পৌষের কোন এক বিকেলে পর্ব -০২+৩

#পৌষের_কোন_এক_বিকেলে
পর্ব – ৩
অপরাজিতা অপু

সারারাত গাঢ় কুয়াশার চাদরে মুড়ে থাকা শহরে ভোর নামছে। রাতের সেই গাঢ় কুয়াশা কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আলো ফুটছে ওই আকাশে। সূর্যের প্রথম আলোটা জানালা গলিয়ে মুখে পড়তেই ঘুম ভেংগে গেলো। চোখটা মেলে তাকালাম জানালার বাইরে। কাল রাতে দরজা জানালা খুলে রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উঠে বসে বিছানা থেকে পা নামাতেই দরজার বাইরে চোখ পড়লো মা হন্তদন্ত করে রান্না ঘরে যাচ্ছে। নাস্তা বানাবার প্রস্তুতি শুরু হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। বাবা আবার সকালে তাড়াতাড়ি নাস্তা সেরে ফেলেন। আমি ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম। এই আমি কাল রাতে এক বড়ো বোকামী করতে যাচ্ছিলাম। ছাদ অব্দি গিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু সময় মতো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছি। আবেগের বশবর্তী হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু এটা বুঝতে দেরি হয়নি যে ক্ষতিটা আমারই হতো। এমন একটা কাজ করে ওই বিশ্বাস ঘাতক টাকে জিতিয়ে দেয়া হতো। অপমান করা হতো আমার ভালোবাসাকে। সম্পর্কটা যেহেতু দুজনের মাঝেই ছিলো তাহলে আমি একাই কেনো তার মাশুল গুনবো। কেনো আমি একাই কষ্ট বয়ে বেড়াবো সারাজীবন। আমি তো নিজের কোন অপরাধ খুজে পাইনি। তাহলে আমি কেনো নিজেকে শাস্তি দেবো। কেনো মুক্তি হিসেবে মৃ ত্যুকে বেছে নেবো। আমার উচিত নিজেকে জীবনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এতটা ভালো থাকা যে সেই মানুষটা যেনো আফসোস করে। আমি তার জীবনের এক মাত্র আফসোস হতে চাই যাকে না পেয়ে সে সারাজীবন পস্তাবে। নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নিচে এসে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আমি আর ভাবতে চাই না তার কথা। শুধু যে তাকে ভুলে যেতে চাই তা নয়। আরো একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। বাবার পছন্দের ছেলেকে একটা সুযোগ দিতে চাই। জড়াতে চাই একটা বেনামী সম্পর্কে। আবেগ দিয়ে আর জীবন বিচার করবো না। এবার বাস্তবতায় বাঁচবো। ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে নাস্তার টেবিলে গিয়ে বসলাম। ততক্ষণে বাবাও চলে এসেছে টেবিলে। আমাকে এতো সকালে দেখে কিছুটা অবাক হল বোধহয়। আমি সাধারণত এতো সকালে উঠিনা। সবার নাস্তা খাওয়া শেষ হলেই তবে আমার নাস্তার সময় শুরু হয়। এভাবে কখনো বাবার সাথে একসাথে বসে নাস্তা খাওয়ার সুযোগ হয়নি। হয়নি বললে ভুল হবে আমিই চাইনি। আমার মাঝেই জড়তা ছিল। বাবা নিজের কৌতূহল চেপে রাখতে পারলো না। কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল
” তুমি এতো সকালে উঠেছো যে? রাতে ঘুম হয়েছে? শরীর খারাপ নাকি তোমার?”

