#পথে_হলো_দেরি
#নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ১৩
,
,
ইরা শাড়ির আচল মাজায় গুজে এদিকওদিক দৌড়াদৌড়ি করে।
বিয়ে বাড়িতে কাজের অন্ত নেই। এতো মানুষের ভিড়ে ইরা রেহেনা বেগমের যত্ন করতেও ভোলেনা।
সে আজও শাড়ি পরেছে।
গোলাপী শাড়িতে তাকে দেখতে ফুটন্ত এক গোলাপের মতোই লাগছে।
তবে চুল আজ খোলা আছে তার।সে নিজ ইচ্ছাতেই চুল খুলে রেখেছে।
কাল শৌখিন বলেছিলো কয়েকবার।ইরা শোনেনি।জেদ দেখিয়ে ইচ্ছে করেই শোনেনি।
তবে আজ শুনতে ইচ্ছে হলো খুব।
কেনো ইচ্ছে হলো ইরা জানেনা।মাঝে মাঝে অজান্তেই কোন কাজ করাটা মন্দ হয়না খুব।
সকল ছেলেমেয়েরা চিৎকার করে ওঠে,বর এসেছে,বর এসেছে।
ইরা সেদিকে দৌড়ায়।শরবত,মিষ্টি এগিয়ে দেয়।
শাম্মিকে ঘরে পার্লারের মেয়েরা সাজাচ্ছে।ইরা আজ আর সেমুখো হয়নি।হবেওনা।
শাম্মি ইরাকে দেখলেই জোর করে সাজাতে বসিয়ে দেবে।
ইরা কোনমতেই পার্লারের মহিলাদের দিয়ে সাজবে না।এমনিতেও তার সাজগোজ পছন্দ না।তারউপর ওমন উদ্ভট সাজ?উহু,কখনোই না।
ইরা সিড়ি বেয়ে ছাদে ওঠে।
ছাদের ডালায় ফুল রাখা আছে।
ফুলের ডালা নামাতে গিয়েও পারেনা।ডালাটা উঁচুতে রাখা আছে।
ওতো উপরে ইরা নাগাল পায়না।
রিফাত কোথাথেকে হুট করে এসে পাশে দাড়ায়।
হাত দিয়ে ডালাটা পেরে ইরার হাতে তুলে দেয়।
ইরা সেদিকে তাকিয়ে বলে,
—ধন্যবাদ।
রিফাত মাথা নিচু করে মুচকি হাসে।
বলে,
—আরে না,ধন্যবাদ দিতে হবেনা।
তোমায় সাহায্য করার জন্য তো আমি সবসময় হাজির।এতে আবার ধন্যবাদের কি আছে?
ইরা অবাক গলায় বলে,
—মানে?
রিফাত থতমত খায়।সে আমতাআমতা করে বলে,
—না মানে তোমাদের মতো সুন্দরী মেয়েদের সাহায্য করতে পারলে সব ছেলেরা নিজেদের ধন্য মনে করে তো…এই আরকি।
ইরা হেসে বলে,
—আপনি কি আমার সাথে মশকরা করছেন?
