নেশাক্ত প্রণয়োণী পর্ব -০৫

#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০৫

‘মেয়ে পা’চার’কারী হয়ে কেমনে বড় গলায় কথা বলতে পারিস হুম! বুক কাঁপে না। এর শাস্তি কি হতে পারে জানস।’

আরভীক ট্যুরিস্ট ছেলেটার চৌপাশ ঘুরে ফিরে কথাটি বলে। ছেলেটা অন্য কেউ নয় বরং সেই ছেলে যে আনজুমাকে হ্যা*রা*স করতে চেয়ে ছিল। তার ঘাড়ের উপর ছুড়ি নিয়ে মন্থরগতিতে রেখা বানাচ্ছে। ছেলেটা ছাড়া পাওয়ার জন্য নড়চড় করতে থাকে। আরভীক বাংলায় যা বলেছে এর শব্দাক্ষরও বুঝেনি ছেলেটি। ইংরেজিতে উল্টো প্রশ্ন করে উঠে।

‘ওয়াট ইউ সে বা*স্টার্ড!’

‘বাংলা বুঝিস না ও বুঝবি কেমনে তুই তো ইংরেজির মাংস খাওয়া ছেলে।’

‘আই উইল কি*ল ইউ বয়, লিভ মি।’

‘মুরগির মত ছটপট করছিস। সেই তুই আবার আমাকে মারার কথা বলিস। নাইচ জোক অফ দি মোমেন্ট। অঞ্জয় প্লিজ টেক দ্যা বেস্ট কেয়ার অফ মাই গেস্ট।’

বাকাঁ হাসি দিয়ে আরভীক অপর পাশের রুমে প্রবেশ করে। যেখানে সখী নামের মেয়েটিকে মহিলা গার্ডস শাস্তি দিচ্ছে। সখীর চেহারার রঙ বদলে দিয়েছে তারা। ফর্সা মুখশ্রী একদিনেই কালো,ব্যথাতুর মুখশ্রীতে পরিণত হয়েছে। হাতঘড়ির দিকে একপলক তাকিয়ে মহিলা গার্ডকে প্রশ্ন করে।

‘জিন্দা আছে না মরে গেল।’

‘স্যার মরেনি বেঁচে আছে।’

‘ওহ কৈ মাছের প্রাণ। প্রব্লেম নেই আমার কাটগড়ায় বেশিদিন বাঁচবে না।’

সখী চমকে উঠে। ছলছল দৃষ্টিতে ঝাপিয়ে পড়ে আরভীক এর পায়ের কাছে। ক্ষমা পাওয়ার লোভে বেদনার গলায় বলে,

‘স্যার আমারে ছাইড়া দেন। আমি কিছু করি নাই। কথার উপরে চলছি।’

‘মিথ্যে কথা,বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণা নিয়ে আরভীকের ডিকশনারিতে একটি মাত্র শব্দ আছে। সেটি হলো ‘শাস্তি’। কি ভেবেছিস তুই! আনজুমার উপর নিজের ক্ষোভ ঝারবি আর আমি না বুঝার ভান ধরে ছেড়ে দেব।’

এবার যেন গলাফাটা মরা কান্না দিয়ে উঠে সখী। তার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে আরভীক এর সন্নিকট হতে গেলে সে স্বশরীরে পিছিয়ে যায়। তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট গোল করে ‘ছুহ্ ছুহ্’ শব্দ করে ভাবনার মত গালে হাত দিয়ে বলে,

‘এই পুরুষের উপর শুধু এক নারী ছুঁয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। অন্য নারীর ছুঁয়া হলো ঐ যে শিকলবিদ্ধ করা। আর তুমি শিকলবিদ্ধ হতে চলেছো। গার্লস প্লিজ টেক হার প্রপার রেস্ট।’

পা পিছে মোড়ে চলে যেতে নেয়। দরজা অব্দি এসে পায়ের কদম থামিয়ে দেয়। আড়চোখে সখীর গলার দিকে তাকিয়ে বাকাঁ হাসি দিয়ে এগিয়ে যায়। মহিলা গার্ডকে ডেকে বলে,