আমি সরাসরি বাবার চোখে চোখ রাখলাম। দুটো চোখে কি স্নিগ্ধতা! অস্থিরতা! সবটাই আমার জন্য। ভাবতেই ভেতরটা কেমন শীতল হয়ে গেলো। আর সহজ হয়ে গেলো সিদ্ধান্ত নেয়াটা। কাল রাতে যদি আমি বোকামী করে বসতাম তাহলে শুধু শুধু এই মানুষ গুলোকে কষ্ট পেতে হতো। আমার প্রতি তাদের এই অগাধ ভালোবাসা আর কোনদিন অনুভব করা হতো না। এই আফসোস টা থেকেই যেতো। মৃদু হেসে বললাম
” কিছুই হয়নি। আমি একদম ঠিক আছি। ঘুম ভেংগে গেলো তাই উঠে গেছি। তোমার সাথে কথা ছিলো কিছু।”

বাবা চিন্তিত চেহারায় বলল
“বলো।”

মা খাবার দিয়ে গেলো। আমার সামনে খাবারের প্লেট রেখে রান্না ঘরে চলে গেল না। দরজার এক পাশে দাড়িয়ে আছে অধীর আগ্রহে আমার কথা শোনার জন্য। তার মাঝের দুশ্চিন্তা আমার চোখে ধরা পড়লো। বুঝলাম তাদের মানসিক অবস্থা ভালো না। আমাকে নিয়ে বেশ ভয়েই আছে। আমি খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়ে বললাম
” বাবা তোমার যদি ছেলেকে ভালো লাগে তাহলে হ্যা বলে দাও। আমার আপত্তি নেই।”

আমার কথা শেষ হলেও তার রেশ রয়ে গেলো কয়েক সেকেন্ড। সবকিছু নিস্তব্ধ। আমি বাবার দিকে তাকালাম। তার চেহারায় অবাধ আনন্দ। খুশির আমেজ ঝলকে উঠছে। বাবা হেসে উঠে বলল
” আমি জানতাম। ছেলেটা অপছন্দ করার মতো নয়। আমি আজই তাদেরকে জানিয়ে দিবো।”

আমি নিশব্দে নাস্তা শেষ করে টেবিল ছাড়লাম। ঘরে যাবার আগে বাবাকে বললাম
” তোমার কাছে কিছু টাকা হবে?”

বাবা অবাক চোখে চাইলো। আমি এর আগে মুখ ফুটে বাবার কাছে কখনো টাকা চাইনি। আমার জতটুকু প্রয়োজন বাবা নিজেই দিয়ে দিতো। সেখান থেকেই টাকা বাঁচিয়ে হাত খরচ করতাম। উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো
” কত টাকা লাগবে?”

“খুব বেশি না হাজার দুয়েক হলেই হবে। ভাবছি শপিং এ যাবো। আমার কাছে তো টাকা নেই।”

বাবা নাস্তা ছেড়ে ঘরে চলে গেল। অল্প কিছু সময় পরেই আবার বাইরে এসে মুড়ে রাখা হাজার টাকার কয়েকটা নোট আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল
” এটা রাখো। তোমার যা লাগবে খরচ করো। আর বাকিটা রেখে দিও।”

আমি বাবার চোখের কোনে লুকানো পানিটা খেয়াল করলাম। মুচকি হেসে টাকা নিয়ে ঘরে চলে এলাম। বিছানায় বসে আরো প্রশস্ত হাসলাম। আমার কাছে টাকা আছে। তারপরেও বাবার কাছে চাইলাম। বাবার সাথে বরাবর আমার প্রয়োজনের সম্পর্ক। প্রয়োজন ছাড়া কখনো কথা হয়েছে বলে মনে পড়ে না। কিন্তু কয়েকদিন থেকে খেয়াল করছি বাবা নিজে থেকেই আগ বাড়িয়ে সহজ হওয়ার চেষ্টা করছে। তাই আমিও একটু সহজ হয়ে গেলাম। সম্পর্কটা সহজ করে নিলাম। বাবা মায়ের সাথে শুধু প্রয়োজনের সম্পর্ক হয়না। সম্পর্কের গভীরতা থাকতে হয়। আজ প্রথমবার টাকা চাইলাম বলে বাবা যে কি খুশি হয়েছে সেটা চোখে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। ভাবীর সাথে সম্পর্কটাও খুব ভালো ছিলো না। কিন্তু এই কয়দিনে ভাবী একজন বন্ধুর চেয়েও বেশি হয়ে উঠেছে। যতটা সাপোর্ট পেয়েছি কখনো ভাবিনি এমন হতে পারে। এবার আমার পালা। ভাবীর সাথে কখনো বাইরে যাওয়া হয়নি। ভাইয়ার এখন অফিস টাইম। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে পড়বে। তাই আমিও এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলাম। দরজায় নক করতেই ভাইয়া বলল
” কে?”

