প্রণয় রেখা পর্ব -২২+২৩

#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২২.

‘আপনার বাগান পছন্দ?’

‘না। মা’র পছন্দ। এই পুরো বাগানটাই মা’র।’

অরূপের কথা শুনে মোহনার মনে একটু বিষাদ এল। মানুষের বাগান পছন্দ না হওয়াটা বড্ড বেমানান। মানুষ মাত্রই তো প্রকৃতি পূজারী হবে। তার প্রেম, মোহ, ভালোবাসা সব তো কেবল হবে প্রকৃতিকে নিয়েই। অথচ এই মানুষটার নাকি বাগান পছন্দ না। এত বিরস মানুষ কেমন করে হয়?

মোহনাকে কিছু ভাবতে দেখে অরূপ বলল,

‘কী ভাবছ, মোহনা?’

মোহনা হালকা হেসে বলল,

‘না, কিছু না। আচ্ছা, আপনার রুমের বেলকনি টা এত বিশাল কেন? দেখে মনে হয় যেন, এইটা আরেকটা রুম।’

‘ভেবেছি, বিয়ের পর এখানেই আমার বাসর ঘর সাজাব। তাই ইচ্ছে করেই বেলকনিটা বড়ো রেখেছি।’

মোহনা হতভম্ব হয়ে চাইল। এই খোলা আকাশের নিচে বাসর ঘর, সিরিয়াসলি? মোহনার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখটা দেখে অরূপের হাসি পেল। তবে সে হাসি আটকে রেখে বলল,

‘কী হলো, এমন ভাবে হা করে তাকিয়ে আছো কেন? এখানে বাসর রাত করলে ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং হবে না?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব ইনটারেস্টিং হবে।’

পেছন থেকে মাহিয়ার গলা পেয়ে দুজনেই খানিক চমকাল। মাহিয়াকে দেখে অরূপ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল যেন। বাচ্চা মেয়েটাও কথাটা শুনে ফেলেছে?
মাহিয়া তাদের কাছে দৌড়ে এসে বলল,

‘ভাইয়া, তোমার আইডিয়াটা কিন্তু জোস। এমন খোলা আকাশের নিচে যদি একটা বাসর ঘর সাজাতে পারো তাহলে তো মনে করো ব্যাপারটা একেবারে জমে যাবে।’

মোহনা মাহিয়াকে ধমক দিয়ে উঠে বলল,

‘খুব পেকেছিস তাই না? কানের নিচে একটা দিলে সোজা হয়ে যাবি।’

‘ওমা, আমি আবার কী করলাম? আমি তো ভাইয়ার আইডিয়াটার প্রশংসা করছিলাম কেবল।’

অরূপ কথা কাটাতে বলল,

‘আচ্ছা চলো, তোমাদের ছাদে নিয়ে যাই। সেখানেও মায়ের ছোট্ট একটা বাগান আছে।’

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। মাহবুব সাহেবের আড্ডার সময়ের অন্ত আর হলো না। মা, লায়লা বেগমও ভাবির সাথে বেশ জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছেন। আর মাহিয়া তো বরাবরই বকবক প্রিয় মানুষ। বেচারা অরূপ, সেই দুপুর থেকে এই মেয়েটার কথা গিলতে গিলতে এখন বোধ হয় ক্লান্ত। অন্যদিকে মোহনা এক অসহায় বান্দা যে তখন থেকে হাঁসফাঁস করছে বাড়ি ফেরার জন্য। এই পরিবেশে আর নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না। এবার বাসায় ফিরতে হবে। শরীর ক্লান্ত না হলেও মন তার ক্লান্ত হয়ে উঠেছে বেশ আগেই। মা’কে গিয়ে দু একবার বলেছেও; কিন্তু, মা তাকে পাত্তা দিচ্ছে কই। বাবাকে যে বলবে সেই সাহসও পাচ্ছে না সে। তাই বিষন্ন মন নিয়ে লিভিং রুমেই চুপচাপ বসে রইল।

বেশ কিছু সময় যাওয়ার পর, লিভিং রুমে লায়লা বেগম এলেন। মোহনা তখন বসে বসে ফোন দেখছিল। তিনি এসে বললেন,

‘মোহনা, চল; তোর বাবা তোকে ডাকছে।’

মোহনা উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘কেন মা, বাবা হঠাৎ ডাকছে কেন?’

