নীলাঞ্জনা পর্ব -০৭

#নীলাঞ্জনা
#পর্ব_৭
#লেখনীতে_শুভ্রতা

Happy birthday to you. Happy birthday to you. Happy birthday to you Mohuya Akshar🖤

সবাইকে একসাথে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে দেখে প্রচন্ড অবাক হয় মহুয়া। সে তো ভুলেই গিয়েছিলো আজ তার জন্মদিন। কিন্তু বাকিরা ঠিক মনে রেখেছে। তার পাপাই রেহমান আকশার, মামনি আয়শা বেগম, তাঁদের মেয়ে রেহানা আকশার [দুঃখিত গত পর্ব তে রওনক আকশার এর একমাত্র মেয়ে লিখতে গিয়ে আকশার বাড়ির লিখে ফেলেছিলাম 🥺] রহিমা খালা, বাড়ির বাকি সার্ভেন্ট গুলো সব একসাথে উইশ করাতে খুব খুশি মহুয়া। কিন্তু তার বাবাই রওনক আকশার কোথায়?

কিছুক্ষণ আগে মহুয়া তার রুমে বেঘোরে ঘুমাচ্ছিলো। হঠাৎ বাড়ির সবাই হৈহৈ করতে করতে হুড়মুড় করে তার রুমে ঢুকে পড়লে ধড়ফড় করে উঠে বসে সে। তারপর এই কান্ড। কিন্তু আশ্চর্য! বাবাই কোথায় গেলো? সবার আগে তো তার থাকার কথা।
দরজার দিকে চোখ যেতেই মহুয়া দেখে তার বাবাই রওনক আকশার কেক হাতে রুমে ঢুকছেন। তা দেখে বিসানা থেকে নেমে গিয়ে মহুয়া জড়িয়ে ধরে নিজের বাবাই কে। রওনক সাহেবও মেয়ের মাথায় হাত রাখেন। তারপর বলেন

“শুভ জন্মদিন মাই প্রিন্সেস নীলাঞ্জনা।”

বাবাই এর আহ্লাদ পেয়ে যেন গলে যায় মেয়েটা। বাবাই কে জড়িয়ে ধরেই বলে
“থ্যাংক ইউ সো মাচ বাবাই।”

মেয়ের কপালে অধর ছোঁয়ান রওনক। তারপর সবাই মিলে কেক কেটে তা খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে যার যার মতো ঘুমাতে যান। রওনক আকশার যাওয়ার আগে মেয়েকে ঘুমাতে বলে যান। সাথে এও বলেন যেন সকালে উঠে পড়া গুলো একটু রিভাইজ করে নেয়। মহুয়াও মাথা নেড়ে সায় জানায় বাবাই এর কথায়।

রওনক আকশার এর স্ত্রী মারা গেছেন আরো ১৫ বছর আগে। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে। আপাতত একমাত্র মেয়ে আর ভাইয়ের পরিবার নিয়েই তার জীবন। রওনক সাহেবের একমাত্র বোন নয়না আকশার ছেলে পিয়াল চৌধুরী আর স্বামী পলাশ চৌধুরীকে নিয়ে আমেরিকায় থাকেন। বছরে বা দুই বছরে একবার করে বেড়াতে আসেন। ভাই রেহমান আকশার এর স্ত্রী আয়শা আর মেয়ে রেহানা বাড়িতেই থাকেন। তাঁদের ছেলে অভ্র নিজের ফুপির কাছে আমেরিকায় থেকে স্টাডি করছে। শেষ হলে ব্যাক করবে দেশে। এইতো এবছরই আসবে হয়তো অভ্র। কতদিন দেখা হয় না ছেলেটার সাথে। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন রওনক আকশার।

সকালে ঘুম থেকে উঠে মামনির কথা মতো নামাজ পড়ে বই নিয়ে বসেছে মহু। আজ থেকে তার এসএসসি পরীক্ষা শুরু। বাবাই আর পাপাই অফিসে যাওয়ার সময় তাকে নিয়ে যাবে। আবার লাঞ্চ টাইম এ বাসায় নিয়ে আসবে। এক্সাম নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই। শুধু বাবাই খুশি হবে বলেই পরীক্ষা দিচ্ছে মহু। নাহলে তার মতে এসব পরীক্ষা টরীক্ষায় কিছু এসে যায় না। মানুষ হওয়াটা জরুরি। আর মানুষের পাশে তো যেকোনো পেশা দিয়েই দাঁড়ানো যায়। তাহলে ঘটা করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার মানে কি? বুঝে আসে না তার! এই যে সবাই মানুষ কি বলবে সেই ভয়ে এত কিছু করে, সেই মানুষ কি তাঁদের একবেলা খেতে দেয়? না তো। তাহলে এত কেনো ভাবতে হবে মানুষের কথা?

