোমান্স করতে পারতাম। ওই চশমিশ বিলাইটা তো আমাকে দেখলেই উল্টো দিকে হাটা দেয়। ভাল্লাগে না।”

” তুই এখনো ওই বিলাইয়ের পিছনে আছিস?”,হিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।

” হ্যা, ওই চশমিশ বিলাই ইভানকে তো আমি ছাড়ছি
না।”,মুখ বাঁকিয়ে বললো দিবা।

হিয়ার এবার সত্যি মনে হচ্ছে দিবার জন্যে একটা বর খুঁজতে হবে। বরের শোকে মেয়েটা দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। বলেই হিয়া মনে মনে হাসলো।

ছুটির পর হিয়া নাচতে নাচতে বের হলো।আজ বাড়ি গিয়ে ম্যারিকে সাথে নিয়ে গোসল করবে। ম্যারি এতো কিউট। হিয়ার ইচ্ছে করে কলেজে তাকে সঙ্গে করে আনে। কিন্তু দারোয়ান তো ঢুকতেই দিবে না আর প্রিন্সিপাল তো আছেই। হিয়া বের হয়ে গাড়ির সামনে এসে দেখে শুভ্র দাড়িয়ে আছে।

হিয়া ঘন ঘন দুবার পলক ফেললো। কি যে হয়েছে তার? স্বপ্নেও শুভ্রকে দেখে ঠিক আছে তাই বলে যেখানে সেখানে দেখবে? ঠিক আছে যেহেতু এইটা তার হেলসিনেশন তাহলে লোকটাকে গিয়ে কিছু কথা শুনিয়ে দেই। বাস্তবে তো বলতে পারি না সপ্নে তো আরো পারি না। হেলসিনেশনে পারতেই হবে। হিয়া হনহনিয়ে এগিয়ে এলো। ভ্রু কুঁচকে শুভ্রের সামনে কোমরে দুই হাত দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।

শুভ্র হটাৎ হিয়ার এমন আচরণ দেখে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালো। হিয়া ভ্রু তুলে আবার নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,” কি?…. কি সমস্যা আপনার? যেখানে যাই সেইখানে আপনি। বাড়িতে আপনি, ঘুমাতে গেলে স্বপ্নেও আপনি, কলেজে এসেছি এইখানেও আপনি। আর কত জ্বালাবেন আপনি আমাকে?”

শুভ্র হিয়ার এমন আচরণে শুভ্র এদিক সেদিক তাকালো। লোকজন তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।

” মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে তোমার? রাস্তায় কি শুরু করেছো?”,একটা ভ্রু তুলে বললো শুভ্র।

হিয়ার রীতিমত হা করে তাকিয়ে আছে। এর আগেও হেলোসিনেশনের সাথে সে ঝগড়া করেছে কিন্তু কখনো জবাব পায় নি। কিন্তু একি আজ দেখি কথাও বলছে। হিয়া শুভ্রের সামনে ঘন ঘন হাত নাড়লো। শুভ্র রাগী চোখে হিয়ার দিকে তাকালো। তারপর চারপাশে তাকালো। কলেজের ছেলে মেয়েরা রীতিমত হাসাহাসি করছে। শুভ্র হিয়ার হাতটা ধরে নামিয়ে রাখতেই হিয়া চোখ ছানাবড়া করে ফেললো।

তার মানে কি? তার সামনে শুভ্র দাড়িয়ে আছে। হিয়া দুবার চোখের পাতা ফেলে একটা ঢোক গিলে বললো,” তারমানে আপনি সত্যি…। হে হে আমি তো বুঝিই নাই।”

শুভ্র নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হিয়ার হাত ধরে টেনে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে বললো,” হুম, আমি সত্যি। তোমার কোনো হেলোসিনেশন না কিংবা তোমার রাতের বেলার স্বপ্ন না।” শেষের কথাটা শুনেই হিয়ার গা শিউরে উঠলো। হিয়া বিষয়টাকে কিভাবে ঢাকা দিবে সেটা মনে মনে সাজাতে লাগলো। এর মাঝে সিটবেল্ট লাগাতে গিয়ে শুভ্র আরেকটু কাছে এসে হিয়ার চোখের দিকে তাকাতেই মাথায় সাজানো সব কথা ভুলে গেলো সাথে হার্ট বিট অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেলো তার। শুভ্রের শীতল চাহনিতে ছটফট হিয়া একদম শান্ত হয়ে গেল।

শুভ্র সেই দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে নীচের ঠোঁট কামড়ে বললো,” রাতের বেলায় আমাকে নিয়ে কি স্বপ্ন দেখো তুমি?”

