নেশাক্ত প্রণয়োণী পর্ব -০৪

#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০৪

‘স্যার ম্যাডাম পালিয়ে গেছে।’

পানি খেতে গিয়ে বিষম খেল আরভীক। মুখ থুবড়ে কেশে দেয়। হঠাৎ কাশি দেওয়ায় মিটিংয়ের ক্লাইন্টর্স ড্যাবড্যাব করে তাকায়। কেননা কাশির থেকে থুথু গিয়ে পড়ে অন্য এক ক্লাইন্টের পিএয়ের শার্টে। বেচারা বোকার মত মুখ করে কি হলো বোঝার জন্যে দুসেকেন্ড সময় নিল। বুঝতে পেরে তার বসের দিকে তাকায়। সে মিটমিটিয়ে হেসে ইশারা করে পরিষ্কার করে আসতে। ভোঁতা মুখ করে বেরিয়ে যায়। তবে আরভীক সরি বলতে ভুলেনি। ফোনটা সজোড়ে বন্ধ করে দেয়। অঞ্জয় পুনরায় কলব্যাক করে। কিন্তু রিসিভ হলো না উল্টো শুনা গেল অপরপাশের ফোন বন্ধ। শুনে কৌতূহলী নয়নে ফোনের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘লেটেস্ট নিউজ শুনিয়েও লাভ হলো না। স্যারের কি চমকানোর অভ্যাস নেই! এত নরমাল বিহেভ কেমনে করে ভাই। আমার তো বদহজম হয়ে যায়।’

ডক্টর আকুতিভরা কণ্ঠে অঞ্জয়কে অনুরোধ করে।

‘স্যারকে প্লিজ ক্ষমা করতে বলবেন। জ্ঞান ফিরতেই পাগলামি করছিলেন চলে যেতে। বলছিল তার ছেলে নাকি কাঁদবে।’

‘তার ছেলে’ কথাটি বজ্রপাতের ন্যায় শুনায় অঞ্জয়ের কানে। ভুল শুনছে ভেবে ডক্টরকে জিজ্ঞেস করে।

‘ডক্টর তার ছেলে বলতে ম্যামের বাচ্চাকাচ্চা আছে কি!’

‘আই ডোন্ট নো স্যার। আরভীক স্যার ট্রিটমেন্ট করাতে এনে ছিলেন।’

আনমনে সন্দেহ পুষে সে। কেননা আরভীক স্যারের লোক হয়ে সে যা খোঁজ পেয়েছে তার থেকে শুধু জানতে পেরেছে আনজুমা নামের মেয়েটি একা ভাড়া ফ্লাটে থাকে। তার সঙ্গীপথ কেউ নেই। অনেকের মুখে মেয়েটিকে নিয়ে চর্চা হয়। ‘সংগ্রামী মেয়ে’ বলে উপাধি দেয়। রহস্য আছে নাকি চক্রান্ত বুঝতে পারছে না অঞ্জয়। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে ঘেঁটে দেখার চেষ্টা করবে। আরভীক স্যারকে মিথ্যে বানোয়াট কাহিনি বুঝিয়ে দমিয়ে নেবে। মেডিক্যাল হতে অফিসের রাস্তার দিকে গাড়ি ঘুরায়।

৭.
‘মাম্মা তোমার কপালে কি হছে!’

আশফি কান্না করে অস্থির প্রায়। মাকে হালকা চোট পেতে দেখলেই দিনদুনিয়া ভুলে মাকে আদর করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে রেখে নিশ্চুপে। বিউটিখালা চলে গিয়েছে একঘণ্টার মত হবে। ক্লান্ত-দূর্বল শরীর নিয়ে বাসায় এলে বিউটিখালা জানার চেষ্টা করে ‘কি হয়ে ছিল’ । তবে এড়িয়ে গেল আনজুমা। তিনিও হাল ছেড়ে চলে যায়। আশফি মায়ের ক্লান্তিকর চেহারা দেখে মায়াভরা কণ্ঠে বলে,

