পরিশেষে ভালোবাসি পর্ব ৯

#পরিশেষে_ভালোবাসি
#পর্ব_০৯
#সামিয়া_মেহেরিন

তারমানে আহিয়ান অন্যকাউকে ভালোবাসে!

আহিয়ান আমাকে খেয়াল করেন নি। আমি আর ঘরের ভেতর গেলাম না। দৌঁড়ে নিচে নামতে গিয়ে আমার অজান্তে হাতের সাথে লেগে একটা ফুলদানি পড়ে ভেঙে যায়। সেই সময় আরিয়া বেখেয়ালি ভাবে হেঁটে আসছিল। যার ফলে একটা বড় কাঁচের টুকরো ওর পায়ে গেঁথে যায়। আরিয়ার কান্নার আওয়াজ পেয়ে আহিয়ান সহ বাড়ির সকলে সেখানে চলে আসে।

আরিয়া ঘুমিয়ে পড়লে আমি ওর ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাই। ডাক্তার এসেছিল ব্যান্ডেজ করে দিয়ে গেছে সাথে কিছু ওষুধ দিয়ে গেসে। আমার ভুলের জন্যই আজ আরিয়ার এমন একটা অবস্থা হলো। প্রচণ্ড খারাপ লাগছে বিষয়টা।

ঘরে ঢুকতেই আহিয়ান আমাকে ধাক্কা দিয়ে আমার হাত দুটো দেয়ালের সাথে চেপে ধরেন। তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি আৎকে উঠলাম।

-কী ভেবে রেখেছো তোমরা? আমার পরিবারকে কি একটুও শান্তিতে থাকতে দেবে না?
-দে…দেখুন আ…মি…

-তোমার বাবা আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে আর এখন তুমি চাইছো আমার বোনকে মেরে ফেলতে?

আহিয়ানের কথায় আমি চমকে উঠলাম। এসব কি বলছেন তিনি?

-দ…দেখুন আমি…মানছি আমি ভুল করে ফেলেছি। কিন্তু তাই বলে আপনি আমার পরিবার নিয়ে এসব বলতে পারেন না।

আহিয়ান ঈশার হাত ছেড়ে দেয়। আজ বেমালুম সে ঈশাকে তার জীবনের অনাকাঙিক্ষত সত্যটা বলে দিয়েছে। সে ভাবছে কথাটা ঈশাকে এভাবে জানানো ঠিক হয় নি।

আহিয়ান নিজেকে শান্ত করে। ঠাণ্ডা গলায় বললেন
-আমি যা বলছি ঠিকই বলছি। এটাই সত্যি।

আমি কি বলব কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার বাবা কিছুতেই এমন কাজ করতে পারেন না। কিন্তু…কিন্তু আহিয়ান! সে তো বানিয়ে এসব বলার মানুষ নন। তিনি হয়তো আমাকে ভালোবাসেন না, আমিতো বাসি। আমার ভালোবাসার ওপর আমার বিশ্বাস আছে। সেই বিশ্বাস থেকে বলতে সে কখনো বিনা কারণে এমন কিছু বলবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি মনে-প্রাণে চাইছি আহিয়ানের কথা যেন ভুল প্রমাণিত হয়। আমাকে সত্যিটা জানতে হবে। আর এই সত্যি আমাকে শুধু খালামণিই বলতে পারবে।

সেই মুহূর্তেই আমি কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম।

খালামণির বাড়িতে এসে তাকে সবটা বললাম। কিন্তু তাকে আমতা আমতা করতে দেখে আমি ঘাবড়ে গেলাম। তাহলে কি আমার ভয়ই ঠিক হলো!

