নেশাক্ত প্রণয়োণী পর্ব -০৩

#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০৩

‘তোর তেজ হলো লেজ গুটানোর তেজ বুঝছিস। পাওয়ালেস ম্যান। বাইরের ক্ষমতা ভালোই বাইরে দেখাস। ইউ কান্ট গিভ মি ফি*জি*ক্যা*ল সাটিসফেকশন মিস্টার আরভীক ফাওয়াজ। এই আনজুমা আবানের কথা মনে রাখিস। আমার নাম নিলেই তুই নিজেকে আন্সিটিস্ফাইড পার্সন মনে করবি হাহ্।’

কথাগুলো আরভীক এর কর্ণপাতে বজ্রপাতের ন্যায় বাজছে। মুখ খুলে কিছু বলার পূর্বেই তার মুখের কল কেটে দেয় আনজুমা। যা বুঝতে পেরে ফোনটা সজোড়ে ছুঁড়ে মারে। বিছানার কোণায় ঠাস করে পড়ে ভেঙ্গে টুকরো হলো ফোনটা। ছেলের রুম থেকে গুরুতর শব্দ শুনতে পেয়ে রুম হতে বেরিয়ে এলো জনাব আরাজ। ছেলের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে দেখে আলো বের হচ্ছে রুমের ভেতর হতে। বাহিরে দরজার নিচ থেকে আলোর কিরণ উপচে পড়ছে।
ভেতরে রাগে ভাঙচুর করছে আরভীক। তার কানে কটুতিক্ত কথাগুলো অনবরত বেজে চলছে। তার মস্তিষ্কেজুড়ে আনজুমার জীবন ধ্বংসের লিলা পুষছে। কি করে পারল মেয়েটা তার শা*রীরি*ক ক্ষমতার উপর কথা বলতে! আজ পর্যন্ত মেয়েদের সম্মান দিয়ে এসেছে। জোড়পূর্বক কোনো মেয়েকে বিছানা অব্দিও নেয়নি। সেই তার উপর আনজুমা আবান নামের মেয়েটি কিনা তাকে আন্সিটিস্ফাইড পার্সন বলে গণ্য করল। রেগে যাওয়ায় হারাম জিনিসের প্রতি জোঁক বাড়ছে তার। কোনো ব্রান্ডের মদের বোতল সে বাসা অব্দি আনে না। ক্লাবে যা পান করে তা হলো স্ফট ড্রিংকস। এমনকি তার বন্ধুদেরও স্ফট ড্রিংকস খেতে অভ্যস্ত করে তুলেছে। অন্যথায় আজ তার হিংস্র পশুটাকে বোধ হয় আনজুমা নামের মেয়েটা নাড়া দিয়ে জাগিয়ে তুলেছে। দিগিদ্বিক ভুলে যাওয়ায় মদে হাত লাগাতে গেলে কেউ যেন এসে তার হাত চেপে ধরে। রাগে যম হলেও স্নিগ্ধ হাতের পুরুষালী স্পর্শ পেয়ে মাথা ঠান্ডা করার প্রয়াস করে। আরাজ দরজা ভিড়িয়ে ছেলের মতিগতি লক্ষ করছিল। মদ খাওয়া অপছন্দকর তার নজরে। ছেলেকেও খাওয়া হতে বিরত রাখে। তবে ব্রান্ডের মদগুলো লুকোচুরি করে এনে রাখে অঞ্জয়। তাও আবার তারই আর্দশ ছেলের আদেশে। সে বলে খাইনা কিন্তু লুকোচুরিভাবে খাওয়ার জন্যে উৎপেতে বসে থাকে। যা কখনো সম্ভব হয় না তার বাবার জন্য। বাবা দেখায় মদের দিক হতে নজর সরিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে। পা হতে রক্ত ঝরছে। ছেলের পাশে মলিন মুখে বসে বলে,

‘নিজে কষ্ট পেয়ে আমাকেও কষ্ট দিলি বাবা! রক্তে যে আমার পায়ে ব্যথা করছে। যদি ইনফেকশন হয়ে স্ক্রিন ক্যানসার হয়। তখন কি হবে!’

