নুনভাত

ছোটগল্প: নুনভাত

‘মা! আমি পরপর দুই রাত্রে দেখসি! সবাই ঘুমায় গেলে পরে ভাবী চুপচুপ রান্নাঘরে যায়। তারপর, এক্কেবারে সোজা বাড়ির বাইরে! আমি শিউর, লুকায়ে লুকায়ে কারোর সাথে ঘোঁট পাকায় বইসা আছে তোমার সুন্দরী ছেলেবৌ!’

দিলারা প্রথমে বিশ্বাস করেননি মেয়ের কথা। কী দেখতে কী দেখেছে কে জানে! মিরাজের বউটা এমনিতে বেশ লক্ষ্ণীমন্ত। সবে ছ’মাস হয়েছে ছেলেকে বিয়ে করিয়ে ঘরে বউ তুলেছেন দিলারা, তবু এই কম সময়েও যতটুকু চিনেছেন, বুঝেছেন তাতে নদীকে দিয়ে এমনধারা পাপচিন্তা মাথাতেই আসবার কথা নয়। কিন্তু রোজ রোজ সেই একই কথা যখন বলতে লাগল পূর্বা, তখন আর দ্বিধা না করে পারলেন না। কথায় বলে, গলতে গলতে পাথরও নাকি স্রোতে ভেসে যায়। রোজ রোজ কানে বিষমন্ত্র ঢালা হলে নিতান্ত বিশ্বাসীর মনেও অবিশ্বাস জন্মায় বৈকি!

দিলারা আজ ঘুমুননি, ঘুমের ভান করে খাটে পড়ে আছেন চুপচাপ! রাত তখন কত কে জানে, ‘খুট’ করে একটা শব্দ শোনা গেল। পায়ে পায়ে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন দিলারা, অন্ধকারের সাথে একেবারে মিশে গিয়ে। বিস্মিত চোখে দেখলেন, ওড়নার নিচে বড় পুঁটলিমত কিছু একটা লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নদী! এইতো পায়ে পায়ে এগুচ্ছে, এইতো চুপচুপ সদর দরজার খিল খুললো!

এ মা! পূর্বার কথাই তবে ঠিক!

ওড়নার তলা থেকে হাঁড়িটা বার করে সবে নিচে নামিয়েছে কি নামায়নি নদী, প্রচণ্ড আলোর বিকিরণ এসে লাগলো চোখেমুখে। তিনটে স্মার্টফোনের ফ্ল্যাশলাইট যেন সিনেমায় দেখা আলোর মতন ঝলমলিয়ে উঠলো।

‘নদী!’- রাতের নিস্তব্ধতা কেটেছিঁড়ে মিরাজের ঘুমজড়ানো, বিস্মিত কণ্ঠ ধ্বনিত হয়।

‘বলসিলাম না আমি! আমি দেখসি! শিওর! পরপর দুইদিন, বলসিলাম না?’- ডানহাতের মুষ্ঠি দিয়ে বাঁহাতে কিল বসায় পূর্বা। তার কণ্ঠে স্পষ্ট উত্তেজনা, হাতেনাতে আসামী ধরা পড়বার আনন্দ।

দুই-তিন হাত দূরে কুইকুই করছিল ছানাগুলি, হাড়গোড় মেশানো ভাতের হাঁড়িটা তুলে নিয়ে সেদিকে এগিয়ে যায় নদী। বাড়ির লোকেদের নিয়ে আপাতত কিছু ভাবছে না সে, একদিন না একদিন যে ধরা পড়তেই হতো- এ তো জানাই ছিল! সোজা পথে কম চেষ্টা করেনি সে, বাধ্য হয়েই মাঝরাত বেছে নিতে হয়েছে।

‘আয়, আয়! এই নে! চ্চ..চ্চু’- আদরসূচক চ-কারান্ত কিছু শব্দ করে ছানাগুলির দিকে হাঁড়িটা বাড়িয়ে দেয় নদী। অনতিদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মা কুকুরটাও পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে, আলতো জিহ্বাস্পর্শে নদীর পায়ের পাতাটা ভিজিয়ে দেয়।

‘এসব কী! কী এসব!’- মিরাজের ঘুমভাব কেটেছে, বিস্ময় এখনও কাটেনি।

‘মিরাজ! গত সপ্তায় এই ছানা পাঁচটার জন্ম দিয়েছে মা কুকুরটা। রোজ কাঁড়ি কাঁড়ি ভাত ফেলা হয় তোমাদের বাড়িতে। সেগুলোর একটা সদগতি করা আরকি…’

‘তাই বলে এভাবে? এই মাঝরাতে, চোরের মতন! কেন নদী? কেন?’