হিয়া শুভ্রের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। কিছু যে বলবে গলা দিয়ে আওয়াজ পর্যন্ত বের হচ্ছে না তার। শুভ্র দৃষ্টি সরিয়ে ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি রেখে বেড়িয়ে এসে ড্রাইভিং সিটে বসলো।#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_২২

হিয়া বাহিরে দৃষ্টি রেখে চুপচাপ বসে আছে। অন্যদিন গাড়িতে বসলে ঘুমে ঢলে পড়লেও আজ সে একদম সজাগ। শুভ্র এর মধ্যে বাড়ির দিকে যাবার রাস্তাটা পাশ কাটিয়ে অন্য মোড়ে ঢুকেছে। হিয়ার মনে প্রস্ন তো জেগেছে কিন্তু সে চুপচাপ। শুভ্রকে প্রশ্ন করতেও কেমন জানি ইতস্তত বোধ করছে সে। আচ্ছা এর আগে তো কোনোদিন এই হিয়া এতো ভাবেনি কোনো ছেলেকে নিয়ে। অথচ এখন কিনা প্রতিটা মুহূর্তে শুভ্রের চিন্তা তার মাথায়। হিয়া আড় চোখে একবার শুভ্রের দিকে তাকালো। শুভ্রের দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির।

প্রশ্ন করার চিন্তা হিয়া মাথা থেকে দূর করলো। যেখানে ইচ্ছে যাক, দিন শেষে বাড়ি পৌঁছালেই হলো।

শুভ্র গাড়ি থামালো শহর থেকে দূরে কোলাহল বিহীন নির্জন এক বিলের ধারে। বিলের একপাশে বিশাল খালি মাঠ। সেই মাঠের পাশ দিয়ে রাস্তা।

শুভ্র কোনো কিছু না বলেই গাড়ি থেকে নামলো। তারপর ঘুরে এসে হিয়ার পাশের দরজাটা খুলে ঝুকে এসে বললো,” সিটবেল্ট কি নিজে খুলবে নাকি আমায় খুলে দিতে হবে?”

হিয়া রীতিমত হকচকিয়ে তাকালো। শুভ্র চোখে হাসছে। হিয়া চটজলদি সিট বেল্ট খুলতেই শুভ্র গাড়ির সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো। হিয়া গাড়ি থেকে বেরিয়ে এমন মনোরম দৃশ্য দেখবে কল্পনাও করেনি। কি সুন্দর জায়গাটা! হিয়া অবাক হয়ে চারিপাশ দেখতেই শুভ্র হিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। হিয়া পলক ফেলে শুভ্রের বাড়িয়ে দেওয়া হতের দিকে তাকালো। শুভ্র কি তার হাত ধরতে চাইছে? হিয়া চোখ তুলে একবার শুভ্রের দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভিতরটা ধুক করে উঠলো তার। হিয়া হাত বাড়াতে গিয়ে সংকোচ বোধ করছে।

শুভ্র পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নিজেই হাত বাড়িয়ে হিয়ার হাতটা ধরলো। তারপর হাতটা শক্ত করে ধরে সামনে যেতে লাগলো।

কিছুদূর যেতেই চোখে পড়লো কয়েকটা জলকুটির। দেখেই হিয়ার চোখ মুখ আনন্দে ভরে গেল। জায়গাটা এতো সুন্দর যে হিয়া সারাবেলা এই কুটিরে বসে কাটিয়ে দিতে পারবে।

জায়গাটা শুভ্রের খুব পছন্দের। এতো সুন্দর জায়গায় প্রচুর ভিড় থাকার কথা হলেও যারা এখনে আসে তারা কেমন জানি শান্ত হয়ে যায় প্রকৃতির এই রূপে।

