প্রণয় রেখা পর্ব -১৮+১৯

#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৮.

মোহনা লরিনকে ডিরেক্ট কল করে বসল। লরিন সেই কল রিসিভ করলে মোহনা তিক্ত সুরে বলল,

‘অরূপের কথা আপনি কী করে জানলেন?’

‘কী করে জেনেছি সেটা বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা হলো এই অরূপটা কে সেটা জানা। Who is he?’

‘আমার বাবার বন্ধুর ছেলে।’

মোহনার সরাসরি জবাব। লরিন খানিকটা চুপ থেকে বলল,

‘ঠোমার বাবা আবার তার সাথে ঠোমার বিয়ে দিয়ে দিবে না তো?’

মোহনা গলার স্বর এবার চওড়া করে বলে,

‘আপনাকে কে বলেছে উনার সাথে বাবা আমায় বিয়ে দিবে? আর যদি দেয় ও তাতেই বা আপনার কী?’

লরিন চাপা সুরে বলল,

‘ঠোমার বিয়ে হয়ে গেলে আমার কী হবে?’

মোহনা বিরক্ত সুরে বলল,

‘আপনিও তখন আপনার দেশের কেউ একজনকে বিয়ে করে সুন্দর সংসার শুরু করবেন।’

লরিন বিষন্ন মনে বলল,

‘ইশ, যদি আমার ক্ষমতা থাকত তবে আমি অবশ্যই আমার মনকে কন্ট্রোল করতে পারতাম। কিন্তু আফসোস! আমার সেই ক্ষমতা নেই।’

‘চাইলেই পারবেন। মন আপনার, সেটাকে কন্ট্রোল করার ক্ষমতা আপনার থাকতে হবে। নয়তো সেই মন বারবার ভুল কাজ করে বসবে, পরে তো তার জন্য আপনাকেই পস্তাতে হবে তাই না? তাই আগে থেকেই মনকে কন্ট্রোল করতে শিখুন।’

লরিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কিছু হারিয়ে ফেলার তীব্র যন্ত্রণা তাকে ভীষণ ভাবে আঘাত করছে। মোহনার প্রতি তার এক অন্তরীক্ষ মায়া। সেই মায়া কাটিয়ে উঠার মতো ক্ষমতা তার নেই। ভাবলেই তো বুক ধরফর করে, মন বিষিয়ে উঠে। সাধারণ একটা মেয়ের প্রতি এত কেন আকৃষ্ট তার, কেন এত মায়া। মায়ার এই তীব্রতা থেকে সে কীভাবে তার মনকে উদ্ধার করবে সেই উপায় তার আজও জানা নেই। তবুও যদি কোনোদিন মোহনা অন্যকারোর হয়ে যায়, তবে সে অবশ্যই খুব কষ্ট পাবে। বুক তার সেদিন নিশ্চয়ই তীব্র ব্যথায় কুঁকড়ে উঠবে।
লরিননের নিরবতা দেখে মোহনা বলল,

‘আর কিছু বলার আছে আপনার?’

লরিন কিছুটা সময় নিয়ে কম্পিত সুরে বলল,

‘ঠোমাকে হারিয়ে ফেলার কথা ভাবলে আমার বুকে ব্যাথা হয়, মোহনা।’

লরিনের এই সুরে বিষাদ স্পষ্ট। যেন মোহনাকে না পাওয়ার এক আক্ষেপ ছেলেটাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কেমন যেন মোহনার মায়া হয় তার জন্য। ছেলেটার অমন মিইয়ে যাওয়া স্বর তার মনকে আটকে ফেলছে যেন। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেই দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি লরিনও শুনতে পায়। হয়তো সেও বুঝতে পারে, মোহনা নিরুপায়। লরিন তাই মিহি সুরে বলে,

‘আমরা কি অন্তত বন্ধুও হতে পারিনা?’