‘গ্লাভস আর একটি কেঁচো দাও।’

মহিলা গার্ডটি মাথা নেড়ে কেঁচোর বক্স থেকে একটি কেঁচো বের করে আরভীক এর হাতে দিল। সে হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সখীকে বলে,

‘কেঁচো শরীরের জন্য বেশ অপকারী প্রাণী।’

কথাটি বলে দিগিদ্বিক না ভেবে সখীর গলার উপর ছেড়ে দিল। লম্বা সুতাকৃতির কেঁচো ধীরস্থির চলনে সখীর কানের দিকে এগিয়ে যায়। সখীর আর্তনাদময় কণ্ঠ চার দেওয়ালের মাঝে বারি খাচ্ছে। তখনি তার গলায় মৃদু ছুঁড়ি দিয়ে দাগ এঁকে দেয় আরভীক। ধারালো ছুড়ির আঘাতে সখীর গলায় থাকা চেইনটির হুক খুলে মেঝেতে পড়ে। আরভীক সন্তপর্ণে চেইনটি নিয়ে সযত্নে বাক্সে রেখে দেয়। মহিলা গার্ডকে ইশারা করে সখীর ব্যবস্থা নিতে।

১০.
পুলিশ অফিসারের এর সামনে শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে আরভীক। তার পাশে চিন্তিত মুখশ্রী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফাহাদ ও সায়াজ। আজই তারা ভার্সিটির গন্ডগোল মিটিয়ে অফিসে এসেছিল বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু এসেই আশ্চর্য হলো! অফিসের বাহিরে পুলিশের গাড়ি।
এমপ্লয়ের ভাষ্যমতে আরভীক ফাওয়াজ কে এরেস্ট করা হয়েছে আমেরিকান রাজনীতিবিদ ক্লেভ কে কিডনাপ করার দায়ে। কথাটি শুনে হতবাক তারা। আরভীক নিজের বাক্যে কোনো কিছু বয়ান বা প্রমাণ করেনি। বরং শান্তশিষ্ঠ স্বভাব বজায় রেখে অফিসারের সঙ্গে গেল। অঞ্জয় ঢোক গিলছিল বারংবার। কেননা সে অনিশ্চিত সময়ের অপেক্ষায় আছে! অফিসারের উপর তন্ডব পড়বে।
আরভীক ফাওয়াজ যার কাজে কেউ ঠ্যাং নাড়াতে পারে না। সেখানে অফিসার গর্বিত বুকে এরেস্ট করে নিয়ে যাচ্ছে। থানায় আরভীক কে নানান প্রশ্ন করছে অফিসার। যার উত্তর সাধুসিধে কণ্ঠেই দিল সে।

‘আপনি মিস্টার ক্লেভ কে কোথায় রেখেছেন!’

‘হু ইজ ক্লেভ। আই ডোন্ট নো।’

‘দেখেন মিস্টার ফাওয়াজ! আপনি সম্মানিত ব্যক্তি। যার উপর হাত উঠানো দন্ডিয় অপরাধ।’

‘আপনি হাত উঠাতেই পারবেন না অফিসার।’

আত্মবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ভ্রু নাঁচিয়ে আরভীক বলে। যা শুনে হাতমুঠো বদ্ধ করে ফেলে অফিসার। তার নিকট ক্লেভের পরিচিত দলবৃন্দ কেস ফাইল করেছে। তাদের মতে ক্লেভের সঙ্গে আরভীক এর শত্রুতামি ছিল। বিধেয় অফিসার ক্রিমিনাল হিসেবে সর্বপ্রথম আরভীককে বিবেচনায় রেখে গ্রেফতার করে। তিনি উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে গলা উচিঁয়ে বলে,

‘দেখুন মিস্টার ফাওয়াজ শেষ বার জিজ্ঞেস করছি। আপনি ক্লেভকে কোথায় রেখেছেন! না বললে আপনার উপর লিগ্যাল অ্যাকশন নেবো আমি।’