-কি হলো খালামণি, তুমি কিছু বলছো না কেন?
-আ…সলে আসলে
-প্লিজ খালামণি আমাকে সত্যিটা বলো।

খালামণি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলেন।
-তোর বাবা আর আহিয়ানের বাবা বিজনেস পার্টনার ছিলেন। আহিয়ানের বাবা আফজাল সাহেব ছিলেন একজন অত্যন্ত সৎ মানুষ। যখন তিনি জানতে পারেন তোর বাবা অবৈধ কাজের সাথে যুক্ত, তিনি ব্যবসায়িক সব সম্পর্ক শেষ করে দেন। এতে তিশান ভাইয়ের ব্যবসায় অনেক লস হয়ে যায়। তিশান ভাই আবারও আফজাল সাহেবের সাথে মিলে ব্যবসা করতে আফজাল সাহেবকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি রাজি হন নি। তোর বাবা সবসময় অল্পতেই রেগে যেতো আর রাগে তার মাথা ঠিক থাকতো না। সেদিনও আফজাল সাহেবের ওপর প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিল। নিজের রাগকে দমন করতে না পেরে নিজের বন্দুক দিয়ে আফজাল সাহেবের দিকে পরপর তিনটা গুলি করে। আফজাল সাহেব সেখানেই মারা যান। তোর বাবা হয়তো অবৈধ কাজের সাথে যুক্ত ছিল, কিন্তু তোকে আর নিশাকে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসতো। লোভ মানুষকে কত কি করতে বাধ্য করে!

আমি আর কিছু শুনতে পেলাম না। দৌঁড়ে খালামণির বাড়ি থেকে বেরিবেরিয়ে এলাম। আমার বাবা একজন খুনি, সন্তান হিসেবে কিছুতেই আমি মানতে পারছি না।

ঈশা বেরিয়ে যেতে তার খালামণি কাউকে কল করে। কল রিসিভ হতে তিনি বলেন
-তুমি ঠিকই বলেছিলে, ঈশা এসেছিল আমার কাছে। কিন্তু তুমি আমাকে পুরো সত্যিটা বলতে দিলে না কেন?

ফোনের ওপাশ থেকে আহিয়ান বলল
-সবটা জেনে ঈশা যদি অন্যায়কে সমর্থন করে তাই। যতই হোক নিজের রক্ত বলে কথা। আর এমনটা হলে আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো না।
-কিন্তু ঈশাতো এমন মেয়ে নয়।
-মানুষ বদলাতে সময় লাগে না।

সন্ধ্যার আবছা আলোয় রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। আমার আশেপাশে কী হচ্ছে সেদিকে আমার কোনো খেয়াল নেই। কিন্তু আমার মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা লেগে বাস্তবে ফিরলাম। পড়ে যেতে নিলে মেয়েটি আমার হাত ধরে দাঁড় করায়।

-ঈশা, তুমি? তুমি এখানে এভাবে কেন?
-আ…আপনাকে ঠিক চিনলাম না।

মেয়েটি ম্লান হেসে বলল
-তুমি আমাকে না চিনলেও, আমি তোমাকে চিনি। কিন্তু তুমি রাস্তা দিয়ে এভাবে হাঁটছো কেন? কিছু একটা হয়ে যেতে পারতো। আচ্ছা চলো আগে বাড়ি যাই।

বাড়িতে ঢুকতেই মায়ের মুখোমুখি হলাম। মা মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন
-আরে কুহু, তুই?
-হ্যাঁ মামি, আমি।

ওনাদের কথার মাঝখানে আমার থাকতে ইচ্ছে করছিলো না। যতটুকু বুঝলাম মেয়েটি আহিয়ানের ফুফাতো বোন।

ঘরে এসে দেখি আহিয়ান সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছেন। আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

-আমার বাবা যদি আপনার বাবাকে খুন করেই থাকেন, তাহলে আপনি আমাকে বিয়ে করলেন কেন?

আহিয়ান একপলক আমার দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মন দেন। আমার রাগ তরতর করে বেড়ে গেলো। চেঁচিয়ে বললাম
-কি হলো বলছেন না কেন? আজ আমি আমার সব প্রশ্নের উত্তর চাই।

আহিয়ান উঠে দাঁড়ালেন। কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বেরিবেরিয়ে যেতে নিলেন।

-তাহলে কি আমি ধরে নেবো, নিজের বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিতে আপনি এসব করছেন?

