প্রণয় রেখা পর্ব -২৬+২৭

#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৬.

সবকিছু শুনে মাহবুব সাহেব তিক্ত সুরে মেয়েকে বললেন,

‘তোমার কাছ থেকে আমি এসব আশা করিনি, মোহনা। তোমাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু, তুমি আমার সেই বিশ্বাসের মর্ম দাওনি।’

বাবার কথায় প্রচন্ড খারাপ লাগে মোহনার। তার শুকনো চোখে সঙ্গে সঙ্গেই জল জমে। নাক লাল হয়ে উঠে। বাবার দিকে যে একবার চোখ তুলে তাকাবে তার সেই সাহসটুকুও নেই।

মাহবুব সাহেব শান্ত হয়ে বসে আছেন। লরিনও এই মুহুর্তে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। লায়লা বেগম স্বামীর নিরবতা দেখে প্রথমে অবাক হলেও এখন তিনিও স্বাভাবিক। মানুষটা হয়তো একটু বেশিই কষ্ট পেয়েছেন। তার শিক্ষায় তার মেয়ে আঘাত করেছে, তাই হয়তো এতটা দমে গিয়েছেন। নয়তো ছোট খাটো ব্যাপারেই উনি যে পরিমাণ ক্ষেপে যান এই ব্যাপারটা নিয়ে তো উনার তুলকালাম কান্ড বাঁধানোর কথা ছিল। কিন্তু, উনি এখন নিশ্চুপ…

কেউ কিছু বলছে না দেখে লায়লা বেগম এবার সাহস করলেন। তিনি নরম সুরে মাহবুব সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘সন্তান তো ভুল করেই, তাই বলে কি মা বাবা সন্তানের সাথে অভিমান করে বসে থাকে? মা বাবা তো আর সন্তানদের সাথে কথা না বলে থাকতে পারে না, হাজার ভুল করলেও তো সন্তান তো নিজের, তাকে ক্ষমা করে দিতেই হয়। আর তোমার মেয়ে তো তোমার প্রাণ। সে না হয় ছোট্ট একটা ভুল করেই ফেলেছে তার জন্য তুমি কি তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিবে? তাতে তো তুমিও কষ্ট পাবে তাই না? থাক না, যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এবার ওদের মাফ করে দাও।’

লায়লা বেগম কথাটা শেষ করতেই মাহবুব সাহেব তার দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন। ভীষণ শান্ত, কঠিন সেই দৃষ্টি। লায়লা বেগম কিঞ্চিত ঘাবড়ালেন। তার কথা শুনে মানুষটা উল্টো আরো বেশি রেগে যাবেন না তো?

তার দুশ্চিন্তা অবসান ঘটল মাহবুব সাহেবের পরবর্তী উক্তি শুনে। মাহবুব সাহেব সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মোহনার দিকে চেয়ে শক্ত হয়ে বললেন,

‘মোহনা, তুমি কি লরিনকে বিয়ে করতে চাও?’

মোহনা ভয়ে ভয়ে বাবার দিকে তাকায়। বাবার চোখ মুখ রুক্ষ। সে চেয়ে থাকতে পারল না। চোখ নামিয়ে ফেলল। জবাব সাজাতে লাগল, কী বলবে। ভয় করছে, অস্বস্তি লাগছে। নিশ্বাস ক্রমে ক্রমে ভারী হয়ে উঠছে। তার জন্য তার বাবা কষ্ট পাচ্ছে, সেটার জন্যও বুকে ব্যথা হচ্ছে তার। কিন্তু, এখন আর চুপ থাকলে চলবে না। এমন একটা দিন যে আসবে সেটা সে আগে থেকেই জানতো। তাই আর আফসোস করে লাভ নেই। এবার এই কঠিন প্রশ্নের জবাব তাকে দিতেই হবে। সে নিজেকে শক্ত করল। লরিনের দিকে এক পলক চাইল। ছেলেটা একরাশ আশা নিয়ে তার মুখপানে চেয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষা করছে। এই মানুষটাকেও আর কষ্ট দেওয়া যাচ্ছে না। অতঃপর সে ঠিক করল। বাবার দিকে চেয়ে বলল,