উচ্চশব্দে ‘ড্যাড’ বলে থামিয়ে দেয় আরভীক। রাগ নেই মাথায় শুধু মেয়েটার প্রতি চাপা ক্রোধ ঘুরপাক খাচ্ছে। এ মুহুর্তে বাবার সামনে প্রকাশ করতে ব্যর্থ । বাবার পা হতে রক্ত ঝরছে দেখে গলা চেঁচিয়ে অঞ্জয়কে ডাক লাগায়।
অঞ্জয় ঘুমে ঝিমুচ্ছিল। ডাক শুনে অন্তআত্মা কেঁপে উঠার ন্যায় দৌড় লাগায়। বসের রুমে এসে দেখে এলাহি কান্ড ঘটে গিয়েছে। নিশ্চুপে বাবার পায়ের রক্ত মুছে অয়েনমেন্ট লাগিয়ে দিচ্ছে। ব্যান্ডেজ করে পা আস্তে করে মেঝের উপর রাখে। আরাজ চাপা হেসে বলে,

‘এত ব্যথাও পায়নি যেমনে তুই যত্মে রাখছিস।’

‘ড্যাড প্লিজ।’

আরাজ মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করার ভান দেখায়। আরভীক চাপা দৃঢ়চিত্ত শ্বাস নেই বাবাকে ধরে দাঁড়ায়। বোকার মত চেয়ে আছে অঞ্জয়। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে বলে,

‘ওয়াট অক্সের মত চেয়ে আছস কেন!’

‘আপনি ডেকেছিলেন।’

‘মিথ্যে কথা বলে বলে বাড় বেড়েছে তোর। সর সামনে থেকে।’

গর্দভের মত হা করে কাঁদো মুখ করে ফেলে অঞ্জয়। সে নিশ্চিত স্যারই তাকে ডেকেছে! আসতে না আসতেই মত পাল্টে পল্টি খেল। গিরিসঙ্কট আছে বোধ হয় তার বসের উপর। কেমনে কোন রুপে পল্টি মারে আজও ধরতে পারিনি সে। বাবাকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে বলে,

‘গুড নাইট ড্যাড এন্ড সরি ফর….।’

বাক্য পরিপূর্ণ করতে পারিনী তার পূর্বেই আরভীক এর কান মলে দেয় আরাজ। আর্তনাদে ‘আহ’ করে উঠে। করুণ গলায় আকুতি করে।

‘আর বলব না চ্যাম্প এবার ছেড়ে দাও।’

কান ছেড়ে দিল আরাজ। ছেলেকে আঙুল দেখিয়ে বলে,

‘মনে থাকে যেন।’

মাথা নেড়ে রুম থেকে বের হতে গেলে বাবার ডাক পেয়ে থেমে যায়। স্বচক্ষে ছেলেকে ইশারায় পাশে বসে সঙ্গ দেওয়ার আকুতি জানায়। মুচকি হেসে বসে আরভীক। আরাজ ছেলের পিঠে মালিশ করে অজানা হওয়ার ভান করে বলে,

‘ছেলে কি প্রেমে পড়েছে নাকি ফেঁসেছে।’

বাবার কথায় পুরুপুরি নির্বোধ বনে গেল আরভীক। ভ্রু বাঁকিয়ে কপাল চুলকায়। ভাবে ‘ড্যাড কোন প্রেমের কথা বলছে! আমি কারো সঙ্গে প্রেম করছি আমিই জানি না স্ট্রেঞ্জ!’

‘এই বাবা বল না বউমা কেমন দেখতে!’

