নয়নতারা পর্ব ২৬

#নয়নতারা_২৬
#জেরিন_আক্তার_নিপা

নয়ন ঘরে চলে যাবার পর নক্ষত্র ভাবতে লাগল তার শ্বশুরের কানে কাল রাতের কথা তুলেছে কে? এই বাড়ি থেকে কেউ না জানালে ওদের জানার কথা না। নয়ন জানায়নি এটা শিওর। তাহলে বলেছে কে? আজ যদি নয়ন বাবার সাথে চলে যেত তাহলে কি নয়নকে সে আটকাতে পারতো? পারতো না। কিন্তু নক্ষত্রর এটা ভেবে ভালো লাগছে নয়ন বাবার সাথে যায়নি। তার সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

—-নয়ন কি আমাকে ভালোবাসে? ভালো না বাসলে আজ বাবার সাথে গেল না কেন? ওর না যাওয়ার কারণ আর কী থাকতে পারে।”

নয়নদের বাড়ির মানুষ চলে গেলে রামিশা এসে নক্ষত্রর পাশে দাঁড়াল।

—-কারা এসেছিল নক্ষত্র?”

নক্ষত্র রামিশার দিকে ফিরল। কাল রাতের জন্য অনেকটা রামিশাই দায়ী। সে নিজেও দায়ী। রামিশার কথা শোনাই উচিত হয়নি তার। তার আগে নয়নের কথা ভাবার উচিত ছিল। নয়ন তার বউ। নয়নের থেকে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট তার কাছে আর কেউ হওয়া উচিত না।

—-আমার শ্বশুরবাড়ির লোক।”

—-ওহ। কেন এসেছিল ওরা? আর চলে গেল কেন?”

—-তারাকে দেখতে এসেছিল। কেউ কাল রাতের ব্যাপারটা উনাদের জানিয়েছে।”

—-নয়নকে নিতে এসেছিল নাকি! নয়ন কি যায়নি?”

নক্ষত্র রামিশার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। রামিশা কথা অন্য ভাবে ঘুরিয়ে বলল,

—-এরকম সিচুয়েশনে মেয়ের ফ্যামিলি জামাইকেই দোষারোপ করবে। কিন্তু তোমার তো কোন ফল্ট নেই নক্ষত্র।”

নক্ষত্র অন্য কথা ভাবছে। রামিশা সাবধানে জিজ্ঞেস করল,

—-কী ভাবছো নক্ষত্র? ”

—-ভাবছি কাল রাতের কথা আমার শ্বশুরবাড়িতে কে জানিয়েছে। আমি ওদের কিছু বলিনি। তারাও না। তবুও ওরা খবর পেয়ে গেল! সকাল হবার আগেই নয়নকে দেখতে চলে এসেছে। অবশ্য ওকে নিতে এসেছিল। নয়ন যায়নি বলেই নিতে পারেনি। ওদের বলল কে?”

রামিশা বিড়বিড় করল,

—-নয়নতারা যায়নি!”

নয়ন ঘরে এসে ভাবতে লাগল, আজ সে বাবার সাথে চলে গেলে রামিশা ডাইনীটা ফাঁকা বাড়িতে নক্ষত্রকে একা পেয়ে কী না কী করতো আল্লাহ জানে। তার শাশুড়িও তো তেমন নাচুনী। ছেলের বউকে দেখতে পারে না। ওই মেয়েকে কোলে তুলে নাচে। আর তার বরটাও বন্ধু বলতে অন্ধ। বন্ধুর মনে শয়তানি আছে কিনা তা কে জানে।

—-না বাবা না। ওই রামিশার সাথে উনাকে একা ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। আমার বর। আমাকেই তো দেখে রাখতে হবে। নইলে কবে কোন মেয়ে উনাকে চুরি করে নিয়ে যাবে! আমার কপাল পুড়বে তখন। এমনটা আমি কখনও হতে দেব না। উনি আমার বর। সারাজীবন আমার কাছেই থাকবেন।”

নক্ষত্র ঘরে আসে। নয়নকে স্বাভাবিক দেখে সে কিছু বলতে চায়। কিন্তু কীভাবে বলবে ভেবে পায় না। তাকে কিছু বলতে হলো না। নয়নই আগে বলল,

—-আপনি রাতের কথাটা বাবাকে জানাতে গেলেন কেন? বাবা আমার জন্য কত চিন্তা করবে জানেন?”

