দীর্ঘ ৩ বছরের সম্পর্কের ইতি টেনে নিজেকে যখন ঘরবন্দী করে ফেললাম ঠিক তখনই বাবা নতুন আরেক সম্পর্কে জড়ানোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন।
প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে ছাদের এক কোনায় বসে ডুবু ডুবু সূর্যটা দেখছিলাম। কুয়াশায় ঘেরা লাল সূর্যটা তেজহীন ডুবে যাচ্ছে অদূরে। সাথে শিরশিরে হাওয়া বইছে। শরীর শিউরে উঠলেও আমার মন সেদিকে নেই। আমি ভাবছি এক সপ্তাহ আগের কথা। শাতিলের সাথে ৩ বছরের সম্পর্ক ছিলো। আমিই তার প্রতি বেশি দুর্বলতা প্রকাশ করেছি বরাবর। কিন্তু কখনো এটা ভাবনাতেও আসেনি যে সে আমার দুর্বলতার সুযোগ নিতে পারে। শাতিল নতুন চাকরিতে জয়েন করলেই আমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে সেটাই কথা ছিলো। আমিও সেই আশাতেই বসে ছিলাম। অনেক চেষ্টার পর শাতিলের একটা চাকরি হলো। কিন্তু তারপর থেকেই খেয়াল করলাম তার মাঝের পরিবর্তন টা। মেনে নিতে কষ্ট হলেও সহ্য করে নিতাম সবকিছু। তার উগ্র আচরণ দেখেই ভাবী বলেছিল
” ছেলেটাকে নিয়ে করে সুখী হতে পারবে তো? ভেবে দেখো আরো একবার।”
আমি সেদিন হেসেছিলাম। মুখ ফুটে ভাবীকে কিছু বলিনি তবে মনে মনে তার এই কথায় কিছুটা হিংসার আভাস পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমার ভালোবাসার মানুষের সাথে বিয়ে হোক সেটা হয়তো ভাবী চান না। ব্যবহারে কি আসে যায়। মানুষটার সাথে সারাজীবন থাকতে পারবো এই তো অনেক। যখন বাড়িতে জানানোর কথা উঠলো তখনই শাতিল স্পষ্ট জানিয়ে দিলো সে তার পরিবারের লোকজনকে এভাবে আমার বাসায় পাঠাতে পারবে না। এতে নাকি তারা ছোট হবে। তাই আমাকেই আগে বাসায় কথা বলে ম্যানেজ করে নিতে হবে। তারপর তারা আসবে কথা বলতে। আমি তখনো বোকার মতো মেনে নিলাম। বাবাকে রাজি করাতে বেশ বেগ পেতে হল। তবুও হাতে পায়ে ধরে রাজি করালাম। তার বাসার লোকজন আসলো আমাকে দেখতে। কথা ছিলো তারা আমাকে আংটি পরিয়ে যাবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। কোন সিদ্ধান্ত না জানিয়েই তারা চলে গেলো। তারপর দুইদিন কোন খবর নেই। শাতিল ও অফিসের কাজে ব্যস্ত। ফোন করার বা ধরার সময়টা সে পায়নি। অতঃপর দুইদিন পর ফোন এলো শাতিলের। কোন রকম জড়তাহীন কণ্ঠে জানিয়ে দিলো আমাদের পরিবেশ নাকি তার পরিবারের লোকজন পছন্দ করেন নি। আপ্যায়ন তাদের ভালো লাগেনি। জানতে চেয়েছিলাম এখন কি করবো। স্পষ্ট ভাষায় বলেছিল
” আমি জানিনা। তুমি তোমার মতো বুঝে নাও। জীবনটা তোমার। আমার কিছুই করার নাই।”
