পথে হলো দেরি পর্ব ১৪

#পথে_হলো_দেরি
#নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ১৪

,
,
শাম্মিকে বসানো হয়েছে খাটের মাঝ বরাবর। তার আজ বৌভাত।
পার্লারের মেয়েরা শাম্মিকে সাজাতে ব্যাস্ত।এদিক ওদিক বাঁকা করে তাকে সাজাচ্ছে মেয়েরা।
তাতেও শাম্মির মুখে বিরক্তির কোন ছাপ নেই।
সে সাজতে পছন্দ করে।
মিতালীরও সাজগোজ পছন্দ। তবে সে আজ সাজেনি।কেনো যেনো ইচ্ছে করেনি।
তার সাজের মুল কারণই তো শৌখিন।সেই শৌখিনই আজকাল অন্যমনস্ক থাকে।
মিতালীর দিকে তাকায়ই না।তো খামোখা সাজতে যাবেই বা কেনো মিতালী।

তারা আজ বৌভাতের অনুষ্ঠানের জন্য শাম্মির শশুড়বাড়ি এসেছে।
শৌখিন,রিফাত,ইরা আরও অনেকে এসেছে।
মিতালী মনোযোগ দিয়ে শাম্মির পাশে বসে সাজানো দেখে।
কি মিষ্টি দেখাচ্ছে শাম্মিকে!চোখেমুখে তার খুশি উপচে পরছে।
ভালবাসার মানুষকে নিজের করে পাবার খুশি।
মিতালি ভাবে,শৌখিনকে পেলে সেও কি এতোটাই খুশি হবে?নাকি এরচেয়েও বেশি?
ভাবনার মাঝেই শাম্মি বলে ওঠে,

—তুমিও একটু সাজো না আপু।

মিতালি মুচকি হাসে।বলে,

–না শাম্মি, আমার আজ মোটেও সাজতে ইচ্ছে করছেনা।তারচেয়ে তোমায় সাজানো দেখি বসে বসে।
কি যে মিষ্টি লাগছে তোমায়!

শাম্মি লজ্জামাখা হাসি হাসে।
মাথা নিচু করে।বলে,

—তোমায় বউ সাজলে আরও মিষ্টি লাগবে আপু।
কবে খবর দিচ্ছো বলোতো?

—দেবো দেবো।অপেক্ষা করো।

একটু চুপ থেকে আবার বলে,

—তোমারা ইরার বিয়ের কথা ভাবছো না?

শাম্মি চমকে তাকায়।বলে,

—কার?

—কেনো ইরার?ও তো তোমাদের বাড়িতেই থাকে।বাবা মাও নেই।ওর বিয়ে দেওয়া তোমাদের দায়িত্ব না?
তো কবে দিচ্ছো ওর বিয়ে?ভেবেছো কিছু?

শাম্মি আচমকা বলে ওঠে,

—কিন্তু ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে।

কথাটা বলেই জিভে কামড় দেয় সে।শাম্মি বোঝে কথাটা তার বলা,উচিত হয়নি।ইরার বিয়ের কথাটা কেউ জানেনা।কাউকে জানানো নিষেধ ও আছে।
তবে মুখ ফসকে কথাটা এভাবে বের হয়ে যাবে সে বোঝেনি।

মিতালি অবাক হয়ে বলে,

—কিহ?ইরার বিয়ে হয়ে গেছে?
কই আগে তো কেউ বলেনি?

শাম্মি বোকা বোকা হাসে।
বলে,

—না মানে ওই আরকি।

মিতালির বিস্ময় কাটেনা।
বলে,
—কার সাথে বিয়ে হয়েছে?ওর বর কোথায় থাকে?বিয়ে যেহেতু হয়েছে তো শশুড়বাড়ি না থেকে তোমাদের বাড়িতে কেনো থাকে ইরা?

—ও তো ওর শশুড়বাড়িতেই থাকে আপু।

—শশুড়বাড়িতে?কোথায়?আমি তো দেখলাম না।

শাম্মি পাশ ঘেসে বসে।কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

—কাউকে বলবে নাতো?

মিতালি মাথা নাড়ে।
সেদিকে তাকিয়ে শাম্মি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
ভাবে মিতালিকে বললে কি এমন হবে?সে তো আর কাউকে বলতে যাচ্ছে না।তাছাড়া মিতালী তাদের ঘরের মানুষ,আপন মানুষ।
এসব কথা সে জানলে শৌখিন নিশ্চয়ই খুব বেশি রাগ করবেনা।
হয়তো করবে,কিন্তু একটু আধটু।
সে কন্ঠ আরও দাবিয়ে আশেপাশে কড়া নজর বুলায়।
বলে,

—ইরার বিয়ে হয়েছে আমার ভাইয়ার সাথে।

মিতালি চমকে শাম্মির চোখে চোখ রাখে। তার নিশ্বাস আটকে আসে।কেমন যেনো অন্ধকার লাগে চারিদিক।
কানে শো শো শব্দ হয়।মনে হয় না না এসব সে ভুল শুনছে।হয়তো কানে ভুলভাল কথা বাজছে।
সে কাঁপাকাপা গলায় বলে ওঠে,

—কার সাথে?