‘জ্বি বাবা, আমি লরিনকে বিয়ে করতে চাই।’

মেয়ের উত্তর মেয়ে মাহবুব সাহেব কিছুক্ষণ থ মেরে বসে রইলেন। বুঝতে পারছেন না কী বলবেন। মাহিয়া এখনো ভীত সন্ত্রস্ত। বলে তো দিয়েছে কিন্তু বাবা ব্যাপারটা কেমন ভাবে নিবে কে জানে।

তবে তার এই কথাটা শুনে যার প্রাণ ফিরে এসেছে সে হলো লরিন। সে তো বিশ্বাসই করতে পারছে না। মোহনা সত্যিই তাকে বিয়ে করতে চায়। আজ যেন জীবন স্বার্থক মনে হচ্ছে। এবার সবশেষে যেন তার শ্বশুরমশাই ও রাজি হয়ে যান এই কামনাই করছে সে।

মাহবুব সাহেব অনেক ভাবলেন। লরিনের সম্পর্কে সবই শুনেছেন, জেনেছেন। ছেলে ভালো, পরিবার ভালো। তার মেয়েও রাজি। ঐদিকে তো অরূপ ও তাকে কম ঘুরাচ্ছে না। সব চিন্তা ভাবনা করে তিনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। লরিনের দিকে ঘুরে বললেন,

‘কাল তোমার দাদা দাদুকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসবে। কালই বিয়ের ডেইট পাকা করব।’

মোহনা আর লরিন দুজনেই হতবিহ্বল। বাবা রাজি হয়ে গেল? এত সহজেই? মোহনা হা করে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। লরিন তো পারছে না নাচতে শুরু করে। সে খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,

‘ধন্যবাদ, আংকেল।’

মাহবুব সাহেবের গাম্ভীর্য ভাবে তেমন ফাটল এল না। তিনি গম্ভীর সুরে লায়লা বেগমকে বললেন,

‘চা নিয়ে এসো।’

লায়লা বেগমও খুশি মনে চা বানাতে গেলেন। মোহনাও মা’র পেছন পেছন রান্নাঘরে গেল। সে যেতেই মাহিয়া তাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরল। লাফাতে লাফাতে বলল,

‘অবশেষে এই বিদেশিই আমার দুলাভাই হতে যাচ্ছে। আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে…’

মোহনা হেসে বলল,

‘হয়েছে ছাড়। এখনই এত নাচানাচি করিস না। বাবার মুড এখনো ঠিক হয়নি। বলা যায় না হুট করে যদি আবার মত পাল্টে ফেলে।’

মাহিয়া তাকে আশ্বাস দিয়ে বলল,

‘আরে আমাদের বাবা হলো এক কথার মানুষ, একবার যেটা বলে দিয়েছে মানে বলে দিয়েছে, আর সেই কথার খেলাপ হবে না। এত চিন্তা করো না তো। জানো, আমি তো শুধু লরিন ভাইয়ার মুখটা দেখছিলাম। বাবা রাজি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কী চমৎকার হাসিই না ফুটে উঠেছিল। উনারও বোধ হয় তখন আমার মতো নাচতে মনে চাচ্ছিল, যা উত্তেজনা উনার চোখে মুখে দেখেছি।’

মোহনা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,

‘তোরা দুইটা হয়েছিস একইরকম, বাদর কোথাকার।’

মোহনা রান্নাঘরে গিয়ে দেখে লায়লা বেগম চা বানাচ্ছেন। মোহনা ধীর পায়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। চুলায় ফুটন্ত পানি, লায়লা বেগম সেই পানিতে চা পাতা ঢালতে ব্যস্ত। মোহনা ঢোক গিলে গলা ভেজায়। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘আম্মু, বাবা কি কষ্ট পেয়ে এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন?’