অফিসারের উচ্চ শব্দে থানার হাবিলদাররা চুপ হয়ে যায়। থানায় যে হৈচৈ হচ্ছিল তা মিইয়ে যায়। তবে আরভীক,ফাহাদ ও সায়াজ এ তিনজনের মাঝে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। আরভীক পানির গ্লাসটা এগিয়ে দেয় অফিসারকে। তিনি একপলক আরভীক এর দিকে তাকিয়ে পানির গ্লাসটি নিয়ে ঢকঢক করে গলা ভিজিয়ে নেয়। পায়ের উপর পা তুলে আরভীক ত্যাড়া বাকাঁ দাঁত দেখানো হাসি দিল। ফাহাদ ও সায়াজ বুঝতে পারে এ হাসির অর্থ কি! তাদের মনপ্রাণ প্রশান্ত হলো। কানের ব্লুথুট স্পিকারে দিল আরভীক। কার নাম্বারে যেন কল দেয়। অফিসার কপালে ভাঁজ ফেলে চেয়ে রইল। মুখ দিয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি আর।
কল রিসিভ হতেই অপরপাশের ব্যক্তি বলে উঠে।

‘আরভীক স্যার আপনি! ওহ মাই প্লেজার স্যার। ওসি সাহেবের কথা কেমনে মনে পড়লো! বলুন কি সহায়তায় আসতে পারি আপনার।’

‘বেশি কিছু না শুধু জানতে চেয়েছি আপনি কি আমার উপর লিগ্যাল ক্রিমিনাল কেসের ফাইল করতে চেয়েছেন।’

আরভীক এর কথায় ওসি সাহেব চমকে গেল। তিনি ঢোক গিলে অজানা দৃষ্টপাতে বলে,

‘স্যার কি বলছেন আপনি! আমার উপর আপনি অনেক উপকার করেছেন! আপনার উপর লিগ্যাল কেস ফেলার কোনো প্রশ্নই আমার মাথায় আসতে পারে না।’

‘ওহ আপনার থানায় আমাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের কথামতে আমি ক্রিমিনাল। ক্যান ইউ সি দ্যাট!’

‘ইয়াহ্ স্যার আমি এখনি বিষয়টার খোলাসা করছি।’

‘থ্যাংকিউ স্যার।’

অফিসার ঘেমে প্রায় একাকার। ফ্যান চলছে তাও চাকরী হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে চিন্তায় শেষ হবার উপক্রম। আরভীক মৃদু হেসে দুহাত টেবিলের উপর রেখে স্বাভাবিক গলায় বলে,

‘অফিসার অফিসারের মত দেশের দুর্নীতি রোধ করুন। কুর্নীতির অংশ হয়ে আমার শাস্তির শিকার হয়েন না। হলে মল্লুক বানিয়ে ছাড়ব। আমার আবার মগের মল্লুক পালার বেশ শখ। কি হবেন নাকি!’

দাতঁ কেলিয়ে আরভীক ফাহাদ ও সায়াজ এর দিকে চোখ টিপ দেয়। তারা ঠোঁট কামড়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিল।
অফিসার ডান হাত গুটিয়ে পকেটে রাখে। যে পকেটে গুলি রাখা সেখানে তীব্রভাবে হাত চেপে ধরে। তার মন চাইচ্ছে এখনি আরভীক নামের লোকটার মাথায় গুলি করে মগজ ফাটিয়ে দিতে। তবে রাগের বশে পড়তে চাইছে না সে। ক্ষণিকের মধ্যে ফোন এলো অফিসারের ল্যান্ডফোনে। আরভীক চোখের ইশারায় ফোন রিসিভ করতে বলে। কিন্তু হাত কাঁপছিল অফিসারের। তাকে রিসিভ করতে না দেখে আরভীক স্ব হাতে ল্যান্ডফোনের হ্যান্ডেল ধরে লাউডস্পিকারের বাটন প্রেস করে। ওসির কণ্ঠে শুনা গেল।