—আরে শৌখিন ভাইয়ার সাথে।
বিয়ে তো হয়েছে আরও দুবছর আগে জানো তো।
কিন্তু ভাইয়া ইরাকে কিছুতেই তার বউ হিসেবে মানবে না।আসলে এক্সিডেন্টলি হয়েছিলো তো বিয়েটা।
সেইজন্য কাউকে জানাতে দেয়নি ভাইয়া।যেখানে সে নিজেই বিয়েটা মানেনা সেখানে কাউকে জানানোর ও তো প্রশ্ন আসেনা।

শাম্মি নিজের মতোই বকবক করতে থাকে।
মিতালি সেদিকে নজর দেয়না।
তার হাত পা কাপে অনবরত।
কেমন অসহ্যকর যন্ত্রনা শুরু হয় বুকে।
মাথাটা ঘোরে খুব।
এ বাড়িতে দম আটকে আসে তার।
খোলা হাওয়ায় নিশ্বাস নেওয়ার জন্য বুকটা আকুপাকু করে।
চারিদিকে যেনো শুধু বিশ্বাসঘাতকতার বাতাস বয়।
শাম্মির কথার মাঝেই মিতালি উঠে দাড়ায়।
শাম্মি বলে ওঠে,

—কি হলে আপু?কোথায় যাও?

মিতালি সেদিকে তাকায় না।উত্তর ও দেয়না।
তার গলা আটকে আসছে।গলা দিয়ে কোন কথা এখন বের হবেনা।
শুধু চোখ বেয়ে জলের কনা বের হতে চায়।
মিতালি বহু কষ্টে বাধা দেয়।

💮💮

বাড়ির বাইরে খোলা হাওয়ায় মিতালি জোরে জোরে নিশ্বাস নেয়।তার বুক ভারী লাগে।
শৌখিন,তার ভালবাসার মানুষ।
সে কিনা তাকে ঠকালো?
এই দুটো বছর ধরে সে বিবাহিত, এই কথাটা সে লুকিয়ে রাখলো?
এই জন্যেই কি ইরার প্রসঙ্গ এলেই সে এড়িয়ে যেতো?ইরার বিয়ের ব্যাপারে কথা তুললে সে রেগে উঠতো?
এই জন্য?
যতোই সে না মানুক বিয়েটা,যতোই কাউকে জানাতে না দিক,তবুও তো ইরা তার বিয়ে করা বউ।
একথাটা শৌখিন কিকরে অস্বীকার করতে পারে?
আর করলেও,মিতালিকে কেনো জানায়নি?কেনো বলেনি একবারও যে সে বিবাহিত? ইরা তার বিয়ে করা বউ,শুধুমাত্র মামার মেয়ে না।
মিতালি ডুকরে কেঁদে ওঠে।
এতোক্ষণ আটকে রাখা কান্না ছিটকে বেরোয় তার চোখ থেকে।
মুখে হাত দিয়ে মাটিতে বসে পরে মিতালি।
বাড়িতে অনেক মেহমান আছে।কেউ দেখে ফেললে শাম্মির অসম্মান হতে পারে।
সেইজন্য মিতালি বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাড়ির পেছনে এসেছে।
এখানে মানুষজন নেই।
তার কান্নার মাঝেই পেছন থেকে কেউ বলে ওঠে,

—আরে আরে নাকের জল বেশি পরছে তো!

মিতালি চমকে ওঠে।
এসময় এখানে কে আসতে পারে?আর কেই বা তার কান্না দেখে ফেললো।
সে তাড়াতাড়ি উঠে দাড়িয়ে চোখের জল মুছে নেয়।হাত দিয়ে মুখ চোখ ঠিক করে।মুখটা স্বাভাবিক বানায়।পরক্ষনেই কপাল কুঁচকে আসে।
কথাটা মাথায় ঢোকে তার।
পেছন ফিরে দেখে মুগ্ধ।
পাশে একটা গাছে হেলান দিয়ে দুহাত পকেটে পুরে স্টাইল করে দাড়িয়ে আছে সে।
মুখে শয়তানি হাসি।
মিতালি এগিয়ে গিয়ে বলে,

—কি বললেন?