ওর কথার অর্থ বুঝে গিয়েছিলাম। তাই আর কথা বাড়াইনি। সেদিনের পর থেকে আমিও আর তাকে ফোন দেইনি। তার কাছে দুর্বলতা প্রকাশ না করলেও ভেংগে পড়েছিলাম খুব। এই একটা সপ্তাহ আমার কাছে জীবনের সবথেকে কষ্টের হয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু ভাবী নামক মানুষটা যার উপদেশের কারণে এক সময় উপহাস করেছিলাম সেই মানুষটাই পাশে দাঁড়ালো। হয়ে উঠলো খুব ভালো বন্ধু। মনের সব কষ্ট ভাবীকে খুলে বলতাম আর কাদতাম। ভাবী আমাকে সামলাতে চেষ্টা করতো। আমার ভাবনার মাঝেই ভাবী এসে জানালো বাবা আমার বিয়ের জন্য ছেলে ঠিক করেছেন। আর বাবা চান আমি আগামীকাল ছেলের সাথে দেখা করি। আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। শুধু বুক ভেংগে কান্না পাচ্ছিল আমার। ভাবী আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। অনেক চেষ্টার পর অবশেষে সফল ও হলো। কিন্তু বাবার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছিলাম না। এতো বড় ধাক্কা খেয়ে আবার কোন সম্পর্কে জড়ানোর মতো সাহস আমার হচ্ছে না। বাবা হয়তো আমার আচরণ খেয়াল করেছিলো। তাই ভেবেছিল ভাবীর থেকেও খুব কাছের একজন বন্ধু প্রয়োজন আমার। সেই থেকেই হয়তো বিয়ের সিদ্ধান্ত। পুরো একটা নির্ঘুম রাত পার করলাম। তবুও কিছুতেই নিজেকে বোঝাতে পারলাম না। সকাল সকাল হাত মুখ ধুয়ে এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে ছাদে এলাম। পুরো ছাদে খালি পেয়ে হেঁটে হেঁটে চা টা শেষ করলাম আর ভাবলাম। ছাদ থেকে নেমে দেখি বাবা নাস্তার টেবিলে বসে আছে। আমাকে দেখেই মা বলল
” আয় নাস্তা খাবি।”
আমি প্রতি উত্তর না করে টেবিলে গিয়ে বসলাম। মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ বাবা কথা শুরু করলো
” তোমার মানসিক অবস্থা বাবা হিসেবে আমি বুঝতে পারছি। আমি অমন বাবা নয় যে তোমার উপরে যে কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবো। ছেলে আমার ভালো লেগেছে। বাবা হিসেবে আমি খোঁজ নিয়েছি আর কোথাও কোন ত্রুটি পাইনি। এখন আমি চাই তুমি ছেলের সাথে দেখা করো। তারপর সিদ্ধান্ত জানাও। একটা কথাই বলবো যে মানুষ কে চেনা এতো সহজ না। আর তোমার থেকে আমি অন্তত মানুষকে ভালই চিনি। তাই আশা করছি আমার সিদ্ধান্তে তুমি দ্বিমত পোষণ করবে না।”
আমি কোন কথা খুঁজে পেলাম না। একদিকে যেমন আমার উপরে সিদ্ধান্ত ছেড়ে দিলো অন্যদিকে ঠিক তেমনই কোন রাস্তা খোলা রাখলো না। চোখ উপচে পানি চলে এলো। তবুও নিজেকে সামলে রাখলাম। এই মুহূর্তে কাদতে চাইনা। নিজের ভুলের মাশুল তো দিতেই হবে। অনেক কষ্ট করে বাবাকে রাজি করিয়েছিলাম। এখন আর কথা বলার মুখ নেই আমার। তাই বাবার কথা মানতেই ছেলের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
বিকেল হতেই তৈরি হয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় চলে গেলাম। রিক্সা থেকে নেমে কিছুটা অবাক হলাম। এই ধরনের মিটিং গুলো সাধারণত কোন রেস্টুরেন্টে বা পার্কে হয় কিন্তু এটা তো পুরোই ব্যতিক্রম। আমি এই মুহূর্তে একটা গাছ ভর্তি নার্সারীর সামনে দাড়িয়ে আছি। মাথায় কিছুই ঢুকছে না। ভেতরে যাবো কিনা ভাবছি। ঠিক তখনি একজনকে দেখতে পেলাম। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে ফেললাম
” এক্সকিউজ মী? আমি কি রুপম শাহরিয়ার এর সাথে দেখা করতে পারি?”
