প্রণয়িনী পর্ব -১১

#প্রণয়িনী
#আফসানা_মিমি
|১১তম পর্ব |

চারপাশে পিনপিন নিরবতা। সোফার রুমে সোফায় শ্বশুর বাবা মাথায় আইসব্যাগ দিয়ে বসে আছে আর উনার একপাশে সাদা বিলাই আর অপরপাশে শাশুড়ি মা বসে আছেন। হামি পিচ্ছিটা একটি পাতলা কাগজের সাহায্যে শ্বশুর বাবার ঐ চকচকে তালুর বরাবর বাতাস করছে। যেন মাথা দ্রুত ঠান্ডা হয়। এদের দেখে বাংলা সিনেমার কোন অংশ থেকে কম লাগছে না। আমার শ্বশুর বাবাকে দেখে মনে হচ্ছে অভিনেতা আবুল হায়াত আর তারপাশে স্ত্রী রুপে ইমোশনালের ডিব্বা ডলি জহুর বসে আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদছেন। আর তাঁদের বাচ্চারা বাবা-মায়ের কষ্টে কষ্টিত হয়ে পাশে বসে আছে।
চার ড্রামাবাজ পরিবারের সদস্যদের সামনে আমি এক নিরীহ প্রাণী দাঁড়িয়ে নখ কামড়াচ্ছি আর তাদের ড্রামা দেখছি। আমার অবস্থা দেখে সাদা বিলাই একটু পর পর চোখ রাঙাচ্ছে যার অর্থ,” এই খচ্চর মেয়ে, নখ কামড়াতে একদিন নিষেধ করেছিলাম না? আজ রুমে গেলে দশবার শাবান দিয়ে হাত ধুয়াবো।”
আমার ভাবনার মাঝে শ্বশুর বাবা মুখ খুললেন,

– এই মেয়েকে কে আমার ছেলের বউ করে এনেছে? একদিনেই তো ভূমিকম্প তৈরি করবে আমার বাড়িতে।

শ্বশুর বাবার কথা শুনে প্রত্যুওরে আমি বললাম,

– শ্বশুর বাবা, আমি তো আপনার বাড়িতে আছি আজ প্রায় অনেকদিন ধরে। মানে এক দিনের চেয়ে বেশি আছি । কই একদিনও তো ভূমিকম্প হলো না! মিথ্যা কথা বলেন কেন?

আমার কথা শুনে শ্বশুর বাবা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইলেন। এদিকে শ্বশুর বাবার অবস্থা দেখে সাদা বিলাই খানিকটা কেশে শশুর বাবার উদ্দেশ্যে বললেন,

– বাবা তুবাকে আমি বিয়ে করে নিয়ে এসেছি। এক প্রকার জোর করে তুলে নিয়ে বিয়ে করেছি। আয়মানের এখানে কোন দোষ নেই। তুমি যদি মেনে না নাও তাহলে আয়মানকে নিয়ে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।

সাদা বিলাইয়ের কথা শুনে শ্বশুর বাবা ক্ষিপ্ত চোখে তাকালেন। এতক্ষণ চকচকে তালুতে ধরে রাখা আইসব্যাগ দিয়ে সাদা বিলাইয়ের কাঁধে দুইটা চাপড় দিয়ে বললেন,

– তোর সাহস তো কম না! আমার বাড়ির মেয়েকে তুই আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবি। তোর মত নিরামিষের জন্য এই মেয়ে ঠিক আছে। আমি আমার মেয়েকে আমার কাছ থেকে দূরে রাখব না। এ কয়েক মাসে তোর সব খবর তোর মা আমাকে দিয়েছে। তুই কি ভেবেছিস তোর ব্যাপারে আমি কিছুই জানিনা? আমি তুবার সম্পর্কে সব জানি এবং আজকে স্বচক্ষে দেখলাম তুবার কাণ্ডকারখানা। আজনমার এই রসহীন ভুতুরে বাড়ির জন্য এমন বউ চাই আমার।

শ্বশুর বাবা এবার হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলেন। আমিও ভদ্র মেয়ের মত কোন দুষ্টামি না করে শ্বশুর বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার দাঁড়ানো দেখে শ্বশুর বাবা ভ্রু কুঁচকে পাশে বসে থাকা সাদা বিলাইয়ের দিকে তাকিয়ে ধমকালেন,

– যা করার তা করে তো নিয়ে এসেছিস গাধা। এবার তো আমার পাশ থেকে উঠে আমার মেয়েকে আমার পাশে বসতে দে?