“ভাইয়া আমি।”

ভাইয়া গলা তুলে বলল
” ভেতরে আয়।”

আমি ভেতরে ঢুকেই ভাবীর দিকে তাকিয়ে বললাম
” তোমার আজ কি বিশেষ কোন কাজ আছে? একটু সময় দিতে পারলে ভালো হতো।”

ভাবী অবাক হয়ে বলল
” কেনো বল তো?”

আমি মুচকি হেসে বললাম
” তেমন কিছু না। তোমাকে নিয়ে একটু বাইরে যেতাম।”

ভাইয়া ভাবী দুজনেই অবাক হলো। ভাবী কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল
” কখন যাবে আমাকে বলিও।”

আমি মৃদু হেসে বেরিয়ে এলাম। নিজের ঘরে এসে জানালার পাশে দাড়ালাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছি। কিছুক্ষণ পরেই ভাবী দুই কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকলো। আমাকে বাইরে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল
” মন খারাপ?”

আমি বেশ সাভাবিক ভাবেই বললাম
” না তো। মন খারাপ হওয়ার কোন কারণ আছে কি?”

ভাবী হেসে ফেললো। চায়ের কাপটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো। আমি সেটা হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে ভাবীর দিকে তাকালাম। বেশ খুশি লাগছে তাকে। বুঝতে পারলাম আমার চেষ্টা সফল হয়েছে। সবাইকে ভালো রাখার চেষ্টায় আমি সফল। আর নিজের মাঝেও এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। আশে পাশের সবাই ভালো থাকলে সত্যিই অনেক আনন্দ পাওয়া যায়। হুট করেই কেমন সব পরিবর্তন হয়ে গেলো। কথাটা মাথায় ঢুকতেই মস্তিষ্ক খুলে গেলো। মনে পড়ে গেলো সেদিন সেই মানুষটার বলা কথাটা
‘ নিজে ভালো থাকলেই অন্যকে ভালো রাখা যায়।’
এতদিন বাদে কথাটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছি। নিজে ভালো থাকলেই বাকি সবাই ভালো থাকতে পারে। মানুষটা আসলেই অদ্ভুত। তার কথার গভীরতা অনেক বেশী। আমার মতো অলস মস্তিষ্ক সেই সূক্ষ্ম কথার ধার ধরতে পারবে না সেটাই স্বাভাবিক। ভাবীর সাথে আরো কিছুক্ষণ চলল কথোপকথন। চা শেষ করে ভাবী কাপ নিয়ে বেরিয়ে গেলো। আমিও ভাবছি আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব। ঘুমের ঔষধ খাওয়ার পরেও ঘুমটা ঠিক মতো হয়নি তাই মাথাটা ব্যথা করছে। আর ঘণ্টা খানেক ঘুমালে হয়তো ভালো লাগবে। শুয়ে পড়লাম। অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই ঘুম চলে এলো। বেশ গাঢ় ঘুম। কত সময় ঘুমালাম জানিনা। ফোনের শব্দে ঘুমটা ভেংগে গেলো। ঘুমু ঘূমু চোখে তাকিয়ে দেখি অপরিচিত একটা নাম্বার। ফোনটা রিসিভ করলাম।
” হ্যালো।”

“কেমন আছেন?”

শীতল কণ্ঠ শুনেই মস্তিষ্ক স্থির হলো। আমি কিছুটা গা ছাড়া ভাবেই বললাম
” কে বলছেন?”

” আমি রুপম। মনে আছে আমাকে?”

