নয়নতারা পর্ব ১৪

#নয়নতারা_১৪
#জেরিন_আক্তার_নিপা

নক্ষত্র রুমে এসে নয়নতারাকে দেখে বলে,

—-ব্যাগ গুছিয়ে নাও। আমরা দুই সপ্তাহের জন্য বেড়াতে যাব।”

কোথায় যাব? কেন যাব? বা আমি যাব না। এরকম কোন কথাই বলল না নয়নতারা। নীরবে মাথা নেড়ে নক্ষত্রের কথায় সম্মতি জানাল। কয়দিন ধরে নয়নের এই ব্যাপারটাই নক্ষত্রর ভালো লাগছে না। মেয়েটা হঠাৎ এরকম চুপচাপ হয়ে গেল কেন? ওকে এভাবে দেখতে ভালো লাগে না। একটু ঝগড়া করবে, কথা বলবে, কারণ ছাড়া জেদ করবে। তবেই না ভালো লাগবে। রিমোট নিয়ন্ত্রিত কোন পুতুলের মত হয়ে গেছে নয়ন। রিমোট নক্ষত্রর হাতে ধরিয়ে দিয়ে নক্ষত্রর ইশারায় চলছে। নক্ষত্রর রাগ হলো৷ সে আজ মনের রাগ দেখিয়েই ফেলল। নয়নের বাহু টেনে ধরে ওকে নিজের সোজাসুজি দাঁড় করিয়ে বলল,

—-হয়েছে কী তোমার? এরকম পুতুল হয়ে গেছ কেন? কে তোমাকে কী বলেছে? তুমি কি আমার কোন আচরণে কষ্ট পেয়েছ তারা? তাই আমার সাথে কথা বলছো না।”

নয়নতারা নক্ষত্রের হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইছে। নক্ষত্র নরম গলায় আবার জিজ্ঞেস করল,

—কী হয়েছে আমাকে বলো। কোনোভাবে আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি?”

—আমার হাত ছাড়ুন।”

নক্ষত্রর রাগ হলো। এই মেয়ের জেদ কমে নি। বরং জেদ করেই চুপচাপ হয়ে গেছে। নয়নের মত ঘাড় ত্যাড়া মেরে এত সহজে ঠিক হবে না। নক্ষত্র নয়নতারার হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরল। রাগে মাথায় আগুন জ্বলছে তার। এত জেদ!

—-এই মেয়ে সমস্যা কী তোমার? আমি তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করছি এটা তোমার হজম হচ্ছে না! কথা বলো না কেন? দু’টা মানুষ একসাথে থাকতে গেলে এভাবে থাকা যায়! তোমাকে বিয়ে করেছি বলে সব দায় কি আমার?”

নয়নতারা হাতে সত্যিই ব্যথা পাচ্ছে। চোখে জল এসে গেল ওর। লোকটা তাকে কখনোই বুঝে না। সব সময় ভুল বুঝে ওর সাথে এরকম করে। তার নিজের কতটা কষ্ট হয় এটা সে কাউকে বুঝাতে পারে না। সবাই তার উপরই সবকিছু চাপিয়ে দেয়।

—-কথা বলবে না তো তুমি?”

চিৎকার করে কথাটা বলে নক্ষত্র। নয়নেরও রাগ হয়। সে-ও প্রায় একই স্বরে চেঁচিয়ে বলে,

—-কী কথা বলব আমি? আমার কথা শোনার জন্য আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন? আমাকে তো আপনি নিজের ইশারায় নাচাতে চান। শুধু আপনি না। সবাই চায়। আমার পরিবারও। বিয়ে দেবার আগেও কেউ আমার কথা ভাবেনি। ইলা আপু পালিয়ে গেছে। সেই দায় আমার উপর এসে পড়েছে। নিজের জেদ ও অসম্মান থেকে বাঁচতে আপনি আমাকে কুরবানির গরু বানালেন। আমি রাজি কি-না? আমার কোন শখ, ইচ্ছে আছে কি-না? সেটা একবারও জানার চেষ্টা করেননি। আপনারা সবাই নিজের কথাই ভেবেছেন। আমি তো মানুষ না। মাটির পুতুল আমি। আমার খারাপ লাগা থাকতে পারে না। আমি কষ্ট পেতে পারি না। যে যেমন বলবেন তেমনটা মেনে নিয়ে আমাকে খুশি থাকতে হবে।”