শশুর বাবার কথা শুনে বড্ড হাসি পাচ্ছে। আপাতত হাসিটা চেপে রাখার কোন ইচ্ছা হলো না। তাই হো হা করে হেসে ফেললাম। আমার হাসি দেখে সাদা বিলাই নেশার্ত চোখে আমার পানে তাকিয়ে মাথা চুলকে পাশে সরে বসল। সাদা বিলাইয়ের তাকানো দেখে আমি শুধু ঢোক গিললাম।

শ্বশুর বাবা এবার আমার মাথায় হাত রেখে আমার উদ্দেশ্যে বললেন,

– এভাবে কি সারাজীবন তুই আমাকে ভুঁড়ি ওয়ালা চকচকে তেল মাথা ডাকবি? নাকি বাবা বলে ডাকবি।

শ্বশুর বাবার কথা শুনে জিভ কাটলাম। নিচের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে উত্তর দিলাম,

– আর কোনদিনও তোমাকে এসব বলব না। আসলে আমি তোমাকে দেখে ভেবেছিলাম বাড়িতে কোন ভদ্রলোকের বেশে চোর ঢুকেছে। আমাকে তো আগে বলেনি কেউ যে তুমি আসবে।

তাড়াহুড়ো করে উল্টা পাল্টা শ্বশুর বাবাকে কথাটা বলে আবারো জিভ কাঁটলাম। আমার অবস্থা দেখে শ্বশুর বাবা কিটকিটিয়ে হেসে বলল,

– আমি তো চোরের বড়ো বাপ। আমার এত বছর জীবনে এই প্রথম তোর মত কোন দষ্যি মেয়ের কবলে পড়িনি। যে নাকি আমার বুলি বন্ধ করে দিয়েছে।

আমাদের কথার মাঝখানে হামি এসে গোমড়া মুখে বলল,

– আমার কথা সবাই ভুলে গিয়েছে। থাকব না আমি আর এখানে গেলাম আমি।

হামির কথা শুনে শ্বশুর বাবা এবার হেসে হামিকে কোলে তুলে নিলেন। হামির গালে একটু আদর দিয়ে বললেন,

– আমার হামি সোনা তো ছোট্ট সোনা। আমার এই ছোট্ট সোনাকে কীভাবে ভুলে যাই? এখন তো আরও একটা মেয়ের যুক্ত হয়েছে। এখন আমার তিন সন্তান। আমার তিন সন্তান নিয়ে পৃথিবী।

নানান হাসি মজার মাঝে আমাদের বেলাটা কেঁটে গেল।

———–

রাত দশটা বাজে আমি মায়ের ঘরে এসে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছি। আজ আর নিজের ঘরে যাবো না। আমি খুব ভাল করেই জানি আজ ঘরে গেলে আমার বত্রিশটা বাজবে।

এদিকে সোফার ঘরে চিন্তিত হয়ে বসে আছেন আশিকুর রহমান মানে রাদের বাবা। রাদের মা মেহরিন স্বামীর চিন্তিত মুখখানা দেখে পাশে এসে বসলেন। স্বামীর হাতের উপর হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন,

– কি হয়েছে আপনার? অনেক্ষন যাবৎ লক্ষ্য করছি আপনি কোন বিষয় নিয়ে চিন্তা করছেন।

– তোমার রিতা ভাবির কথা মনে আছে মেহরিন? রহিমের বউ! যার মেয়ে রাদের জন্য পাগল। অনেকদিন ধরে রিতা ভাবি আমাকে লিজার সাথে রাদের বিয়ের কথা বলছিল। আমি তাদের বলেছি যে রাদ বিয়ে করে ফেলেছে কিন্তু তারা বিশ্বাস করছে না উল্টো আগামীকাল তারা আসবেন এখানে।