‘মাম্মা আমি তোমাল জন্যে পাস্তা আনছি।’

খিদের চোটে খেতে আরম্ভ করে আনজুমা। ছেলের মুখেও লোকমা তুলে দেয়। কাজ করার শক্তি নেই শরীরে। কি বলবে ছেলেকে তার জন্যে কামাই করা টাকা লুটে নেওয়া হয়েছে! খাওয়ানো হয়ে গেলে বুকে জড়িয়ে কেঁদে দেয় সে। মাকে কাঁদতে দেখে ছোট কোমল হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দিতে থাকে আশফি। সেও নিভু চোখের অশ্রু ঝরায়। যা আনজুমার চোখ এড়িয়ে গেল। ভোর সকালে ফোনের তীব্র আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায় আনজুমার। গতরাতে মা-ছেলে কেঁদেকুটে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে ছিল। সাত সকালে ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য কড়া শাস্তি দিতে ফোনটি রিসিভ করে।

‘ঐ কোন বদখো*ড় বলদ রে! ভাই বুঝছি তুই কল সার্ভিসের ঠেলায় ঘুমাস না। তার মানে এ না যে আমিও রাত জেগে ঘাস কাটতেছি। তুই কু*ত্তা,বিলাই,খটাইশা পোলা। সাত সকালে কাঁচা ঘুম ভাঙ্গানোর দায়ে তোর উপর মামলা দেব হা*রা*মী গর্দভ।’

কট করে ফোনটা রেখে আশফিকে জড়িয়ে ধরে। অঞ্জয় সাত সকালে ঝারি খেয়ে বোবা হয়ে গেল। আরভীক শান্ত নেত্রযুগলে লেপটপে ফাইল সাজাচ্ছে। স্যারের নিকট ফোন এগিয়ে বলে,

‘স্যার এরপর থেকে স্যালারি বাড়িয়ে দিয়েন।’

‘হুম ভাবতেছি মাস শেষে না বছর শেষে তোকে স্যালারি দিব।’

ব্যস ঠোঁটের উপর আঙুল চেপে চুপ দেখায় নিজেকে অঞ্জয়। কারণ আরভীক যদি সত্যিই বছর শেষে স্যালারি দেয়। তাহলে পকেটমানি, দানাপানি জুটবো না। মাস শেষে যা পাই তাও অনেক সন্তুষ্টজনক। বছর শেষে পেতে পেতে নিশ্চিত বুড়া হয়ে যাবে! কানে ব্লুটুথ লাগিয়ে ক্লাইন্টের নির্বাচিত প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলা শুরু করে। চাপা মুখ বাঁকিয়ে অঞ্জয় চলে যেতে নিলে আরভীক ‘অঞ্জয়’ বলে ডাক দেয়। ঢোক গিলে ইদুঁরের মত চোখ করে তাকায়। একটা খাম এগিয়ে দিল তার নিকট। খাম দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে বলে,

‘স্যার আপনি আমার উপর এতটাই ইমপ্রেস হলেন যে মাস শেষ হবার আগেই পেমেন্ট দিয়ে দিচ্ছেন। উফ স্যার আই লাভ ইউ।’

বিরক্তিতে কপাল চুলকে লেপটপের দিকে দৃষ্টিপাত রাখে আরভীক। অঞ্জয়কে খোঁচা মারার উদ্দেশ্যে ত্যাড়া কণ্ঠে জবাব দেয়।

‘এট ফাস্ট আইম নট এ গে*। সেকেন্ড দিজ ইজ নট ইউর পেমেন্ট। থার্ড ডোন্ট এক্ট লাইক এ ফুল।’