সেই ‘কেন’র কোনো উত্তর যোগায় না নদীর মুখে, কেবল নিরুত্তর শাশুড়ির মুখের দিকে চেয়ে থাকে সে। ফোনের আলোয় রাতের আঁধার পুরোপুরি কাটেনি। আলো-আঁধারির ভেতর থেকে চেয়ে থাকা সেই দৃষ্টিতে কী লেখা ছিল কে জানে, দিলারা একদম কুকঁড়ে যান। আরেকদিনের কথা মনে পড়ে যায় তার। খুব বেশিদিন আগে নয়, পনেরো-ষোলদিন হবে হয়ত। অফিস ফেরত নদী সরাসরি ঢুকে গেছিল রান্নাঘরে। বউকে অমন হন্তদন্ত ছুটতে দেখে দিলারাও এসেছিলেন পেছন পেছন।

‘কী করো? কী করো? ময়লা ঘাঁটতেসো যে?’

‘ময়লা না… দুপুরের খাওয়া হাড়গোড়গুলি।’- ময়লার ঝুড়িটা থেকে বেছে বেছে হাতের পলিথিনে ঢোকায় নদী। তারপর পাতিল উল্টে ভাতগুলিও ঢুকিয়ে নেয়।

‘আরে! কী করতেসো এইসব! আজব তো! ময়লার মধ্যে ভাত ঢাললা কেন?’

‘এইগুলি তো সকালের রান্না ভাত, একটু পরেই তো ফেলে দিয়ে আবার নতুন রান্না বসাবেন।’

‘ঠাণ্ডা বাসি ভাত তো ফালাইতেই হবে। তুমি এইগুলা নিয়া কই যাও?’

‘ঐ মোড়ের টেইলার্সটার সামনে একটা মা কুকুর বাচ্চা দিয়েছে। অফিস যেতে আসতে রোজ দেখি, খালি পেটে বাচ্চাগুলিকে নিয়ে দোকানের সামনেটায় পড়ে থাকে বেচারি। বাচ্চাগুলিকে রাস্তায় ফেলে রেখে খাবারের খোঁজেও যেতে পারেনা, কে কোনদিক দিয়ে নিয়ে যায় বা মেরেধরে বসে! বলছি, এই ভাতগুলি তো বাড়িতে কেউ খাবেনা, ফেলেই দিতে হবে… ওদেরকেই দিয়ে আসি বরং। মা, এরপর থেকে খাওয়ার পর হাড়গোড়গুলি এই ছোট বক্সটাতে করে ফ্রিজে রেখে দিলে ভাল হয়।’- ব্যাগ থেকে ছোট টিফিন বক্সটা বের করে নদী, তারপর পলিথিনটা হাতে করে দরজার দিকে এগোয়।

‘এই! দাঁড়াও! পাগল টাগল হই গেসো নাকি? বিয়ের পরপর আইসা সকালের ভাত ফ্রিজে রাইখা রাত্রে আবার সেই ভাতের সাথে মিশায়া চাউল বসানি আরম্ভ করলা- সেই ভূত তো নামসে এখন মাথা থিকা। এখন আবার নতুন ভূতে পাইসে? বাড়ির বৌ রাস্তার বেটাগো সামনে ঢ্যাং ঢ্যাং কইরা যাইয়া ভাত বিলাইবো? অ্যাঁ? আরে, আমরা হইলাম তিন পুরুষ ধইরা জমিনদার, বাড়িওয়ালা। আমাগো বাড়ির বৌ যাইব নেড়ি কুত্তারে বাসিভাত খাওয়াইতে? মহল্লাবাসী কী কইবো? চ্যাংড়া পোলাপানের দল দুইদিনের পর তিনদিন বাদে “কুত্তাওয়ালী” নাম ধইরা ডাকবো, “কলিম মহল” এর নাম বদলায়া মানুষজন “কুত্তামহল” ডাকা শুরু করবো- তাই চাও? থামো তুমি! এই হাড্ডি-গুড্ডি সব ময়লার ঝুড়িতে ফালাও বললাম!’

