পুরোনো ডাকবাক্স পর্ব -১৩

#পুরোনো_ডাকবাক্স
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১৩

মেলা থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। বাসার ঠিক সামনে হঠাৎ পায়ে কিছুতে লেগে ব্যথা পেয়ে আলিজা চিৎকার দিয়ে বসে যায়। আরসালও সামনের দিকে হাটা থামিয়ে আলিজার পাশে বসে পড়ে।

” কি হলো?

” পায়ে লেগেছে খুব জোরে?
আরসাল পকেট থেকে ফোন বের করে। ফোনের টর্চ অন করে দেখে আলিজার পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে র*’ক্ত বের হচ্ছে। আরসাল তাড়াতাড়ি আলিজার আঙুল চেপে ধরে যেন র*’ক্ত না বের হয়। আলিজার দিকে তাকিয়ে দেখে চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গিয়েছে তার। আরসাল আর দেরি না করে আলিজাকে কোলে তুলে নিয়ে হাটা দেয় এই পা নিয়ে আলিজা হেটে যেতে পারবে না ভেবে। আলিজাও কান্না থামিয়ে চুপ হয়ে যায়। সে হয়তো মনে মনে এটাই চাইছিলো। আরসাল দরজার সামনে গিয়ে কলিংবেল চাপলে নওরীন এসে দরজা খুলে দেয়।
দরজা খুলে আরসালের কোলে আলিজাকে দেখে নওরীন একটু অবাক হয়ে যায়। ভ্রু কুচকে ইশারা করে আরসালকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে কারণ ওদের মধ্যে তো এখনও এতটা মিল হওয়ার কথা না যার জন্য দুজন এত রোমান্টিক হয়ে যাবে যে বাসায় বাবা মা বোন থাকা সত্ত্বেও আরসাল আলিজাকে কোলে তুলে নিয়ে আসবে। আরসাল বাসার ভেতরে ঢুকে আলিজার পায়ের দিকে তাকাতে বলে। পায়ের দিকে তাকালে দেখতে পায় আলিজার পায়ের বুড়ো আঙুলে র*’ক্ত শুকিয়ে গিয়েছে।

” কি হয়েছে বউমণির পায়ে?

” আসার সময় ইটে লেগেছে, অনেক র’ক্ত ঝরেছে।

” কি বলছো! তাড়াতাড়ি রুমে নিয়ে যাও।

” হ্যাঁ তুই একটু আম্মিকে রুমে পাঠিয়ে দে।

” আচ্ছা ঠিক আছে।

” বাবা এসেছে?

” হ্যাঁ রুমেই আছে।

” মনে হয় না আলিজার গ্রামে যাওয়া হবে আম্মিকে পাঠিয়ে দে আমি কথা বলে দেখি।

” হ্যাঁ হ্যাঁ আমি আম্মিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি তুমি কোন চিন্তা করো না।

” আচ্ছা আমি রুমে যাচ্ছি ওকে নিয়ে।

” হুম।

আরসাল আলিজাকে নিয়ে রুমের দিকে রওয়ানা দেয়, এমন সময় আলিজা হাতের বুড়ো আঙুল নওরীনকে দেখিয়ে প্ল্যান সাকসেসফুল বুঝিয়ে মুচকি হেসে দেয়। নওরীনও হাসতে হাসতে মায়ের রুমের দিকে চলে যায়।

*****

আরসাল আলিজাকে আস্তে করে বিছানায় শুইয়ে দেয়।

” তুমি এখানে চুপ করে শুয়ে থাকো আমি দেখি কি করতে পারি।

” আপনি এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?

” চুপ করে বসে থাকবো?

” আপনার প্রেমিকার কিছু হলেও বুঝি এমন করতেন?

কথাটা এই মুহূর্তে একেবারেই আশা করে নি আরসাল। কথাটা শুনে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

” কিছু বলছেন না যে?

” আ আপনি অপেক্ষা করুন আমি নওরীনকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, সে আপনাকে সাহায্য করবে।

” আরে আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

” আপাতত এটা আপনার জানতে হবে না, আসছি।

” আপনি করে কেন বলছেন?

” বাসা লক করে যেতে বলবেন, আমার কাছে চাবি আছে।

” মানে কি!