‘চল, গেলেই বুঝতে পারবি।’

মা’র পেছন পেছন মোহনা আব্দুল্লাহ সাহেবের রুমে যায়। সেখানে তখন সবাই ছিল। মাহিয়া আর অরূপও। মোহনা সেই রুমে প্রবেশ করার পর অরূপের মা তার কাছে এগিয়ে এসে বললেন,

‘তুমি এখানে বসো মা।’

মোহনাকে একটা কাঠের চেয়ারে বসানো হলো। তার অপর পাশের আরেকটা চেহারে অরূপ বসেছে। দুজনের মুখস্রীতেই বিশাল এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন ঘুরছে। কেন তাদের এখানে এভাবে বসানো হলো। মোহনার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। মনের মধ্যে এক অশুভ ইঙ্গিত দিচ্ছে। তার আশংকাটাই সত্যি হতে যাচ্ছে না তো?

তার ভাবনায় ফোড়ন পড়ল মাহবুব সাহেবের গম্ভীর স্বরে। তিনি গলা ঝেরে বললেন,

‘তোমরা নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়েছ তাই না, কেন তোমাদের এভাবে এখানে এত জরুরি তলবে ডেকে আনা হয়েছে এই ভেবে? অবশ্যই এর পেছনে কোনো কারণ আছে। আর কারণটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেখো, তোমরা এখন বড়ো হয়েছ। তোমাদের এখন যথেষ্ট জ্ঞান বুদ্ধি হয়েছে ভালো মন্দ বিচার করবার। তোমাদের জীবন নিয়ে নিশ্চয়ই তোমাদের নিজস্ব অনেক পরিকল্পনা আছে। তবে মা বাবাও কিন্তু সন্তানদের জীবন নিয়ে নিজেদের মতো পরিকল্পনা করেন। তাদের পরিকল্পনাটাও কিন্তু অনেক বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ; কারণ মা বাবা যা ভাবেন তা সন্তানদের ভালোর কথা চিন্তা করেই ভাবেন। আর যেহেতু তোমরাও আমাদের সন্তান, তাই তোমাদের নিয়েও আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে আমরা তোমাদের উপর কিছু চাপিয়ে দিব না, তোমাদেরও মত প্রকাশের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। তাই আগে আমাদের কথাটা মনোযোগ দিয়ে শোনো, তারপর তোমরা ভেবে সিদ্ধান্ত নিও। আব্দুল্লাহ, এবার বাকি কথা তুই বল।’

মাহবুব সাহেব থামার পর এবার আব্দুল্লাহ সাহেব শুরু করলেন।

‘অরূপ, মোহনা, আমরা বড়োরা মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর সেটা হলো তোমাদের বিয়ের সিদ্ধান্ত। আমরা তোমাদের বিয়ে দিতে চাই। আর এই চাওয়া মানে এই না যে আমরা তোমাদের উপর জবরদস্তি করে আমাদের চাওয়া চাপিয়ে দিব। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এবার তোমরা নিবে। একেবারে স্বতঃস্ফূর্ত থাকো তোমরা এই ব্যাপারে।’

অরূপ আর মোহনা দুজনেই নিশ্চুপ। দুজনের মাথায় কী চলছে তা সবার অজানা। মাহিয়াও ভীষণ দ্বিধায় আছে। সে না খুশি হতে পারছে আর না পারছে নারাজ হতে। অরূপের সাথে বিয়ে হলে লরিন কষ্ট পাবে এই নিয়ে মাহিয়ার মন খারাপ আবার তার অরূপ ভাইয়াও খুব ভালো ছেলে, তার সাথে বিয়ে হলে তার বোন সুখী হবে এই ভেবেও আবার ভালো লাগছে। কিন্তু, এখন খুশী হবে না কষ্ট পাবে সেটা নিয়ে সে বড্ড দুটানায় পড়ে গিয়েছে।

মোহনা আর অরূপকে নির্বাক দেখে মাহবুব সাহেব বললেন,

‘তোমাদের কি সময় লাগবে?’

