প্রণয়িনী পর্ব -১২

#প্রণয়িনী
#আফসানা_মিমি
|১২তম পর্ব |

চোখে মোটা করে কাজল, ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক, হাত ভর্তি চুড়ি, পায়ে নুপুর, আর পরনে সুতি শাড়ি দিয়ে মাথায় ঘোমটা ব্যস তৈরি আমি। আমাকে দেখে পাক্কা গৃহিনী মনে হচ্ছে। আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছি এমনসময় চোখ যায় বিছানায় ঘুমন্ত সাদা বিলাইয়ের দিকে। সাদা বিলাই আরামে কোলবালিশকে বউ বানিয়ে ঘুমিয়ে আছে। সাদা বিলাইয়ের এহেন অবস্থা দেখে আমার সরল মনে এক দুষ্টু বুদ্ধি করতে হচ্ছে হলো। মাথায় এক হাত ঘোমটা টেনে সাদা বিলাইয়ের পাশে গিয়ে বসলাম। সাদা বিলাইয়ের কানের কাছে দু’হাত নিয়ে রিনিঝিনি শব্দ করে যাচ্ছি একনাগাড়ে, থামার কোন নাম নেই। চুড়ির আওয়াজে সাদা বিলাইয়ের ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম থেকে উঠে আমায় এই অবস্থায় দেখে প্রথমে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায় যেন আমি কোন পর নারী। আমিতো ঘোমটার আড়ালে খুব মজা পাচ্ছি বেটাকে আচ্ছামত জ্বালাতন করতে পারছি বলে। সাদা বিলাই হয়তো আমাকে ঐ সতিন মনে করছে তাই পিছিয়ে গিয়েছে। হঠাৎ সাদা বিলাইয়ের কি হলো কে জানে! আমাকে একটানে সাদা বিলাইয়ের বক্ষের উপর ফেলে গভীরভাবে জরিয়ে ধরে শুয়ে পড়লো। সাদা বিলাইয়েরকান্ড দেখে আমি হতভম্ব। কথায় আছে,’ পরের জন্য গর্ত খুঁড়লে সেই গর্তে নিজেরই পড়তে হয়।’ আমার অবস্থাও তাই। সাদা বিলাই আমাকে ধরে ফেলেছে।
চুপচাপ সাদা বিলাইয়ের হৃদপিন্ডের আওয়াজ শুনে যাচ্ছি যা খুব দ্রুতই বেজে চলছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সাদা বিলাইয়ের উদ্দেশ্যে বললাম,

– কীভাবে বুঝলেন যে এটা আমি?

সাদা বিলাই শোয়া থেকে আমাকে নিয়ে উঠে বালিশে হেলান দিয়ে বসলেন। আমার মুখের উপর থেকে ঘোমটা সরিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও শক্ত করে জরিয়ে ধরলেন। আমাকে জরিয়ে ধরে রাখা অবস্থায়’ই কপালে অধর ছুঁয়ে বললেন,

– মাশাআল্লাহ, আমার শুভ্রপরী। কাজল কালো নয়নে আস্ত একটা মায়াবতী। এই আঁখিযুগলের মায়াতে বার বার আহত নিহত হতে প্রস্তুত আমি। আর ঐ গোলাপের ন্যায় টকটকে অধরে ডুব দিতে রাজি আমি। কেন এসেছো এভাবে? হারিয়ে যেতে ইচ্ছে যে করছে তোমার অতলে। তোমার শরীরের ঐ মিষ্টি সুবাস বলে দিয়েছে যে এটা আমার শুভ্রপরী।

সাদা বিলাইয়ের কথায় শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উঠেছে। একেমন কঠিন শব্দে কথা বলে রাদ! যা শুনতে অন্য জগতে চলে যাই বারবার।

– আমি কি তোমার ঐ রসালো অধরে ছুঁয়ে দিতে পারি, শুভ্রপরী?

সাদা বিলাইয়ের আবেগমাখা আবদার ফেলতে ইচ্ছে করছে না আবার সম্মতি দেয়াও সম্ভব না। এখন আমার করণীয় কি তাও বুঝতে পারছি না। অগত্যা চুপ করে রইলাম। আমার চুপ করে থাকা দেখে সাদা বিলাই আমাকে আরো গভীরভাবে জরিয়ে ধরল।
মাথায় পরপর কয়েকটা আদর দিয়ে আমার মুখ সাদা বিলাইয়ের দিকে ফিরেলো। চোখ বন্ধ রাখা অবস্থায় সাদা বিলাইয়ের তপ্ত নিশ্বাস অনুভব করতে পারছি। কিছুক্ষণ পর সাদা বিলাইয়ের দু’হাতের স্পর্শ আমার গালে পেলাম। সাদা বিলাই আমার কপালের সাথে কপাল মিলিয়ে ঘন ঘন নিশ্বাস ত্যাগ করছেন। কপালে অধর ছুঁয়ে দু’চোখের পাতায় অধর ছুঁয়ে দিলেন। আমার নাকে নাক ঘষে ঠোঁটের কোণে আদর দিলেন। আর এইদিকে সাদা বিলাইয়ের কান্ডে আমার কাঁপাকাপি অবস্থা। আমাদের দুজনের অধরের মাঝে কিছুটা ব্যবধান আছে এমন সময় দরজার কড়াঘাতে সাদা বিলাইয়ের ধ্যান ভাঙ্গে। আর আমি ছিটকে চলে আসি সাদা বিলাইয়ের কাছ থেকে। আমার কান্ড দেখে সাদা বিলাই খানিকটা বিরক্তির সহিত জোরে হাক ডাকল,

– কে?