মোহনা দ্বিধাহীন সুরে বলল,

‘যদি বন্ধুত্বের খাতিরে সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে তখন আপনার সাথে সাথে আমারও কষ্ট হবে, লরিন।’

লরিন হতাশ হয়ে পড়ল। অনেক ভেবে বলল,

‘তেমন কিছু হবে না। আমি কখনো আমাদের বন্ধুত্বের সীমা লঙ্ঘন করব না। যেমন সম্পর্ক ঠোমার রাফাত আর এশার সাথে তেমন সম্পর্কই ঠোমার আমার সাথে থাকবে।’

মোহনা স্পষ্ট স্বরে বলল,

‘তাহলে আমার বিয়ে হয়ে গেলেও আপনি কষ্ট পাবেন না, বরং এশা আর রাফাত আমার বিয়েতে যেভাবে আনন্দ করবে আপনাকেও ঠিক সেইভাবেই আনন্দ করতে হবে।’

লরিন আবার উত্তেজিত হয়ে পড়ে। বিচলিত সুরে বলে,

‘তাহলে কি ঠোমার সত্যি সত্যিই অরূপের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে? ঠুমি সত্যিই ওকে বিয়ে করে ফেলবে, মোহনা?’

মোহনা চোখ বুজে নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে বলল,

‘এই তো বিয়ের কথা শুনে অস্থির হয়ে পড়লেন। এবার আপনিই বলুন, আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব কী করে সম্ভব? আপনি পারবেন একজন বন্ধু হিসেবে আমার বিয়েটা হাসি মুখে মেনে নিতে? যদি বলেন পারবেন, তবে আমিও আপনার বন্ধু হতে রাজি।’

লরিন দুটানায় পড়ে গেল। এর আগে কখনো এমন কঠিন মুহুর্তে সে পড়েনি। কী সিদ্ধান্ত নিবে? কী বলবে? মোহনাকে হারালে যেমন কষ্ট হবে তেমনি বন্ধু হিসেবে তার বিয়ে দেখাটাও কষ্ট হবে। এত জটিল কেন সবকিছু? এত এত প্যাঁচে তার মাথা এখন আর কাজ করছে না। লরিন শুকনো মুখে বলল,

‘আচ্ছা এখন রাখি। পরে বলব।’

লরিন কল কেটে দিল। মোহনা তার ফোনটা পাশে রেখে মনে মনে ভাবতে লাগল, “ইশ, যদি ভাগ্য লরিনের সহায় হতো, তবে কতই না ভালো হতো।”

.

রাত আট’টা,

মোহনা তার টেবিলে বই খুলে বসে আছে। পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছে না। কিছু একটা নিয়ে সে খুব অস্থির। মাহিয়া অন্য টেবিলে গলা ছেড়ে পড়ে যাচ্ছে। পর্যায় সারণির মৌলগুলো তার টুটস্থ মুখস্ত, তাও কেন এই মেয়ে বারবার রসায়ন বই খুলে এই একটা জিনিসই চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে পড়ে কে জানে। মোহনা গালে হাত দিয়ে বোনের দিকে ফিরে তাকায়। বোন তার চোখ বন্ধ করে পড়ে যাচ্ছে। বাহ, মেয়েটা নির্ঘাত এ প্লাস পাবে। ওর বয়সে মোহনাও এত পড়েনি, আর তার জন্যই হয়তো অল্প কিছু পয়েন্টের জন্য তার এ প্লাস ছুটে গিয়েছিল। যাক, সেসব নিয়ে সে আর ভাবতে চায় না। আপাতত তার মন আর মস্তিষ্ক অন্য কথা ভাবছে। সে মাহিয়াকে ডেকে থামতে বলল। মাহিয়া পড়া থামিয়ে অদ্ভুত চোখে বোনের দিকে চেয়ে বলল,

‘কী হয়েছে?’

মোহনা কিছুক্ষণ থ মেরে বসে থেকে বলল,

‘আমার না এবার এশা কে সন্দেহ হচ্ছে।’

মাহিয়ার ফর্সা ললাটে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। সে বলল,

‘কী নিয়ে?’