ঘুম ছুটে গেলো আমার। মুহূর্তেই কয়েকবার চোখের পলক ফেলে গলার স্বর নামিয়ে বললাম
” জী।”

বলার মতো আর কোন কথা খুজে পেলাম না। আমি চুপ করেই থাকলাম। উনি বললেন
” আপনার সাথে কথা ছিলো। একটু সময় দিতে পারবেন আজরা?”

চলবে#পৌষের_কোন_এক_বিকেলে
পর্ব – ৪
অপরাজিতা অপু

রুপমের কথায় আমি একটু অবাক হলাম। মাথায় এলো আমার নাম্বার পেলো কোথায়। তার কথার উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে বসলাম
” নাম্বার কোথায় পেলেন আপনি?”

” যার যাকে প্রয়োজন সে ঠিকই খুজে নেয়। বলতে পারেন এই মুহূর্তে আপনাকে আমার প্রয়োজন। তাই খুজেঁ নিলাম।”

তার কথার অর্থ বুঝতে পারলাম না। অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
” আমাকে কেনো প্রয়োজন আপনার?”

” আপনার বাবা ফোন করেছিলেন। জানালেন আপনি নাকি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন। সে বিষয়েই একটু কথা ছিলো।”

তার অকপটে বলা কথার উত্তরে আমি বললাম
” জি বলুন।”

উনি কিছুটা সময় নিয়ে ভেবে বললেন
” এভাবে না বলে যদি দেখা করতে চাই? সুযোগ দেবেন আমাকে?”

আমি না ভেবেই হ্যা বলে দিলাম। উনি আমাকে আবার সেই নার্সারীতে যেতে বললেন। তবে একা না বিকেলে নিজেই নাকি আমাকে নিতে আসবেন। আমি আপত্তি করিনি। তবে ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হলো না। আমার মনে হলো উনি হয়তো সুযোগ নিতে চাইছেন। কিন্তু কেনো এমন করবেন? কি উদ্দেশ্য ওনার। মাথায় নানা রকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। সব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাকে ওনার সাথে দেখা করতে হবে। তার আগে কিছুই বলতে পারবো না। তবে এই কথাটা তো বাসায় জানাতেই হবে। ভাবীকে সবটা জানিয়ে দিলাম। বাকিটা এখন ভাবীই ম্যানেজ করবে। পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢলে পড়তেই আমার ফোনে মেসেজ এলো
” রেডি? আসবো আমি?”

নাম্বার টা দেখেই বুঝে গেলাম এটা রুপম। আমিও ছোট্ট করে একটা জবাব দিয়ে দিলাম ” আসুন।”
তারপর রেডি হয়ে নিলাম ঝটপট। রুপম আসতে খুব বেশি দেরি হলো না। বাড়ির সামনে এসে ফোন দিলো আমাকে। আমি ফোনটা ধরতেই বলল
” আমি বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছি।”

” আসছি।”

বলেই আমি বেরিয়ে গেলাম। বাড়ির মেইন গেট পেরিয়ে দেখি রুপম রিক্সায় বসে এদিকেই তাকিয়ে আছে। আমি ধির পায়ে রিক্সার কাছে গিয়ে দাড়ালাম। তার সাথে একই রিক্সায় বসতে আমার অসস্তি হচ্ছিলো। তাই দাড়িয়ে ভাবছিলাম। তিনি হয়তো বিষয়টা বুঝতে পেরেছেন। রিক্সার অপর পাশে চেপে বসে বললেন
” রিক্সায় উঠতে কি খুব বেশি সমস্যা?”

আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না খুব সমস্যা কিনা। তবে অসস্তি হচ্ছে। তবুও মনস্থির করে রিক্সায় উঠে বসলাম। রুপম কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেই বসেছে। আমার বাড়ি থেকে সেই নার্সারীর দূরত্ব খুব বেশি না। কিছুদূর যেতেই রুপম বলল
” জানতে ইচ্ছা করছে না কেনো আমি নিজেই নিতে আসলাম?”