‘অফিসার আর ইউ ইডিয়েট! ডোন্ট’স ইউ ডেয়ার টু এরেস্ট মিস্টার ফাওয়াজ! আপনি জানেন যার নামে কেসের লিগ্যাল অ্যাকশন নিচ্ছিলেন সে কে! তিনি জনগণের জন্য যা করেছেন তার অবদানে জনগণ আপনাকেই মাটিতে পিষে দিবে। এখনি কেস তুলে নেন। আদারওয়াস আই উইল রেস্টিগেইট ইউর পজিশন।’

টুট টুট কল কেটে দেওয়ার শব্দে আরভীক ল্যান্ডফোনটা সযত্নে নিজ জায়গায় রেখে দেয়। অফিসারের দৃষ্টিভঙ্গি স্বাভাবিক। এতক্ষণে অপমান হয়ে সে মূর্তিতে পরিণত হয়েছে। চোখ তুলে আরভীক এর দিকে তাকায়। তাকে অপমানের ফেলার মূলকেন্দ্র বিন্দু হলো এই আরভীক। সে কেমনে তাকে জিন্দা ছেড়ে দেবে। ঠোঁট কামড়ে মাথা নেড়ে যাওয়ার জন্যে সম্মান দেখায়। আরভীক বসা থেকে উঠে চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ায়। তার পিছেই অফিসার হাতে গুলি চেপে ধরে মাথা বরাবর টার্গেট করে। কিন্তু তার হাত-পা ক্রমান্বয়ে কাঁপছে। যেই না ট্রিগার চাপবে তখনি তার হাতে কেউ গুলি চালিয়ে দেয়। রক্ত ঝরতে লাগল অফিসারের হাত দিয়ে। সে আতঙ্কিত চোখে সামনে তাকায়। আরভীক তখনো সামনে ঘুরে আছে। অফিসারের হাত বরাবর বুলেট চালিয়েছে ফাহাদ। আতঙ্কভরা গলায় বলে,

‘আপনি সরকারি পুলিশের উপর গুলি চালিয়েছেন। এর জন্য শাস্তি অনিবার্য করা হবে।’

আরভীক পিছু মোড়ে ফাহাদের কাঁধে হাত রাখে। সায়াজ তাদের দিকে তাকিয়ে অট্টহাসি দিয়ে উঠে। তাদের হাসি যেন ঝংকার তুলেছে অফিসারের রুমে। মনে হচ্ছে মজার জোকস শুনে তাদের গা গুলিয়ে হাসি পাচ্ছে। আরভীক ঢোক গিলে হাসি থামানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে। ফাহাদের দিকে ইশারা করে বলে,

‘মিস্টার ফাহাদ আকবার পজিশন অফ সিআইডি অফিসার। দ্যাটস মিন ইউর হায়ার অফিসার।’

কথাটি শুনে যেন অফিসারের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। আতঙ্কের সঙ্গে ভীতি নজরে ফাহাদের দিকে তাকায়। ফাহাদের গুলিটা আরভীক নিজ হাতে নিয়ে আদর করার ভঙ্গিতে বলে,

‘তোর কি মনে হয় তুই যেতে বলে পিঠপিছে আক্রমণ করবি। আর আমরা বুঝি গর্দভ হয়ে গুলি খেয়ে পাঁচফিট মাটির নিচে শুয়ে পড়ব। না মুন্না, না। তুই তো তোর বাপের হার্ট ভেঙ্গে দিবি। এমন চালাকি বোকাদের মানায়। আর কি জানি বলছিলি ওহ হে! সরকারি পুলিশ,পিস্তল লাইক দ্যাট! তোর প্রশিক্ষণে ভর্তি হওয়ার আগে থেকে সরকারি মাল চালিয়ে ক্রিমিনালের বুক ঝাঝরা করে আসছি। সেখানে তুই ইদুঁর হয়ে সিংহের মুখে পিউপিউ করিস কোন সাহসে! নাউ ফরগেটেড। ফাহাদ আজ কাঁচাকে মাটি পুতে দিস। কাল যাতে লেটেস্ট নিউজ শুনতে পায়।’