তিন বাক্য উচ্চারিত করে নবাবের মত মুখ করে ধ্যানরত হলো সে। ফাটা বাঁশ খেয়েছে মনে হলো অঞ্জয়ের। বাঁশ চাবানোর ভান করে খামটা খুলে। এগ্রিমেন্ট লেটার নাম ‘আনজুমা আবান’ লিখা। বিস্ফোরিত চোখে বসের দিকে তাকায়। আমতা আমতা করে মুখ খুলতে নিলে আরভীক গাম্ভীর্যভরা কণ্ঠে বলে,

‘তোর ফাটা বাঁশ চালু করলে জানালা থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেব।’

ব্যস অঞ্জয়কে আর পাই কে একদৌড়ে তার বসের রুম থেকে চলে যায়। আনমনে হেসে দেয় আরভীক। সে জানে ফোনের মধ্যে ঝারি খেয়েছে অঞ্জয়। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে খবর শুনার জন্য প্রস্তুত থাকে না। অথচ অঞ্জয় আটঁসাট ওভার কনফিডেন্ট নিয়ে বলে ছিল, ‘সে পারবে আনজুমা ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলতে।’
তবে হলো হিতে বিপরীত। আজ দুপুরের দিকে তার কানাডার ফ্লাইট। ইচ্ছে না হলেও যেতে হবে। কানাডায় গিয়ে প্রজেক্ট দেখানো হলে, পাবলিস্টেড হবে উন্নতিসাধক।

‘বাবা ফ্রি আছিস।’

বাবার কণ্ঠ পেয়ে চোখ তুলে তাকায় আরভীক। আরাজ সাহেব মৃদু হেসে ছেলের পাশে বসে। তড়িঘড়ি সব মিটমাট করে লেপটপ বন্ধ করে দেয়। এখন সময় হলো শুধু বাপ-ছেলের।

‘বাবা না গেলে হয় না।’

‘কেনো ড্যাড এটা তোমার ড্রিম ছিল। কানাডায় আমাদের কারর্স পাবলিস্টেড করা।’

ঢোক গিলে আরাজ সাহেব। মুখে ভেসে উঠে অকৃত্রিম ভয়ভীতি। ছেলের কথার পিঠে নজর সরিয়ে দৃঢ় শ্বাস নিয়ে বলে,

‘তুই বরং যাস না। তোর বদৌলে অঞ্জয়কে পাঠা।’

আরভীক সন্দেহের দৃষ্টিতে তার বাবার দিকে তাকায়। চেহারায় আজকের মত অস্থিরতা, দাম্ভিকতা দেখেনি। একরাশ চিন্তিধারার ফলে কপালে ভাঁজ পড়েছে তার। বাবার আকস্মিক উদ্দিনতা ভয়াবহ রুপে পরিণত হলো। কাশতে লাগল বেগতিক। আরভীক ‘ড্যাড’ বলে তার বাবার বুকে মালিশ করতে থাকে। গার্ডস কে ডাক দেওয়ায়। তারা বসের রুমে এসে হাজির হয়। আরাজ স্যার এর বুকে ব্যথা উঠেছে,শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার। আরভীক গার্ডকে ধরতে বলে দৌড়ে তার বাবার রুমে গেল। ইনহেলার না পাওয়া পর্যন্ত তার বাবা কাশতেই থাকবে। ইনহেলার তন্নতন্ন করে খোঁজে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় বাবার রুমের কোথাও ইনহেলার নেই! মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গেল আরভীক এর। চুল টেনে তড়িৎবেগে বাবার কাছে গেল।
ড্যাডকে কাঁধে নিয়ে গাড়ি বের করতে বলে আরভীক। গার্ডস পিছু নিতে গেলে সে সকলকে বলে,

‘ইনহেলার নিয়ে আসতে।’

ড্রাইভার দরজা খুলতেই আরভীক তার বাবাকে ভেতরে বসায়। ইতিমধ্যে কাশি থেমে গিয়েছে তার। পুরু দমে নিস্তেজ শরীরে পিটপিটে চোখ দিয়ে দেখছে। আরভীক করুণ গলায় বলে,

‘ড্যাড ডোন্ট ক্লোজ ইউ আইস প্লিজ।’