লায়লা বেগম তার কাজের উপর মনোযোগ রেখেই বললেন,

‘মা বাবা সবসময়ই সবকিছু ভেবে চিন্তেই সিদ্ধান্ত নেন। তোর বাবা যা ভালো মনে করেছেন তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই নিয়ে তুই আর এখন কিছু ভাবিস না।’

‘কিন্তু আম্মু, বাবা যে বললেন কালই বিয়ের ডেইট ফাইনাল করবেন। কিন্তু, আমি তো অনার্সের পর বিয়ে করতে চাই, আমার তো আরো এক সেমিস্টার বাকি।’

‘তাহলে কাবিন হয়ে যাবে। অনুষ্ঠান না হয় পরে হবে। এমনিতেও সামনে রোজা আসছে। এখন অনুষ্ঠান করার মতো সময় হবে না।’

মোহনা খুশি হয়ে বলল,

‘আচ্ছা, তুমি তাহলে বাবাকে এটাই বলো।’

.

চা খেতে খেতে মাহবুব সাহেব লরিনের কাছ থেকে আরো কিছু ইনফরমেশন নেন। লরিনও বসে বসে বাধ্য ছেলের মতো উনার সমস্ত প্রশ্নের জবাব দেয়। লরিনকে ছেলে হিসেবে মাহবুব সাহেবের প্রথম থেকেই পছন্দ ছিল। বিদেশি হলেও বাবার রক্তের ছোঁয়া স্পষ্ট। আজ তার সাথে কথা বলে উনার সেই পছন্দটাই আরো একটু পাকাপোক্ত হয়েছে আরকি।

যাওয়ার সময় মোহনা একবারও লরিনের সামনে আসেনি। লরিনের তৃষ্ণার্ত দুই চোখ মোহনাকে বার কয়েকবার খুঁজেছে। কিন্তু মোহনা তার রুম থেকেই বের হয়নি। বাধ্য হয়ে লরিনকে সেই তৃষ্ণার্ত নয়নে বাইরে বেরুতে হলো। তবে রাস্তার কাছে গিয়ে একবার কী ভেবে সে উপরে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গেই চিরচেনা সেই প্রিয় মুখশ্রী দেখে তার ঠোঁটে হাসি ফুটে। বেলকনিতে মোহনা দাঁড়িয়ে আছে। তার ঠোঁটের কোণেও মৃদু এক হাসির রেশ প্রতিয়মান। লরিনের চোখের তৃষ্ণা এবার মিটল। মন ভরে সে মোহনাকে দেখে তবেই সে সেই জায়গা প্রস্থান করল।

চলবে…

(ভেবেছিলাম শেষ করে দিব কিন্তু, যেহেতু তোমরা চাও তাই আরো কয়েকটা পর্ব দিয়ে তবেই শেষ করব)#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৭.

বিয়ের পাকা কথা হয়ে গিয়েছে। সবাই মিলে ঠিক করেছেন আগামী সপ্তাহে কাবিন হবে আর মোহনার অনার্সের পর অনুষ্ঠান হবে। মোহনা আর লরিন দু’জনেই খুব খুশি মনে এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। বাড়িতে হৈ হুল্লোড় শুরু হয়। মাহিয়া পুরো বাড়ি মাথায় তুলে রেখেছে। ওর এত এত চঞ্চলতা দেখে মোহনা বিস্মিত। কতটা খুশি একটা মানুষ হতে পারে, মাহিয়ার এত আনন্দ কোথ থেকে আসছে? মোহনা অবাক চোখে বোনকে দেখে, কত সুন্দর মেয়েটা তার বোনের সুখে সুখী হচ্ছে। কতটা ভালোবাসা তার। ইশ, এই বাড়ি থেকে চলে গেলে মেয়েটার জন্য তার খুব যন্ত্রণা হবে।

এশাও খুশিতে লাফাচ্ছে। সে সব পেয়েছে। লরিনকেও পেয়েছে, মোহনাকেও পেয়েছে। এত এত ঝামেলার পরও এই গল্পের শেষটা তো সুন্দর আর মনোমুগ্ধকর।