নদীর সেদিনের দৃষ্টিতে বিস্ময় ছিল, সাথে হয়ত ঘৃণা কিংবা করুণা- দিলারা ঠিক ধরতে পারেননি। আজকের দৃষ্টি তার অন্যরকম, আলো-আঁধারিতে দিলারা পড়তে পারেননা সেই চোখ।

‘পঞ্চাশের মন্বন্তরের কথা তো সবাই জানে। ১৯৪৩ এর সেই দুর্ভিক্ষ, শিল্পাচার্যের আঁচড়ে আঁকা দুর্ভিক্ষ সিরিজ, সাড়ে তিন মিলিয়ন মানুষের না খেয়ে পেয়ে মরে যাওয়া… পড়েছ ত সব ই বইতে, না?’- প্রশ্নটা ঠিক কার দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে কে জানে। তিনটি মানুষ স্তব্ধ মূর্তিবৎ বসে আছে, কারুর মুখেই উত্তর যোগায় না।

পরনের উলের শালটা খুলে আলনায় রাখে নদী। এক ঝলক তাকায় তিনজোড়া বিরক্ত, বিস্মিত অথচ কৌতূহলী চোখের দিকে। তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলতে আরম্ভ করে আবার-

‘১৯৭৪ এও হয়েছিল… দুর্ভিক্ষ। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য জন্মানো দেশটার মানুষগুলোর আরেক যুদ্ধে নামতে হয় সে বছর- দু’মুঠো ভাতের জন্য, একদানা লবণের জন্যে… নুন মেশানো ভাতের মাড়ের জন্য! সখিপুরের নূরজাহান বেগমের অন্নসংস্থান বলতে কেবল সেলাই করে পাওয়া দু’চারটে টাকা আর বাড়ির আশপাশে বুনে রাখা শাকপাতা। নুন-ভাতের টান পরলে লোকে পোশাকের বিলাসিতাটুকু ত্যাগ করতে বাধ্য হলো, নূরজাহান বেগমের সেলাইয়ের উপার্জনেও পড়লো ভাটা। বাজারে জিনিসপত্রের আগুন সমান দাম, সে পথ মাড়ানোর চিন্তাও তো করা যায়না! একহাতে সাত বছরের পুত্রসন্তান আর কাঁখে তিন বছুরে মেয়েটিকে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঝিয়ের কাজ খুঁজে বৃথাই হয়রান হলেন নূরজাহান। খেতে পাচ্ছেনা লোকে, এই দৈন্যের দিনে আবার ঝি রাখবে কে! শাক-লতা-পাতা সেদ্ধ করে করে দিন চারেক মত চলল, তারপর? বোনটাকে বড় আদর করে ছেলেটা, লোকের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ফ্যান-ভাত যা পায় কাঁচিয়ে কুঁচিয়ে বোনের জন্য নিয়ে আসে সবটুকুন। সপ্তাহখানেকের মধ্যে সেটুকুও আর আসেনা, লোকেরা ভাতের সাথে সাথে মাড়টুকুও নিজেরাই রাখছে। কেবল পানি খেয়ে কয়দিন থাকা যায়, বলতে পার?

এক বেলা? দুই বেলা?
একদিন? দুইদিন?
এক সপ্তাহ?