‘ড্যাড বি পজেটিভ। পায়ে ব্যথা পেয়ে দেমাগ হারিয়েছো কি! আমি প্রেমে পড়ব। এই আরভীক ফাওয়াজকে প্রেমে ফেলার মত মেয়ে জম্মেনি এখনো।’

কপাল চাপড়ে উঠে আরাজ। দুঃখি মুখ করে চোখ বন্ধ করে কপালে হাত রাখে। আফসোসপূর্ণ গলায় বলে,

‘ব্যস কাহিনী খতম। এই পোলার বিয়ে দেখার শখ পূরণ হইবো না। তোর জন্য মেয়ে খুঁজতে গেলে এমন ডায়লগ যদি মারস। তাহলে বিগত কয়েকবছরেও বউ পাইতি না। আমারও নাতী/নাতনীর মুখ দেখার সুভাগ্য হবো না।’

‘ড্যাড পায়ের ব্যথায় তুমি সেন্স হারিয়ে ফেলেছো।’

কোনোমতে কথার ছলে পালিয়ে যায় আরভীক। যা দেখে আরাজ মুখ বাঁকিয়ে ‘স্টুপিড সান’ বলে ছেলেকে গণ্য করে। ফোনটা ড্রয়ারের উপর থেকে নিয়ে অফিসের ম্যানেজারকে কল দেয়।

‘ইয়েস স্যার।’

‘ঐ আরভীক কোন মেয়েরে জব দেবে। তার ডিটেলস আমাকে পাঠাস।’

‘ওকে স্যার বাট এখনো জয়েনড হয়নি।’

‘আরে গাধা হওয়ার পরই দিবি।’

থতমত খেল ম্যানেজার। মালিকের কথার জবাব দেওয়ার আগে কল কেটে দেয়। তিনি বেচারা হতছাড়ার মত দাঁড়িয়ে হিসেব মিলাছে। ছেলে মেয়ে বসাবে বলে জায়গা খালি চাই,বাপ মেয়ের ডিটেলস চাই। বাপ-ছেলের আক্কেল কোনদিকে খই গেল কে জানে!

৫.
দুদিন পাড় হয়ে গেল। সময়ের গতিতে আনজুমা সবলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছার অপেক্ষায় আছে। আজ সে তার কাজের স্যালারি পাবে। ক্লাব যেহেতু বেসরকারি আয়োজনস্থ কেন্দ্র সেহেতু কাজের স্যালারিও বেশি। মাস শেষে মোটা অংকের টাকা পায় বলে বাসায় এসে ছেলের সঙ্গে ভালো সময় কাটাতে পারে। ঘুমন্ত আশফির কপালে গভীর চুমু একেঁ দেয়। বার কয়েক চুলে হাত বুলিয়ে পরিপাটি হয়ে নেয়। তম্মধ্যে চলে এলো বিউটিখালা। তিনি আত্মীয়তার সম্পর্কে এলেও স্যালারি হিসেবে পাঁচ হাজার টাকা দেয় আনজুমা। অসহায় মহিলা সংসারে ছেলের কাছে মূল্যহীন। ছেলের বউ চাকরাণীর মত খাটায়। অথচ তাড়িয়ে দেয় না। কেননা তাড়িয়ে দিলে ঘরের কাজকর্ম করবে কে! ছেলের বউ ভুলেও কাজে হাত দেয় না। ফলে বিউটিখালাকে দিয়ে রাতদিন কামলার খাটিয়ে যাবে। নিরবে তারই মত নিশব্দে কাজ সেরে ফেলে। দিনশেষে ভাত তো জুটে।

‘মা কই হারিয়ে গেলে।’

