প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব -৩৯

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব_৩৯

সৌহার্দ্যকে নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কেঁপে উঠলো তরী। সৌহার্দ্য সবটা জেনে গেছে! ভাবতেই মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তরীর। সৌহার্দ্য ওর দিকে কয়েক পা এগিয়ে এলো। তরীর চোখে চোখ রাখতেই তরী দেখতে পেল, সৌহার্দ্যের চোখ দুটো আজ অস্বাভাবিক লালাভ ও অশ্রুসিক্ত। সেখানে গভীর বেদনার ছাপ স্পষ্ট।

“এতোটা নিচে কীভাবে নামলে তুমি, তরী? কী করতে চাইছিলে তুমি এটা? তুমি এবোরশান করানোর জন্য এভাবে…..”

“নাহ্! তোমাকে এসব কে বলেছে, সৌহার্দ্য? আমি এসব করতে আসিনি। তুমি ভুল ভাবছো, সৌহার্দ্য! ”

বলেই তরী সৌহার্দ্যের হাত ধরতে গেলেই সৌহার্দ্য হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে নেয়। তরীর দিকে আঙুল তুলে বললো,

“তোমার ঐ হাত দিয়ে আমাকে স্পর্শ করবে না! তোমার প্রতি ঘৃণা আসছে আমার। আর মিথ্যে বলার চেষ্টাও করো না। নিচে তোমার লোকেরা দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। সকাল হলেই নাকি তুমি হসপিটালে যাবে! সব ব্যবস্থা নাকি হয়ে গেছে! ওরা নিজেরা তো মিথ্যে বলবে না! কিন্তু তুমি এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যে বলছো। প্রিটেন্ড করছো যে, তুমি ভালো মানুষ।”

তরী অবাক হয়ে বললো,

“আমি ভালো মানুষীর প্রিটেন্ড করছি?”

“হ্যাঁ, করছো। তোমার এই এলোমেলো চুল, কাঁধ জড়িয়ে মাটি পর্যন্ত ছড়ানো সুতি শাড়ি আবরণ আর নিষ্পাপ মুখের এই সত্তাটা শুধু মাত্র একটা মুখোশ! সেই মুখোশ অনেক আগেই খুলে গেছে আমার সামনে থেকে। তোমার এই মুখোশের আড়ালে থাকা ভ*য়ং*ক*র রুপটা আমি জানতাম আগেই। তবুও আমি তোমাকে কিচ্ছু বলিনি, তোমার প্রতি আমার মন বদলায়নি। কেন জানো? তোমায় আমি ভালোবাসি বলে! আমি তোমায় সত্যি সত্যিই অনেক ভালোবাসি। মনেপ্রাণে ভালোবাসি! কিন্তু তুমি? তুমি কী করতে চেয়েছিলে? তোমার মধ্যে সৃষ্টি হওয়া আমার অংশ, আমাদের ভালোবাসার অংশটাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলে!”

শেষোক্ত কথা শুনে তরী কেঁপে উঠলো। সৌহার্দ্যের দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বললো,

“সৌহার্দ্য! ”

সৌহার্দ্য নিজের চোখের কার্ণিশে জমা পানি গুলো আঙুল দিয়ে মুছতে মুছতে বললো,

“আমি আমার চাঁদকে অনেক ভালোবাসি। চাঁদ ছাড়া যেমন আকাশ অন্ধকার, আমার জীবনটাও আমার চাঁদের অনুপস্থিতিতে তেমনই নিকষ। কিন্তু এই সত্যির উল্টো পিঠে আরেকটা সত্যি আছে। আর সেটা হলো, চাঁদকে আমি যতটা ভালোবাসি, তরীকে আমি ততটাই ঘৃণা করি। এই তরীকে আমি মনেপ্রাণে ঘৃণা করি। এর প্রতি আমার কোনো ভালোবাসা নেই।”

বলেই তরীর দিকে আঙুল তুলে তাকালো সৌহার্দ্য। তরী হতবাক হয়ে একবার সৌহার্দ্যের আঙুল, আরেকবার ওর মুখের দিকে তাকালো। কথা বলতে চাইলেও তরীর মুখ থেকে একটা কথাও বের হলো না। নির্বাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখলো শুধু!