আরসাল আর কোন কথা না বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আলিজার যেন এবার নিজের মাথার চুল নিজের ছিড়তে ইচ্ছে করছে। কেন যে এসব বলতে গেল সে। আলিজা নিজেও এসব বলতে চায় নি কেন যেন মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছে। সে ভালো করেই জানে আরসালের মনের অবস্থা কেমন তবুও কেন যে এটা বলতে গেল! পাশে থাকা ফোনটা হাতে নিয়েই আরসালকে কল দিতে থাকে কিন্তু আরসাল কোনভাবেই কল রিসিভ করে না। একসময় আরসালের ফোন বন্ধ পায় সে। এবার যেন আলিজার খারাপ লাগা বৃদ্ধি পেল, আফসোস হতে লাগলো। কিছুক্ষণ আগেও সবকিছু ঠিক ছিল।

******

রাত দশটা বেজে গিয়েছে এখনও আরসাল খোলা আকাশের নিচে মাঠে বসে আছে। আলিজার কথাটা বারবার কানে বাজছে তার। সে এসব কথা শুনতে বাধ্য তবু কেন তার এত খারাপ লাগছে! অন্যায় করলে তো অন্যায়ের শা*’স্তি পেতেই হবে। আর সেখানে তো একটা অপ*’রাধ করে ফেলেছে সে, এই অপ*’রাধের শা’*স্তি খুব সহজে শেষ হবে না। কিন্তু সে তো আলিজার সাথে নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিল, নতুন করে সংসার সাজাতে চেয়েছিল সেটা হবে বলে মনে হয় না। মানুষের কাজই হচ্ছে কোন একটা দূর্বলতা খুঁজে বের করে বারবার সেখানে আঘাত করা। আর কোন একটা মানুষকে যদি প্রিয় মানুষ ভাবতে শুরু করা হয়, আর সেই প্রিয় মানুষটি যদি বারবার আঘাত করে কথা বলে তাহলে সেই আঘাত সহ্য করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। তাহলে কি আলিজার সাথে ও কাগজে কলমে বিচ্ছেদটা করিয়ে নিতে হবে! কারণ মাঝে মাঝে মনে হয় আমি যে তাকে ভালবাসে না আর যদিও মুখে বলে তবুও এরকম কথায় মনে হয় না সে তাকে ভালোবাসে।

আকাশের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবছিল আরসাল। হঠাৎ পকেট থেকে ফোনটা বের করে অন করে বাসার দিকে রওয়ানা দেয়। এতক্ষণে হয়তো বাসার সবাই গ্রামে পৌঁছেও গিয়েছে কারণ সে বাড়ি থেকে বের হয়েছে সন্ধ্যার পরই। আনমনে হাটতে থাকে, এখন তার মাথায় খারাপ চিন্তাগুলো ভর করছে। আলিজার মতো তারও বলতে ইচ্ছে হচ্ছে তার ব্যক্তিগত দুনিয়ার সবাই তাকে ঠকিয়ে গেল। সে যাকে ভালোবাসলো সেও ঠকালো, বাবাও জোর করে অন্যকারও সাথে সংসার বাধিয়ে দিল আর এখন যখন সেই মেয়ের সাথে সব ভুলে একটু ভালো থাকতে চাইছে তখন সেই মেয়ে বারবার তাকে কথা দিয়ে আঘাত করে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। হৃদয় যেন তার করা আঘা*’তে দ্বিখন্ডিত হয়ে যাচ্ছে।

হয়তো আজ সুযোগ আছে জীবনের সব সমস্যার ইতি টেনে দেওয়ার। সত্যিই যদি আজকে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় তাহলে তো সবার জন্যই ভালো হবে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে সে যদি সবকিছু ছেড়ে চলে যায় তাহলে তো তিথি জিতে যাবে। কিন্তু তার জন্য যে এরকম মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। চারপাশের মানুষজন খুব অচেনা লাগে নিজেকেও খুব কম অচেনা লাগে না।

******

বাসার সদর দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে আরসাল। সবগুলো রুম অন্ধকারে নিমজ্জিত। হয়তো সবাই বের হওয়ার সময় সব লাইট অফ করে রেখে গিয়েছে। পাশেই স্যুইচবোর্ড থেকে স্যুইচ অন করে লাইট অন করে দেয় সে। রুমের দিকে পা বাড়াতেই বুঝতে পারে তার রুমের লাইট অন আছে তার মানে কি আলিজা যায় নি নাকি রুমের লাইট অন রেখেই চলে গিয়েছে!
দরজার সামনে গিয়ে বুঝতে পারে দরজাও খোলা আছে। রুমের ভেতরে যেতেই দেখে আলিজা বিছানায় বসে। আলিজা তাকে দেখে মুখটা কালো করে ফেলে। আরসাল এগিয়ে যায় আলিজার দিকে।

” আপনি যান নি?