সুন্দর মতো নাস্তা করে বাবাই, পাপাই এর সাথে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে মহু। যাওয়ার আগে মামনি আয়শা আর আপুই রেহানাকে বলে যেতে ভুলে না সে। ভাবতেই ভাল্লাগে কয়দিন পরেও মহুও রেহানা আপুই এর মতো একা একা কলেজ যাবে।

ভার্সিটিতে এসে রিহান, সাথী, রিমু, আকাশ সবাই চিন্তিত হয়ে বসে আছে। চিন্তার বিষয় এই যে নভ এখনো উপস্থিত হয়নি। উপস্থিত হয়নি সেটা বড় কথা নই, বড় কথা হচ্ছে নভর ফোন অফ। কন্টাক্ট করা যাচ্ছে না তার সাথে। বাকিরা চিন্তাই চিন্তায় শেষ। বেশি চিন্তার কারণ হলো কাল নীলাঞ্জনাকে নিয়ে কথা হওয়া নভর কথায় যা মনে হলো মেয়েটাকে নিয়ে বেশ সিরিয়াস সে। কাল স্মৃতি জেগে ওঠায় ভুলভাল কিছু করে বসবে না তো? যদিও নভ বিচক্ষণ ছেলে কিন্তু তবুও চিন্তা কমে না কারো। অতিরিক্ত আবেগ প্রবন হয়ে পড়লে মানুষ সব করতে পারে। না জানি কোথায় আছে নভ। সবার চিন্তায় ছেদ পড়ে আকাশের কথায়।

“কিরে রিহান। কাল তোর সাথে না নভর কথা হলো বিকেলে।”

মলিন সুরে রিহান বলে
“হ্যাঁ হয়েছিলো তো। আছরের পরপর। বেশ স্বাভাবিক ভাবেই কথা বললো। আর ওর জন্য অপেক্ষা করতে বারণ করেছিল কিন্তু আমি কীভাবে বুঝবো ও হঠাৎ উধাও হয়ে যাবে?”

রিহান এর কথা শুনে সাথী তেড়ে এসে বলে
“মানে ও তোকে আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলো আর তুই সেটা জানানোর প্রয়োজন মনে করিসনি?”

রিমু সাথীকে সরিয়ে নিতে নিতে বলে
“হাইপার হোস না সাথী। আমাদের সবারই চিন্তা হচ্ছে নভর জন্য। রিহান বুঝতে পারলে তো বলতোই। ওর ও তো ফ্রেন্ড নভ। ঠান্ডা হয়ে বস।”

অতঃপর সবাই আবারও ব্যাস্ত হয়ে পড়ে নভর সাথে কন্টাক্ট এর প্রচেষ্টায়। কিন্তু পরিশেষে ফলাফল শুন্য। উপায় না পেয়ে সবাই নভকে ছাড়াই ক্লাসে চলে যায়। ক্লাস মিস করলে আবার নভ এসে তুলকালাম বাঁধাবে। তারচেয়ে ক্লাস করাই ভালো। সময় হলে নভ ঠিক চলে আসবে। বাচ্চাদের মতো কোনো নিশ্চই নভর করবে না। এসব ভেবে নিজেদের সান্ত্বনা দেয় আকাশ, রিহান, সাথী, রিমু। তারপর চলে যায় ক্লাস করতে।

অত্যন্ত ভালো না হলেও বেশ মোটামুটি একটা পরীক্ষা দিয়ে বের হয় মহু। পড়াশোনার তুলনায় পরীক্ষা অনেকটা ভালো হওয়ায় সে বেজায় খুশি। অবশ্যই পাপাই আর বাবাই ও খুশি হবে। মহুকে স্কুলের গেট পেরোতেই দেখতে পায় ড্রাইভার দাঁড়িয়ে আছে তাকে নেওয়ার জন্য। কাছে যেতেই গাড়িতে উঠে বসেন তিনি। মহু ওঠার পর গাড়ি স্টার্ট করে চলতে শুরু করেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়ির ছোট মেয়ে হওয়ায় সবার খুব আদরের মহু। আর মা না থাকার কারণে আয়শা বেগম আর বাড়ির কাজের লোক গুলোর সাথেই তার ছোটবেলার বেশিরভাগ সময় কেটেছে। রেহানা আপুইকে স্কুলে দিয়ে মামনি তাকেই সময় দিতেন। রহিমা দিদুন আর ড্রাইভার দাদাও অনেক ভালোবাসে। মিষ্ট ভাষী হওয়ার দরুন সবাই খুব সহজেই আপন করে নেয় তাকে। সবকিছু ভেবে মুচকি হাসে মহু। এই মানুষ গুলোর জন্য সে মা না থাকলেও কখনো মায়ের অভাব বুঝতে পারেনি।