এই কুটিরে মাত্র একজন বৃদ্ধ আছে তাদের ছাড়া। হিয়া এতক্ষণ এদিক সেদিক হেঁটে পুরো জায়গাটা সুন্দর করে দেখেছে। এখন সে কুটিরে একপাশে দাড়িয়ে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
শুভ্র এগিয়ে এসে হিয়ার দুপাশে কুটিরের রেলিংয়ে হাত রেখে দাড়ালো। তারপর হিয়ার কাছাকাছি এসে বলো,” এইটা আমার প্রিয় একটা জায়গা।”

হিয়া শুভ্রের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। শুভ্রর দৃষ্টিতে যে তার দিকেই স্থির ছিলো। না তাকালে হয়তো সে বুঝতে পারতো না। এবার চেস্টা করেও হিয়া চোখ ফিরাতে পারলো না শুভ্রের সে দৃষ্টি থেকে। নেশার মতন তাকে গ্রাস করেছে সে দৃষ্টি। হিয়া শুভ্রের দিকে তাকিয়েই বললো,”হুম্, অনেক সুন্দর জায়গাটা। কিন্তু আপনি আমাকে এইখানে এনেছেন কেনো?” খুব সাহস করে প্রশ্ন করলো হিয়া।

শুভ্র মুখটা আরেকটু এগিয় আনতেই দুরুত্ব যেনো একেবারে কমে গেলো। শুভ্রের নিশ্বাস আছড়ে পড়ছে হিয়ার ঘাড়ে আর গলায়। শুভ্রকে নিজের এতো কাছে আবিষ্কার করেও হিয়া নড়তে পারলো না। গোধূলির এই হলদে আভায় কেনো জানি শুভ্রের গাল ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে তার। সেই নেশা আরো গভীর ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে শুভ্রের চোখে।

শুভ্র ঘোর লাগা কণ্ঠে বললো,” তুমিই একমাত্র যাকে আমি এই জায়গায় এনেছি।”

কথাটা যেনো হিয়াকে একদম অবশ করে ফেলেছে।
শুভ্রের চোখের ভাষা যেনো সে পড়তে পারছে। শুভ্রের এই ঘোর থেকে বেড়িয়ে আসা দরকার কিন্তু কিছুতেই সে তা পরছে না। হয়তো সে চাইছেও না।
শুভ্র এগিয়ে এসে হিয়া ঠোঁট স্পর্শ করার আগে সেই বৃদ্ধ লোকটা হালকা কাশির আওয়াজ করলো। এতে হিয়ার ঘোর ভাঙলো। চোখ বড় বড় করে মুখ ঘুরিয়ে ফেললো সে। হিয়া লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। এমন একটা জায়গায় সবার সামনে কি করতে যাচ্ছিল।

শুভ্র ভ্রু কুঁচকে বৃদ্ধ লোকটার দিকে একবার তাকালো। লোকটা মিট মিট করে হাসছে। হিয়া রীতিমত শুভ্রের হাতের নিচে দিয়ে বেরিয়ে অন্যদিকে এসে দাড়ালো।

ফেরার সময় হিয়া কোনো কথা বললো না। সবটা সময়ে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। তবে শুভ্রের বলা শেষ কথাটা ভাবতেই ভালোলাগছে তার।

হিয়া গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে নিজের রূমে চলে গেলো। রুমে ঢুকে বাতি জ্বেলে দিতেই, বড় রকমের একটা শক খেলো সে। রীতিমত চিৎকার করতে গিয়েও নিজেকে থামিয়ে নিলো হিয়া। রায়হান ম্যারিকে কোলে করে টেবিলের পাশে দাড়িয়ে আছে। হিয়াকে এমন চমকে উঠতে দেখে বললো,” রিলাক্স। ভয় পেয় না।”

” আপনি তো আসলেই একটা এলিয়েন। এভাবে হুটহাট সামনে আসেন কেনো?”, ভয়ার্ত গলায় বললো হিয়া।

” এলিয়েন? বাহ্ নামটা তো সুন্দর। তোমার চয়েস অফ ওয়ার্ড অনেক ভালো।”,বলেই হাসলো সে।

হিয়া হা করে তাকিয়ে আছে। তারপর নিজেকে শান্ত করে বললো,” আপনি এই অন্ধকার রূমে কি করছিলেন?”