অপরপাশ থেকে সকালের সেই মেয়ের কন্ঠস্বর ভেসে আসলো। যে কিনা খুবই কর্কশ আওয়াজে বলে যাচ্ছে,

– আমি লিজা। রাদ বেবি দরজা খুলো। কি করছো ভেতরে? সেই কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি তোমাকে।

সাদা বিলাই লিজা নামক সতিনের কথা শুনে নিজের কপাল নিজে চাপড় দিচ্ছে। আমার পানে তাকিয়ে করুন কন্ঠস্বরে বলল,

– এবারের মত এই সাইকোকে আমি পিছুছাড়া করো প্লিজ বউ!

প্রত্যুওরে আমি ভেংচি কেঁটে মাথায় ঘোমটা টেনে দরজা খুলে দিলাম। আমার দরজা খুলতে দেরি কিন্তু আমার সতীন ঝড়ের বেগে প্রবেশ করতে দেরি করল না।

– রাদ বেবী! মিস ইউ সো মাচ। তুমি জানো তোমাকে ছাড়া আমার এত বছর কত কষ্টের কেঁটেছে! যখন শুনেছি তুমি দেশে ব্যাক করেছো উড়ে চলে আসতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু আমার পরীক্ষার জন্য আমি আসতে পারিনি। এইযে এখন এসেছি, সারা জীবন তোমার কাছে থাকব।

লিজা মেয়েটার কথা শুনে রাদ কঠোর কন্ঠস্বরে বলল,

– লিজা দূরে গিয়ে বসো। আমি এখন বিবাহিত। আমার বউ আছে। ভবিষ্যতে আমার ধারেকাছেও যেন তোমাকে না দেখি।

এই বলে রাদ এক মিনিটও দাঁড়াল না। ওয়াসরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। আর এদিকে লিজা আমার কাছে এসে আমার উদ্দেশ্যে বলল,

– ইশ অভদ্র গাইয়া ভুত! এসেছে আমার রাদকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে। আমি এসে গেছি রাদের একমাত্র ভালোবাসা। তোর মত মেয়েকে আমি রাদের জীবন থেকে খুব শীঘ্রই বের করে ছাড়বো।

মেয়েটার কথা শুনে ঘোমটার আড়ালে মুচকি হাসলাম। আমি যে কি জিনিস মেয়েটা তো জানে না। এদিকে হামি এসেছিল আমাদের ডাকতে। আমার অবস্থা দেখে হামি হা করে তাকিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল,

– মিষ্টিপরী, কোথায় তুমি? এই মহিলা কে?

মিনি সাদা বিলের কথা শুনে মুখ থেকে ঘোমটা সরিয়ে চোখ টিপ দিলাম মিনি সাদা বিলাইকে। আমাকে শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখে হামি কোনো কথা না বলে এক দৌঁড়ে চলে গেল। একটু কান পেতে শুনতে পাচ্ছিলাম হামি মা-বাবা বলে চিল্লিয়ে যাচ্ছে।
হামির কান্ড দেখে খিলখিলিয়ে হাসি আমি। আমার হাসি শুনে লিজা নামের মেয়েটি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। আমার দিকে আঙুল তুলে বলতে লাগল,

-পাঁচ দিনের ভিতরেই তোমাকে আমি রদের জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দিবো। এই বলে হনহন করে নিচে চলে গেল মেয়েটা।

এদিকে রাদ ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে আমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো,

– কি ব্যাপার ম্যাডাম, হঠাৎ আজ শাড়ি পরে নারীর বেশ ধরেছেন যে? মাথায় কি চলছে?
সাদা বিলাইয়ের কথার প্রত্যুওরে মুখ ভেংচি কেঁটে বললাম,

– বাসার ভূত ঢুকেছে। ওঝা ডেকেছি ভূত তাড়াবো বলে। ওঝার শর্ত ছিল যে, আমাকে শাড়ি পরে থাকতে হবে তাই পরেছি। আপনার কোন সমস্যা?