‘বা বা বাবা তো কে তোকে সত সত্য এক এ ক ক…।’

বাক্য পূর্ণ করতে পারল না আরাজ সাহেব। নেতিয়ে পড়ে চোখ বন্ধ হয়ে যায় তার। আরভীক ‘ড্যাড’ বলে আহাজারি করে। ড্রাইভারকে অতি দ্রুত গাড়ি মেডিক্যালে নিয়ে যেতে বলে। তবে খোদার কি নির্মম খেলা!
গাড়ির টায়ার পান্চার হয়ে যায় আইসক্রীম দোকানের সামনে। আরভীক দুঃখে ‘শিট নো নো ড্যাড’ বলে তার বাবার চৈতন্য ফেরানোর চেষ্টা করে। ড্রাইভারকে অন্য ব্যবস্থা করতে বলে, ব্লুটুথ দিয়ে অঞ্জয়কে কল দেয়। কিন্তু তার ফোনে সংযোগ যাচ্ছে না। ভাবমূর্তি রুপে গাড়ি থেকে বেরিয়ে দরজাগুলো খুলে দেয়। যেন বাতাসের চলন বেড়ে যায়।

৮.
গার্ডেন প্লেসে দাঁড়িয়ে আশফি বল নিয়ে খেলছে। বল কে একবার দেওয়ালে ছুড়ে মারে তো আরেকবার পা দিয়ে খেলতে থাকে। বল পুনরায় মারার পর সেটি দিক হারিয়ে অন্য জায়গায় পড়ে। একটা সাদা গাড়ির নিচে তলিয়ে যায়। আশফি ঠোঁট ফুলিয়ে চোরা চোখে দেখে আস্তে ধীরে গাড়ির কাছে গেল। বলটা হাত নিয়ে চলে যেতে নিলে। আঙ্কেল টাইপ এক লোককে কষ্ট পেতে দেখল। এগিয়ে যায় সে। আরভীক তার বাবাকে চিৎ করে শুয়েছে। হাত-পা মালিশ করছে। জ্ঞান ফেরানোর প্রচেষ্টা। অসুস্থ অবস্থা দেখে আশফি দৌড়ে তার মায়ের কাছে গেল। খুব ভোরে উঠে না তারা। তবে তার মায়ের ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় আশফির। ক্লান্ত আনজুমা তখনো প্রশান্তির ঘুমে মগ্ন। তাই মাকে না ডেকে সে নিজেই খেলা করতে থাকে। ভাড়া বাসা হলেও নিচতলায় থাকে তারা। যেন বের হয়ে অন্যান্য মানুষের সঙ্গে গার্ডেনে খেলা করতে পারে। মাকে ঘুম থেকে টেনেহিচঁড়ে জাগিয়ে দেয় আশফি। থতমত খেয়ে আনজুমা ‘কি হয়ছে কি হয়ছে’ বলে উঠে পড়ে। আশফি মায়ের মুখ তার মুখোমুখি করে বলে,

‘মাম্মা দাদুভাই অসুস্থ , দাদুভাই অসুস্থ ।’