রাফাত চট জলদি কয়েক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে আসে। বাড়ি জুড়ে মিষ্টি খাওয়ার আমেজ পড়েছে। মোহনার অত একটা মিষ্টি পছন্দ না। তাও এশা তার মুখে মিষ্টি পুরে দিয়ে চলে গিয়েছে। বেচারি মুখ ফুলিয়ে কোনোরকমে সেটা গিলছে।

__________________________

মোহনা আর লরিন ছাদে এল। সাথে এশা আর রাফাতও এসেছে। মোহনা আর লরিন ছাদের একপাশে যায় আর এশা আর রাফাত যায় অপর পাশে। লরিন আজ বুক ভরে নিশ্বাস নিচ্ছে। এত এত দুশচিন্তা, এত এত অপেক্ষার অবশেষে অবসান ঘটছে। অবশেষে তার প্রেম সফলতা পেতে যাচ্ছে। মাঝখানে তো সে আশাই ছেড়ে দিয়েছিল; ভেবেছিল, মোহনা কখনোই তার হবে না। কিন্তু ঐ যে কথায় আছে, যার সাথে যার প্রণয় রেখা ঠিক করা থাকে, তাকে অবশ্যই তার সাথে মিলতে হবে।

লরিন মুগ্ধ চোখে মোহনার দিকে চেয়ে বলল,

‘আমি খুব খুশি, মোহনা।’

মোহনা তার দিকে ফিরে বলল,

‘এত খুশি হওয়ার কী আছে? সবাই বিয়ে করে, আপনিও বিয়ে করছেন, এটা নরমাল ব্যাপার; এটাতে এত খুশি হওয়ার মতো কী আছে?’

মোহনার কথা শুনে লরিন হাসে। বলে,

‘তুমি খুব কঠিন মোহনা। নিজের অনুভূতিগুলো চেপে রাখতে পারো, উল্টো দিকে আমি সেটা একদমই পারিনা। অনুভূতি প্রকাশ করতে না পারলে মনে হয় যেন পেট ফুলে ব্রাস্ট হয়ে যাবে। তবে এতদিন তোমার এই গম্ভীরতা আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু, এখন থেকে তোমার মুখ খুলতে হবে। অনুভূতি প্রকাশ করতে হবে। আর..’

‘আর?’

মোহনা প্রশ্ন করলে লরিন মুচকি হেসে বলে,

‘ভালোবাসা প্রকাশ করতে হবে।’

‘কেন, প্রকাশ না করলে বুঝি ভালোবাসা বোঝা যায় না?’

‘হ্যাঁ, যায়। তবে আমার মন ততক্ষণ পর্যন্ত শান্ত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি ভালোবাসি বলছো। আর কত অপেক্ষা করব, বলো? এবার তো সব ঠিক হয়ে গিয়েছে, এবার তো বলতে পারো ভালোবাসি, তাই না?’

‘একদমই তাই না। এত সহজ? দুর্লভ জিনিস এটা, বুঝেছেন? এত সহজে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিন।’

লরিন চোখ মুখ কুঁচকে অসহায় সুরে বলল,

‘মানে কী? আরো অপেক্ষা করতে হবে? সম্ভব না।’

‘না হলে না। আমার কী।’

‘মোহনাআআআ…’

‘কী? আমি আপনার পাশেই তো আছি, চিল্লাচ্ছেন কেন?’

লরিন মিনমিনিয়ে তখন বলল,

‘খালি পাশে থাকলেই কি হয়? কাছেও তো আসতে হবে।’

‘কিছু বললেন?’

মোহনার প্রশ্নে সে হেসে বলে,

‘না না, তেমন কিছু না। উমম, আমরা যেন কোথায় ছিলাম? ওহ হ্যাঁ, ভালোবাসি বলা নিয়ে। অনেক হয়েছে এবার বলে ফেল। এর থেকে ভালো সুযোগ কিন্তু তুমি আর পাবে না। সুযোগের সঠিক ব্যবহার করতে শিখো। নাও, বলো বলো।’

মোহনা কিঞ্চিত বিরক্ত হয়ে বলল,

‘আজব তো, আমি না বললে আপনি কি আমাকে জোর করে বলাবেন?’