ফাহাদ কপালে হাত দিয়ে স্যালুট করে। যা দেখে আরভীক-সায়াজও বন্ধুর মত সায় দিয়ে স্যালুট করে বেরিয়ে যায়। ফাহাদ তাদের যাওয়ার দিকে মৃদু হেসে তৎক্ষণাৎ চোখ-মুখ লাল করে অফিসারের দিকে তাকায়। গুলি তার কপাল বরাবর রেখে বলে,

‘ক্রিমিনালের শাস্তি সবসময় ক্ষমা হয় না। কখনো কখনো মৃত্যুও হয়। যেমন তোর সাথে হবে।’

অফিসার তখনি রক্তাক্ত হাত দিয়ে ফাহাদের পা জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাওয়ার ন্যাকা ভান ধরে। যা দেখে স্বহাতে গুলি নামিয়ে নেয় ফাহাদ। অফিসার গুলি নামাতে দেখে হিংস্র হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে নিলেই ঠাসস করে উচ্চস্বরে গুলির শব্দ হলো। লুটিয়ে পড়ে অফিসার। তার কেবিনের বাহিরে হাবিলদার এসে ভীড় জমিয়েছে। দরজা বন্ধ বলে সাহস পাচ্ছে না ভেতরে প্রবেশ করার। ফলে ফাহাদ তার নিজের শার্টে রক্ত মেখে অসহায় নিরহ রুপের বেশে দরজা খুলে দেয়। হাবিলদার অফিসারের মৃত্যুদেহ পেয়ে প্রশ্নাত্মক চোখে নতুন ব্যক্তির দিকে নজর দেয়। ফাহাদ আরভীক এর পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিনয় চালু করে দেয়। যা শুনে হাবিলদারদের মনে কোনো ধরনের সন্দেহ রইল না। প্রশ্ন করে দ্বিধায় ফেলেনি ব্যক্তিকে।

১১.
আশফিকে কোলে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগছে আনজুমা। সে কি তার আরাজ আঙ্কেলের কথা রাখবে! নাকি অন্য কোম্পানি যেখানটায় জব পেয়েছে। সেখানে জয়েন করে নিবে। আশফি গাড়ির খেলনা নিয়ে খেলা করছে। তার চুলে পরপর বিলি কেটে দিচ্ছে আনজুমা। আকস্মিক চেঁচামেচির তীব্র শব্দে কেঁপে উঠে। আশফিকে বুকে জড়িয়ে ধরে জানালার সামনে এলো। পর্দা টাঙানো থাকায় ভেতরের দৃশ্য বাহিরের লোকজন খেয়াল করতে পারে না। আনজুমা সূক্ষ্মভাবে পর্দাটা হালকা করে সরিয়ে বাহিরের দৃশ্যে পরখ করে। চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। একরোগা দেখতে বয়স্ক পুরুষ বিউটিখালার ফ্লাটে সামনে এসে বিবাদ সৃষ্টি করছে। তার ফ্লাটে প্রবেশ করার জন্যে চিল্লাচ্ছে। আশফি অবুঝ চোখে চেয়ে আছে। মায়ের কোল থেকে নামার জন্যে হাত-পা ছড়াছড়ি করছে। আনজুমা বিরক্ত হয়ে মেঝে থাকা বালিশের উপর বসিয়ে দিল আশফিকে। আর সে গিয়ে পর্দা সরিয়ে ভালো করে শুনার প্রচেষ্টা করে ঐ পুরুষটা কি করতে চাইছে তার বিউটিখালার সঙ্গে!