ছেলেটি আমাকে আঙ্গুলের ইশারায় ভেতরে যেতে বলল। আমিও উপায় না দেখে এক পা দুই পা করে ভেতরে গেলাম। নানা জাতের গাছের মাঝে কেমন অদ্ভুত লাগছে। আসে পাশে যতদূর চোখ যায় ফল আর ফুলের গাছ। ফুটন্ত ফুলের গাছ গুলো থেকে কেমন সুবাস ভেসে আসছে। ভেতরের অস্থিরতা কিছুটা কমে এলো। এক পাশেই সারি বদ্ধ গোলাপের গাছ। রং বেরংয়ের সেই গাছের সমারোহ দেখেই আমার চোখ কপালে। এতো ধরনের গোলাপ হয় এখানে না আসলে কখনো জানাই হতো না। আমি গোলাপের গাছের দিকে এগিয়ে গেলাম। গাঢ় কমলা রঙের গোলাপটা কি সতেজ! ভেতরটা শান্ত হয়ে গেলো। আমি ফুলের দিকে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিতেই পেছন থেকে ভারী আওয়াজ কানে এলো
” এটা এক ধরনের ক্লোনিং গোলাপ। এক গাছেই তিন রঙের ফুল দেখা যায়। ফোঁটার সময় এক রং। মাঝ বয়সে আরেক রং আর ঝরে পড়ার আগে সব থেকে আকর্ষণীয় রংটা ধারন করে।”
আমি চমকে পেছনে তাকালাম। অপরিচিত একজন যুবক। ছিমছাম গড়নের। চেহারা মোটামুটি ভালোই। হাত ভাঁজ করে দাড়িয়ে আছে। ঠোঁটে চমৎকার হাসি। আমার মনোযোগ সেই গোলাপটা থেকে নড়ছেই না। ওনার কথা শোনার পর আরো আগ্রহ চেপে বসলো। আমি সেদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
” এখন কি ঝরে পড়ার সময়? রংটা বেশ লাগছে।”
উনি মৃদু হেসে বললেন
“জী।”
” খুবই অবাক করা বিষয়। একই ফুলের তিন রকম রং! ভাবতেই অবাক লাগছে।”
আমার কথা শুনে উনি খানিক্ষ্ন হাসলেন। তারপর বললেন
” এভাবে না ভেবে অন্যভাবেও তো ভাবা যায়। জীবন্ত সত্ত্বা একেক সময় একেক রূপ ধারণ করে। যেমন মানুষের কথাই বলেন। যৌবন বয়সে এক রকম থাকে মধ্য বয়সে আরেক রকম আবার মৃত্যুর সময় অন্য রকম।”
আমি মুগ্ধ নয়নে তাকালাম। কি অদ্ভুত ব্যাপার! এভাবে তো ভাবা হয়নি। কত সহজ ভাবেই না বর্ণনা করলেন উনি। উনি নিরবতা ভেংগে বললেন
” আমি রুপম। আপনি আমার সাথেই দেখা করতে এসেছেন মিস আজরা।”
আমি হকচকিয়ে গেলাম। বার কয়েক চোখের পলক ফেলে অপ্রস্তুত হয়ে বললাম
” ওহ!”
উনি হাতের ইশারায় দেখিয়ে বললেন
” ঐদিকটায় বসার জায়গা আছে। আমরা কি বসতে পারি?”
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। উনি আগে হেঁটে গেলেন। আমি ওনার পিছু পিছু গেলাম। একদিকে পার্কের মতো বসার ছোট্ট একটা জায়গা। তার চারিদিকে গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, বেলী অসংখ্য সৌরভি ফুলের সমারোহ। উনি আমাকে এক পাশে বসতে বললেন। আমি বসেই চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম। উনি আমার সামনে বসে বললেন
” এই পৌষের বিকেলে এক কাপ গরম চা হলে খারাপ হয়না তাই না?”