পুতুলের মত সুন্দর দেখতে বলে বোনের নাম ভাইয়ে রেখেছিল পুতুল, বাকি সকলে ডাকত নাহার বলে। ক্ষিধে সইতে না পেরে সে মেয়ে জ্যান্ত কেঁচো পিষে পিষে মুখে পুরতে আরম্ভ করলো যখন, মুখ বেয়ে পড়তে আরম্ভ করলো ঘিনঘিনে পোকার পেটের রস- মিরাজ, তুমি ভাবতে পার দৃশ্যটা? মাটি খুঁড়ে কিলবিলে কেঁচো মুখে পুরছে পূর্বা, ক্ষিধের চোটে সেটাকেই অমৃত মনে হচ্ছে ওর কাছে কিংবা আর কিছু না পেয়ে ফুলগাছের পাতা সিদ্ধ করে চিবুচ্ছে তোমার মা- ভাবতে পারো মিরাজ? পারবেনা জানি, ১৪ সিএফটির ফ্রিজ ভর্তি খাবার ঘরে আগলে নিয়ে সেসব ভাবতে পারার কথাও না তোমাদের! তরকারি পছন্দ না হলেই ভাত ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া পূর্বা কী করে বুঝবে ক্ষিধের জ্বালায় সেদ্ধপাতা চিবুনো নাহারের যন্ত্রণা? রোজ দু’বেলা ভাত ফেলে দেওয়া বাড়িওয়ালা, জমিনদার দিলারা বেগম কেমন করে জানবেন বিধবা নূরজাহানের অসহায়ত্বের কথা? গ্রামের আড়তদার মঞ্জুমিয়ার কুপ্রস্তাবে ১৯৭৪ এর নূরজাহান কেন সম্মতি দিয়েছিলেন, এই ২০১৯ এর দিলারা-পূর্বা-মিরাজেরা তা কেমন করে বুঝবে, বলো?

বুঝেছিল, একজন অবশ্য বুঝেছিল! নয়ন- নূরজাহানের সেই সাত বছরের ছেলেটি। এর আগে দু’বার মা’কে দেখেছে সে, বটি নিয়ে মঞ্জুমিয়াকে দৌড়ানি দিতে। সেদিন রাতে ভাঙা চৌকির ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজে ঘুম ভেঙে সেই মা’কেই আবার দেখলো সে- মঞ্জুমিয়ার বিশাল দেহটার নিচে মরা ফুলের মতন পিষ্ট হতে। মায়ের চোখে কি জল ছিল? কে জানে! হারিকেনের আলোয় ঠিক বুঝতে পারা যায়নি।

পরদিন নুনছেটানো ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত পড়েছিল থালায়। চুকচুক শব্দ করে ভাত চিবুতো পুতুল, গুনে গুনে ঊনত্রিশ দিন পর আবার সেই শব্দ কানে আসে নয়নের। মাথার ভেতর আরও একটা শব্দ সেই ভাত চিবুনোর শব্দের সাথে তালগোল পাকিয়ে যায়- ‘ক্যাঁচক্যাঁচ, ক্যাঁচক্যাঁচ, ক্যাঁচক্যাঁচ!’

গলা ধরে এসেছিল নদীর, চোখ ভরে গেছিল জলে। মাঝরাতের স্তব্ধ তিন মূর্তি বোবা চোখে চেয়ে ছিল কেবল।

‘নূরজাহান তার স্বামীকে হারিয়েছিলেন একাত্তরের যুদ্ধে, আর নিজেকে হারিয়ে ফেললেন চুয়াত্তরের যুদ্ধে!

মুক্তিযোদ্ধা রমিজ আলীর লাশটা পরিবারের লোকেরা কেউ পায়নি আর। এই দেশের কোনো নদীতে ভাসতে ভাসতে হয়ত ঠাঁই হয়েছিল কোনো অচেনা অঞ্চলের মাটিতে কিংবা বঙ্গোপসাগরের বুকে- কে জানে! নূরজাহানের জীবন্ত লাশটার অবশ্য এত দুর্গতি হয়নাই! চুয়াত্তরের যুদ্ধ শেষে তার ঠাঁই হয়েছিল টাঙ্গাইলের কান্দাপাড়ায়।

আর নাহার? সেই চার বছরের মেয়েটা? নয়নের সেই পুতুল?