কাঁদছে নয়নতারা। নক্ষত্র ওর হাত ছেড়ে দিয়ে হতভম্ব হয়ে নয়নের মুখের দিকে চেয়ে আছে। মেয়েটা মনে মনে কষ্ট পেয়ে যাচ্ছে। মুখ ফোটে কাউকে বলছে না। কাকেই বা বলবে? নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগছে তার।

—-আমার বাবা মা এক দিনেই আমাকে পর করে দিল। ওরা জানে ওদের ছাড়া থাকতে আমার কতটা কষ্ট হবে। তবুও ওরা আমাকে জোর করে এখানে পাঠিয়ে দেয়। আমি যেন ওদের সবার কাছে বোঝা হয়ে গেছি। বিয়ে দিয়ে বোঝা মাথা থেকে নামিয়েছে। নইলে আমার বাবা, যিনি আমাকে তার জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসতেন। সে কীভাবে পারল নিজের মেয়ের সাথে এই অন্যায় করতে! মা-ও চুপ করে থাকে। আমার চোখে চোখ রাখে না। রাখবে কীভাবে? মনের মধ্যে মা’রও যে অপরাধবোধ কাজ করছে। সবাই সবকিছু সহজে মেনে নিতে পারে না। মানুষকে একটু সময় দিতে হয়। আমাকে সেই সময়টাও কেউ দেয়নি। বিয়ের পরদিন ওদের সাথে চলে গিয়েছিলাম বলে ঝিনুক আপু আমাকে কত কথা শোনাল। যেই ঝিনুক আপু কখনও আমার কোন কাজে রাগ করেনি। তার চোখে আমি বিরক্তি, রাগ দেখেছি। সেদিনই আমি চলে এসেছি। আমার জন্য কারো কষ্ট না হলে, আমার কেন সবার জন্য কষ্ট হবে? আসার আগে সবাই একটা কথাই বুঝিয়েছে, আপনার কথার অবাধ্য যেন না হই। আমি সেরকম ভাবেই চলছি। অবাধ্য হচ্ছি না। এতেও আপনার সমস্যা। কোথায় যাব আমি? কার কাছে যাব? এখন তো মনে হচ্ছে, আমি মরে গেলেই সবাই বেঁচে যাবে।”

কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে নয়নের। লাল টকটকে দু’টো চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে।

—-আপনার মা’ও আমাকে দেখতে পারে না। সেদিন কতগুলো কথা বলল। আমি লোভী। আমার পরিবার লোভী। আমার বাবা মা’কে নিয়ে যা তা বলেছে। আমার বোনকে নিয়েও যা মুখে এসেছে বলে গেছে। আমরা ছোটলোক। আপনাদের সাথে আমাদের যায় না। আপনাকে যেন আমি ডিভোর্স দিয়ে দিই।”

নক্ষত্র জানত না মা নয়নের সাথে বাজে ব্যবহার করেছে। আসলে জানার চেষ্টা করেনি। মা নিজের দুনিয়ায় ব্যস্ত থাকে। নয়নের সাথে তার কখন কথা হলো। আর হলেও নয়নকে কেন এসব কথা শোনাল। বিয়ে তো সে নিজে করেছে। নয়নতারার পরিবার প্রথমে রাজি হচ্ছিল না। নিজের উপরই রাগ হতে লাগল তার। মেয়েটাকে কেউ বুঝতে চেষ্টা করেনি। জোর করে শুধু ওর উপর পরিস্থিতি গুলো চাপিয়ে দেওয়াই হয়েছে। সে ওই পরিস্থিতির সামনা কীভাবে করবে তা কেউ ভাবেনি।