” কিছুই না তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আর আমার অন্ধকার একটু বেশি পছন্দ।”,বলতে বলতে এগিয়ে এলো রায়হান।

” আমার জন্যে? কেনো?”,অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো হিয়া।

” তোমার সাথে কিছু কথা বলার ছিলো।”, বাকিটা বলার আগেই শুভ্র দরজার পাশে এসে দাড়ালো। দেখে তো মনে হচ্ছে এক্ষুনি বাহির থেকে এসেছে। রায়হান শুভ্রর দিকে তাকিয়ে রক্তিম চোখে বললো,
” তোমরা দুজন কি একসাথে ফিরলে?”

রায়হানের প্রশ্নে হিয়া পিছনে তাকালো। পিছনে শুভ্রকে দেখে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেল সে। হিয়া কিছু বলার আগেই শুভ্র রায়হানের উদ্দেশ্যে বললো,” একচুয়ালি আমি তোকেই খুঁজছিলাম। তোর সাথে আমার কথা আছে। আমার রুমে আয়।”

” কিন্তু আমি এখন হিয়ার কাছে এসেছি। তোর কথা না হয় পরেই শুনলাম।”, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো রায়হান।

শুভ্রের রাগ হলো প্রচুর শুধু হিয়া আছে বলে সে রাগটা দমিয়ে রেখেছে। হিয়া নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। এরা কি এমন গম্ভীর ভাবেই একে অপরের সাথে কথা বলে? এদের এই ঘর থেকে বিদেয় করা লাগবে। এদের এমন রোবোটিক কথা শুনার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই তার।

হিয়া এদিক সেদিক তাকিয়ে বললো,” আপনারা দুজনেই এখন নিজ নিজ রুমে চলে যান। আমি ফ্রেশ হবো।” কথাটা বলে শেষ করার আগেই শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে রায়হানের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো।

হিয়া কথাটা শেষ করে পিছনে তাকিয়ে দেখলো শুভ্র নেই। রায়হান হালকা হেসে সহজ গলায় বললো,” আচ্ছা, তাহলে তুমি ফ্রী হলে আসবো। তবে একটু ডিস্টার্ব করি। ম্যারিকে রেখে যাই তোমার কাছে।”

হিয়া খুশি হয়ে গেলো। ছুটে এসে হাত বাড়িয়ে ম্যারিকে কোলে নিয়ে নিলো। রায়হান কয়েক সেকেন্ড হিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেলো। রায়হান চলে যেতেই হিয়ার নিজের রুমের দরজা আটকে দিলো। তারপর ম্যারিকে সাথে করে শাওয়ারে ঢুকলো।

রাতে শুভ্র রায়হানের ঘরে এলো। রায়হান কাউচে বসে ভিডিও গেম খেলছিল। শুভ্রকে দেখে বললো,” বাহ্ সূর্য কোন দিকে অস্ত গিয়েছে? তুই আমার ঘরে?” দৃষ্টি তার গেমের দিকে। শুভ্র ঘরে এসেই টিভিটা বন্ধ করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে রায়হান ভ্রু কুঁচকে তাকালো। শুভ্র টিভির সামনে পকেটে হাত ভরে দাড়ালো।

রায়হান বিরক্তির সুরে বলল,” তুই এটা কি করলি?”

শুভ্র রায়হানের প্রশ্ন সম্পূর্ন অগ্রাহ্য করে বললো,
” তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে?”

” আচ্ছা, বল শুনি তোর ইম্পর্ট্যান্ট কথা। নাহলে তো আমাকে গেমটাও খেলতে দিবি না।”, কাউচে গা এলিয়ে দিয়ে বললো রায়হান।

শুভ্র গম্ভীর গলায় বললো,” সবটা জেনেও তোর আর ফুফুর এমন ছেলে মানুষির মনে কি?”

রায়হান তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসলো। তারপর উঠে দাড়াতে দাড়াতে বললো,” আমি আর আমার মা কি এমন ছেলেমানুষী করেছি যে তুই এতটা বিরক্ত?”