ভদ্রতা বজায় রাখার জন্য জিজ্ঞেস করলেও হয়তো না বলা যায় কিন্তু এভাবে বললে কিভাবে না বলতে হয় সেটা আমার জানা নেই। তাই সম্মতি জানালাম। উনি চা আনতে বলে আমার দিকে তাকালেন। তারপর অতি ভদ্রভাবে বললেন
” আমি রুপম সেটা তো জেনেছেন আগেই। বাকি টাও বলে ফেলি? একটা ছোট চাকরিতে ঢুকেছি। খুব বেশিদিন হয়নি। চাকরি করার ইচ্ছা ছিল না। আমি আবার গাছ প্রেমী। তাই সখের বশেই নার্সারী বানিয়েছি। নিজেও উপভোগ করি আবার অন্যকেউ আমার সংগ্রহ থেকে গাছ সংগ্রহ করার সুযোগ করে দেই। আমি বই পড়তে পছন্দ করি। বলতে পারেন সেটা আরেকটা সখ। হাসতে ভালোবাসি। জটিলতা পছন্দ করি না। মনকে কষ্ট দেয়ার মতো কোন কাজই আমি করিনা। মন তো একটাই তাকে আর কষ্ট দিয়ে কি হবে বলেন।”
আমি ওনার কথায় হেসে ফেললাম। সত্যিই এভাবে ভাবা হয়নি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলে ফেললাম
” আপনার চিন্তা ভাবনা অনেক সুদূর প্রসারী।”
” মোটেই না। আমি যেহেতু জটিলতা পছন্দ করি না তাই যা ভালো লাগে সেটাই করি। শুধু বাবা মায়ের ইচ্ছাতেই চাকরিটা করা। এই একটা কাজই আমি আমার অনিচ্ছাতেই করেছি। বাকি সবকিছুই নিজের ভালো থাকার জন্য করি। আসলে আমি ভাবি নিজে ভালো থাকলেই অন্যকে ভালো রাখা যায়। আর আমি চাই আমার আসে পাশের সবাই ভালো থাকুক। বলতে পারেন আমি এক রকম স্বাধীন ভাবে চলতে ভালোবাসি। আর বিশেষ কিছু আমার সম্পর্কে জানার নেই।”
আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যেই চা চলে এলো। উনি ওনার নার্সারী সম্পর্কে আমাকে সব ধরনের তথ্য দিলেন। ওনার কথায় খুব ভালোভাবে বোঝা যায় যে গাছ ওনার কতটা প্রিয়। চা শেষ করে আমি উঠে পড়লাম। সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরতে হবে। আমাকে উনি একটা রিক্সা ডেকে উঠিয়ে দিলেন। আমি রিক্সায় বসে ভাবছি ব্যাপারটা আশ্চর্য হলেও সত্য যে উনি আমার সম্পর্কে কিছুই জানতে চাইলেন না। নিজের সম্পর্কে অল্প কিছু কথা বলেই পুরো সময়টা গাছ নিয়েই কথা বললেন। মানুষ হিসেবে চমৎকার। কিন্তু আমার মাঝে কোন অনুভূতির সৃষ্টি হয়নি। একটা অপরিচিত মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার পর যেমন দ্বিতীয় বার দেখার কোন প্রয়াস জাগে না আমার ক্ষেত্রে তেমনই হচ্ছে। একটা অনুভূতিহীন সম্পর্কে আমি কিভাবে জড়াবো? কিভাবেই বা বাবাকে না বলবো? দ্বিধার মাঝেই পেরিয়ে গেলো পুরোটা রাস্তা।
চলবে
#পৌষের_কোন_এক_বিকেলে
পর্ব – ১
অপরাজিতা অপু
(গল্পটা ছোট আকারের হবে। অল্প কয়েক পর্বেই শেষ হবে। যারা গল্পটা পড়বেন অবশ্যই মন্তব্য করবেন কেমন লাগছে। আপনাদের ছোট্ট মন্তব্য আমাদের লেখার অনুপ্রেরণা যোগায়।)