বিউটিখালার কণ্ঠে ধ্যান ফিরে আনজুমার। মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে কিছু না বোঝায়। ছেলের কাছে বসতে বলে বেরিয়ে যায় দরজা আঁটকে। ক্লাবের দিকে যেতে বাসস্ট্যান্ডের সামনে আসে। আজ রিক্সা-সিএনজি পাওয়া যাচ্ছে না। রক্তদানের জন্যে মানুষের আনাগোনা বহুল বেড়েছে। চট্টগ্রামের মত পাবনায়ও ভয়াবহ অগ্নিকান্ড হয়েছে। দু জেলায় মর্মান্তিক ঘটনা টিভিতে লাইফ দেখে আশফি খুব ভয় পেয়ে ছিল। অগ্নিকুন্ডের ভিডিওটি যে ছেলে করছিল। বিস্ফোরণের পর সেই ছেলের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। অথচ ফোনে রয়ে গেল ভিডিও। যেখানে বিস্ফোরণ হওয়ার পরও মানুষের মর্মভেদী শব্দের হাহাকার শুনা যাচ্ছিল। ছেলে ভয়ে তষ্ট হয়ে কেঁদে ছিল। ফলে টিভি বন্ধ করে দেয়। পাবনায় অগ্নিকুন্ড হয়েছে তা পাবনায় বসবাসরত তার বাবার বন্ধুর মেয়ের কাছ থেকে জেনেছে। একসময় বাবার বন্ধুর পরিবারের সঙ্গে বেশ কাতির ছিল আনজুমার। যা কালের বিবর্তনে ফাটল ধরে বিচ্ছেদ হয়ে যায় আনজুমার সঙ্গে। হয়তো পরিবারের সঙ্গে এখনো যোগসূত্র রয়েছে।

‘এই আপা আপনি যাননি কেনো!’

বাসের কন্ডাক্টর যিনি বাসের আসা-যাওয়ার সময় নির্ধারণ করে। তিনি এসে উক্ত কথাটি বলায় আনজুমা ভ্রু কুঁচকে সামনে থাকায়। বাসটা মেইন রোড পাড় করে চলে গিয়েছে। আনজুমা পড়ল বিপাকে। ক্লাবে দেরিতে পৌঁছালে স্যালারি পাবে না। স্যালারি পাওয়ার নির্দিষ্ট সময় নয়টা থেকে দশটা। এখন বাজে নয়টা দশ। চিন্তিত নয়নে চৌপাশে কোনো সিএনজি বা রিক্সা পায় কিনা দেখছে।

অন্যথায় আরভীক কার্যালাপ দেখছিল আনজুমার। চেহারায় তার অস্থিরতা,উত্তেজনা কাজ করছে। যা দেখে পৈশাচিক হাসি দিয়ে বলে,

‘স্যালারির অপেক্ষায় কাতর তুমি। অথচ রাতে আমাকে বড় বড় বাণী শুনালে। ভুল করেছো। আজকের স্যালারি পাওয়া তোমার লাইফের কালো দিন হবে।’

আনজুমার দিকে মন্থরগতিতে গাড়ি এগিয়ে নেই। যেখানে ধ্যান নেই তার। সে পথের মধ্যে এক গাড়ির অপেক্ষায় কাতরাচ্ছে। আনজুমার সন্নিকটে এসে আরভীক সজোড়ে হর্ন বাজায়। যার দরুণ কেঁপে মৃদু চিৎকার করে উঠে আনজুমা। কান চেপে ভর্য়াত দৃষ্টিতে পিছু ঘুরে তাকায়। আরভীক ফাওয়াজ কে এসময় পিছে দেখে রুহ যেন বেরিয়ে আসার উপক্রম। চোখের সানগ্লাস সরিয়ে গ্লাস নামিয়ে কাছে আসতে ইশারা করে আরভীক।
বাধ্য মেয়ের মত জানালা অব্দি এলে সোজাসুজি অফার দেয় গাড়িতে উঠতে। পৌঁছে দিবে! আনজুমার উঠতে খটকা লাগছে। ভীষণ শান্ত মুখশ্রী দ্বারা কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস বোঝানো হচ্ছে কি! ব্যাগ চেপে চুপটি মেরে দাঁড়িয়ে তবুও নজর বুলিয়ে যাচ্ছে। এ জোয়ালামুখির সঙ্গে যাওয়ার চেয়ে ভালো কোনো ঠেলাগাড়ির চাচার সঙ্গে যাওয়া। কিন্তু কপালে বোধ হয় আরভীক এর গাড়িতে উঠার ছিল। কোনো গাড়িই লিভ দিতে আগ্রহদীপ্ত নয়। দ্ব্যর্থতার শ্বাস নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে আরভীক এর পাশে বসে পড়ে। সন্তপর্ণে গাড়ি স্টার্ট দেয় সে। রাস্তায় দুজনার মাঝে কথা হলো না। আরভীক আড়চোখে উপলদ্ধি করেছিল আনজুমার ড্রেসআপ। শালীনতা ক্লাবে যেমন বজায় রাখে তেমনটা বাহিরের চলাফেরাও রয়েছে।