অসস্তিতে বিষয়টা মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিলো। সে নিজে থেকেই যখন জানাতে চাইছে তাই আমিও আগ্রহ দেখিয়ে বললাম
” কেনো এলেন?”

রুপম খুব সহজ স্বাভাবিক ভাবে বলল
” দায়িত্ব তো নিতেই হতো তাই আগে থেকেই বুঝে নিতে চাইছিলাম। প্রথমবার দেখা হওয়ার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা ছিলো। তখনো দায়িত্বটা ঠিক আমাকেই নিতে হবে কিনা সেটা সিওর ছিলাম না। তাই আগ বাড়িয়ে কিছুই বলতে চাইনি। কিন্তু এখন তো পুরোটাই আমার। আমি কি করে অবহেলা করি।”

রুপম থেমে গেলো। সাথে আমিও। বাকি রাস্তাটা আর কোন কথা হলো না। আমরা পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। রিক্সা থেকে নেমে নার্সারীর ভেতরে প্রবেশ করতেই আমার নাকে ভেসে এলো বেলী ফুলের সুবাস। মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো। কি অদ্ভুত ব্যাপার! প্রকৃতির কি অসীম শক্তি। আমরা সেই বসার জায়গাতেই গিয়ে বসলাম। সেদিনের মতই রুপম চা দিতে বলল। আমি চারিদিকে চোখ বুলিয়ে সেদিনের টকটকে রঙের গোলাপটা খুঁজলাম। কিন্তু কোনদিকে দেখতে পেলাম না। রুপম বলল
” কি খুঁজছেন?”

আমি চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বললাম
” সেদিনের গোলাপটা কোথাও দেখছি না।”

“ওহ! ওটাতো ঝরে পড়ে গেছে।”

আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। এতো সুন্দর একটা গোলাপ ঝরে পড়ে গেলো। রুপম আবার বলল
” নতুন কলি এসেছে। আবার ফুল ফুটবে। মন খারাপ করার কিছু নেই।”

আমি এক পলক রুপমের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলাম। বিয়েতে মত দিলেও এখনো সহজ হতে পারিনি। অনেক সময় লাগবে আমার এই সম্পর্কটা কে মেনে নিতে। কিন্তু আমি কি এতো সময় পাবো?
“আজরা?”

ভীষণ শান্ত কণ্ঠ আমার ভেতরটা কাপিয়ে তুললো। আমি বাধ্য হলাম রুপমের চোখে চোখ রাখতে। কিছুক্ষণ আগের হাসিমাখা চেহারাটা দেখতে পেলাম না। চোখের ভাষা পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমি পুরো চেহারায় চোখ বুলিয়ে আবারো সেই শীতল দৃষ্টির দিকে নিজের দৃষ্টি স্থির করলাম। রুপম ভীষণ শান্ত ভাবে বলল
” আপনার বিয়ে অথচ সেই আমেজটা কোথাও নেই। চেহারায় হতাশা ছাড়া কিছুই প্রকাশ পাচ্ছে না। কেনো?”

আমার সমস্ত ভাষা কোথায় হারিয়ে গেলো। মুখ দিয়ে একটা কথাও বেরোচ্ছে না। রুপম এর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আমাকে অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। রুপম এখনো আগের মতই তাকিয়ে আছে। আমি বড়ো একটা শ্বাস টেনে নিচের দিকে চোখ নামিয়ে বললাম
” সেরকম কিছুই না। আমি আগে এভাবে কারো সাথে কথা বলিনি তাই একটু হেজিটেশন হচ্ছে।”

“কোনটা হেজিটেশন আর কোনটা ডিপ্রেশন সেটা আমি বুঝি। না বলতে চাইলে আলাদা কথা। জোর করার মত অধিকার আমার এখনো হয়নি। আর হলেও আমি সেটা করবো না। ব্যাপারটা যেহেতু সেনসিটিভ তাই জানতে চাওয়ার জন্য প্রশ্নটা করা। হয়তো এভাবে প্রশ্নটা করা এক রকম অনধিকার চর্চা। আমি জাস্ট জানতে চাই বিয়েতে কি সত্যিই আপনার মত আছে নাকি পরিবারের চাপে বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছেন। যদি এমন টাই হয় তাহলে বলবো ভেবে দেখতে। যে কোনো সম্পর্ক তৈরি হওয়ার জন্য সচ্ছতা প্রয়োজন। সমস্যা থাকলে সেটা নিয়ে আলোচনা করা দরকার।”