—মশকরা কেনো করবো?সিরিয়াসলি বলছি।
একটু থেমে শান্ত গলায় বলে,
—তুমি খুব সুন্দর ইরা,খুব খুব খুব সুন্দর।
ইরা চমকে তাকায়।তার কাছে রিফাতের গলা অন্যরকম লাগে।
একেবারেই আলাদা।
সে বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকায়।
সেদিকে খেয়াল করে রিফাত হেসে ওঠে।
চোখেমুখে দুষ্টুমি মাখা হাসি ভর করে তার।
বলে,
—সবকিছুই ঠিক আছে,শুধু নাকটা একটু বোঁচা , আর আর…
একটু ভেবে বলে,
—চোখটা একটু টেরা।
ইরা তার কথার ভঙ্গিমা শুনে হেসে ওঠে।রিফাত যে ফাজলামি করে এসব বলছে সে কথা ইরা ঠিক বুঝতে পারে।
সে হাসতে হাসতেই বলে,
—আপনি পারেনও রিফাত ভাই।
রিফাত বুকে হাত দিয়ে শব্দ করে।আহত হওয়ার ভান করে বলে,
—আহহ,কি বললা ইরা।
উফফ এক্কেবারে বুকে গিয়ে লাগলো।
ইরা আবারও হেসে ফেলে।
তার খিলখিল হাসির শব্দ রিফাতের বুকে গিয়ে বারি খায়।তার মুগ্ধ দৃষ্টির পেছনেই কেউ দাড়িয়ে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
রিফাতের বুকে ভালোলাগার বাতাস বইলেও তার বুকে ঈর্ষার আগুন দাউদাউ করে জ্বলে।
,
,
ইরা রেহেনা বেগমকে দেখতে তার রুমে যাওয়ার জন্য সিড়ি বেয়ে উপরে ওঠে।
বেশ কিছুটা সময় রেহেনা বেগমের খোজ নেইনি সে।
রেহেনা বেগমকে খাবার দিয়ে ঔষধ দিয়ে এসেছিলো।তারপর কাজের মধ্যে ব্যস্ত হয়ে গেছিলো ইরা।
পথিমধ্যে কেউ পথ আগলে দাঁড়ায়।
ইরা বড়বড় চোখ করে সামনে তাকায়।
শৌখিনকে দেখে চোখ আরও বড় হয়।
তারচেয়ে বেশি ভর করে ভয়।
শৌখিনকে কেমন যেনো রাগী রাগী লাগছে।
রেগে বোম হয়ে আছে মনে হচ্ছে।
ইরা ভয়ার্ত গলায় মিনমিন করে বলে,
–পথ আগলে কেনো দাড়ালেন?আমি যাবো তো।
শৌখিন সেকথার উত্তর দেয়না।সে দাত কিড়মিড় করতে করতে বলে,
—এতো হাসাহাসি কিসের তোর?
—মানে?
শৌখিন আরও এগিয়ে আসে।
মাথা ঝুকে ইরার মুখোমুখি হয়।বলে,
—বুঝতে পারছিস না?নাকি ভান ধরছিস?
ইরা বেশ অবাক হয়।সে ভান ধরেছে?কিসের?
—ঠিক করে বলুন তো কি বলছেন?
—রিফাতের সাথে তোর কি চলে হ্যা?ওর সাথে দাঁত কেলিয়ে হাসার কি হয়েছে?
কই আমার সাথে কথা বলার সময় তো হাসিস না?
ইরা বিষয়টা বোঝে।কিন্তু এতে রাগার মতো কি হয়েছে তার মাথায় আসেনা।আর শৌখিনই বা ইরার ব্যাপারে এতো মাথা ঘামাচ্ছে কেনো?সে কি বলেছে?
কই ইরা তো শৌখিনের কোন বিষয়ে মাথা ঘামাতে যায়নি।
সে শক্ত হয়ে বলে,
—রিফাত ভাই হাসাতে পারে তাই তার কথায় হেসেছি।
আর আপনার সাথে হাসবো কিভাবে?আপনি কি মানুষকে হাসাতে পারেন?আপনি পারেন কাঁদাতে।
শৌখিন ক্রুদ্ধ হয়ে ইরাকে পাশের দেয়ালে চেপে ধরে।
হাত মুচড়ে ধরে রাখে।
অগ্নি দৃষ্টি ফেলে বলে,
—কি বললি?আমি মানুষকে কাঁদাই? আমি?
কবে কাঁদিয়েছি বল?
তোকে আমি বলেছি কখনো কাঁদতে?
ইরা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে।
মনে মনে বলে,কেউ কি কখনো বলে নাকি কাঁদতে?কষ্ট দিতে দিতে তিক্ত করে ফেলেছে এখন বলছে কাঁদিয়েছি তোকে?
তবে মুখ ফুটে বলে,
—আপনি আমার সাথে এমন করছেন কেনো বলুনতো?আমি যার সাথে ইচ্ছে তার সাথে বেড়াই,হাসি,কান্না করি,যা ইচ্ছে করি।তাতে আপনার কি?