‘আজ তোমার সঙ্গে গেম খেলা হবে।’

আরভীক এর কথার অর্থ না বুঝায় আনজুমা বলে উঠে।

‘বুঝিনী আপনি কি আমায় বলছেন।’

‘না আমি নিজের মনকে বলেছি।’

দ্বিতীয় কোনো কথা বলেনি। ক্লাবের সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে দিল। আনজুমা নেমে যাওয়ার পর ধন্যবাদ দিয়ে ভেতরে চলে যায়। গাড়িতে বসে সে ক্লাবের ম্যানেজারকে কল দেয়।

‘সে আসছে যা করতে বলেছি তা করা স্টার্ট দাও।’

‘ওকে স্যার।’

কাসুন্দি মিটনাইট ক্লাব💥

ক্লাবে এসে ভীড় দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে গেল আনজুমা। ক্লাবে কাজরত সঙ্গী মোট পাঁচজন। তাদের সবার হাতে মোটা বান্ডেল দেখে ঢোক গিলে আনজুমাও এগিয়ে যায়। কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ায়। তার ছেলে সঙ্গী তখন লাইনে ছিল। ছেলে বান্ডেল পেলে আনজুমা আগায়।

‘স্যার আমি আনজুমা আবান। আমার স্যালারি।’

কাউন্টারের লোকটি মাথা নেড়ে কম্পিউটারে নাম চেক দেয়। চেকলিস্টে নাম দেখে স্যালারি এগিয়ে দেয়। আনজুমা পনেরো হাজার টাকার বান্ডেল পেয়ে খুশিতে চোখের পানি ছেড়ে দেয়। কাউন্টার হতে বেরিয়ে চলে যেতে নিলে ডাক পড়ে ম্যানেজারের। সে তৎক্ষণাৎ স্যারের কেবিনে গেল। ম্যানেজার পান চাবাচ্ছিল আনজুমা এলে বসতে বলে।

‘এই নাও রেজিকনেশন লেটার।’

হতবাক হয়ে গেল আনজুমা। কাজে কোনো ধরনের গাফিলতি করে না সে। তার ফলেও কেনো বের করে দিবে! কাঁপা গলায় বলে,

‘আমার শাস্তি কি!’

‘তুমি অস্বীকার করে ছিলে বেড পার্টনার হতে।’

টনক নড়ে তার। স্বাভাবিক দৃষ্টিজোড়া ম্যানেজারের উপর ফেলে। একরাশ বেদনায় অতিষ্ঠ হলো তার হৃদয়। বিনাবাক্য ব্যয় করে রেজিকনেশন লেটার নিয়ে বেরিয়ে যায়। স্যালারি পেল আর কি চাই! মাসের খরচ ভেবেচিন্তে করতে হবে। ভাবান্তর আনজুমাকে দেখে মৃদু হাসে আরভীক। গাড়ি সরিয়ে গাছগাছালীর পিছনে আড়াল করে রেখেছে। সে দেখতে চাই মেয়ের কাতরতা। যে কিনা রাতে তাকে অপমানে কুটির বানিয়ে ছিল। সেও দেখতে চাই তার অপমানিত চেহারা। ফোনের রিং এ আরভীক কলটি পিকআপ করে।

‘স্যার মেয়েগুলো রেডি।’

‘হুম টং দোকানের কাছে পাঠিয়ে দাও। গেম সেখান থেকেই শুরু হবে।’