মোহনা বাবার দিকে তাকাল তবে, কিছু বলল না। অরূপ তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,

‘আমাদের না জানিয়েই এভাবে বিয়ের মতো এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়াটা আমার চোখে ঠিক হয়নি। তাও আপনারা যখন বলছেন, আমাদের সিদ্ধান্ত জানানোর স্বাধীনতা আছে তখন আমি বলব, আমার সময় লাগবে। আপাতত, বিয়ে নিয়ে আমি এখন কিছু ভাবতে পারছি না।’

অরূপের কথা যেন কারোরই পছন্দ হলো না। তবে কেউ কোনো দ্বিরুক্তি জানাতে পারল না। মাহবুব সাহেব মেয়ের দিকে চেয়ে বললেন,

‘তোমার কী সিদ্ধান্ত, মোহনা?’

মোহনা নত মস্তিষ্কে মিইয়ে যাওয়া সুরে বলল,

‘আমারও সময় লাগবে, বাবা।’

সন্তানদের সিদ্ধান্তে দু’পক্ষের মা বাবাই ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেন। তবে উনাদের ভাষ্যমতে উনারা চাপ প্রয়োগ করতে পারবেন না। আর এখন সন্তানদের সময় দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও তাদের জানা নেই।
.

.

বাড়ি ফিরতে রাত হলো মোহনাদের। গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে মা যখন তালা খুলছিল তখন মোহনার হঠাৎ চোখ গেল রাস্তার ওপারের চায়ের দোকানটাই। এটা এখনো খোলা। তবে দুজন লোক ব্যতিত সেখানে আর কেউ নেই। সেই দুজনের মধ্যে একজন ছিলেন চা বিক্রেতা আর অন্যজন ছিলেন লরিন, হ্যাঁ লরিন। লরিনকে এই সময়ে এখানে দেখে মোহনা হতবিহ্বল। সে ভ্রু কুঁচকে সেদিকেই চেয়ে আছে। লরিনের হাতে ধোঁয়া উঠা গরম চা। সে এক চুমুক দিচ্ছে তো একবার মোহনার দিকে তাকাচ্ছে। রাস্তায় এখন তেমন গাড়ি নেই। আশেপাশে মানুষও নেই বলতে গেলে। ছেলেটা এমন সময়ে এখানে কেন এল? মোহনা সেখানে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারল না। মা তালা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই তারা সবাই বাসার ভেতরে প্রবেশ করল। বাসায় এসে মোহনা তাড়াতাড়ি তার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল। তারপর সে তার ফোনটা নিয়ে গেল বেলকনিতে। সেখান থেকে চেয়ে দেখল মানুষটা এখনো ঐ চায়ের দোকানেই বসে। এবার সে বিরক্ত হয়ে লরিনকে কল করল। লরিন সাথে সাথেই তার কলটা রিসিভ করলে সে বলল,

‘এত রাতে এখানে কী করছেন?’

লরিন মোহনার প্রশ্নের জবাবে বলল,

‘আমি আজ বিকেল থেকেই এখানে এসে বসেছিলাম তোমাদের অপেক্ষায়। কোথায় গিয়েছিলে? আমি তো বিয়ের কথা বলতে এসেছিলাম।’

মোহনা রাগান্বিত সুরে বলল,

‘কাল বলেছি আর আজই বিয়ের কথা বলতে চলে এসেছেন? এত তাড়া কেন আপনার?’

‘তাড়াহুড়ো না করলে তো আমার সুযোগ অন্য কেউ নিয়ে নিবে। তাই রিস্ক নিতে চাইছি না আরকি। কিন্তু, আজকে কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?’