” একদম না বোঝার ভান করবি না। হিয়ার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে জেনেও এমন পাগলামির মানে কি?”, কঠিন গলায় বলল শুভ্র।

” আচ্ছা এই ব্যাপার? বিয়েটা তো তোরা দুজনেই বাধ্য হয়ে করেছিস। তুই তো হিয়াকে বউ বলে মেনেও নিবি না বলেছিস। আলাদা আলাদা ঘরে থাকিস। তারপর ও আমাকে এই প্রশ্নটা করা কি তোর পাগলামি না?”, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বললো রায়হান।

শুভ্র আবারো কঠিন গলায় বলল,” সেটা আমাদের পার্সোনাল ম্যাটার। তুই কেনো ইন্টারফেয়ার করবি।”

রায়হান শুভ্রের দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে জোর গলায় বলল,” অবশ্যই করবো। বিকজ আই লাভ হার। আই এক্সট্রিমলি…….” বাকিটা বলার আগেই শুভ্র রায়হানের কলার চেপে ধরলো। বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললো,” শাট আপ রায়হান। জাস্ট শাট আপ। তুই যা করছিস এর ফল কিন্তু ভালো হবে না।”

রায়হান কলার থেকে শুভ্রের হাত সরিয়ে দিয়ে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” ফল যেটাই হোক। এতো সহজে তো আমি হাল ছাড়ছি না। ডিভোর্স প্যাপার রেডি হচ্ছে ডাক্টার সাহেব। তোর বাবাই সবটা করছে। গুটি কিন্তু ওনার হাতে আমি তো শুধু বিয়েটা এগিয়ে এনেছি। থাটস ইট।”

শুভ্র হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেললো। নিজেকে কথা সম্ভব সামলানোর চেষ্টা করছে। শুভ্র চোয়াল শক্ত করে বললো,” জাস্ট স্টপ টকিং নোনসেন্স। ইউ আর ডে ড্রিমিং।”

” নো, দিস ইজ রিয়ালিটি ব্র। জাস্ট ভাব হিয়া তোর বাবাকে কতটা শ্রদ্ধা করে। তোর বাবা যা বলবে হিয়া কিন্তু সেটাই করবে। আসলে ফল্টটা কার বলতো? তোর। তুই ওকে অবহেলা করেছিস। হিয়া নিশ্চই তোর কাছে থাকতে চাইবে না মামার কথার বাইরে গিয়ে। নাউ ইউর টাইম ইজ অভার মিস্টার শুভ্রনীল আহমেদ।”,

” তুই যে আকাশ কুসুম চিন্তা করে আছিস না এইসবের কিছুই হবে না। আই গ্যারান্টি ইউ। ইউ আর মেসিং উইথ দা রং পারসন।”, কঠিন গলায় বলেই শুভ্র ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আর কিছুক্ষণ রায়হানের সামনে থাকলে হয়তো শুভ্রের হাত উঠে যেতো। তার বাবা কেনো যে এইসব সাড়া দিচ্ছে সেটাই সে বুঝতে পারছে না।

শুভ্র রেগে নিজের বাবার ঘরে ঢুকলো। রবীউল সাহেব সবে নিজের ঘুমের ওষুধ খাচ্ছেন। একপাশে সাহারা খাতুন কাপড় ভাজ করছেন। শুভ্র ঘরে ঢুকেই বললো,
” বাবা তুমি কি শুরু করেছো? তুমি তোমার বোন আর বোনের ছেলে কি পাগল হয়ে গেছো?”

সাহারা খাতুন আর রবীউল সাহেব চমকে তাকালেন। রবিউল সাহেব মনে মনে হাসলেন। এতোক্ষণে তার ছেলের টনক নড়েছে। রবীউল সাহেব ঠিক কি করবেন সেটা তিনি খুব ভালো করেই জানেন। হিয়ার মতের বিরুদ্ধে কিছুই হবে না। ততক্ষন যে যত পারে আকাশ কুসুম চিন্তা করে লাফালাফি করুক। তার কি? যে মহিলা তাকে বারন করেছে এই বিয়েটা যেনো কেউ না জানে অথচ সে এখন মুখ কালো করে আছে। করুক মুখ কালো। সবার একটা শিক্ষা হওয়া দরকার। তবে জলটা হিয়ার মামার কাছে পৌঁছানোর আগেই এসব বন্ধ করা দরকার। চিন্তা তো হয় এই ছেলেটাকে নিয়ে, রেগে গিয়ে আবার কি করে?

থাক করুক। এখন খুব মেজাজ দেখাতে রূমে এসেছে। রবীউল সাহেব ঠিক করে নিয়েছেন এইসবের পর হয়তো এই বিয়ে টিকবে নয়তো ভাঙবে। এই যন্ত্রণা তার আর ভালো লাগছে না।

[ #চলবে ]

[ #চলবে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here