অঞ্জয় ঢোক গিলে তার পাশে থাকা মেয়েদের যেতে ইশারা করে। তারা গেলে অঞ্জয়ের মনে খানিক খারাপ লাগে আনজুমা নামের মেয়েটির জন্যে। সে বুঝেও পাচ্ছে না কেন মেয়েটা স্যারকে সাটিসফেকশনলেস বলতে গেল! সিধাসাধা চলনের মেয়েটির মনে কুৎসিত কথা থাকতে পারে ভাবেনি সে। এখন স্যার যে অপমানের ফাঁদে ফেলবে। তা শুধু নিজের পৈশাচিক আনন্দের জন্য। তপ্তহীন শ্বাস নিয়ে অফিসের কাজে মনোনিবেশ করে। তার কাজ আজ অব্দিই আছে। কাল থেকে সে ম্যানেজার পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হবে বলে লেটার পেয়েছে। স্যারের পিএ ছিল এখন ম্যানেজার পদে নিয়োগ হওয়ার লেটার পেয়ে তব্দা খেয়ে ছিল বটে। প্রশ্নহীন লেটার নিয়ে আজকের পিএ হিসেবে কাজ দেখেশুনে নেই।

টংয়ের দোকানে কিছু ম*দখো*ড় মেয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। আনজুমা কাধের ব্যাগটি চেপে ধরে। তাদের পাশ কাটিয়ে টংয়ের দোকান থেকে পেট্রিস,বন,চিকেন রোল কিনে। স্যালারির টাকা থেকে একশ বিশ টাকা দিয়ে দেয়। টংয়ের দোকান হতে হেঁটে বার দুয়েক মাইল এগিয়ে গেলেই তার বাসার সামনে চলে আসবে। বিনা দ্বিধায় এগিয়ে যেতে নিলে ব্যাগ কেউ শক্ত করে চেপে ধরে। ধুক করে উঠে আনজুমার স্পন্দন। মেয়েগুলোর লিডার মদ খেয়ে সামনে দাঁড়ায়। আপাদমস্তক আনজুমাকে দেখে তার সাথীদের উদ্দেশ্য বলে,

‘বালিকা বাখড়া পেয়েছি রে। এই মাইয়া কত আছে ব্যাগে বের কর।’

কথাটি শুনে ভড়কে গেল আনজুমা। আজই সুখময় হতো জীবন। তার পূর্বেই স্যালারি হাতড়ে নিবে। না, সে প্রতিবাদ করবে। কাঠিন্য গলায় বলে,

‘আ আমার ব্যাগে টাকা নেই। কসমেটিক্স আছে।’

‘আচ্ছা আমাগো বেক্কল ভাবিস। ঐ সখি মাইয়ার ব্যাগ নিয়া আমারে দে চাই।’

আনজুমার ব্যাগ ধরতে নিলে জোরোসরে ধাক্কা দেয় তাদের। মেয়ে দুজন রেগে এগিয়ে আসতে নেই, দৌড় লাগায় আনজুমা। নির্জন রাস্তা হওয়ায় তাকে সহায়তা করার মত কাউকে পায় না। প্রাণপণে দৌড়ে যায় যেন ছেলের জন্যে আমানত রক্ষা করতে পারে। সখি তার সাথীদের থামতে বলে রাস্তা থেকে একটি পাথর কুড়িয়ে ছুঁড়ে মারে। পাথরটি আনজুমার পায়ে লাগায় মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। হাতের কনুই এ প্রচন্ড জ্বালতে থাকার দরুণ বুঝতে পারল ব্যথা পেয়েছে। কপাল রাস্তায় লাগায় কেটে গিয়েছে। মেয়েগুলো এসে দাঁত কেলিয়ে শয়তানি হাসি দেয়। কপাল চেপে নিভু দৃষ্টিতে মেয়েগুলোর হাসি দেখে তার বুকের যন্ত্রণা বেড়ে যায়। কষ্টের স্যালারি ছেলের জন্যে কামিয়েছিল। যা আজ মদ*খো*র মহিলাদের কবলে পড়ে গেল। সখিকে তার লিডার বলে,