লরিনের কথা শুনে মোহনা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মনে মনে বলে, “সেই সুযোগ তো অলরেডি একজনের দ্বারপ্রান্তে ঘুরছে। কবে জানি চট করে সেটা সে হাতিয়ে নেয় কে জানে।”

চলবে…#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৩.

দিনগুলো চলে গেল চোখের পলকেই। আর দু’দিন পর থেকে মোহনার ফাইনাল পরীক্ষা। এই কয়দিন সে খুব পড়েছে। ভার্সিটিতে খুব প্রয়োজন ছাড়া যায়নি। এশা আর রাফাতের সাথেও এখন খুব একটা কথা হয় না। তবে এই কয়দিন সে প্রায় রোজ বিকেলেই ছাদে যেত। আর ঠিক রোজ বিকেলেই লরিন বাড়ির ওপাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে মোহনাকে দেখত। মাঝে মধ্যে ইশারা দিয়ে মাহিয়ার সাথে কথা বলত। লরিন এর মাঝে অনেকবার চেয়েছিল, মোহনার বাবার কাছে তাদের বিয়ের কথা বলার জন্য। কিন্তু, মোহনা তাকে বারণ করে বলেছে, সামনে তার পরীক্ষা এখন বিয়ের কথা বললে বাবা তার উপর ক্ষেপে যেতে পারেন। তখন দুশ্চিন্তায় তার পরীক্ষা খারাপ হবে। মোহনার কথা রাখার জন্য আপাতত লরিনও চুপ রয়েছে। ঐদিকে অরূপের তরফ থেকেও কোনো পজিটিভ রিপ্লাই আসেনি, এই নিয়ে মোহনাও এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত। সে ভেবেই নিয়েছে, অরূপ হয়তো আর এই বিয়েতে রাজিই হবে না।

আজ বিকেলে হুট করেই এশা মোহনাকে কল করে। প্রথমে মোহনা কল রিসিভ করেনা। কিন্তু এশার লাগাতার কলে মোহনা পরে বাধ্য হয় কল রিসিভ করতে। আর কল রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটা হাউমাউ করে কাঁদতে আরম্ভ করে। এমন ভাবে কাঁদছে যেন তাকে কেউ মেরে ফেলছে। তার অমন কান্নার স্বর শোনে মোহনাও হতভম্ব হয়ে পড়ে। ভয়ও পেয়ে যায় খুব। অস্থির গলায় বলতে থাকে,

‘কী হয়েছে, এশা? এভাবে কাঁদছিস কেন?’

এশার কান্না থামছে না। মোহনা আরো বেশি বিচলিত হয়ে উঠছে। প্রায় দুই সপ্তাহ পর এশা তাকে আজ কল করেছে। হঠাৎ এমন কী হলো যে মেয়েটা কল দিয়ে এভাবে কাঁদছে। মোহনা বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায়। উদ্বিগ্ন সুরে আবারও বলে,

‘কিরে, বলনা কী হয়েছে?’

এশা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,

‘তুই আমাকে কবে ক্ষমা করবি? আমি যে আর এভাবে থাকতে পারছি না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, দোস্ত। প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করে দে।’

মোহনা কপালে ভাঁজ পড়ে। এর জন্য এশা এভাবে মরা কান্না কাঁদছিল? মোহনার রাগ হলো। সে ক্ষেপে গিয়ে বলল,

‘এর জন্য তুই এভাবে কাঁদছিলি? আর আমার এইদিকে বুকে মোচড় দিয়েছে ভয়ে। এর জন্য তুই এমন মরার মতো কাঁদছিলি কেন, আশ্চর্য?’