—-ডিভোর্স দিতে বলেছেন আপনার মা। আমিও ডিভোর্স চাই। এসব আর সহ্য হয়না আমার। আমি হাঁপিয়ে গেছি। এই জীবন আমি কখনও কল্পনা করিনি। আপনি আমাকে ডিভোর্স দিন। বাবা মা যদি আমাকে নিতে না চায়, তাহলে দূরে কোথাও চলে যাব। তবুও এই দম বন্ধ হয়ে আসা সম্পর্কে থাকতে পারব না। নিজের সব খুশি, সব সুখ হারিয়ে গেছে। আমি আমার স্বস্তি কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। এভাবে থাকলে একদিন আমি মরে যাব।”

নয়নতারা কাঁদছে। নক্ষত্র স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নয়নতারাকে দেখল। মেয়েটা কেঁদেই যাচ্ছে। নক্ষত্র ওকে কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতেই এক সময় নয়নতারা ফ্লোরে বসে বিছানায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। নক্ষত্র ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা ওর মা’র ঘরে গিয়েছে। মা’কে ঘরে পেল না। রাগে তার কপালের শিরা দপদপ করছে। এত বছর মা বাবা কেউ তার কোন কাজে নাক গলায়নি। সে কী করছে? কীভাবে আছে জানতে চায়নি। এখন কেন তাহলে তার লাইফে ইন্টারফেয়ার করছে! তারাকে মা ওসব কথা শোনালো কেন? নক্ষত্র মা’কে কল করল। রাগে কিড়মিড় করে বলল,

—-মম, কোথায় তুমি? বাসায় কখন ফিরবে? হ্যাঁ কথা ছিল। সামনাসামনি বলতে চেয়েছিলাম। আচ্ছা তাহলে ফোনেই শোনো। আমার বউয়ের সাথে বাজে ব্যবহার করার কোন অধিকার তোমার নেই। ও যেমন, আমি ওকে তেমন রূপেই গ্রহণ করেছি। আমার শ্বশুর শাশুড়িকে অপমান করা মানে আমাকে অপমান করা। নিজের অবস্থায় ছেড়ে দাও আমাকে। অহ আমাকে নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না, প্লিজ! ছোট থেকে যেভাবে একা ছেড়ে দিয়েছিলে। বাকি জীবনটাও ছেড়ে দাও। আমাকে নিয়ে তোমাদের টেনশন করতে হবে না।”

মা’কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নক্ষত্র কল কেটে দিল। মা যে কেন বুঝতে চাইছে না। নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত সে নিজে নিতে পারে।

—যখন তোমাদের দরকার ছিল। তখন তোমাদেরকে আমি পাশে পাইনি। এখন দরকার নেই। আমি নিজের মত চলতে পারি। আমার জীবন আর ঝামেলা তৈরি কোরো না তোমরা প্লিজ।”

নয়নতারার বাবার শরীরটা বেশি ভালো যাচ্ছে না। নয়নের বিয়ের পর থেকে শরীরটাও কেমন খাপছাড়া ঠেকছে। উনার প্রায় মনে হয় শরীরের ভেতর বড় কোন অসুখ বাসা বেঁধে ফেলেছে। এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। আসলে উনার আসল রোগ নয়নতারা উনার চোখের সামনে নেই।
ইমন, আকিব ওরা ইলাকে খোঁজাখুঁজি করছে। ব্যর্থ চেষ্টা। উনি কখনও ইলাকে বাড়িতে পা রাখতে দিবে না। যে মেয়ে বাবা মা পরিবারের কথা না ভেবে বিয়ের দিন পালিয়ে যায়, সেই মেয়ের মুখ উনি বেঁচে থাকতে দেখবেন না। ইলার অপরাধের শাস্তি তার ছোট মেয়েকে পেতে হচ্ছে। অবশ্য নক্ষত্র ছেলেটা মন্দ না। নয়নের কষ্ট হতে দিবে না। তবুও তো মন থেকে চিন্তা দূর হয় না।

নক্ষত্র ফোনে কারো সাথে কথা বলতে বলতে বাড়ি ফিরে।

—-হ্যাঁ পিক পাঠিয়ে দিচ্ছি আমি। যেভাবে পারিস, যেখান থেকে পারিস ওর খোঁজ বের করে দিবি। না, না। তোদের কিছু করতে হবে না। তোরা জাস্ট এটুকু জানবি ও এখন কোথায় আছে। বাকিটা ওর পরিবার দেখে নিবে। হ্যাঁ রাখছি এখন।’

