পথে হলো দেরি পর্ব ২৪

#পথে_হলো_দেরি
#নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ২৪

,
,
ইরা দাড়িয়ে থাকতে থাকতে হাপিয়ে উঠলো।
কতক্ষণ লাগে এই রুম পর্যন্ত আসতে?শৌখিন কি আসছে না?না কি করছে টা কি?
খাটে গিয়ে বসে অস্থিরভাবে উশখুশ করতে লাগলো।আবার উঠে পায়চারি করতে লাগলো।
প্রতিটা সেকেন্ড তার মনে হলো ঘন্টার মতো।
অবশেষে কৌতুহল মেটাতে না পেরে সে সিদ্ধান্ত নিলো রুমের বাইরে যাবে।
দেখে আসবে শৌখিন কি করছে?অদৌ শৌখিন এসেছে কিনা তাও তো জানেনা ইরা।
সে ধীরপায়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেলো।
শরীরটা এখনো প্রচন্ড দুর্বল তার।
তবুও পা টিপে টিপে হাটলো।
দরজার কাছে গিয়ে মাথাটা বের করে বাইরে উঁকি দিলো কি হচ্ছে দেখার জন্য।
তবে তখনই মাথায় বেদম গুতো খেয়ে পিছে উল্টে পরে যেতে গেলো ইরা।
ইরা ভয়ে চোখ বুজে ফেললো।তার অন্তর আত্মা তাকে ছেড়ে যায়,যায় অবস্থা।
এই অবস্থায় পরে গেলে তার কি হবে?বাচ্চাটার কোন ক্ষতি হবেনা তো?
ইরা সামনে হাতরে যা পেলো তাই খামচে ধরলো।
তবে নাকে সমধুর ঘ্রান এসে বারি খেতেই সে চোখ মেলে তাকালো
পিঠে কারো হাতের ছোয়া ইরা স্পষ্ট টের পাচ্ছে।
কেউ তাকে জাপটে ধরে রেখেছে ফ্লোরে পরার হাত থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে।
ইরা তার চেহারা না দেখেই বুঝলো লোকটা শৌখিন।শৌখিনের গায়ের গন্ধ সে চেনে।
ইরা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বুকে মাথা রাখলো।
পরম আবেশে চোখ বন্ধ করলো।
কতোদিন পর সে শৌখিনের বুকে মাথা রাখতে পারলো!
শৌখিন ইরাকে ঝট করে সরিয়ে সোজা করে দাড় করালো।
ইরার দিকে না তাকিয়ে নিজের ব্যাগপত্র পাশে রেখে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
ইরার সাথে কথা বলা দুরের কথা ফিরে তাকালো পর্যন্ত না।
ইরা না হয় একটু ভুল করেইছিলো।না না একটু না,একটু বেশিই।
তাই বলে এতো রাগ করে থাকবে কেনো শৌখিন?
সে কেনো ইরার ভুল ভাঙিয়ে দিলোনা?কেনো জোর করলো না?
কেনো ইরাকে ফেলে চলে গেলো?
অভিমানে ইরার গাল ফুলে একাকার হলো।
সে মুখ ফুলিয়ে খাটে পা তুলে বসলো।
এভাবে বসায় শাড়ির কুচি এলোমেলো হয়ে গেলো তবু ইরার কোন হেলদোল হলোনা।
হবেই বা কেনো?যার জন্য শাড়ি পরলো,এতো সাজগোজ করলো, সে কিনা একটি বার চোখ তুলে তাকালোও না?
নিজের মনেই বিরবির করলো ইরা।
সেও রাগ করে থাকবে শৌখিনের সাথে।
এতোটা দিন শৌখিন যেমন কষ্ট পেয়েছে ইরাও তো পেয়েছে।তার তো আর কম কষ্ট হয়নি।
হঠাৎ ওয়াশরুমের দরজায় শব্দ হতেই ইরা চকিত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালো।
একটু আগে সে শৌখিনের মুখটা স্পষ্ট দেখতে পায়নি।
কতোগুলো দিন দেখেনি তাকে!
শৌখিন টাওয়ালে মুখ মুছতে মুছতে বের হলো।
টিশার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার পরিহিত শৌখিনকে দেখেও বোঝা যাচ্ছে সেও ভালো ছিলোনা।একদিনে তার চোখমুখও শুকিয়ে গেছে।চোখ গর্তে গিয়ে চারপাশে কালো দাগ দেখা,দিয়েছে।
ঠোঁটটা কি কালো হয়ে গেছে?কেনো?সে কি আরও বেশি করে সিগারেট খায়?
ইরা নিজের মনেই প্রশ্ন করলো।
সে এতক্ষণ মনে মনে ভাবা সব রাগ অভিমান জলান্ঞ্জলী দিয়ে শৌখিনের সামনে গিয়ে দাড়ালো।
শৌখিন পাশ কাটিয়ে চলে যেতে গিয়েও পারলোনা।ইরা সামনে যাওয়ার পথ আগলে দাঁড়ালো।
শৌখিন কপাল কুঁচকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,