‘তুই আমার সাথে আর কত রাগ করে থাকবি? কতদিন তোকে দেখি না। লরিনের কাছ থেকে খবর নিই। ও তো তোকে প্রায়ই ছাদে দেখে, পরে আমাকে কল করে সব বলে। কিন্তু তাও তোর সাথে কথা বলতে না পারার আক্ষেপ টা তো আমার থেকেই যায়। আমি মানছি আমি ভুল করেছি, অনেক বড়ো ভুল করেছি। কিন্তু তুই আর আমাকে এভাবে শাস্তি দিস না প্লিজ। আমার এখন খুব কষ্ট হয়। তুই ছাড়া আমাকে কে বোঝে বল? কত কথা জমে আছে, কিন্তু বলার মানুষ নেই। একটু দয়া কর দোস্ত, প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দে।’

মোহনা যেন বাকরুদ্ধ। মন বলছে এক কথা আর মস্তিষ্ক বলছে আরেক কথা। এখন তো আর রাগ নয়, অভিমান হচ্ছে। কিন্তু, মেয়েটার এত আকুতি মিনুতির কাছে সে তো এই অভিমানটাকেও ধরে রাখতে পারছে না। কী করবে এখন? ক্ষমা করে দিবে এশাকে?

মোহনার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে এশা আবারও কাঁদতে আরম্ভ করল। মোহনা এবার বিরক্ত গলায় বলল,

‘থামবি। তখন থেকে তোর ব্যা ব্যা শুনতে শুনতে এখন আমার মাথা ব্যথা করছে।’

এশা নাক টেনে জবাবে বলল,

‘তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দে।’

হ্যাঁ, ক্ষমা করা যায়। ক্ষমা মহৎ গুণ, ক্ষমা করলে কেউ ছোট হয় না। তবে মাঝেমধ্যে অভিমানের পাল্লা এত ভারি হয় যে ক্ষমা করতে গেলেও কয়েকবার ভাবা লাগে।

এশা ফ্যাচফ্যাচ করে বলল,

‘ক্ষমা করবি না, মোহনা?’

এশার এমন সুরে মোহনা আর নিজেকে কঠোর রাখতে পারল না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘তোর সাথে কথা বলতে না পারলে আমার নিজেরও শান্তি লাগে না। কষ্ট তো আমারও হয়। তবে যখনই ঐ কথাগুলো মনে পড়ে তখন তোর উপর থেকে রাগটা আর ফেলতে পারি না। মনে হয় আর কখনোই কথা না বলি। কিন্তু, একটু পরেই আবার তোর কথা মনে পড়ে। তোদের দেখি না কতদিন। খারাপ তো আমারও খুব লাগছে। কিন্তু, মনের অভিমানের কাছে সেই খারাপ লাগা আর টিকতে পারছে না। তবে আমিও আর পারছি না। অনেক হয়েছে এই মান অভিমান। রাগ পুষে রাখতে রাখতে মন ভার হয়ে উঠেছে। আর পারব না। ক্ষমা করে দিয়েছি তোকে। তবে এরপর যদি কোনোদিন এমন কিছু করেছিস তাহলে আর জীবনেও ক্ষমা পাবি না।’

এশা অস্থির হয়ে বলতে লাগল,

‘না না, আর জীবনেও আমি এই ভুল করব না। এই তওবা কাটালাম। এখন একটু কষ্ট করে দরজাটা এসে খোল।’

মোহনা অবাক হয়ে বলল,

‘দরছা খুলব মানে? তুই কি বাইরে?’

‘হ্যাঁ, তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। তাড়াতাড়ি এসে দরজা খোল।’

মোহনা কল কেটে দরজার কাছে ছুটে গেল। দরজা খুলে দেখল সত্যি সত্যিই এশা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার ফর্সা মুখ লাল হয়ে আছে। এতক্ষণ সে তাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কেঁদেছে? মোহনাকে দেখে এশা ঝাপটে জড়িয়ে ধরে, যেন কত বছর পর দেখা। মোহনাও আর সংশয় না করে এশাকে জড়িয়ে ধরে। ভেতর থেকে তখন মাহিয়াও দরজার সামনে আসে। দুই বান্ধবীর ভালোবাসা দেখে সে খুশিতে হাত তালি দিতে থাকে।