মোহনা হাঁসফাঁস করছে। এশাকে সন্দেহ করা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। তবে তার অযাচিত মন সেই কথাই মানতে নারাজ। সে বারংবার কেবল বলে যাচ্ছে, “এশা’ই সে, যে লরিনকে সাহায্য করছে”। তবে এই অদ্ভুত সন্দেহের কোনো যুক্তি এখনও মোহনা তলিয়ে পাচ্ছে না। যুক্তিহীন কোনো বিষয় নিয়ে এশাকে সন্দেহ করা অবাঞ্ছনীয়। তবে একেবারে সন্দেহ না করেও থাকতে পারছে না।

মাহিয়া যেন বোনের এমন নিরবতায় খুব বিরক্ত হলো। তার পড়া থামিয়ে এভাবে ঘাপটি মেরে বসে থাকার কোনো মানে হয়না। সে আবারও তাই পড়তে আরম্ভ করল। এবার মোহনা চেতে গেল। রূঢ় সুরে বলল,

‘আশ্চর্য, একদিনেই সব পড়ে শেষ করে ফেলবি নাকি?’

‘তো কী করব? পড়া বন্ধ করে তোমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছি কিন্তু, তুমি তো কিছু বলছো’ই না।’

মোহনা নিশ্বাস নিল। বলল,

‘বলতে চাইছি আবার চাইছিও না। আসলে আমার এখন মনে হচ্ছে এশা’ই হয়তো লরিনকে সাহায্য করছে।’

‘কী? মাথা খারাপ তোমার? এশাপু কেন লরিনকে সাহায্য করবে? ও তো তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড, ও তোমার সাথে কখনোই এমন করবে না।’

মোহনা অসহায় গলায় বলল,

‘হ্যাঁ, সেটাই তো। আমিও তাই ভাবছি। কিন্তু এশার কিছু ব্যবহারে আমার ওকে সন্দেহ হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি না কী করব। ঐ ব্যক্তিটাকেও খুঁজে পাচ্ছি না। তবে আমি শিউর ওদের কারো মধ্যেই এসব কেউ করছে। দিশার উপর থেকে আপাতত আমার সন্দেহ উঠে গিয়েছে। আর বাকি রাফাত, ওর উপর আমার সন্দেহ হচ্ছে না। কারণ ওর আমার ব্যাপারে কোনো ইন্টারেস্টই নেই। ও সারাক্ষণ এশা এশা’ই করে। তো এখন সবশেষে সন্দেহ বার বার এশার উপরই পড়ছে। তারও অবশ্য কারণ আছে। আজ সকালে আমি এশাকে অরূপের কথা বলেছিলাম। রাফাতও কিন্তু অরূপের ব্যাপারে জানে না, জানে শুধু এশা। ওমা, বিকেলে দেখি লরিন আমাকে মেসেজ দিয়ে অরূপের কথা জানতে চাইছে। এখন তুই’ই বল, লরিন কী করে অরূপের কথা জানল? মানলাম, ও হয়তো আমাদের বাড়ির উপর নজর রাখে সেই সুবাদে আমাদের বাড়িতে যে মেহমান এসেছে সেটা হয়তো ও দেখেছে; কিন্তু এখানে অরূপের নাম ও কী করে জানল? আমার তো মনে হচ্ছে এশা’ই ওকে অরূপের কথা বলেছে, আর তাছাড়া ওর জানার কোনো উপায়ও নেই।’

মোহানার কথা শুনে মাহিয়াও খুব চিন্তায় পড়ল। উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,

‘এখন তাহলে কী করবে? যদি সত্যি সত্যিই এশাপু এত কিছু করে থাকে, তখন?’

মোহনা শক্ত হয়ে বসল। বলল,

‘কাল আমি ওর সাথে সরাসরি কথা বলব। আর কত লুকোচুরি হবে? এবার যা হবে সামনা সামনি হবে।’

চলবে…#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৯.