আহিয়ান থামলেন। কেমন যেন দৃষ্টিতে আমার দিকে একবার তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার সেই চোখের ভাষা পড়ার সাধ্য আমার নেই। আমি সেখানেই হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদতে লাগলাম। মাত্র কয়েক মুহূর্তেই সব কিছু বিষাদময় হয়ে উঠেছে।

আহিয়ান আর কুহু ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। আহিয়ান একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবছে এসবের মাঝে ঈশার তো কোনো দোষ নেই। তবুও মেয়েটা এত কষ্ট পাচ্ছে। ঈশার কান্না আজ কেন যেন তার হৃদয়কে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে।

নিরবতা ভেঙে কুহু বলল
-এমন মনমরা দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?

কথাটা হয়তো আহিয়ানে কর্ণকুহরে পৌঁছে নি। কুহু আহিয়ানের কাছে গিয়ে তার কাধে হাত রাখে।

-আহিয়ান?
-হ…হ্যাঁ বলো।
-ভালোবেসে ফেলোনি তো ঈশাকে?
-এ..এসব ক…কী বলছো? আ…আমি তোমাকে ভালো…ভালোবাসি। ঈশা আমাদের মাঝে কখনো আসবে না।
-তাহলে এভাবে তোতলাচ্ছো কেন? (একটু থেমে) ঈশা ভালোবাসা পাওয়ার মতোই একজন মানুষ।

আহিয়ান কী বলবে ভেবে পায় না। এই কয়েকদিনে তার মনে ঈশার প্রতি যে অনুভূতি জন্ম নিয়েছে সেটা সা অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু এই অনুভূতি যে কীসের সেটা এখনো বুঝে উঠতে পারে নি।

কুহু আবারও বলতে শুরু করে।
-ঈশাকে এখনো বলনি কেন যে তার বাবা বেঁচে আছে।
-বলব।
-ঈশার এক্সিডেন্ট করানোর চেষ্টা করে তুমি ঠিক কর নি।

আহিয়ান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
-আমি জানি, আমি ঠিক করি নি। তিশান আহমেদকে ধরতে হলে ঈশাকে ব্যবহার করতেই হতো। তিশান আহমেদ যতই খারাপ মানুষ হোক, সে তার মেয়েদের প্রচণ্ড ভালোবাসে। ঈশার ক্ষতি হতে দেখলে সে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু করবে। সেই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চেয়েছি….

হঠাৎ একটা শব্দে আহিয়ান আর কুহু ছাদের দরজার দিকে তাকায়। একটা অবয়ব দেখতে পায়। আহিয়ান দ্রুত দরজার কাছে যায় অবয়বটা কার দেখার জন্য। কিন্তু ততক্ষণে অবয়বটা মিলিয়ে যায়।

🌸🌸🌸

গত দুঘণ্টা ধরে শাওয়ারের নিচে বসে ভিজছি। শাওয়ারের পানি আর আমার চোখের পানি, দুটো মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! একটার পর একটা চমক উপহার দিয়ে যাচ্ছে।

ঘরে দম বন্ধ হয়ে আসছিল দেখে ছাদে গিয়েছিলাম। কিন্তু কে জানতো সেখানে গিয়ে আমি চরম সত্যের মুখোমুখি হব।

সকালবেলা মা ড্রইংরুমে টিভি দেখছিলেন। আমি তাকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে টিভির একটা নিউজ শুনে আমার পুরো পৃথিবীঈ যেন থমকে গেলো। নিউজে দেখাচ্ছে- গতকাল রাতে ঢাকার একটি শপিংমলে প্রাণঘাতী বোমা হামলায় নিহত অর্ধশত, আহত দুই শতাধিক। পুলিশের দেয়া তথ্যানুসারে এই হামলার পেছনে একটি মাফিয়া দলের হাত রয়েছে। যার লিডার একসময়ের প্রখ্যাত ব্যবসায়ী তিশান আহমেদ।

ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এক ধ্যানে হেঁটে যাচ্ছি। হাঁটতে হাঁটতে একটা খাদের সামনে চলে এসেছি। খাদটা এতটাই গভীর যে একবার কেউ পরলে আর বেঁচে ফিরতে পারবে না। আর এক পা পেরোলেই আমি সেই খাদে পড়ে যাবো।

খাদের দিকে এক পা বাড়াতে….

চলবে

ঈশাকে মেরে ফেললে কেমন হবে?
গল্পটা খুব শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here