এশা আসার কিছুক্ষণ পর মোহনা রাফাতকেও কল করে আসতে বলে। কতদিন পর ওরা তিন বন্ধু এক হয়েছে, কতদিন পর আবার একটু মন খুলে হেসেছে ওরা। সেই আগের মতো, হাসতে হাসতে একজন অন্যজনের পিঠে দুই চারটা চড় মেরে দেওয়ার প্রকোপটাও এখনো রয়েছে। যেন কয়েকদিনের জমানো কথা শতশত বছরের জমানো কথার সমান হয়েছে। আজ সেগুলো মন খুলে বলে তবেই মন হালকা হলো তাদের।

মোহনার হাতে কফি খেয়ে তবেই এশা আর রাফাত বাড়ি ফিরল। মোহনার আজ আনন্দ লাগছে। মনে হচ্ছে আজ যেন আবার নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে সে। বন্ধুত্ব সুন্দর জিনিস। তবে যদি সেখানে স্বার্থ চলে আসে তবে সেই সুন্দর জিনিসটাই কুৎসিত হতে বেশি সময় লাগে না।

রাতে বাবার সাথে ফোনে কথা বলে মোহনা আবার গিয়ে পড়তে বসে। মা আর তার ছোটবোন শুয়ে পড়েছে । মোহনা একাই তখন তার রুমে পড়ছিল। তখন আচমকাই তার ফোনে ভো ভো শব্দ হয়। এমন নিস্তব্ধ পরিবেশে এই ভো ভো শব্দেই মোহনা যেন আঁতকে উঠে। সে তাড়াহুড়ো করে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে, “লরিন”। এই ছেলেটা এমন হুটহাট করে কেন কল দেয় কে জানে। মোহনা কল রিসিভ করে। বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘কী হয়েছে, এত রাতে কল দিয়েছেন কেন?’

‘একটু বেলকনিতে আসবে?’

মোহনার ভ্রু কুঁচকে যায়। তার জানা মতে লরিন তো আজ তার বাড়িতে। এশা তো তাই বলল। তাহলে সে এখন হঠাৎ মোহনাকে বেলকনিতে যেতে বলছে কেন? মোহনা বলল,

‘কেন, বেলকনিতে গিয়ে কী হবে?’

‘আসলে, তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।’

‘আপনি কি এখানে? আপনি না আপনার বাড়িতে ছিলেন?’

‘হ্যাঁ, ছিলাম। তবে কিছুক্ষণ আগেই চলে এসেছি। জানতো, হুট করেই না তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল। মানে যেই সেই মনে পড়ে না, মনে হচ্ছিল এক্ষণ যদি তোমাকে একবার না দেখি তাহলে হয়তো মরে যাব। আশ্চর্য, আমি কোনোভাবেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারছিলাম না, কেমন যেন করছিল। দাদা দাদু কোনোভাবেই এত রাতে আসার জন্য দিচ্ছিলেন না। তবে আমি তো আমার মনের সাথে পারছিলামই না। এত বুঝিয়েও লাভ হয়নি। মন বলেছে সে মোহনাকে দেখবে, মানে দেখবেই। কী আর করব বলো, মনের এত জোরালো আন্দোলন আমি কীভাবে ফেলব? তাই চলে এলাম। এখন একবার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে তোমার মুখদর্শন করার সৌভাগ্য আমাকে পেতে দাও প্লিজ।’

মোহনা মাথা চাপড়ে হতাশ হয়ে পড়ল। না জানি ছেলেটা তার এই কঠিন প্রেমরোগে কবে মারা পড়ে। প্রেমে পড়লে বুঝি মানুষ এত পাগলামী করে? তাহলে তো প্রেম ভয়ানক জিনিস, আর যাই হোক এই প্রেমে পড়া যাবে না।

কিন্তু মোহনা যতই সতর্ক থাকুক না কেন, সে নিজেও জানে লরিন তার প্রেম ভাইরাস দিয়ে ঠিকই তাকে সংক্রমিত করবে। আর তার প্রসেস হয়তো এখনই শুরু হয়ে গিয়েছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here