আলিজা এবার বালিশের নিচে থেকে ফল কাটার ছু*’ড়ি হাতে নিয়ে আরসালের দিকে তেড়ে আসে। প্রায় গলায় ঠেকিয়ে আরসালের দিকে রাগী চোখে তাকায়।

” আর একবার যদি আপনি করে বলেছেন তাহলে একদম জিহ্বা কে*’টে নেব বলে দিলাম।

” গলায় ছু*’ড়ি ঠেকিয়ে জিহ্বা কা*’টার ভয় দেখাচ্ছেন?

” আবার আপনি করে বলছেন!

” সবকিছু সবসময় নিজের মন মতো হয় না আলিজা।

” হতে হবে, হয় না মানে?

” সামনে থেকে সরুন ঘুমাতে হবে খুব ঘুম পেয়েছে আমার।

” আমি আপনার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করছি আপনার এই ব্যবহার পাওয়ার জন্য।

” আমি মানুষটা ভালো না, আমার থেকে দূরে থাকবেন। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডিভোর্সের কাগজ পেয়ে যাবেন।

” মানে?

” বাংলাতেই বলেছি।

” অনেকসময় বাংলা কথাও বোঝা যায় না। কি বলতে চাইছেন আবার বলুন।

” আমি মানুষটা ভালো না, আমার থেকে দূরে থাকবেন। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডিভোর্সের কাগজ পেয়ে যাবেন।

” ডিভোর্সের কথা আসছে কোথায় থেকে?

” আমার থেকে, আমি ডিভোর্স দিলে নিশ্চয়ই কেউ আটকাতে পারবে না তাই না? আমি আর আমার বাবাকেও ভয় পাই না। আপনি কথায় কথায় বলেন না পুরো দুনিয়া আপনাকে ঠকিয়েছে? আমি যেভাবে ঠকেছি সেভাবে আপনি ঠকলে, আমার সাথে যা যা হয়েছে সেসব আপনার সাথে ঘটলে আপনি হয়তো সেচ্ছায় মৃ*’ত্যু নামক সমাধান বেছে নিতেন। পুরুষ মানুষকে ভুল বোঝা যায়, সঠিক বোঝার মানুষ থাকে না। পুরুষ মানুষ শত কষ্ট পেয়েও মেয়েদের মতো চিৎকার করে কান্না করতে পারে না বলে আপনাদের ধারণা পুরুষ মানুষ কষ্ট পায় না। আজকেও চেয়েছিলাম সবকিছু ভুলে নতুন করে শুরু করতে। ভালো থাকার অধিকার তো সবার আছে। কিন্তু এখন আমি নিজের কাছে একদম পরিষ্কার কোন মেয়ে মানুষের সাথে নিজের ভালো থাকার রঙ আমি আর মেশাবো না।

” আরসাল!

” আপনি খুব জলদি ডিভোর্স পেপার হাতে পেয়ে যাবেন। আর আমি খুব শিঘ্রই দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাব যেখানে চেনা মুখ থাকবে না একটাও।

” আপনি আমার সাথে এটা করতে পারেন না আরসাল।

” আমি কারও সাথে কখনও খারাপ কিছু করি নি, যা করার অন্যরাই আমার সাথে করেছে। আমার ভালো থাকা কেড়ে নিয়েছে। আমার চারপাশের মানুষগুলোর আঘা*’তে আমার মৃ*’ত্যুটা হওয়া শুধু বাকি।

কথাগুলো বলেই কান্না করে দেয় আরসাল। এই প্রথম কোন পুরুষকে এভাবে কান্না করতে দেখছে আলিজা। আরসাল বারবার চোখ মুছে যাচ্ছে।

” একটু জড়িয়ে ধরতে দেবেন?

আলিজার কথা শুনে নাবোধক মাথা নাড়ায় আরসাল। আলিজা তার নিষেধ না শুনে জড়িয়ে ধরে। আরসাল বারবার নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে আলিজা আরও শক্ত করে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আরসালকে।

চলবে….
আজকে আর কিছু বলব না, কারও বড় বড় কমেন্ট পাই না, আগের মত ভালোবাসাও পাই না।💔

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here