আনজুমা হতবাক। তার ধারণাতীত আশফির কোনো দাদুভাই নেই, সে বিয়ে করে ছিল পরিবারহীন এক স্বামীকে। যার কোনো জাত-বংশ পূর্বে ছিল কি ছিল না তা অজানা। সুখের মোড়ে ভেসেছে তারা। কিন্তু এক কালো রাতে হারিয়ে যায় তার প্রাণপ্রিয় স্বামী। ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটে ছেলের ডাকাডাকিতে। অসহ্য হয়ে আশফির কথায় সায় দিয়ে উঠে পড়ে। আয়নার সামনে চুল ঠিক করে কালো হিজাব ও আবায়া পরে বের হলো। আশফি টেনে সাদা গাড়ির সামনে নিয়ে আসে। অবাক হলো আনজুমা। গাড়িতে আরভীক এর যন্ত্রণাভরা আর্তনাদ দেখে শিউরে উঠে সে। আশফি কে দাঁড় করিয়ে রেখে তড়িঘড়ি চোখ বুলায়। আরভীক তার পাশে কাউকে শায়িত হতে দেখে চোখ তুলে তাকায়।
আনজুমাকে দেখে কেনো যেন তার ভরসার স্থান পেল। কিন্তু আরভীক এর সঙ্গে কোনো প্রকার কথা বলেনি । পুরুপুরি উপেক্ষা করে বয়স্ক লোকটির শ্বাস প্রশ্বাসের অবস্থা পরীক্ষা করে। মন্থরগতিতে চলছে। বুঝতে পারল লোকটি শ্বাসকষ্টের রোগী। উপযুক্ত সময়ে ইনহেলার না পাওয়ায় অজ্ঞান হয়েছে। তবে মারাত্মক কোনো ঘটনা ঘটবে না। সে তার আঙ্কেলের বয়সী লোকটাকে সহায়তা করতে আরভীক এর উদ্দেশ্যে বলে,

‘পারলে উনাকে নিয়ে ভেতরে আসুন। জ্ঞান ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।’

কথার বিপরীতে নিশ্চুপে কাজটি করে গেল আরভীক। বাবাকে কাঁধে নিয়ে আনজুমার ফ্লাটে ঢুকে পড়ে। পিছুপিছু ছোট আশফি যে আসছে এ খেয়াল তখনো করেনি আরভীক। আনজুমা দরজা আঁটকে দেয়। আরভীককে চিন্তাহীন হওয়ার জন্যে মৃদু হেসে বলে,

‘আঙ্কেলকে কাত করে রাখেন। চিৎ করে শুয়ালে সমস্যা হবে।’

মাথা নেড়ে সে তার বাবাকে কাত করে। আনজুমা বার কয়েক জোরালো ভাবে বুকের উপর চাপ প্রসারিত করে। এতে আকস্মিক মৃদু কেশে দেয় আরাজ। চৈতন্য ফিরে আসায় আরভীক তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

‘ড্যাড কেমন লাগছে এখন ! আমাকে ভয় পেয়ে দিয়ে ছিলে। তোমার কিছু হলে আমিই ইয়াং বয়সে হার্ট এ্যাটার্ক করতাম।’

আহাম্মক বনে গেল আরাজ সাহেব ছেলের কথায়। চোখ বুলিয়ে অচেনা জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করে। বিছানার পাশে ছোট শিশুকে দেখে হাতের ইশারায় কাছে ডাকে। আরভীক ছোট শিশুকে দেখে হা হয়ে যায়। পুচকো ছেলে কখন থেকে বাসায় ছিল ধ্যানই দেয়নি। কিন্তু কার ছেলে সে!

‘আঙ্কেল আদার চা খান শ্বাসকষ্ট কমে যাবে।’

মেয়েলি কণ্ঠ শুনতে পেয়ে আরাজ প্রথমত চেহারার দিকে তাকায়। কোমল মুখশ্রীর, শ্যামরুপবর্তী নারী হিজাব ও আবায়া পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। নূর উপচে পড়ছে তার আচরণে। আরাজ নম্র কণ্ঠে চা নিয়ে বলে,

‘কে তুমি মা!’

‘ড্যাড তুমি শ্বাসকষ্টের কারণে অজ্ঞান হয়ে ছিলে। তোমার ভয়াবহ অবস্থা দেখে মাথা ফাঁকা হয়ে গিয়ে ছিল আমার। তখন মিস আবান এসে সহায়তা করে। তাদের ফ্লাটেই আমরা আছি এখন।’

‘মাশাআল্লাহ মুবারাকান!’