প্রথম ক্লাস শেষ করেই মোহনা এশাকে নিয়ে মাঠে গেল। এশা মোহনার ব্যবহারে কেন যেন খুব অবাক হচ্ছে। মেয়েটা সকাল থেকেই তার সাথে খুব অদ্ভুত ব্যবহার করছে। ভার্সিটিতে আসার পর থেকেই কেমন চুপচাপ। তার সাথেও খুব একটা কথা বলেনি। এখন আবার তাকে এভাবে মাঠে নিয়ে এল, এসব কিছুর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো গুরুতর কারণ আছে।

মাঠের এক কোণে যেখানে মানুষের আনাগোনা কম সেই জায়গাটাই মোহনা এশাকে নিয়ে দাঁড়াল। রাফাতও তাদের পেছন পেছন এসেছে। সেও ধরতে পারছে না ব্যাপারটা কী। এশা এবার কপালে ভাঁজ ফেলল। গম্ভীর সুরে বলল,

‘কী হয়েছে তোর?’

মোহনা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বেশি বনিতা না করে সরাসরিই বলল,

‘তুই’ই কি লরিনকে সাহায্য করছিস?’

প্রশ্ন শুনে এশা থমকে গেল। তার চোখে মুখে উপচে পড়ছে বিস্ময়। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মোহনার চোখ মুখের কঠোরতা দেখে আরো বেশি এশা হতভম্ব হচ্ছে। রাফাতও সমান তালে চমকেছে। মোহনা ঢোক গিলল। আবারও সে এশাকে একই প্রশ্ন করল,

‘চুপ করে আছিস কেন, এশা? বল, তুই কি লরিনকে সাহায্য করছিস?’

এশা রাফাতের দিকে চাইল। সেও আশ্চর্য। বোকা বোকা চোখে মোহনার দিকে চেয়ে বলল,

‘কী বলছিস এসব? এশা কেন লরিনকে সাহায্য করতে যাবে?’

মোহনা কাঠকাঠ গলায় জবাব দিল,

‘কেন সাহায্য করছে সেটা ঐ ভালো বলতে পারবে। এশা, চুপ করে না থেকে জবাব দে। দয়া করে আর কিছু লুকাস না।’

এশা এদিক ওদিক চেয়ে নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। ফাঁকা মস্তিষ্ক নিয়ে কিছুক্ষণ আবার মোহনার দিকে চেয়ে রইল। জবাব দেওয়ার মতো কোনো শব্দ সে খুঁজে পাচ্ছে না। হৃৎস্পন্দনের ঢিপঢিপ শব্দ সে টের পাচ্ছে। মিথ্যে বললে বুকে ভয় জন্মে। তারও জন্মাচ্ছে। তাও সত্য বলার সাহস পাচ্ছে না।

মোহনার শক্ত কঠিন চোখজোড়ার দিকে বেশিক্ষণ সে চেয়ে থাকতে পারল না। কেন যে কষ্ট পাচ্ছে। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে জোরে নিশ্বাস নিল। গলার স্বর তো আটকে আছে, কথা বলবে কী করে? মোহনা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘কথা বল, এশা।’

এশা টলমল চোখে কম্পিত সুরে বলল,

‘হ্যাঁ, আমিই এতদিন লরিনকে সাহায্য করেছিলাম।’

মোহনা চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেল। মস্তিষ্কের রক্ত সঞ্চালন যেন হুট করে মারাত্মক রকম ভাবে বেড়ে গেল তার। সে চোখ বুজে বোঝার চেষ্টা করল, সে ঠিক শুনেছে তো? না, হয়তো ভুল শুনেছে। তার এশা তার সাথে এমন করবে না, সে নিশ্চয়ই তাকে এত এত মিথ্যে বলবে না। এটা সম্ভবই না। মোহনা জোরে জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘তুই মিথ্যে বলছিস, না? তুই এমন করিসনি, মজা করছিস তাই তো?’

এশা কেঁদে ফেলে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,

‘না, আমিই এসব করেছি। লরিনকে প্রথম থেকে আমিই সাহায্য করেছি। তোর বাড়ির ঠিকানা, তোর ফোন নাম্বার ইনফেক্ট তোর সমস্ত ইনফরমেশন আমিই ওকে দিয়েছি।’

রাফাতও বাকরুদ্ধ। সে নির্বাক হয়ে চেয়ে এশাকে দেখছে। যেন নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। এশা কেন এমন করবে? ও তো মোহনাকে তার নিজের বোনের মতো ভালোবাসে, তাহলে?