নূরজাহানের পর মঞ্জুমিয়ার নজর পড়েছিল সেই বাচ্চা মেয়েটার দিকেও। তখন মাঝরাত। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত নূরজাহান তখন ঘুমুচ্ছিল। পুতুলের চাপা গোঙানিতে ঘুম ভাঙে নয়নের। দরজার খিল দেওয়া ছিল ভেতর থেকে। পুরনো আমলের শক্ত কাঠের দরজা, সাত বছুরে ছেলেটার গায়ে আর কতটুকুনই বা জোর? দা’য়ের শেষ কোপটায় দরজাটা যখন ভাঙলো, পুতুল ততক্ষণে নিস্তেজ পড়ে আছে মেঝেতে।

ভুল বললাম, দা’য়ের শেষ কোপ দরজায় পড়েনি সেদিন। প্রথমে মঞ্জুমিয়ার ঘাড় আর তারপর তার দুই উরুর মাঝের লোভী সর্পিল অঙ্গটির বিষাক্ত রক্তে স্নাত হওয়ার দুর্ভাগ্য লেখা ছিল বেচারি দা’টার কপালে।

পুতুল তো মরে গিয়ে বেঁচে গেছিল, নয়ন আর নূরজাহান হয়ত পালিয়ে বাঁচতে পারত। কিন্তু মাঝরাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে দরজা ভাঙার শব্দ লোকেদের কাছে পৌঁছে গেছিল তার আগে। স্বাভাবিক সময় হলে কী হতো কে জানে, হয়ত মাতা-পুত্র জেলে পচে মরতো কিন্তু সেই ক্ষুধাবন্দি, উত্তাল দুর্ভিক্ষের সময়টাতে লোকেদের বিচার বুদ্ধি সব আউলে গেছিল। মঞ্জুমিয়ার আড়তে কয়েকশ’ মণ চাল মজুত আছে- এরকম একটা গুঞ্জন গ্রামে উঠেছিল। কিন্তু ক্ষমতাশীল মঞ্জুমিয়ার ভয়ে কেউ তখনও সেদিকে হাত বাড়ানোর সাহস যুগিয়ে উঠতে পারেনি। চোখের সামনে মঞ্জুর ধড়হীন মুণ্ডু পড়ে থাকতে দেখে এবারে সেই সাহস জুটে যায়। রাতারাতি মঞ্জুমিয়ার আড়ত লুট হয়, শোনা যায় প্রায় দু’শ মণ চাল পাওয়া গেছিল সেরাতে।

সখিপুরের ঘরে ঘরে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের গন্ধ ছড়ায়, যেন বহু বছর পরে।

গ্রামসুদ্ধ লোকে ভরপেটে ঘুমুতে যায়, যেন একটা সুখস্বপ্নের মতন। যে স্বপ্নটা এই কিছুকাল আগেও সত্যি ছিল, অথচ আজ অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে।

পেট ভরলে পরে লোকেদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়। একে তো গ্রামের মধ্যে বেশ্যাখানা খোলা হয়েছে তার ওপর আবার এক রাতে দু’টো লাশ পড়ে গেছে। থানা পুলিশের ভয় দেখিয়ে মা-ছেলেকে ভিটেছাড়া করতে দেরি হয়নি তারপর, রমিজ আলীর পরিত্যক্ত ভিটেটা দখল করতেও নয়।’

হাতের উল্টো পিঠে চোখ মোছে নদী। ছেলেবেলায় একদম খেতে চাইতো না সে, মা জোর করে ভাতের গোল্লা মুখে পুরে দিলেও থুঃ করে ফেলে দিত। সেরকম একদিন বাবা একটা ‘গল্প’ শুনিয়েছিলেন নদীকে। নূরজাহানের গল্প, নয়নের গল্প, নাহার কিংবা পুতুলের গল্প।

সেই থেকে আজ অব্দি একদানা ভাত কিংবা এককণা রুটিও নষ্ট করতে পারেনি নদী৷ বুকের ভেতর একজন নূরজাহান, একজন নাহারকে পুষে রেখেছে নদী নামের মেয়েটা। পলিমাটি বুকে নিয়ে নদী যেমন ছুটে চলে জনমভর- তেমনি করে আজীবনের জন্য এই দু’টি অদেখা সত্তাকে নিজের ভেতর লালন করে এসেছে সে।