গ্রামের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে এক মাঝারি আকারের নদী। থেকে থেকে নৌকা চলাচল করছে তার বুকে। নদীর পাড় ঘেঁষে বেশ বড় একটা কড়াই গাছ। তার নিচে বসে একমনে বিড়বিড় করে যাচ্ছে এক যুবক। কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু কণা।

“তুই কি সত্যি সত্যি হারিয়ে গেলি নীলময়ী? আর কখনো ফিরবি না আমাদের কাছে? তোর বাবা কারো সাথে ঠিক মতো কথা বলেন না তোর শোকে। খালামনিও চুপচাপ। আম্মু এখনো কান্না করে। আর বাবা তো অসুস্থই হয়ে গেছেন। জানিস নীল তোর একটা ছোট বোন হয়েছে, নাম নিহা। নয়ন বড় হয়ে গেছে। সিক্স এ পড়ে এখন সে। কিন্তু তোর কথা ওদের মনে নেই। আমি বাড়িতে আসলে আমার কাছে তোর গল্প শুনতে বায়না করে। তোর আধো আধো বুলির কথা গুলো যখন বলি, ওরা খুব হাসে তা শুনে। তখন আমি বলি তুই থাকলে নিশ্চই বকে দিতিস তোর কথা শুনে হাসার জন্য। মনে আছে আমাকে কেমন ঝগড়ুটে বলতি?”

নভর হাহাকার যেন আশপাশ ছেয়ে ফেলেছে। তার মাঝে মাঝে ডুকরে কেঁদে ওঠার শব্দে গাছ ছেড়ে দূরে গিয়ে বসে আছে পাখি গুলো। হয়তো অবাক হয়ে ভাবছে এত বড় ছেলে কাঁদে কেনো? আমাদের একটু শান্তি দেবে না নাকি! কিছুক্ষণ চুপ থেকে নভ আবার বলে ওঠে

“তুই কি বুঝতে পারছিস না নীল তোর জন্য কত কষ্ট পাচ্ছি আমি? ফিরে আয় না রে।”

কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ রেগে বলে
“তোর কথা শুনে সেদিন নৌকা মাঝ নদীতে নেওয়া উচিত হয়নি। নইলে তোকে হারাতে হতো না। বেশি বেশি আহ্লাদ দেওয়া হয়ে গেছে তোকে তাই এত বেড়েছিস।”

বলতে বলতে আবার কেঁদে ফেলে নভ। তার হৃদয় যে বড্ড পুড়ছে নীলময়ীর জন্য। নীলময়ী কি সত্যিই নেই? নাকি থেকেও নভর কষ্ট গুলো বুঝছে না? ফিরে আসবে নভর নীলময়ী? নভর দুঃখে প্রকৃতিও যেন কেঁদে ওঠে। শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির মাঝেও ঠাই বসে থাকে নভ। নীলের প্রতি জন্মদিনে সে এখানে এসে বসে থাকে। করে দুঃখবিলাস। তার বিশ্বাস একদিন এখানেই আবার সে তার নীলময়ীকে পাবে। আদৌ কি পাবে? হবে কি সৃষ্টিকর্তা সহায়?

বাড়িতে ঢুকে আশেপাশে কাউকে না পেয়ে সোজা বাবাই এর রুমে চলে যায় মহু। বাবাই নেই তো কি হয়েছে? বাবাই এর বই গুলো তো আছে। সেখান থেকে উপন্যাস পড়তে পড়তে রেস্ট নেবে ভেবে ওদিকে এগোয় সে। বাবাই এর রুমে রকিং চেয়ারে উল্টো ঘুরে কাউকে বই পড়তে দেখে অবাক হয় মহু। বাবাই এত তাড়াতাড়ি চলে এলো? তাছাড়া কেউ তো আসে না বাবাই এর রুমে। ভাবে হয়তো তার জন্মদিন উপলক্ষে আগে আগে চলে এসেছে। খুশি হয়ে বেডের ওপর ফাইল ছুড়ে ফেলে দৌড়ে গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে সেই মানবের। কিছু বলতেই যাবে তখনই শুনতে পায় নিচে পাপাই মহু মহু বলে চিৎকার করছে।

“মহু মামনি কোথায় তুই? দেখে যা বাবাই আর পাপাই তোর জন্য কি গিফট এনেছি?”

কথা গুলো কানে আসতেই হতবাক হয় মহু। আশ্চর্য! বাবাই যদি নিচে থাকে তাহলে সে কাকে জড়িয়ে ধরে আছে?

চলবে…?

[আস্সালামুআলাইকুম। আশা করি আল্লাহর রহমতে সবাই ভালো আছেন। কিন্তু আমি মোটেও ভালো নেই। আমি সাঁতার জানিনা বলে আপনাদের next এর ঢেউয়ে ডুবে যেতে চলেছি🥹]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here