শৌখিন আরোও একটু কাছে এগোয়।তার নিশ্বাসের শব্দ ইরার চোখেমুখে বাড়ি খায়।ইরা চোখবুজে ফেলে মুহুর্তেই।
ভয়ে তার ঠোট কাপে অনবরত।
সেদিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে শৌখিন ফিসফিস করে বলে ওঠে,
—আমারই তো সব।
ফিসফসানির শব্দে ইরা কেঁপে ওঠে।
ফট করে সে চোখ মেলে তাকায়।শৌখিনের দৃষ্টি দেখে তার মন পুলকিত হয়।চোখের ভাষা যেন একনিমিষেই পরে ফেলতে পারে ইরা।
আগে যে চোখে ইরা নিজের জন্য ঘৃনা ছাড়া আর কিছু দেখতে পেতোনা সে চোখে আজ স্পষ্ট ভালবাসা দেখে।
তবে পরক্ষনেই মিতালীর কথা মনে পরে।
সে একটা মেয়ের ভালবাসাকে কেড়ে নিচ্ছে না তো?
শৌখিন তাকে পরবর্তিতে তার আর মিতালীর সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য দায়ী করবে নাতো?হয়তো বলবে ইরা ছলনা করে শৌখিনকে পটিয়েছে।তাছাড়া শৌখিন মিতালীকে ভালবাসে,তাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এসব না জানলে হয়তো শৌখিনের চোখে নিজের জন্য ভালবাসার প্রতিফলন দেখে দেখে ইরা খুশি হতো কিন্তু এখন?কিকরে খুশি হবে ইরা?
ইরা চোখ নামিয়ে ফেলে দ্রুত।
কাঠকাঠ গলায় জবাব দেয়,
—আমি ব্যাথা পাচ্ছি, হাত ছাড়ুন আমার।
💮💮
রেহেনা বেগম চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছেন।
তার ভাল লাগছেনা।এমনিতেই তার শরীর ভালোনা তারউপর এতো চিন্তা।
বাইরে বিয়ের হৈচৈ লেগে আছে।
সেদিকে তার কিছুতেই মন বসছেনা।
সে শৌখিনের চিন্তায় উশখুশ করছে।।শৌখিনকে বেশকিছুদিন ধরে লক্ষ করছেন তিনি।
শৌখিনকে দেখে এটুকু বুঝেছেন যে সে ভালো নেই।কোন বিষয় নিয়ে তার মনে ঝড় বইছে।
সে ঝড়ে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সে।
তবে কারনটা রেহেনা বেগম জানেননা।শৌখিন কখনো বলেনি তাকে।
তবে কিছুটা আন্দাজ করতে পারছেন।
ইরার সাথে এ বিয়েটা নিয়েই তো শৌখিন রাগারাগি করতো আগে।এমনকি বাড়ি ছেড়ে পর্যন্ত চলে গিয়েছিলো।যদিও এখন রাগারাগি করেনা তবে হয়তো ভেতরে ভেতরে গুমড়ে ওঠে সে।
হয়তো কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছেনা।
রেহেনা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
শৌখিনের মৌনতা দেখে তিনি আশার আলো দেখেছিলেন।ভেবেছিলেন হয়তো আস্তে আস্তে এভাবেই শৌখিন একসময় ইরাকে মেনে নেবে।
কিন্তু তা যে এমন হিতে বিপরীত হবে তা ক্ষুনাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারেননি তিনি।
এখন যা হবার হয়ে গেছে।
ছেলে মেয়ে দুটোর ভালোর জন্য এখন চেষ্টা করতে হবে।
দুজনেই এই বিয়েটা নিয়ে কষ্টে আছে।
তাদের কষ্ট কিছুটা হলেও দুর করতে হবে।
রেহেনা বেগম পাশে রাখা মোবাইলটা হাতে তুলে নিলেন।তিনি উকিলের সাথে কথা বলবেন।
ডিভোর্সের কাজটা ফেলে না রেখে,সেরে ফেলাই ভালো।
আর কোন কিছুর আশা করে লাভ নেই।
,
,
চলবে……