নক্ষত্র অবাক হয়ে বিস্মিত গলায় বলল,

—-আমি কিছু জানাইনি। আমি আরও ভাবছিলাম তুমি হয়তো…

—-আমি জানাবো! পাগল নাকি আমি? আপনি না জানালে কে জানিয়েছে? আমি কখন জানাতাম বলুন তো?”

নক্ষত্র গভীর ভাবনায় পড়ে গেল। হচ্ছেটা কি এসব? আপাতত সে এখন এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো। আমতা আমতা করে বলল,

—-তুমি তোমার বাবার সাথে যেতে মানা করে দিলে!”

—-কেন? আমি চলে গেলে আপনার ভালো লাগতো?”

—-সে কথা বলেছি আমি?”

—-তাহলে জিজ্ঞেস করছেন যে!”

নয়নকে এভাবে কথার পিঠে কথা বলতে নক্ষত্র কখনও দেখেনি। নয়নের আচরণ রহস্য লাগছে তার কাছে। বিড়বিড় করে সে বলল,

—-মেয়েটার মনে কী চলছে জানতে পারলে ভালো হতো।”

—-কিছু বলছেন? ”

—-না।”

নক্ষত্র দোটানায় আছে। নয়নের মনের কথা না জানা অব্দি সাহস করে নিজের মনের কথাও বলে ফেলতে পারছে না।
এদিকে রামিশার প্ল্যান ফেল হয়েছে। যা চেয়েছিল সে তেমন হয়নি। নয়নের বাড়ির লোক এসেছিল ঠিকই। কিন্তু মেয়েকে নিয়ে যায়নি। নয়নও চালাক মেয়ে। কালকের অত বড় ঘটনার পরও রাগ করে নক্ষত্রকে ছেড়ে চলে যায়নি। কী চায় মেয়েটা? নক্ষত্রর টাকাপয়সা দেখে গলে গেছে নাকি?
রামিশা ছটফট করছে। যেভাবেই হোক নয়নতারাকে নক্ষত্রর জীবন থেকে বিদায় করে সে নক্ষত্রর বউ হবে। এতো প্ল্যান করেও মেয়েটার কিছু করতে পারল না। অন্ধকারে ভয় পায় না ছাই। সব নাটক। নাটক করে নক্ষত্রকে হাতে রাখতে চাচ্ছে।
আজ রামিশা সবাইকে নিয়ে মুভি দেখতে যাওয়ার প্ল্যান করেছে। এই কথাটাই নক্ষত্রকে বলতে এসেছে সে। দরজায় নক না করে সোজা নক্ষত্রর ঘরে চলে এসেছে। নক্ষত্র তখন শার্ট পরছিল। রামিশা ঘরে ঢুকেই বলল,

—-আজ কিন্তু তোমাদের না চলবে না। নয়নতারা, তুমি দু’জনকেই যেতে হবে। টিকেট কেটে ফেলেছি আমি।’

রামিশার এই আচরণে নক্ষত্র বিরক্ত হলো। তার বন্ধু এত বছর বিদেশ থেকেও সাধারণ ভদ্রতাটুকু শিখেনি। কারো ঘরে আসার আগে নক করতে হয়। ওরা স্বামী স্ত্রী একা ঘরে আছে। এভাবে নক না করে আসা অভদ্রতা। নয়ন এখন ওয়াশরুমে। তবুও যদি ওদের সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকত আর রামিশা ওদের প্রাইভেট মোমেন্টে চলে আসত তখন?

—-কিসের টিকেট?”