‘ঐ দেখছিস কি ! অফিসার হক্কোল আওয়ার আগে সব মাল বের কইরা লো না।’

সখি গিয়ে ব্যাগ খুলে টাকার বান্ডেল পেল। যা বের করে লোভাতুর চোখে বাকি মহিলাদের দিকে তাকায় চোরা অট্টহাসি দেয়। টাকা নিয়ে আনজুমার দেহের কাছে গেল। ততক্ষণে জ্ঞানহীন প্রায় সে। সখিকে ধাক্কা মারায় সে খুব চেঁতে আছে মেয়েটার উপর। বিধেয় হাসতে থেকে আঘাত দেয় আনজুমার পেটে, বুকে। গুরুতর আঘাতের চটে পূর্ণ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তারা মিলে টাকা ভাগ করে চলে যাওয়ার পথে। সখি কি ভেবে যেন চোরাচোখে তাকিয়ে আনজুমার গলায় থাকা সোনার চেইনটা লুপে নেয়। মহিলাদের সঙ্গে তৎক্ষণাৎ বিদায় হয়। নির্জন রাস্তায় পড়ে রইল আনজুমা।

৬.
আরভীক এর চৈতন্যে কেনো যেন খারাপ লাগছে। আনজুমার সঙ্গে হওয়া প্রতিটা দৃশ্যই তার চোখের সামনে হয়েছে। তবে আঘাতের দৃশ্যটা তার গায়ে লাগল। দাঁতে দাঁত চেপে অঞ্জয় কে মেসেজ পাঠায়।

‘ঐ মেয়েদের ধরে রাখবি। আমি আসলে রায় দেব।’

গাড়ি থেকে বেরিয়ে আনজুমার নিকট গেল। ঠোঁট ফেটে,কপাল কেটে, হাতের কনুই হতে রক্তক্ষরণ হচ্ছে দেখে হাত মুঠোবদ্ধ করে দম ফেলল। অপমান করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার আদেশ ছিল, আঘাত করার নয়। কোট খুলে আনজুমাকে কোটের সঙ্গে মোড়িয়ে কোলে উঠিয়ে নিল। বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস শব্দ তীব্রবেগে বাজতে লাগে তার। তোয়াক্কা না করে গাড়িতে বসিয়ে সেও বসে মেডিক্যালের উদ্দেশ্য রওনা দেয়।
মেডিক্যাল এ ভর্তি করিয়ে জানতে পারে। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত মেয়ে। দূর্বল, খাওয়া-দাওয়া নিতান্তই কম তার। শুনে গিল্টি ফিল করে আরভীক। মেডিক্যালের শোধ মিটিয়ে অপেক্ষা করে মেয়েটার জ্ঞান ফেরার।
ডক্টর এসে বলে তিনঘণ্টা পর জ্ঞান আসবে। তিনঘণ্টা হতে সময় আছে। তাই সে আনজুমাকে ছেড়ে অফিসে রওনা দেয়। গেম তো সবেই শুরু।
আরভীককে অফিসে দেখে অঞ্জয় এগিয়ে গেল। সে সোজা আদেশ করে মেডিক্যাল এ যেতে। আনজুমার কাছে থাকতে। কথাটা শুনে দ্বিমত করেনি। কেননা সে জানে এমনি কিছু হবার ছিল। দৃঢ়প্রণে চলে যায়। সিটে গা হেলিয়ে দিল। আজ তার কাজে মন বসবে না। তার বুকে অজানা গিল্টি ফিল হচ্ছে। কেনো সে নিজেও জানে না! হয়তো মেয়েটার কন্ডিশন শুনে না হয় গুরুতর আহত করার দ্বায়ে। মাথা চেপে ধরে মনপ্রাণ শান্ত করার প্রয়াস করে।

‘না আরভীক তুই স্ট্রং। তাকে আঘাত পেতে হবে, আমার শারী*রি*ক সক্ষমতার উপর জোর গলার শাস্তি পেতে হবে। ক্ষতি হয়েছে, লাভও হবে। বাট দ্যা প্রপিট উইল বি লাইক হেল ফর ইউ মিস আবান।’