উচ্চশব্দে আরাজ সাহেব বলে উঠে। আরভীক ও আনজুমা বুঝার জন্য প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি নিয়ে দেখে। থতমত খেল তিনি। আমতা আমতা করে আনজুমাকে জিজ্ঞেস করে।

‘কে কে আছে তোমার পরিবারে মা।’

‘পরিবার’ শব্দটির বিশাল গভীরত্ব মাপার সাধ্য নেই আনজুমার। সে এক জীবনে বেঁচে আছে ছেলের সঙ্গ নিয়ে। মুচকি হেসে আশফিকে আগলে ধরে বলে,

‘এই আমার পরিবার, আমার সন্তান।’

‘আমার সন্তান’ কথাটি শুনে একমুর্হুতের জন্যে আরভীক এর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল যেন। চোখ বড় হয়ে যায় তার। ছোট শিশুর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকায়। অনুশোচনা প্রখর হলো তার। এবার বুঝতে পেরেছে গতকাল এ নারীর প্রতিবাদ করার ক্ষমতা, সাহসিকতা কেমনে হলো বা পেলো! চোখ ফিরিয়ে নেয় সে। হাতমুঠোবদ্ধ করে ঐ নারীগুলোকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার দৃঢ় মনোবল তৈরি করে। সেই সঙ্গে নিজের অনুশোচনা প্রকাশ করে ক্ষমা চাওয়ার প্রবল শক্তি যোগায়। আরাজ সাহেব শুনে দুঃখ প্রকাশ করে। তিনি বেদনার সুরে বলে,

‘তোমার কষ্ট হয় না মা। সংসার চালাতে।’

‘না আঙ্কেল আমি ম্যানেজ করে নেই।’

‘কোথাও চাকরী করো!’

‘জ্বি আঙ্কেল আমি ক্লা….।’

আনজুমার শেষাক্ত কথাটির পরিবর্তে আরভীক সশব্দে বলে উঠে।

‘ক্লাবিয়ান গার্লস মেডিক্যাল কলেজে দপ্তরির কাজ করে ও।’

আরাজ সাহেব সন্দেহের চোখে ছেলের মতিগতি লক্ষ করে বলে,

‘তুই কেমনে জানিস!’

‘ওহ ড্যাড আর ইউ ফরগেট দ্যা ফ্রাইডে ইভেন্ট ইন ক্লাবিয়ান মেডিক্যাল কলেজ!’

তিনি মনে করতে পেরে প্রশংসীত হলো। আনজুমা কি হলো ব্যাপারটা তা জানতে আরভীক এর দিকে তাকায়। কিন্তু সে গা-ছাড়া ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রাগ হলো আনজুমার। ওত ভালো মানসিকতা রোপন করে কে হে! সেও বলতে নিলে তার বাহু চেপে ধরে কান বরাবর এসে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘ডোন্ট সেয়ে এ সিঙ্গেল ওয়ার্ড মিস আবান। আদারওয়াস ইউ উইল বি পানিশড।’

‘আঙ্কেলের দশা খারাপ দেখে চুপ আছি। না হলে আপনার হাল বেহাল করে দিতাম।’

‘তোমাকে দেখে বেহাল প্রথমেই হয়ে গিয়েছি। দ্বিতীয়বার আর কিভাবে করবে!’

দাঁত কটমট করে আনজুমা আঙুল তুলে বলতে নিলে আরাজ সাহেব এর কথা শুনে থেমে যায়। তিনি আশফিকে কোলে নিয়ে আদর করছিল। এরই সুযোগে আরভীক আনজুমার সঙ্গে ছাইপাশ কথাবার্তা বলে পৈশাচিক হাসি দেয়। যা দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে আনজুমা। তবুও মন শক্ত করে মৃদু হেসে আঙ্কেলের দিকে দৃষ্টিপাত করে।
আরাজ সাহেব আনজুমাকে বলে,

‘এখনো চাকরী করছো!’