আমার কথা শুনে সাথে বিদায় হো হা করে হাসতে লাগল। আর আমি এক দৌঁড়ে নিচে চলে আসলাম।

————-

সোফার রুমে শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে একজন মহিলা হেসে হেসে কথা বলছেন। আর আমার শাশুড়ি মা মুখটাকে পানসে করে বসে আছেন। আমি তাঁদের সামনে গিয়ে লম্বা সালাম দিলাম।

– আস্সালামু আলাইকুম শাশুড়ি মা। আজ কি কি কাজ করতে হবে?

আমার কথা শুনে শাশুড়ি মা আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বললেন,

– খালাম্মা আপনি কে?

শাশুড়ি মায়ের কথা শুনে ইচ্ছে করছে কচু গাছের সাথে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করি। কিন্তু তা করলাম না মাথার ঘোমটা ফেলে শাশুড়ি মাকে বললাম,

– আপনার একমাত্র পুত্রবধূ।

খাবার টেবিলে শশুড়বাবা সকালের নাস্তা করছিলেন। আমার এই অবস্থা দেখে খুক খুক করে কেশে উঠলেন। এখন আমার শাশুড়ি মা পড়েছে মহা বিপদে। একদিকে পুত্রবধূ তো অপরদিকে স্বামী। পুত্রবধূর পানে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবেন নাকি স্বামীর সেবা করবেন এই ভেবে। আমার শাশুড়ি মায়ের অবস্থা দেকে চোখ টিপ দিয়ে বাবার কাছে গেলাম। বাবার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিলাম। আমাকে পাশে দেকে বাবা ফিসফিসিয়ে বলল,
– এমন বউ সাজার মানে কি মা?

– সতীন বিদায় করব।

আমার কথা শুনে বাবা হু হা করে হাসতে লাগলেন। বাবার কাছ থেকে এসে মায়ের উদ্দেশ্যে বললাম,

– চা করে দেই মা?
আমার কথা শুনে শাশুড়ি মা হ্যাঁ না কিছু বলবে তার আগেই শাশুড়ি মায়ের সাথে বসা মহিলাটি বলে উঠলেন,

– এই বুয়া, আমার আর আমার বেবির জন্য বেশি করে দুধ দিয়ে কফি করে নিয়ে আসোতো!

মহিলাটির কথা শুনে শাশুড়ি মা মহিলাটির উদ্দেশ্যে বললেন,

– ও বুয়া না লিজার আম্মু। আমার ছেলের বউ।

প্রত্যুত্তরে মহিলাটি একটু টেনে সুরে বললেন,

– আজকালকার বউরা কি এভাবে শাড়ি পেঁচিয়ে চলাফেরা করে? দেখে তো মনে হচ্ছে কাজের লোক!

মহিলাটির কথা শুনে শাশুড়ি মা কিছু বলবে তার আগে শাশুড়ি মাকে চোখে আশ্বাস দিলাম যেন কিছু না বলে। আমি চলে গেলাম রান্নাঘরে চা, কফি বানাতে। এতক্ষণে লিজা নামক মেয়েটি তাঁর মায়ের পাশে বসে কি যেন ফুসুর ফুসুর করছে। এদের অবস্থা দেখে বাঁকা হেসে চা এবং কফির ট্রে টেবিলের উপর রাখলাম। একে একে সবার হাতে চা কফি দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার দাঁড়িয়ে থাকা দেখে শাশুড়ি মা বললেন,

– রাদের জন্য এক কাপ কফি দিয়ে আসো। আজকে ছুটির দিন রাদ বাসায় থাকবে।
আমি আচ্ছা মা বলে চলে গেলাম।

মহিলাটি আমার শাশুড়ি উদ্দেশ্যে বললেন

– এর চেয়ে ভালো কফি বানাতে পারে আমার মেয়ে। এটা তো কেমন তেতো তেতো লাগছে।

ওঁদের কথা শুনে মুচকি হেসে একটু উঁচু আওয়াজে বললাম,

– ঘরে গরুর দুধ শেষ হয়ে গিয়েছিল তো তাই ছাগলের দুধ দিয়ে কফি বানিয়ে নিয়ে আসলাম। হয়েছে কি আমরা সবাইতো রং চা খাই আর আপনারা অতিথি, আপনাদেরকে তো আর রং চা দেওয়া যায় না। আর আপনাদের আবদার ছিল কফি। তাই ঘরে যা ছিল তা দিয়ে বানিয়ে দিলাম। এজন্য একটু তেতো তেতো লাগছে নয় তো আমিও কিন্তু মিষ্টি কফি বানাতে পারি।

আমার কথা শুনে মা-মেয়ে ওয়াক ওয়াক করে ওয়াসরুমের দিকে ছুটল। আর আমিও খুব জোরে হেসে কফি নিয়ে চলে এলাম রুমে।
মা-মেয়েকে একদম উচিৎ শিক্ষা দিয়েছে যাকে বলে,

“গোয়ালে গরু থাকে,
আর মানুষ থাকে ঘরে।
আর এরা তো গরু, মানুষ একটাও না। তাই তো এদের অবস্থান মেইন হলে।”

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here