—কি হয়েছে?কি সমস্যা?

ইরা মুচকি হেসে বললো,

—কিসের সমস্যা? কোন সমস্যা নেই তো।

—তাহলে পথ আগলে দাড়াচ্ছিস কেনো?

ইরা ইনোসেন্ট মুখ বানালো।দুষ্টুমিমাখা হাসি হেসে বললো,

—কোথায় পথ আগলে দাড়াচ্ছি?আপনি যান না।

শৌখিন বিরক্তকর মুখ নিয়ে সামনে এগোনোর জন্য পা বাড়াতেই ইরা আবার সামনে এসে দাড়ালো।শৌখিন ভ্রু কুঁচকে রাগী দৃষ্টি ফেললো ইরার ওপর।
ধমকে উঠে বললো,

—ফাজলামো শুরু করেছিস?

আচমকা ধমকে ইরা কেপে উঠলো খানিকটা। সে ভয় পেয়ে গেছে।
এতো জোরে ধমক দিলে যে কারো ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
সে বুকে ফু দিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে শৌখিনের দিকে তাকালো।
কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,

—আপনি আমায় ধমক দিলেন?এতোদিন পর বাড়িতে এসেও ধমকালেন?

শৌখিন সে কথার উত্তর দিলোনা।এমনকি সেখানে বেশিক্ষণ দাড়ায়ও না।ইরাকে পাশ কাটিয়ে সে হনহন করে হেটে বেলকনিতে গিয়ে দাড়ায়।
ইরা বোঝে শৌখিনের রাগের পাল্লাটা হয়তো একটু বেশিই ভারী হয়েছে।
সে শৌখিনের পিছুপিছু বেলকনিতে গিয়ে দাড়ালো।
শৌখিন ততক্ষণে সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছে।
বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে একের পর এক টান দিচ্ছে সিগারেটে।
ইরা গলা খুকখুক করে নিজের উপস্থিতি জানান দিলো।
তারপরও শৌখিনের কোন হেলদোল না দেখে বললো,

—স্যরি!

শৌখিন পিছু ফিরে না তাকিয়েই বললো,

—কেনো?

—ভুল করার জন্য,ভুল বোঝার জন্য!

—আর?

—বিশ্বাস না রাখার জন্য!

শৌখিন পেছনে ফিরে ইরার চোখে চোখ রাখলো।কি গভীর তার দৃষ্টি! ইরা পলকহীন তাকিয়ে রইলো।
শৌখিন বললো,

—স্যরি যদি এক্সেপ্ট না করি?