‘দেহেন আপা আপনার বউমা আমার লগে দিনরাত কাটাইয়া শুয়ছে। এহন তারে আমার মনে ধরছে। ওরে ছাড়া অন্য মহিলারে বিয়ে করতে পারুম না। আপনি এককাম করেন বউমারে দিয়া দেন। হের বদলে আপনারে পঞ্চাশ লাখ টাকার বস্তা ধরাইয়া দিমু।’

কথাটি শুনে কান্নারত মেয়েটির চোখ আতঙ্কিত হলো। সে সন্তপর্ণে তার শ্বাশড়ি মায়ের দিকে তাকায়। ঢোক গিলছে যদি সত্যিই টাকার লোভে পড়ে দিয়ে দেয়। তাহলে তার জীবন এখানেই শেষ! তবে রাখবেই বা কেনো। কম কী জ্বালিয়েছে সে! কামলাবুয়ার মত রাতদিন খাটিয়েছে। অথচ সে বাহিরে টই টই করে পরপুরুষের বিছানার সঙ্গী হয়েছে। স্বামী বিদেশ থাকার দরুণ এ পাপ কাজে অনায়াসে লিপ্ত হয়ে ছিল। পরিণামে পেতে চলেছে পতি*তার নামে বে*শ্যা* মা**। বিউটিখালা একপলক ছেলের বউয়ের দিকে তাকায়। শ্বাশুড়ির চোখের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না সে। চোখ নামিয়ে রেখেছে। অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হচ্ছে। এখন দগ্ধ হয়েও কি লাভ!

‘মা তালাকনামা প্রস্তুত! আঙ্কেলকে মেয়েটাকে নিয়ে যান।’

স্বামীর কণ্ঠ পেয়ে দুঃখভারাক্রান্ত চোখে তাকায় স্ত্রী। কিন্তু স্বামী তার স্ত্রীর দিকে একবারো তাকালো না। বাচ্চা দুটোকে বুকে আগলে নিয়ে তালাকনামায় নিজের সই দিয়ে দেয়। স্ত্রী কুলকিনারা না পেয়ে তালাকনামায় তার সই বসিয়ে দেয়। বিউটিখালা ছেলেকে দেখে চোখের অশ্রু ধরে রাখতে পারল না। জড়িয়ে ধরে বেদনার অশ্রু ঝরাতে থাকে। ছেলেও নিরবে অশ্রু ঝরায়। তার তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে টেনেহিচঁড়ে নিয়ে গেল বয়স্ক লোকটি। মেয়েটি
যেতে না চাওয়ার দরুণ দু-এক ঘা খেতে হলো বয়স্কের পুরুষের হাতে। আর্তনাদভরা কণ্ঠে মেয়েটি তার ছেলেমেয়েকে ডাকছে। কিন্তু বাচ্চাগুলিও মায়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কেননা সে মা নামে কলঙ্ক। বাচ্চা রেখে বাহিরে ঘুরে বেড়াতো। ঠিকমত বাচ্চাদের খাবারের প্রতি যত্ন নিতো না। তার ছেলেমেয়েগুলো আপন বলতে তাদের বাবা ও দাদির আদর যত্ন পেয়েছে। পর্দা টেনে সরে গেল জানালার সামনে থেকে আনজুমা। আশফির দিকে তাকিয়ে ভাবে।

‘কেউ সৎ চরিত্রের হয় না কেনো! জীবন মানেই কি আয়েশ নাকি সংগ্রাম। আজ ছেলে ও তার মা তাদের ঘরের এক অংশ থেকে আজীবনের জন্যে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এ যেন নিরবচ্ছিন্ন কষ্টের সমতুল্য।’

তপ্ত এক শ্বাস ফেলে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল। চুলোয় ভাতের পাতিল বসালো। তরকারি ফ্রিজে থাকায় রান্নার ব্যস্ততা নেই আনজুমার। কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে কিচেনের জানালা খুলে দেয়। যেন বাতাসের চলনে গরমের উত্তাপ কম লাগে। এদিকে দরজায় যে কড়া নাড়ছে কেউ। তার শব্দ শুনতে পাচ্ছে না সে। কিচেনে ফ্রিজের ইঞ্জিনের শব্দ, বাহির থেকে গাড়ির হর্নের শব্দে দরজায় কড়া নাড়ানোর শব্দ অত্যন্ত নিম্ন। আশফি সরু চোখে দরজা খুলতে চেয়ার টেনে দাঁড়ায়। দরজার হ্যান্ডেল ধরতে পেরে। একঝটকায় নামিয়ে দেয়। তখনি হুরমুড়িয়ে ঢুকে পড়ে আরভীক। আশফিকে দেখে ভয় পাওয়ার ভান ধরে সে। যেন কোনো ভূত দেখে চমক খেয়েছে। খিলখিলিয়ে হেসে ফেলে আশফি। আরভীক আড়চোখে আনজুমাকে খোঁজে। না পেয়ে ছোট আশফির নাকে আদুরীয় টান দিয়ে বলে,

‘তোমার মা কোথায় বাবু!’