বাকাঁ হেসে চায়ের অর্ডার দেয়। কম্পিউটার ওপেন করে আজকের মিটিংগুলো হায়ার করে। অঞ্জয় না থাকায় একা হাতে সামাল দেয় আরভীক। মিটিং এটেন্ট করতে ডাকে তার ব্যক্তিগত কাউন্সিলে। প্রেজন্টেশনের কাজ শেষ হলেই কারর্সের নোমিনেশন তৈরি করবে।
চা এলে অতৃপ্ত হলেও খেল। কেননা চা বানানোর ক্ষেত্রে দপ্তরিগুলো হেলা করে। কখনো তৃপ্তি পায়নি খেয়ে। তাদের থেকে সে নিজেই চা বানিয়ে খেতে জানে। তবুও কাজের ঠেলায় বানানোর সময় সুযোগ পায় না। কম্পিউটারে প্রজেক্ট সেটআপের সময় আকস্মিক কেউ তার গালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে আরম্ভ করে। হাত দিয়ে পিঠ খামচি দেয়। চমকিত হলো আরভীক। কি হচ্ছে বুঝতে বেগ পেতে হলো না তার! অগ্নিশর্মা রুপ ধারণ করে নিল ক্ষণিকের মাঝেই। পিঠ-হাত ঝাপটানি দিয়ে ধাক্কা দেয় মেয়েটিকে। ধাক্কা খাওয়ায় হুমড়ি খেয়ে টাইলসের উপর পড়ে মেয়েটি। শর্ট ড্রেস,গলা উম্মুক্ত,পিঠে ট্যাটু লাগানো যা দেখতে বিশ্রি লাগছে আরভীক এর দৃষ্টিকোণে। মেয়েটি খোলামেলা রুপের ঝলক নিয়ে মেয়েখেলা করতে এসেছে। যার দরুন ক্ষোভিত দৃষ্টিতে জোরসরো শ্বাস নিতে থাকে আরভীক। শান্ত ভঙ্গিতে দেখে মেয়েটি টাইলসের উপর তখনো শায়িত আছে। মুখ সামনে মোড়ে রাখায়। পেছনের খাটো চুল দৃশ্যমান। যেন রাজকুমার এসে তাকে উঠিয়ে নিবে! এমন কল্পনার মধ্যে জল ঢেলে দিতে ভীষণ আনন্দবোধ করে সে। পরিণামে মহিলা গার্ড ডেকে পাঠায়। তারা এলেই মেয়েটি সাধুসুলভ ন্যাকা কণ্ঠে বলে,

‘আইম ইউর ক্লাইন্ট আরভীক। আউট অফ কানাডা।’

কথাটি আরভীক এর কর্ণপাত হতেই থামিয়ে দিল গার্ডসকে। ইশারায় বেড়িয়ে যেতে বলে। তারা গেলে সে স্থিরচিত্তে গিয়ে মেয়েটির মুখোমুখি হলো। মেয়েটি অপরিচিত বটে,ভাব হলো বউয়ের মত। যা দেখে মুচকি হেসে ঠোঁট কামড়ে পিছু মোড়ে সে । মেয়েটি ভাবে আরভীক তার ফাঁদে পা রেখেছে। কিন্তু তার ভুল প্রমাণিত হলো হাতে গরম স্যুপের ছ্যাকায়। আরভীক ইচ্ছেকৃত পিছে মোড়ে স্যুপের বাটি নিয়ে মেয়েটির হাতে ফেলে। স্তদ্ধ হয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে উঠে। আরভীক কান চেপে ধরে গার্ডস বলে ডাক দেয়। এতে মহিলা গার্ডস এসে মেয়েটিকে ধরে নিয়ে যায়। আরভীক বাঁকা হেসে বলে,

‘আইম নট এ্যা বিগ হার্টেড পার্সন এট এল।’

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here