ইরা চোখ কুঁচকে ফেললো।শৌখিনের মনোভাব সে বুঝতে পারছেনা।কি ভাবছেটা কি শৌখিন?সে কি সত্যিই ক্ষমা করবেনা তাকে?
ইরার কান্না পেলো খুব।এতোদিন পরে শৌখিনের দেখা পেলো,তাকে মানানোর সুযোগ পেলো।আর তাও শৌখিন বলছে স্যরি এক্সেপ্ট করবেনা?
ইরা নাক টেনে টেনে বললো,

—কেনো করবেননা? কেনো শুনি?
ডাবল স্যরি পাচ্ছেন আপনি তাও এক্সেপ্ট কেনো করবেননা?

শৌখিন অবাক চোখে বললো,

—ডাবল মানে?

—আমি আর আমার বাচ্চা! আমি স্যরি বললে তো সেও বলেছে নাকি?ডাবল হলো না এতে?

শৌখিনের বিস্ময়ে চোখ বড় হলো।অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সে কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরে খুশিতে আত্মহারা হলো।মুখজুরে আনন্দের বহিপ্রকাশ দেখা দিলো।
উত্তেজিত হয়ে বললো,

—তুই প্রেগনান্ট ইরা?

এতক্ষণে ইরার হুশ এলো।কথায় কথায় কি বলে ফেলেছে সে একদম বুঝতে পারেনি। চোখ পিটপিট করে শৌখিনের দিকে তাকালো।
শৌখিন অধির আগ্রহে ইরার উত্তর শোনার অপেক্ষা করে আছে।
ইরা সেদিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো।
এখন তার লজ্জা লাগছে।চোখে চোখ রাখতেও লজ্জায় গুটিয়ে পরছে সে।
চোখ বুজে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।
শৌখিন এগিয়ে এসে জড়িয়ে নিলো ইরাকে।
মাথায়,ঠোঁটের স্পর্শ দিলো।বললো,

—আগে কেনো জানাসনি?

ইরা মিনমিন করে বললো,

—আমি তো জানতাম না আগে।আজই জানলাম।

একটু চুপ থেকে আবার বললো,
—আমায় ক্ষমা করেছেন তো?

শৌখিন আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।বললো,

—না করে উপায় আছে?

💮💮

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ইরা দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো।কিচেনে ঢুকে নিজের হাতে চা বানিয়ে রেহেনা বেগমের ঘরে নিয়ে এলো।
রেহেনা বেগম তখন সবেমাত্র নামাজ সেরে বেলকনির চেয়ারে বসেছেন।
ইরাকে চা হাতে আসতে দেখে তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন,

—এতো অসুস্থ শরীর নিয়ে তুই চা কেনো বানাতে গেলি ইরা?আর তাও আবার এতো সকাল সকাল?

ইরা ফুপুর পাশে বসে মৃদু হাসলো।চায়ের কাপটা তার হাতে তুলে দিতে দিতে বললো,

—কে বলেছে আমি অসুস্থ ফুপু?এই দেখো আমি একদম ঠিক আছি।
আমি কখনো অসুস্থ হই নাকি?

—সে তো কাল দেখতেই পেলাম।

ইরা আবার হাসলো।
রেহেনা বেগম সেদিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।তার বুকটা আজ প্রশান্তিতে ভরে গেছে।
কেমন যেনো অদ্ভুত শান্তিময় লাগছে চারপাশটা।
ইরার মুখের মিষ্টি হাসি দেখে চোখ জুড়িয়ে আসছে।
তিনি আদুরে গলায় বলেন,

—ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নে ইরা,তোর শরীরটা তো ভালোনা।
তাছাড়া বাচ্চাটার কথাও তো ভাববি?