“তুমি আমার চাঁদ নও। তুমি হতেই পারো না আমার চাঁদ! তুমি একটা স্বার্থপর। নিজের স্বার্থের কাছে পৃথিবীর সবকিছু তুচ্ছ তোমার জন্য। চাঁদ তো খুবই সাধারণ ছিল! সবার হাসিতে হাসতো, কাউকে গোমড়ামুখে দেখলে কান্নাকাটি শুরু করে দিতো। আমি তো সেই সাধারণ মানুষটাকেই ভালোবাসি! তার এই প্রতিশোধপরায়ণ রূপটাকে না।”

সৌহার্দ্য হতাশা মিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তরীর গাল বেয়ে অশ্রু রেখা গড়িয়ে পড়লো। দেয়াল ঘেঁষে ফ্লোরে এলোমেলো ভঙ্গিতে বসে পড়লো সে। ঘরের সামনের এই বারান্দায় এখন ওরা দুজন একে অপরের নিঃশ্বাসের শব্দ-ই শুনতে পাচ্ছে। আশে পাশে আর কেউ নেই। কয়েক মুহূর্ত নীরবতায় কেটে গেল। সৌহার্দ্যের তরীর দিকে কোনো খেয়াল নেই। চশমা খুলে নিজের চোখ দুটো মুছতেই তরীর ওপর চোখ পড়লো ওর। কেমন নির্জীব হয়ে বসে আছে মেয়েটা! তার কথাগুলো কি এতোটাই ধারালো ছিল যে, তরীর মুখ-ই বন্ধ হয়ে গেল? ভেবে পেল না সৌহার্দ্য। রেলিংয়ে দুহাত ভর দিয়ে সামনে তাকাতেই তরীর কন্ঠ স্বর ভেসে এলো,

“তোমার চাঁদ অনেক আগেই মরে গেছে, সৌহার্দ্য! অনেক আগে! যেদিন সে নিজের চোখের সামনে তার মায়ের মৃত্যু দেখেছিল, সেদিন-ই সে মরে গেছে। বয়স কতই বা ছিল আমার! একটা ছোট বাচ্চা ছিলাম আমি। ঐ বয়সে তো সবাই অবুঝ থাকে! আমি কতটা অবুঝ ছিলাম জানি না। নিজের চোখের সামনে নিজের মায়ের মরণ চিৎকার শুনে কতটা অবুঝ থাকা যায়? আমার মায়ের বুকে করা একেকটা ছু*রি*র আঘাত দেখেছি আমি। আমার মা চিৎকার করে কাঁদছিল। কিন্তু নিজে বাঁচার জন্য কাঁদছিল না, বরং আমার জীবন ভিক্ষা চাইছিল। যখন আমার মায়ের শাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিলো, আমি সহ্য করতে পারিনি, জানো? ছুটে যেতে চেয়েছি। কিন্তু আমাকে যেতে দেয়নি। আমার চোখ ফেটে পানি পড়ছিল। সহ্য হচ্ছিল না আমার। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম আমি। আমাকে তো ম*রা মনে করে ছেড়ে দিলেও পারতো! অন্তত আমার মায়ের শেষ ইচ্ছে ভেবেই ছেড়ে দিতো! কিন্তু না, ছাড়েনি। ঐ অজ্ঞান অবস্থায়-ই রাতের আঁধারে আমাকে পুঁ*তে দিয়েছিল। আজাদ চাচা সবকিছুর সাক্ষী ছিলেন। উনি তো এসবে সাহায্য-ও করেছেন! উনি নিজেও অসহায় ছিলেন। মা যখন বুঝতে পেরেছিলেন যে, ওনার হাতে বেশি সময় নেই, তখন নিজের উইলের কাগজগুলো আজাদ চাচার কাছে দিয়েছিলেন। আমার পালিত বাবা যখন আমায় বাচিয়ে নিয়ে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছিলো, তখন উনি সবটা দেখেন। পরবর্তীতে উনিই বাবাকে সবকিছু খুলে বলেন। এই বাড়িটা দেখছো না? এটা আমার মায়ের দেওয়া বাড়ি। মা মৃ*ত্যুর পর আরো অনেক সম্পত্তি ও ফ্যাক্টরি পেয়েছিলেন। উইল অনুযায়ী, সেগুলোর বর্তমান মালিক আমি। এতো বছর সেসব বাবা সামলাচ্ছে! আমি তো নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম! অপরাধীকে নিজের হাতে শাস্তি না দিলে আমার শান্তি নেই। কিন্তু শাস্তি দেওয়ার পর তো আমাকেও শাস্তি পেতে হবে, তাই না? আমিও তো তখন খু*নী হয়ে যাবো! তখন এই বাচ্চাটার কী হবে? ওকে নিজের গর্ভে নিয়ে খু*ন করলে সবাই ওকে-ও খু*নী বলবে। আর যদি কোনোভাবে ওর জন্ম হয়েও যায়, তাহলে ওকে সারাজীবন শুনে যেতে হবে যে, ওর মা খুন করেছিল! আমি কীভাবে আমার সন্তানকে এমন একটা অ*ভি*শ*প্ত জীবন দিবো? বলতে পারো, সৌহার্দ্য? আমার এখন ঠিক কী করা উচিত?”

এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে সবটা বলার পর এখন তরী মুখ ঘুরিয়ে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। সৌহার্দ্যের মুখ জুড়ে অসহনীয় বেদনার ছাপ। বললো,

“এসব ড. আরমান করেছে, তাই না?”

তরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “ওনার চেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ আর কেউ আছে নাকি যে, এসব করবে! এরপরও বলবেন, আমি ঠিক করছিলাম না?”

“তুমি অন্যায় করছিলে। আর অন্যায়কে ঠিক বলা যায় না। তুমি কেন নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছো? তুমি এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। আমার ওপর ভরসা রাখো। আমি ওনার যথাযোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা করবো।”

তরী তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,

“সম্ভব না। যখন করার কথা ছিল, তখনই আপনারা কিছু করতে পারেননি। তখন ড. আরমানের কোনো ক্ষমতা-ই ছিল না৷ এতো বছরে তিনি নিজের ভিত অনেক শক্ত করেছেন। এখন ওনার কিচ্ছু বিগড়াতে পারবেন না আপনারা।”

সৌহার্দ্য অবাক হয়ে বললো,

“কেন? তোমার এমন কেন মনে হয়?”

“কারণ উনার শেকড় এখন অনেক মজবুত। আর সেটা আমাকেই উপড়ে ফেলতে হবে। আমি চাইলে ওনাকে শাস্তি দেওয়ার পর নিজেকে বাঁচাতে পারি। সবটা অস্বীকার করতে পারি। আমার ততটুকু ক্ষমতা আছে। কিন্তু সেটা করলে ড. আরমানের সাথে আমার কোনো পার্থক্য থাকবে না।”

সৌহার্দ্য নিজের কপাল চেপে ধরে দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে আশে পাশে তাকালো। হতাশ হয়ে বললো,

“তুমি… তুমি সবটা ভুলে যাও। ভুলে যাও তোমার অতীত!”

তরী নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। বললো,

“কী? আমি সবটা ভুলে যাবো? এসব তুমি কী বলছো?”

“যা বলছি, ভেবেচিন্তে বলছি। তুমি সবটা ভুলে যাও। কারো কোনো শাস্তির দরকার নেই। কারো কাছ থেকে কোনো প্রতিশোধ নিতে হবে না। তুমি আর আমি সাধারণ ভাবেই সারাজীবন কাটিয়ে দেবো। কোনো প্রয়োজন নেই অতীতের জন্য নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করার। তোমাকে একবার হারানোর পর ফিরে পেয়ে আবার হারানোর কষ্ট সহ্য করার মতো শক্তি আমার নেই। তুমি শুধু আমার দিকটা একবার ভেবে দেখো।”

বলেই এগিয়ে এসে তরীর হাত আকড়ে ধরলো। সৌহার্দ্য কাঁদছে। তরী অবাক চোখে চেয়ে রইলো ওর দিকে। হঠাৎ বলে উঠলো,

“আমি পারবো না, সৌহার্দ্য। আমার মায়ের আর্তনাদ আজও আমাকে ঘুমাতে দেয় না। এতো দূর এগিয়ে এসে আর পিছিয়ে যেতে পারবো না আমি।”

সৌহার্দ্য তরীকে নিজের সাথে চেপে ধরে বললো,

“আমার কি কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে? আমি, আমার ভালোবাসা আর আমাদের সন্তানের দোহাই কি যথেষ্ট নয় তোমার জন্য? প্লিজ, ভুলে যাও সব। আমরা অনেক দূরে চলে যাবো। দেখো, অনেক সুখে থাকবো। তুমি শুধু আমার কথাটা মেনে নাও।”

সৌহার্দ্য করুণ দৃষ্টিতে তাকালো তরীর দিকে। তরী সেটা দেখেও নিজের চোখ নামিয়ে ফেললো। সে নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। সৌহার্দ্যের কথা মেনে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। সৌহার্দ্য সেটা বুঝতে পেরে রেগে তরীকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে ফেললো। চোখের পানি মুছে হতাশ কন্ঠে বললো,

“আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল, আমি তোমায় ভালোবেসেছিলাম। আর এই ভুলের মাশুল আমায় সারাজীবন গুনতে হবে। আজকের পর থেকে আমি ভেবে নেব, আমার চাঁদ মরে গেছে। তুমি আমার কাছে মৃত! আমার জীবনে ফেরার চেষ্টা কখনো করবে না।”

সৌহার্দ্য পা ঘুরিয়ে চলে গেল তরীর সামনে থেকে। তরী পাথরের ন্যায় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর যাওয়ার দিকে। অপলক সেই চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। কিন্তু তরী নড়লো না একবিন্দুও!

#চলবে….

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here