মোহনা নিজেকে খুব শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। মাথা কাজ করছে না তার। তার বন্ধু তার সাথে কেন এমন করল। সে না তাকে ভালোবাসতো? তাহলে সে তাদের বন্ধুত্বকে কেন অপমান করল?

মোহনা শক্ত গলায় বলল,

‘কেন করেছিস এসব?’

এশা কাঁদছে। কান্না থামিয়ে ঢোক গিলে বলল,

‘ও তোকে ভালোবাসে।’

মোহনা আর নিজেকে আটকে রাখতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠল।

‘ও আমায় ভালোবাসে? আর তুই আমায় ভালোবাসতি না? এতদিন যাবত নিজের চোখে তুই দেখেছিস, আমি কতটা ডিপ্রেসড ছিলাম। এই একটা বিষয় নিয়ে আমি কতটা দুশ্চিন্তা করেছি। কত কিছু করে গেছি সেই মানুষটাকে ধরার জন্য যে লরিনকে এত সব ইনফরমেশন দিয়েছে। এইসব কিছু নিজের চোখে দেখেও তুই এতদিন কী করে চুপ করে ছিলি? একটুও তোর বিবেকে আটকাল না এসব করতে? কে হয় ঐ ছেলে, যে ওর ভালোবাসার কথা চিন্তা করতে গিয়ে তুই তোর বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে এমন করেছিস? বল, ঐ ছেলে তোর কে হয়?’

এশা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কেঁদেই চলছে। মোহনা ওর দুই হাত চেপে ধরে বলল,

‘নাটক বন্ধ কর, এশা। এতদিন তুই অনেক নাটক করেছিস, এখন আর তোর এসব নাটকে আমি ভুলব না। তাকা আমার দিকে, তাকিয়ে সত্যি কথা বল। লরিন তোর কে হয়? কেন এসব করেছিস তুই? জবাব দে, এশা।’

এশা নাক টেনে রাফাতের দিকে চাইল। রাফাতের চোখ মুখেও রাগ স্পষ্ট। এবার আরো বেশি কষ্ট হচ্ছে তার। এমন একটা দিন যে একদিন আসবে সেটা সে আগেই জানত। সত্যকে সে কতদিন লুকিয়ে রাখবে? একদিন না একদিন সেটা ঠিকই সামনে আসবে।

এশা নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে অবশেষে বলতে আরম্ভ করে,