,
💮💮
,
ইরা নিজের রুমে ঢুকে সেন্টার টেবিলে হাতে রাখা চায়ের কাপ রাখে।
শৌখিনের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। এলোমেলো চুলগুলো অবাধ্য হয়ে কপাল ছুয়ে আছে।
ইরা হাত বাড়িয়ে চুল সরিয়ে দেয়।
শৌখিন নড়ে ওঠে একটু।
ইরা সরে যেতে গিয়েও আবার বসে পরে।
কপালে ঠোঁট ছুয়ে দেয়।সরে আসতেই খপ করে হাত ধরে ফেলে শৌখিন।চোখ মেলে তাকায়।দুষ্টু হেসে বলে,

—চোর ধরে ফেলেছি!

শৌখিনের বলার ধরন দেখে ইরাও হাসে।বলে,

—ঘুমের ভান ধরে ছিলেন?ঘুমোননি?

শৌখিন উত্তর দেয়না।শোয়া থেকে উঠে বসে সে।
ইরাকে সামনে বসিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে নেয়।
কাধে থুতনি রাখে।
বলে,

—এতো সকালে কেনো উঠেছিস তুই?তোর না শরীর খারাপ?

—কোথায় শরীর খারাপ?

—আমি জানিনা ভেবেছিস?

ইরা মাথা নিচু করে হাসে।
তার আজ মুখ থেকে হাসি সরছেই না।
এ যেন এতো বছরের জিবনের কঠিন পথ পেরিয়ে সুখের দেখা পাওয়া নির্মল হাসি।
বলে,

—আচ্ছা, এ কদিন আমার কথা একটুও মনে পরেনি আপনার?

শৌখিন বলে,

—উহু,একদমই মনে পরেনি।

ইরা মুখ ফুলায়।এতক্ষণের হাসি হাসি মুখ তার গম্ভীর হয় খুব।মুহূর্তেই চোখে জলের দেখা পাওয়া যায়।
সে মুখ ফুলিয়ে চুপ করে থাকে।
শৌখিন যেনো ইরার মনোভাব ঠিকই বুঝতে পারে।
সে ইরাকে সোজা করে মুখোমুখি বসায়।
মুখ তুলে উপরে তুলে।
ইরার ফুলানো মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে সে।
ইরা চমকে শৌখিনের মুখপানে তাকায়।
তার বোধগম্য হয়না শৌখিন হঠাৎ হাসছে কেনো?
সে বিস্ময়ভরা কন্ঠে বলে,

—হাসছেন কেনো?

শৌখিন হাসতে হাসতেই বলে,

—এতো অভিমান?

ইরার হুট করে মনে পরে সে শৌখিনের উপর অভিমান করেছে।শৌখিনের তার কথা মনে পরেনি।তাহলে সে কথা বলছে কেনো?সে তো চুপ থাকবে।
শৌখিন আবার বলে,

—তোর কথা মনে না পরলে কি মনে পরবে শুনি?আমার হৃদয়ে যে তোরই বসবাস।

ইরা লজ্জা পায় তার কথায়।গালদুটো লাল আকার ধারণ করে।
পরক্ষনে একটা কথা মনে পরতেই সে চোখ তুলে তাকায়।বলে,

—আমাকে আর তুই করে বলবেন না।

—কেনো?

—আমাদের সন্তান হওয়ার পর সে কি ভাববে এ কথা শুনলে?

শৌখিন মুখ গম্ভীর করে।চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,

—হুম,তা ঠিক।
তাহলে তোকেও তো তোর সম্মোধন টা বদলাতে হবে।

—কোনটা?

—আমাকে আপনি বলা চলবে না।তুমি বলতে হবে।আমিও তোকে তুমি করে বলবো।

ইরা মাথা নিচু করে সায় জানায়।
শৌখিন সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।ইরাকে লজ্জা পেলে দ্বিগুন সুন্দর লাগে।
তারচেয়েও সুন্দর লাগে হাসলে।
কি প্রানখোলা হাসি হাসছে আজ ইরা।
শোখিন ইরার হাতের ভাজে হাত রাখে।
সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে,এই হাত সে কোনদিন ছাড়বে না,মরে গেলেও না।
,

,

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here