—-কিসের আবার! মুভির। আমরা তিনজন আজ লেট লাইট মুভি দেখে বাড়ি ফিরব। মনে আছে কলেজ লাইফের কথা।”

তখনই নয়ন ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। রামিশার গলা শুনেই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এসেছে সে। চুল থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। নয়ন তোয়ালেটাও ভালো করে মাথায় পেঁচিয়ে আসার সময় পেলো না। ঘরে এসেই রামিশাকে দেখে ওর শরীর জ্বলে গেল। একটু আগে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করে কী লাভ হলো? এখন তো শরীরে আগুন জ্বলছে। নক্ষত্রর দিকে চোখ গেল ওর। শার্টের বোতাম খুলে রেখে কাকে দেখাচ্ছে? বোতাম লাগাচ্ছে না কেন?
নক্ষত্র হাঁ করে নয়নকে দেখছে। গোসলের পর নয়নকে সদ্য ফোঁটা তাজা ফুলের মতো লাগছে। ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছিল নক্ষত্র। নয়নের হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে ওর চুল মুছে দিতে ইচ্ছে করছিল।
রামিশা নয়নকে দেখে মুখে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে বলল,

—-এইতো নয়নতারা, যাবে তো তুমি?”

—-কোথায়?”

—-মুভি দেখতে।”

—-আমার ওসব মুভি-টুভি পছন্দ না। দেখতে ভালোও লাগে না।”

রামিশা মনে মনে খুশি হয়ে গেল। যাক আপদ আজও বাড়িতেই থাকুক। সে আর নক্ষত্র যাবে। একা কিছুটা সময় কাটাবে।

—-যাবে না তুমি?”

—-না।”

—-তাহলে আর কী করার? তুমি না গেলে তো জোর করতে পারব না। টিকেট যেহেতু কেটে ফেলে হয়েছে তাই আমি আর নক্ষত্রই যাব।”

নক্ষত্র না করতে যাচ্ছিল। এক ভুল সে দ্বিতীয় বার করবে না। নয়নকে একা রেখে রামিশার সাথে মুভি দেখতে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। নক্ষত্র না বলার আগেই নয়ন বলে উঠল।

—-আমি না গেলে আমার স্বামীও যাবে না। ডিনারে মা, বন্ধুর সাথে গিয়েছিল, আমি অনুমতি দিয়েছি। কিন্তু বউ না গেলেও যে বন্ধুর সাথে লেট লাইট মুভি দেখতে যেতে হবে এতে আমি অনুমতি দেব না।”

রামিশার গায়ে যেন নয়ন পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। ধক করে চোখ জ্বলে উঠল রামিশার। ঝাঁঝালো গলায় সে বলল,

—-আমার সাথে মুভি দেখতে যেতে হলে নক্ষত্রর তোমার থেকে অনুমতি নিতে হবে?”

—-অবশ্যই নিতে হবে। আমি ঘরের বউ। আপনি পরনারী। পরনারীর সাথে যেতে হলে অবশ্যই বউয়ের অনুমতি লাগবে।”

নক্ষত্র চোখ বড় বড় করে মুখ হাঁ করে ইঁদুর বেড়ালের ঝগড়া দেখছে। সে নিজেই রামিশাকে না করে দিতো। নয়নের ঝগড়া করতে হতো না। তবুও নয়ন রামিশার সামনে যেরকম বউয়ের অধিকার দেখাচ্ছে তাতে নক্ষত্রর ভালোই লাগছে। এই প্রথম নয়নের উপর বউ বউ ফিল আসছে।
নয়নের কী হয়েছে সে নিজেও জানে না। রামিশাকে জ্বালানোর জন্যই হয়তো সে নক্ষত্রর সামনে এসে দাঁড়াল। নিজের হাতে শার্টের বোতাম লাগিয়ে দিতে দিতে আদুরে গলায় বলল,

—-কী গো, আমি না করলেও আপনি যাবেন? আমার কথা শুনবেন না?”