‘মা তো রাল্লা করছে।’

‘রান্না করছে।’

‘হুম।’

‘তুমি কি জানো তোমার মা এক নাম্বারের খা*টাশী মহিলা। আমার বাপের দেওয়া অফার রিজেক্ট করে। আমি যদি অধিকার খাটাতাম তাহলে তোমার আদুরীয় মাকে একহাতে তুলে আছাড় মারতাম। বজ্জা*ত মেয়ে!’

‘মাম্মা ভালো তুমি পঁচা।’

কথাটি শুনে আরভীক এর চোখ বড় হয়ে যায়। এ যেন মর্মভেদী বাক্য তার কাছে। হাটুমোড়ে মরে যাওয়ার ভান করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। হাত-পা নড়বড় করে মরার ভান চালু রেখে আনাচারী কণ্ঠে বলে,

‘আজ কেউ যদি আমাকে ভালো না বলে। তাহলে কাল আমার মরার নিউজ পাওয়া যাবে।’

আশফি না বুঝায় হাত তালি দিয়ে হাসতে থাকে। আনজুমা চুলোয় বন্ধ করে। হাত ধুয়ে মুখ মুছছিল। আকস্মিক আশফির অগত্যা হাসির শব্দে থমকে যায়। শুনতে পেল বসার রুম থেকে কারো শক্ত পুরুষালীর কণ্ঠ ভেসে আসছে। ভয়ে ঘাবড়ে গেল। হাতে ফ্রাইপেন নিল। চো*র বদ*মাইশ হলে একদমে ফ্রাইপেনের বারি দিয়ে মরা লাশ বানিয়ে দিবে। নিশ্চুপ পায়ে মন্থর গতিতে কিচেন থেকে বের হলো। বসার রুমে এসে দেখে আশফি খেলনা নিয়ে খেলছে। শুকনের মত চোখ নিয়ে সোফার কোণায়, টিভির পেছনে, দরজার পেছনে, পর্দার পেছনে বুলিয়ে নেয়। কাউকে না দেখে আশফিকে আদুরীয় গলায় জিজ্ঞেস করে।

‘বাবা কেউ কি এসেছিল!’

‘হে মাম্মা বাথরোবে গেছে ঐ।’

আনজুমা বুঝে গেল অচেনা লোকটি ওয়াশরুমে কাজ ছাড়ছে। সেও নিরবতা বজায় রেখে ওয়াশরুমের ডান সাইডে দাঁড়িয়ে যায়। ফ্রাইপেন শক্ত করে চেপে ধরে রাখে। যেই না দরজা খুলবে তখনি যেন মাথায় বারি দিতে পারে সেই পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বার কয়েক দুঃসাধ্য কাজ সম্ভব করতে জোরে জোরে শ্বাস নিল। মনে মনে তীব্র প্রতিবাদী রুপ ধারণ করে বলে,

‘ডাকাত মশাই আজই তোর ডাকাতির দফারফা করে দেব। ইশ! হা’গু করে দুগন্ধ করে ফেলতেছে হাগুখো*ড়। জীবনে আর কত রকমের খোড় দেখতে হবে আল্লাহ মাবুদই ভালো জানেন।’

দরজা খুলার শব্দ হলো। ধ্যান ফিরে আনজুমার। ফ্রাইপেনটি উঁচিয়ে ‘বিসমিল্লাহ্’ বলে জোরালো আওয়াজে মাথায় বারি লাগায়।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here