‘লরিন আমার কাজিন হয়। ওর বাবা সম্পর্কে আমার বড়ো মামা। মামা বিদেশ গিয়ে একজন বিদেশি মেয়েকে বিয়ে করেন। তবে উনার সেই সম্পর্ক আমার নানা নানু কেউই কোনোদিন মেনে নেননি। তাই মামাও উনার বউ নিয়ে কখনো দেশে আসেননি। তবে আমার মা বাবার সাথে মামার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। সবসময় মা বাবার সাথে মামার কথা হতো। একদিন নানা নানুকে না জানিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে ঘুরেও গিয়েছিল। তখন লরিন নাকি খুব ছোট। আর আমার তখনও জন্মও হয়নি। সেই ছোট্ট লরিনের একটা ছবি আমার মা বাবার কাছে ছিল। সেটা দেখেই আমি প্রথম জেনেছিলাম, আমার একটা বিদেশি মামাতো ভাই আছে। তারপর আস্তে আস্তে যখন আরো বড়ো হলাম তখন একদিন শুনলাম, আমার মামা মামি নাকি একটা রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছেন। আর উনাদের ছেলে লরিন এখন নাকি লরিনের আংকেলের কাছে আছে। মা বাবা তখন চেষ্টা করেছিলেন লরিনকে দেশে আনার জন্য। কিন্তু লরিন তখন আমাদের কাউকে ভালো করে চিনতই না। ওর মা বাবার সুবাদে যতটুকুই আগে চিনত তবে মা বাবা মারা যাওয়ার পর একেবারেই ভুলে যায়। তাই ওর সাথে আমরা আর কোনো যোগাযোগ করতে পারেনি। তবে ওর খোঁজ মা বাবা ওর আংকেলের কাছ থেকে সবসময়ই নিতেন। আর তখনই কোনো একদিন ওর আংকেলের কাছ থেকে ওর ফেইসবুক আইডিটা আমি নিয়েছিলাম। আর ও যেহেতু দেশে আসতে চায়না তাই ওকে দেশের আনার জন্যই আমি তোর ডেয়ারের সময় তোকে ওর আইডি টা দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি নিজেও ভাবতে পারেনি যে ও সত্যি সত্যিই তোর জন্য দেশে চলে আসবে। আর ওর দেশে আসার খবর তোর আগেই আমি ওর আংকেলের কাছ থেকে পেয়ে যাই। তাই ওর সাথে আমি আগে আগেই দেখা করি। তবে আমি যে ওর বোন হই সেই পরিচয় আমি এখনও ওকে দেইনি। ও আমার সাথে প্রথমে কথা বলতে চায়নি তাই আমি তোর ঠিকানা আর পরিচয় দেওয়ার শর্তে ওর সাথে কথা বলেছিলাম। ও বাংলা ভাষা শিখেছিল ওর বাবার কাছ থেকে আর বাকিটা এখানে আসার পর আমি ওকে শিখিয়েছিলাম। তবে জানিস তো ও তোকে নিয়ে সত্যিই খুব সিরিয়াস। তাই আমি ওকে তোর কথা বলে বলে আমাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রথম বারের মতো ও ওর বাবার বাড়িতে পা রেখেছিল। ওর দাদা দাদুকে দেখেছিল। তবে ও তাদের চিনতে পারেনি। বুঝতেও পারেনি এই মানুষগুলো তার কত আপন। এখন ও কেবল এই দেশে পড়ে আছে তোর জন্য। নয়তো এই দেশে ও কখনোই থাকত না। ওর এই দেশের প্রতি কোনো মায়া নেই। স্বাভাবিক ভাবেই ওর জন্ম কর্ম সব ঐদেশেই, তাই ওর এখানে মন টিকছে না। এখন ওকে এখানে শুধু তোর মায়াই আটকে রেখেছে। আর আমার নানা নানু এখন চান, ও যাতে এখানেই থাকে। উনাদের ছোট ছেলের শেষ চিহ্ন যেন উনাদের সাথেই থাকে। ছেলে হারিয়ে বৃদ্ধ মা বাবার এই একটাই দাবি। ছেলেকে দূরে সরিয়ে দিলেও ছেলের শেষ সম্পদটুকু নিজেদের কাছে আগলে রাখতে চান। আর তাই আমি লরিনকে তোর কথা বলে বলে এখানে রাখছি। না হয় ও আরো অনেক আগেই চলে যেত। আমি এইসব কিছু করেছি শুধুমাত্র আমার অসুস্থ নানা নানুর কথা ভেবে। আমি ভুল করেছি, অন্যায় করেছি জানি। যদি পারিস, ক্ষমা করে দিস।’

কথা শেষ করেই এশা দৌড়ে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে গেল। মোহনা এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তার সেই যাওয়ার পথের পানে। তার আঁড়ালে এতসব কিছু হয়ে গিয়েছে, অথচ সে কিছুই জানে না। এখন সবকিছু শুনে মাথা ঝিমঝিম করছে। এই জটিল সমস্যা সমাধান যে এত জটিল হবে সেটা সে ভাবেনি। ভেবেছিল অন্যকিছু। রহস্যময় লরিন যেন তার রহস্যের মায়াজালে তাকে আরো নিখুঁতভাবে আটকে ফেলছে। অথচ সে পথ পেয়েও বেরিয়ে আসতে পারছে না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here