লরিন মোহনার দিকে এক কদম এগিয়ে গিয়ে শক্ত গলায় বলল,

‘অবশ্যই। এতদিন তোমার ভয়ে কিচ্ছু বলতে পারেনি। কিন্তু এখন আমি নিশ্চিন্ত। তাই আমার আর কোনো ভয় নেই। এখন থেকে তুমি আমায় ভয় পাবে, বুঝেছ?’

লরিনের কথা শুনে মোহনা বড়ো বড়ো চোখ করে তার দিকে চাইল। লরিন ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মোহনা তা দেখে তখন শব্দ করে হেসে ফেলে। মোহনার হাসির আওয়াজে লরিন খানিকটা চকিত হয়ে ফিরে তাকায়। মোহনাকে কখনো এত বেশি হাসতে দেখেনি। সবসময় তো মেয়েটা মেপে মেপে হাসে। অথচ মেয়েটা হয়তো জানেও না তার হাসির ধ্বনি কতটা মনোমুগ্ধকর।
লরিন এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে দেখে মোহনা হাসি থামিয়ে বলল,

‘কী, এভাবে কী দেখছেন?’

লরিন চোখ সরিয়ে বলল,

‘কিছু না।’

তারপর সে চুপ হয়ে যায়। মোহনাও আর কথা বাড়ায় না। কিছুক্ষণ বাদেই সেখানে মাহিয়া আসে। সবাইকে এসে বলে, নিচে যাওয়ার জন্য, বড়োরা তাদের ডাকছে। সে তার কথা শেষ করে আবার নিচে নেমে যায়। পাশের ছাদ থেকে এশা আর রাফাত মোহনাদের কাছে আসে। এশা এসে লরিনের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘কী হলো, বলেছে?’

লরিন মুখ কালো করে মাথা নাড়ায়। এশা তা দেখে মোহনার কাছে যায়। কোমরে হাত দিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,

‘এই যে ম্যাডাম, আমার ভাইকে আর কষ্ট না দিয়ে আপনার মনের কথা তাকে বলে ফেলুন। আপনি কি দেখছেন না, বেচারা কতটা কষ্ট পাচ্ছে? এত পাষাণ কেন আপনি? সামান্য একটা কথা বলতে এত অসুবিধা কেন? আমি তো দুদিনের মাথায়’ই রাফাতকে বলে দিয়েছিলাম।’

‘এই তুই মিথ্যে বলছিস কেন? তুই আমাকে এক মাস ঘুরিয়েছিস। কী সুন্দর মিথ্যা বলে দিচ্ছে, উনি নাকি দুদিনের মাথায় বলে দিয়েছে। তুইও কম করিসনি। যত কষ্ট করেছি খালি আমরা ছেলেরা করেছি, তোদের মতো ফকিন্নিদের পেছেনে রাতদিন এক করে ঘুরেছি। তাতেও তোদের মন গলতো না। তুই মোহনার চেয়ে কম পাষাণ ছিলি না।’

রাফাতের কথা শুনে এশার মেজাজ বিগড়ে যায়। সে রাফাতের দিকে তেড়ে গিয়ে বলে,

‘একদম বাজে কথা বলবি না। আর কাকে তুই ফকিন্নি বলেছিস? আমরা ফকিন্নি? আমরা ফকিন্নি হলে তোরা তো ফকির, বিশ্ববিখ্যাত ফকির। তোদের মতো ফকিরকে যে আমরা আমাদের মূল্যবান ভালোবাসা ভিক্ষা দিয়েছি সেটাই তো অনেক, আমার আসছে আমাদের ফকিন্নি বলতে। আমরা চোখ তুলে না তাকালে জীবনেও তোদের কেউ পাত্তা দিত না। সুন্দরী মেয়ে পেয়ে গেছিস বলে এখন এত বড়ো বড়ো কথা। খালি এক মাস না, তোকে তো উচিত ছিল এক বছর ঘুরানো; তাও তো আমি তাড়াতাড়িই একসেপ্ট করেছিলাম। কিন্তু মোহনা, তুই ভুলেও এত তাড়াতাড়ি কিছু বলবি না। বলে দিলেই এগুলো মাথায় উঠে যাবে। যতদিন পারবি ঘুরাবি। সহজে সব কিছু পেয়ে যায় তো, তাই এত বড়ো বড়ো কথা।’

এশা মুখ বাঁকিয়ে ভেংচি কাটে। লরিন বিরক্ত হয়ে বলে,

‘এই না এক্ষণ আমার হয়ে কথা বলছিলি? আর দুই মিনিটেই সাইড বদল?’