রুপম থেমে গেলেও তার কথার রেশ কাটলো না। আমার কানে বাজছে এখনো। যা ভেবেছিলাম তাই। সম্পর্কটা মেনে নেয়ার মতো নিজেকে সময় দেয়ার কোন সুযোগ আমার নেই। একটা অনুভূতিহীন সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছি শেষ পর্যন্ত। রুপম সচ্ছতার কথা বলল। তাহলে কি আমার উচিৎ তাকে অতীত জানানো? আমার জীবনের পেরিয়ে আসা তিনটা বছরের স্মৃতি যা আমি ভুলতেই তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এটা জানার পর রুপমের রিয়াকশন কি হতে পারে আমার জানা নেই। এই বিষয়ে কথা বলা কতটুকু যুক্তি সঙ্গত। মাথায় যখন নানা প্রশ্নের জটলা পাকিয়ে গেছে ঠিক তখনই রুপম বলে উঠলো
” আমার মনে হয় আপনার সময় প্রয়োজন আজরা। আপনি এখনো বিয়ের মতো সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার জন্য প্রস্তুত না। নিজেকে সময় দিন। আর একটা কথা বিশেষ ভাবে বলবো আপনি নিজের ব্যাপারে খুব উদাসীন। নিজেকে ভালোবাসতে শিখুন। নিজের জন্য বাঁচতে শিখুন। দেখবেন সব কিছু সহজ হয়ে গেছে।”

আমি আবারো রুপমের দিকে তাকালাম। এবার রুপমের কথাগুলো আমার ভেতরে ঝড় তুললো। এতক্ষণ নিজেকে শান্ত রাখার যে অভিনয়টা করছিলাম সেটা আর ধরে রাখা সম্ভব হলো না। অস্থির হয়ে উঠলো ভেতরটা। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কিন্তু আমি তো কাদতে চাইনা। আমি নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম। তাহলে কেনো আবার এমন হলো। আমার চোখের কোণে জমে থাকা পানি রুপম বোধহয় খেয়াল করলো। মৃদু হেসে বলল
” সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। চলুন আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।”

আমি কান্নাটা গিলে ফেলে নিস্তেজ কণ্ঠে বললাম
” আমি যেতে পারব। আপনাকে আর যেতে হবে না। আপনার কষ্ট হয়ে যাবে।”

রুপম হেসে ফেলে বলল
” বুঝেছি। আমি জানি আপনি একাই যেতে পারবেন। তবুও দায়িত্ববোধ থেকেই বললাম। আপনার মনের অবস্থা ভালো না। এই অবস্থায় আমি অন্তত আপনাকে একা ছাড়তে চাইছি না।”

আমি কিছু বলতে পারলাম না। নিরব সম্মতি জানালাম। দুজন সেখান থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিলাম। পুরো রাস্তায় আর কেউ কোন কথা বলিনি। বাসার সামনে এসে রিক্সা থেকে নেমে একবার পেছনে ঘুরে তাকালাম। রুপম মুচকি হেসে বলল
” নিজের খেয়াল রাখবেন। আর হ্যা বিয়ে নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমি আমার বাসায় বুঝিয়ে বলবো। আপনি সময় নিন। আর বাসায় একটু বুঝিয়ে বলবেন যে আপনার কিছুদিন সময় প্রয়োজন। মনে রাখবেন পরিবারের চেয়ে আপন কেউ নেই। ওনারা আপনাকে যেভাবে বুঝে সেভাবে আর কেউ বুঝবে না। ভালো থাকবেন। আপনার সাথে হয়তো আর কখনো দেখা হবে না।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here