‘না আঙ্কেল গতকাল বের করে দিয়েছে।’

মনটা ক্ষণিকেই বিষাদগ্রস্থ হলো আনজুমার। বিষয়টা জেনে তিনি গর্জন মিশ্রিত কণ্ঠে শুধায়।

‘এত বড় কলিজা তাদের। এমন কোমল মেয়েকে বের করে দিল। ওদের তো আমি দেখে নিচ্ছি। এই আরভীক তুই আজকেই ওদের চাকরী থেকে বরখাস্ত করে দিবি। নতুন কাউকে নিয়োগ দিবি বুঝছিস। ওহ হে তোর পিএ পদ খালি আছে তাই না!’

আরভীক শুনে বাকাঁ হাসি দিল এ যেন মোক্ষম সুযোগ। হাত মেরে দেওয়ার জন্যে। মেঘ না চাইতেই জল পাওয়ায় সময় বিলম্ব করল না। তবে সে কি দোষ করল! ব্যাড বয়েস সুযোগ লুপে নিতে তৎপর থাকে। তবুও বানোয়াট নাটক রচার জন্য আমতা আমতা করে বলে,

‘ড্যাড আমার পিএ পদে শ্রেয়া কে রাখব।’

ভ্রু কুঁচকে তাকায় আরাজ সাহেব ছেলের দিকে। কর্কশপূর্ণ গলায় জিজ্ঞেস করে ‘কে এই শ্রেয়া।’
বাবাকে ফোঁসলানোর জন্য বলে উঠে।

‘ড্যাড শ্রেয়া ইজ মাই ফিউচার গার্লফ্রেন্ড। ক্লাবে পরিচিত আমরা। তাকে প্রমিস করে ছিলাম পিএ পদে রাখব। এখন তুমি বাদ-রিজেক্টের কথা বলে মন ভুলাইও না আমার।’

‘চুপ বেয়া*দব। বাপের মুখের উপর তর্ক করিস। তোর শ্রেয়া নাকি ফ্রেয়াকে আমি রেস্টিগেইট করছি। তার পদে একমাত্র আনজুমা মায়ে কাজ করবে।’

‘না আঙ্কেল কি বলছেন আমার এডুকেশনাল কোয়ালিফিকেশন বেশি নয়।’

‘কোথায় অব্দি পড়েছো।’

‘এইচএসসি পার্সড।’

‘কত বছর হলো!’

ইতস্তত বোধে নুয়ে গেল আনজুমা। সে এর উত্তর দিতে পারবে না। ছোট বেলা থেকে পড়াশুনার প্রতি জোঁক ছিল তার। এক দেখায় পড়া আত্মস্থ করে ফেলতো। সেই সুবাদে কেজিতে ভর্তি করানো হলে। বছরের তালে এইচএসসি পরীক্ষার্থী হবার পর বিয়ে পড়িয়ে দেয় ‘সুয়াইব’ নামের পুরুষের সঙ্গে। যে তার মৃত স্বামী। আরাজ ও আরভীক জানার দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকে। আনজুমা গলা ঝেড়ে বলে,

‘আঙ্কেল আপনি এখন সুস্থবোধ করছেন!’

আরভীক আনজুমার অস্বস্তিবোধ বুঝে গেল। ইশারায় তার বাবাকে আশ্বস্ত করে সে বিষয়টা আমলে নিবে। আরাজ সাহেব মৃদু হেসে বলে,

‘হে মা আমরা এখন আসি।’