‘মা! রোজ নিয়ম করে দু’বেলা ভাত রান্না হয় এ বাড়িতে, নিয়ম করে বাসিভাত ফেলে দেওয়া হয়। থাল ধরে ফেলা ভাতের প্রত্যেকটা দানা আমায় যন্ত্রণা দেয়। আমি টের পাই- নূরজাহানের সম্ভ্রম ঐ ভাতের দানাটায় মিলেমিশে গেছে, পুতুলের রক্তমাখা ছোট্ট লাশটা ঐ সাদা ভাতকে লালে রাঙাচ্ছে। আমার বুকের ভেতর থেকে নূরজাহান বেগম হাহাকার করে ওঠেন, লাল লাল কেঁচো মুখে পুরে নিয়ে বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রয় চার বছরের পুতুল।

নূরজাহান বেগম, কান্দিপাড়ার খুপড়ি ঘরে যার নাম চাঁনমতি- আমার দাদী। লোকে বলে, আমি নাকি দাদীর মতন সুন্দরী হয়েছি। রূপ দেখেই তো আপনার ছেলের জন্যে পছন্দ করে এনেছিলেন আমাকে, না মা? সেই চার বছরের মেয়েটা, পুতুল? বেঁচে থাকলে সেও আমার মতনই হতো দেখতে বোধহয়… কিংবা লোকে হয়ত তখন বলতো- ‘একেবারে ফুপুর মতন দেখতে হয়েছে নদী!’ বাবা অবশ্য তাই-ই বলেন!

দাদীর রূপটাই কেবল পেয়েছি আমি, শক্তিটুকু পাইনি! তাই যদি হতো, তাহলে এ বাড়িতে আসবার পরদিন থেকেই প্রত্যেকটা ভাতের দানার হিসেব আমি নিতে পারতাম। এই ভাতের জন্যে লোকে নূরজাহানকে বেশ্যা বলেছে, নয়নকে বলেছে খুনি… আমায় নাহয় ‘কুত্তাওয়ালী’ বলতো! কী আসতো যেতো তাতে, মা?’

দিলারা স্তব্ধ চোখে ছেলেবৌ’র দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর অহংকারী চোখজোড়া বেয়ে টপটপ জল ঝরছে।


#নুনভাত
(সমাপ্ত)

ফুটনোট: গত পরশু (২৯ ডিসেম্বর) শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মদিন কেন্দ্র করে গল্পটা লেখতে আরম্ভ করি। এই ছোট্ট গল্পটুকু লেখতেও দুইদিন চলে গেল! ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ সেই ৭৬ বছর আগেই শেষ হয়েছে, কিন্তু তার ভয়াবহ ছবি আজও এই মহান শিল্পীর আঁচড়ে আঁকা আছে। সংযুক্ত ছবিটা তাঁরই আঁকা।

খাবার থেকে আরম্ভ করে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস- যেকোনো কিছুর অপচয় করাটা খুবই বিচ্ছিরি একটা স্বভাব। অনেকেই শেষপাতে খাবার ফেলে রাখাকে ‘ক্লাসি’ কিংবা আভিজাত্যের লক্ষণ মনে করেন। শীতকালে গ্যাসের চুলার ওপর কাপড় শুকানো তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা! সকালে দাঁত মাজতে গেলে ফুলস্পিডে পানির কল ছেড়ে রেখে দাঁতে ব্রাশ ঘষতেই থাকা কিংবা রোজ বালতি বালতি পানি জমিয়ে পরদিন আবার সেসব ফেলে দিয়ে পরিষ্কার পানি ভর্তি করা… লিস্ট করতে থাকলে আসলে শেষ হবেনা। পৃথিবীর বুকে তার সমস্ত সন্তানদের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ আছে। কিন্তু সেই সন্তানদের অর্ধেক যখন ভোগবিলাস, অতি সঞ্চয় আর অতি অপচয়ে মগ্ন, তখন বাকি অর্ধেক কিংবা পরবর্তী জেনারেশনের জন্যে দুর্ভোগ ছাড়া আর কীইবা বাকি থাকে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here