ঠোঁটে হাসি নিয়ে নক্ষত্র ঘরে এসে দেখে নয়নতারা বসে বসে ঘুমাচ্ছে। চোখ ভেজা। কান্না করেছে। চোখের পানি গালে শুকিয়ে লেগে আছে। নয়নকে দেখে নক্ষত্রর মায়া হলো। মনে মনে বলল,

—-আর কয়টা দিন। তারপর তোমাকে আমি মুক্ত করে দেব। তোমাকে কষ্ট দেওয়া আমার উদেশ্য না নয়ন। তুমি আমাকে ভুল বুঝে নিজে কষ্ট পাচ্ছ।’

নক্ষত্র নয়নতারাকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। ওর মুখের দিকে কতক্ষণ চেয়ে থাকল। আলমারি থেকে ওর আর নয়নের কিছু কাপড় বের করে ব্যাগে ভরে নিল। আজ মা বাড়ি আসার আগেই সে নয়নকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বে। খালামনি মা’কে জানাবে না। ওই দিক দিয়ে টেনশন মুক্ত। সে নিজেও মা’কে জানাবে না কোথায় গেছে ওরা। মা,বাবা কয়টা দিন একটু টেনশনে থাকুক। অবশ্য মা বাবা তার জন্য টেনশন করবে এটা ভাবাও বোকামি। তবুও মা কেন তারাকে কথা শোনালো! একটু শাস্তি তো মা’র প্রাপ্য।
নয়নতারার ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় বসে ছিল নক্ষত্র। ওকে উঠতে দেখে বলল,

—-চলো তাড়াতাড়ি উঠো।”

নয়নতারা হতবুদ্ধি হয়ে নক্ষত্রর দিকে কতক্ষণ চেয়ে থাকল। ঝগড়া হয়েছিল ওদের! এটাই কি ঝগড়ার পরের নমুনা! এতটা স্বাভাবিক। ঘুম থেকে ওঠার সাথে সাথে আগের মতই হুকুম করছে। সাধারণ ভাবেও নয়নতারা কারো সাথে ঝগড়া করলে অন্তত তিন চার দিন তো কথা না বলে থাকে। নক্ষত্রর সাথে তো কত বড় ঝগড়া হলো। তার তো এখন এক সপ্তাহ কথা না বলে থাকা উচিত। নক্ষত্র আবার তাড়া দিল।

—-কী হলো বসে আছো যে! উঠো। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে এসো। যাও তারা।’

নয়নতারা নড়ল না। ঝগড়ার পরে কেউ স্বাভাবিক আচরণ করে না। অনেকদিন রাগ থাকে। সে-ও এমনটা করবে। নক্ষত্র বুঝল এই মেয়ে সহজে কথা শুনবে না। চোখ, মুখ কঠিন করে ফেলল সে। ধমকের সুরে বলল,

—-কথা কানে যাচ্ছে না তারা? কী বলেছি আমি? ওঠে রেডি হতে বলেছি?’

নয়নতারা ভয় পেল। ব্যাগের দিকে চোখ গেল ওর। মনে মনে ভাবল, নক্ষত্র হয়তো তাকে বাবার বাড়ি রেখে আসতে চাইছে। খুশি হয়ে গেল নয়ন। যাক ঝগড়া করে তাহলে ভালোই হয়েছে। ঝটপট ওঠে পাঁচ মিনিটের ভেতর নয়নতারা রেডি হয়ে এলো। নক্ষত্রর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

—-চলুন যাই।’

হতভম্ব নক্ষত্র কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিল। হঠাৎ হঠাৎ এই মেয়ের মাথায় কোন কোন ভূত চেপে বসে তা শুধু এই মেয়েই জানে। নক্ষত্র বুঝতে পারে না। এতক্ষণ কথা শুনছিল না। এখন নিজেই যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে।

—-কী হলো চলুন। যাবেন না?’

—-হ্যাঁ যাব। চলো।’

নয়নতারা খুশি মনে নক্ষত্রর আগে আগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নক্ষত্র ওর মতিগতি বুঝতে না পেরে পেছন পেছন পা বাড়াল।

চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here