কথাটা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে আনজুমা। তারা বেড়িয়ে গেলে আরভীক পিছু মোড়ে আশফির মুখোমুখি হয়। ঢোক গিলে ঠোঁট কামড়ে চেয়ে থাকে আশফির দিকে। আশফি কি ভেবে যেন আরভীক এর কানের পিঠে লম্বা হওয়া একটি চুল টান দিয়ে হাতে নিয়ে ফেলে। হঠাৎ টান দেওয়ার দরুণ মৃদু আর্তনাদের সুরে ‘আহ’ করে উঠে আরভীক। হাত দিয়ে চুলের ব্যথাতুর জায়গায় কচলাতে থেকে রাগী দৃষ্টিতে আশফির দিকে তাকায়। অথচ আশফি তার রাগী দৃষ্টি উপেক্ষা করে খিলখিলিয়ে হেসে দেয়। যেন এটি তার কাছে নিতান্ত স্বাভাবিক বাচ্চামী খেলা। আরভীক হতচ্ছাড়া নেত্রযুগলে চেয়ে রইল। আজ পর্যন্ত বসের ক্যাটাগরিতে থেকে কেউ চুল অব্দি হাত দেওয়ার সাহস পায়নি। সেখানে বাচ্চাটি কিনা চুল টেনে ছিঁড়ে নিল। মা যেমন ছেলেও তেমন!
আরভীক আশফির কান মলে দিতে নিলে আনজুমা জোয়ালামুখি রুপ নিয়ে দাঁড়ায়। আরভীকের দিকে আঙুল দেখিয়ে রাগী গলায় শুধায়।

‘ডোন্ট ইউ ডেয়ার টু টার্চ মাই চাইল্ড মিস্টার আরভীক। একদম ভালো করছে চুল ছিঁড়ে। আমি হলে চুল ন্যাড়া করে দিতাম।’

‘স্টুপিড গার্ল কি বললে তুমি!’

‘কেন বয়রা যে কানে শুনেননি। নিজেকে দেশের প্রেসিডেন্ট মনে করেন। আপনার কথায় সব চলবে না। ইটস মাই অন বিজনেস।’

‘ওহ ম্যাডাম প্লিজ। আমারও কাজ করে অভাব পড়েনি মেয়ের যে আপনার পিছে টাইম ওয়েস্ট করব। এট লিস্ট মাই ড্যাড’স অর্ডার। দ্যাটস ওয়াই আই ক্যান কনসিডারেট ইউ।’

‘ওকে ডোন্ট টলারেট মি ! নিজের চরকায় তেল দেন।’

‘ওয়াট!’

‘ননসেন্স।’

‘ইউ গার্ল…।’

‘ইয়াহ্ আইম গার্ল আই নো দ্যাট।’

দাঁতে দাঁত চেপে হজম করে নিল আরভীক। সদর দরজার সামনে খিটখিটে পরিবেশ তৈরির চেয়ে ভালো চুপচাপ কেটে পড়া। যে হারে খেয়ে ফেলার মত তাকিয়ে আছে মেয়েটা। নিশ্চিত মনমেজাজে শত’খানেক গালির দোয়া দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আনজুমা হাতের আঙুল দেখিয়ে গাড়ির দিকে ইশারা করে। আরভীক মুখ বাঁকিয়ে চলে যায়। আরাজ প্রতিটা দৃশ্য দেখে মিটমিটিয়ে হাসে ছেলের চোখের আড়ালে। গাড়িতে উঠে ফোনের মধ্যে রেকর্ডিং পেল অঞ্জয়ের। ব্লুথুট অন করে আড়চোখে তার বাবাকে দেখে নিল। তিনি প্রাকৃতিক ধ্যানমগ্ন থাকায় অঞ্জয়ের রেকর্ডিং ওপেন করে শুনে।

‘স্যার আনজুমা ম্যাডামকে আতঙ্কে ফেলতে যে মেয়েদের পাঠানো হয়ে ছিল। তার মধ্যে একজন পালিয়ে গেছে। পলাতক মেয়েটির ঘনিষ্ঠ সাথী ছিল তাদের লিডার শিল্পা। সে বলেছে, সখীকে সাদা ফর্সা বিদেশী ধরনের দেখতে এক ছেলে ভিটার মধ্যে এসে নিয়ে গিয়েছে। কোন ছেলে বা কেনো নিয়ে গিয়েছে তা জানতে পারিনি। সরি স্যার।’

অঞ্জয়ের কথা শুনে আরভীক বাঁকা হেসে বলে,

‘কাঁচা খেলোয়াড় হয়ে পাক্কা খেলোয়াড়ের সঙ্গে টক্কর। সাউন্ড’স ইন্টারেস্টিং।’

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here