—বললাম কান্নার ফলে আপনার চোখের পানির চেয়ে নাকের পানি বেশি বের হচ্ছে।

মিতালি চোখ মুখ কুচকে ফেলে।
তার শরীর জ্বলে ওঠে রাগে।
তেড়ে এসে বলে,

—দেখুন…

কথা শেষ হওয়ার আগেই মুগ্ধ মাথা ঝোকায়।মিতালির মুখের অনেকটা কাছে ঝুকে আসে সে।
মিতালি ফটাফট চোখ বুজে নেয়।মুগ্ধ সেদিকে তাকিয়ে বলে,

—কি দেখবো?

মিতালি চোখ মেলে তাকায়।চোখ দিয়ে তার আগুন ঝরে।সে পারলে এই মুহুর্তে এই বেয়াদব লোকটাকে কেটে কুচিকুচি করে ফেলতো।
রাগে ফসফস করে সে।
মুগ্ধ আবার হাসে।
একটু পিছিয়ে গিয়ে ভয় পাওয়ার ভান করে।
বলে,

—ওরে বাবা,চোখ দিয়ে ভস্ম করবা নাকি বেয়াইন।
সরি,সিনিয়র বেয়াইন।

মিতালি সে কথার জবাব দেয়না।সে পারলে তাই করতো।কিন্তু তা তো আর সম্ভব না।পরক্ষনেই একটা কথা মাথায় আসে।ছেলেটা আগে তাকে আপনি করে বলতো।কিন্তু এখন তুমি বলছে কেনো?সে বলে,
—আপনি আমায় তুমি করে বলছেন কেনো?

মুগ্ধ দায়সারা উত্তর দেয়,

—ইচ্ছে হলো তাই।

—ইচ্ছে হলো মানে?

—সবকিছুর এতো মানে মানে করো কেনো বলোতো?ইচ্ছে হতে পারেনা?

একটু অন্যরকম গলায় বলে,

—কাউকে আপন করার ইচ্ছে?

কথা বলতে বলতে সে একেবারে কাছে এসে দাড়ায়।
মিতালি পেছনে গাছের সাথে লেগে দাড়ায়।তবু মুগ্ধ এগিয়ে আসে।
চোখে তার অন্যরকম চাহনী।
কেমন মনকাড়া।
মিতালি চোখ নামায়।এমন মুগ্ধতার চাহনি একসময় সে শৌখিনের চোখে দেখেছিলো।
সে কাঠকাঠ গলায় বলে,

–সড়ে দাড়ান প্লিজ।

মুগ্ধ মাথা নিচু করে সরে দাড়ায়।সে ইদানিং নিজের কাজে অবাক হয়।গুরুতর অবাক।
এতো এতো মেয়ে থাকতে তার এই সাধারন মেয়েটার প্রতি মুগ্ধ হতে ইচ্ছে হয়।তাকে রাগাতে ইচ্ছে হয়।রাগলে মেয়েটাকে কি দারুণ লাগে।
নাকটা লাল হয়ে যায়।
তখন তো আরও ভয়ংকর ইচ্ছে মুগ্ধর মনে চাড়া দিয়ে ওঠে।
সে বোঝে,সে রোগে আক্রান্ত হয়েছে।কঠিন এক রোগ।
প্রেম রোগ।নিজের উপর আবার হেসে ওঠে।
কলেজের প্লে বয়,যার সুন্দরী সুন্দরী গার্লফ্রেন্ড ভরা,সে কিনা অবশেষে এই সাধারণ মেয়ের প্রেমে পরলো?তাও আবার সিনিয়র?

মিতালি চুপচাপ ঘাসের উপর বসে।
তার শৌখিনের কথা মনে পরে গেছে।তার বিশ্বাসঘাতকতার কথা মনে পরছে।
এতক্ষণ মুগ্ধর সাথে ঝগড়ার ফলে সে কথা মনেই ছিলোনা।
তার আবার কান্না পাচ্ছে। কিন্তু মুগ্ধর সামনে কান্না করা যাবেনা।
ছেলেটা বেয়াদব, মস্ত বড়ো বেয়াদব।
কখন আবার কি বলে বসে তার নাই ঠিক।
ভাবনার মাঝে পাশে শব্দ পায়।পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে মুগ্ধ ও পাশে বসেছে।
মিতালির শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলে ওঠে,

—এ মুখে শুধু হাসি মানায়।কান্না একেবারেই মানায় না।

মিতালি অন্যমনস্ক হয়ে বলে,

—বুকে যে কষ্ট হয়।

—হালকা করো।

—কিভাবে?

—কাউকে বলো,বলে নিজের ভেতরটা হালকা করো।

—কাউকে যে বলা যায়না।

—তবে সমাধান করো।

মিতালি অবাক নয়নে মুগ্ধর দিকে তাকায়।
ছেলেটাকে এখন মোটেও বেয়াদব মনে হয়না।ছেলেমানুষী করে ঝগড়া করা ছেলেটাকে কেমন অন্যরকম লাগে।

,

,

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here