রাফাত তখন লরিনের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

‘আরে ওদের বাদ দাও, ভাই। মেয়ে মানুষ এমনই, রূপ পাল্টাতে দু মিনিট ও লাগে না।’

এশা দাঁত খিঁচে বলে,

‘তুই থামবি, রাফাত? এবার কিন্তু আমার রাগ হচ্ছে।’

‘তো রাগ না, তোকে আটকালো কে?’

‘মোহনা, তুই কিছু বলছিস না কেন?’

মোহনা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘তোদের এই ঝগড়া দেখতে দেখতে আমি এখন বিরক্ত হয়ে উঠেছি। তোরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝগড়া কর, আমি নিচে গেলাম। লরিন, আপনিও চলুন।’

মোহনা চলে গেল। তার পেছন পেছন লরিনও নামতে লাগল। আর ছাদে দাঁড়িয়ে এশা আর রাফাত বোকার মতো একজন অন্যজনের দিকে চেয়ে রইল। এশা গাল ফুলিয়ে বলল,

‘দেখছিস রাফাত, ওরা কেমন। আমরা এখানে ওদের হয়ে ঝগড়া করছি আর ওরা আমাদেরই পাত্তা না দিয়ে নেমে গেল। হাউ সেলফিশ দে আর।’

‘ঠিকই হয়েছে, আরো করো ঝগড়া। আমিও নিচে গেলাম।’

‘আরে, আমিও তো যাব; দাঁড়া।’
.
.

সবাই একে একে বেরিয়ে গেল। মোহনা তার বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। নিচে লরিন গাড়ি নিয়ে এসেছে। দাদা দাদিকে গাড়িতে উঠিয়ে সে একটু সাইডে এসে দাঁড়ায় মোহনাকে দেখার জন্য। লরিনকে নিচে দেখতে পেয়ে মোহনা মুচকি হেসে তাকে কল করে। লরিন তার ফোনে মোহনার নাম্বার দেখে অবাক হয়ে উপরে তাকায়। মোহনা ইশারা দিয়ে তাকে কলটা রিসিভ করতে বলে। লরিন তাই করে। কল রিসিভ করার পর মোহনা উল্টো দিকে ঘুরে যায়। তারপর সে মৃদু সরে বলে,

“হয়তো তোমারই জন্য
হয়েছি প্রেমে যে বন্য
জানি তুমি অনন্য
আশার হাত বাড়াই

যদি কখনো একান্তে
চেয়েছি তোমায় জানতে
শুরু থেকে শেষ প্রান্তে
ছুটে ছুটে গেছি তাই।”

মোহনা থেমে যাওয়ার পর লরিন বিষন্ন সুরে বলল,

‘আমি বাংলা গানের অর্থ বুঝিনা।’

মোহনা তখন হেসে বলল,

‘গুগল মামাকে বলবেন, বুঝিয়ে দিবে। রাখছি, আল্লাহ হাফেজ।’

মোহনা ফোন রেখে দিয়েই তার রুমে চলে গেল। লরিন কিছুক্ষণ অসহায় ভাবে তাকিয়ে থেকে তার গাড়িতে গিয়ে বসল। অর্থ বুঝক বা নাই বুঝক অন্তত সে এইটুকু বুঝে যে, বাঙালিরা যখন প্রেমের কথা সরাসরি ব্যক্ত করতে না পারে, তখন তারা গান গায়।

চলবে…

টাইপোগ্রাফী: Maksuda Ratna ❣

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here