নক্ষত্র হতভম্ব, হতবুদ্ধি, স্তম্ভিত, পাথর হয়ে নয়নের মুখের দিকে চেয়ে রইল। এই মেয়ের মাথা ঠিক আছে তো? এর আগে কখনও এভাবে কথা বলেনি তার সাথে। নক্ষত্র রোবটের মতো মাথা দুলাল।

—-দেখলেন তো রামিশা আপু। আমার জামাই আমার কথা না শুনে আপনার সাথে মুভি দেখতে যাবে না।”

রামিশাও মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। নয়নকে এতদিন হালকায় নিয়েছিল সে। কিন্তু এই মেয়ে তো তার ভাবনা থেকে কয়েক ধাপ উপরে।

—-শার্টের বোতাম খোলা রেখেছেন কেন? আশেপাশে কত খারাপ চোখ আছে। নজর লাগতে পারে। শুনুন আমরা যখন একা থাকব তখন ঘরের দরজা লাগিয়ে রাখতে পারেন না? হুটহাট যে কেউ চলে আসে! এটা আমাদের বেডরুম নাকি হলরুম, কোনটা?”

নক্ষত্র তার এই জীবনে আজকের মতো অবাক কখনও হয়নি। নয়ন প্রতি মিনিটে তাকে শক দিচ্ছে। এই মেয়ের আরও কত রূপ এখনও নক্ষত্রর অদেখা আছে তা-ই শুধু ভাবছে সে। রামিশা অপমানে লাল হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রামিশা যাবার সাথে সাথেই নয়নও নক্ষত্রকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়াল। এতক্ষণ লজ্জা লাগেনি তার। এখন লাগছে। কী কী করেছে সে! আল্লাহ! এসব কীভাবে করতে পারলো! নক্ষত্র তাকে কী ভাবছে এখন? নয়নের লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। সে এসব করবে কল্পনাও করেনি কখনও।
নয়ন আরও লজ্জা পাওয়ার থেকে বাঁচার জন্য নক্ষত্রর সামনে থেকে চলে আসতে চাচ্ছিল। নক্ষত্র ওর হাত ধরে ফেলে।

—-তারা! কোথায় যাচ্ছ?”

—-বাইরে। মা ডাকছেন।”

—-আমার মা তোমাকে ডাকবে না। আর ডাকলেও আমিও শুনতে পেতাম। কেউ ডাকেনি।”

নয়ন কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। হাত পা কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেছে তার। রামিশার সাথে ওভাবে কথা বলায় নক্ষত্র এখন তাকে বকবে নাকি? খুব তো বড় মুখ করে বলে দিয়েছে, আমার অনুমতি ছাড়া আমার স্বামী কোথাও যাবে না।

—-একটু আগে কী বলছিলে? রামিশার সামনে তোমার স্ত্রী হওয়ার অধিকার নিয়ে বলছিলে। তুমি কি আমাদের বিয়েটা মেনে নিয়েছ তারা?”

নক্ষত্র নয়নের মনের কথা জানতে চাইছে। কিন্তু নয়ন কেন বলবে? নক্ষত্রর মনের খবর জানে নাকি সে? সে তো কবেই তার বরের মায়ায় পড়ে গেছে। ভালোবেসে ফেলেছে মানুষটাকে। কিন্তু বর মহাশয় আছে অন্য ধান্দা নিয়ে। তাইতো বন্ধুর মুখের উপর কিছু বলতে পারে না। নয়নও ঠিক করল সে বোকার মতো আগেভাগে নিজের মনের কথা বলে দিবে না। এতো সহজে কেন ধরা দিবে সে?

—-হাত ছাড়ুন প্লিজ।”

নয়ন নক্ষত্রের থেকে হাত ছাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নক্ষত্র বোকার মতো ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। এই মেয়ে চায়টা কী হ্যাঁ? রামিশার সামনে এমন ভাব করছিল যেন ওদের মাঝে সব ঠিকঠাক। অথচ এখন নক্ষত্রর সামনে থেকে এমনভাবে চলে গেল যেন একটু আগের কথার কোন দামই নেই। নক্ষত্র বেচারা স্বামী হয়ে তার বউকে এক ফোঁটাও বুঝতে পারছে না।

—-সত্যিই নারী জাতি বড় রহস্যময়।”

চলবে___

/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here