– আসুক আসলে বলে দিবো যে, আমাদের ছেলে যাকে বিয়ে করেছে তাকে নিয়ে’ই আমরা খুশি। আপনারা ভালো ছেলে দেখে লিজার বিয়ে দিয়ে দিন।

– বিষয়টা তুমি যতটা সহজভাবে নিচ্ছো ততটা সহজ না কিন্তু। লিজা মেয়েটা খুবই জিদ্দি একটা মেয়ে। আমি চিন্তা করছি তুবার কথা। এমনিতেই মেয়েটার এত বড়ো অপারেশন হয়েছে তারমধ্যে লিজা যদি উল্টা পাল্টা কিছু করে তো কি হবে মেয়েটার!

রাদের বাবা-মায়ের কথার মাঝে রাদের আগমন ঘটে। রাদ বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,

– আমার বউ এতটাও দুর্বল না যে শত্রুকে ঘরে বসিয়ে রাখবে। তাঁদের আসতে দাও আয়মান একটা না একটা কান্ড করে শত্রুদের বিতারিত করবে।

শ্বশুর-শাশুড়ির রুমে শুয়ে আছি এক ঘন্টা হতে চলল কিন্তু কারোর কোন সাড়া শব্দ নেই। এতক্ষণে তো শ্বশুর-শাশুড়ির চলে আসার কথা ছিল কিন্তু তাদের কোনো খবর নেই। শ্বশুর-শাশুড়ি আসলে এ কথা সে কথা বলে শশুরকে আমার ঘরে পাঠিয়ে দিতাম। যদি না মানতো তো বলতাম,’ আমি মায়ের কাছে ঘুমাবো।’ কিন্তু তাদের কোনো খবরই নেই। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম নিচে উঁকি দিয়ে দেখে আসবো কে কি করে। যেই ভাবা সেই কাজ। যেই না আমি বিছানা থেকে উঠতে যাবো অমনিই দরজা খোলার শব্দ হলো আর আমিও চোখদুটো বন্ধ করে ঘুমের ভান করে রইলাম।

– এইযে ড্রামা কুইন, আপনার ড্রামা আমি ধরে ফেলেছি। আমি জানি আপনি ঘুমাননি। আজ যত ঝড়,তুফান আসুক না কেন তোমাকে তো আজকে ঘরে যেতেই হবে। যদি নিজের ইচ্ছেতে না যাও তো তুলে নিয়ে যাবো।

সাদা বিলাইয়ের কথা শুনেও আমি কিছু বললাম না। আজ যাই হোক না কেন ঐ ঘরে আমি যাব না। সাদা বিলাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমায় কোলে তুলে নিল। রাদের কোলে উঠে হাত পা ছড়িয়ে লাফিয়ে যাচ্ছি সমানতালে। যেন সাদা বিলাই বিরক্ত হয়ে আমাকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু সাদা বিলাই আমাকে ছাড়লো না উল্টো আরো শক্ত করে ধরে রাখলো। শাশুড়ি মায়ের ঘর থেকে বের হতেই শাশুড়ি মায়ের ষামনে পড়লাম। আমার এই অবস্থা দেখে শাশুড়ি মা রাদের উদ্দেশ্যে বলল,

– কিরে রাদ, মেয়েটা এভাবে জোর করে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?

– তোমার আদরের মেয়ে গিয়েছিল তোমাদের সাথে ঘুমাবে বলে তাই জোর করে আমার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি। আজ যত কাণ্ড করেছে তার সব কিছুর পই পই করে হিসেব নিবো।
আর এমন কঠিন শাস্তি দিবো যেন ভবিষ্যতে আর এমন কান্ড করতে না পারে।

কথাগুলো বলে আর এক মিনিটও দাঁড়াল না আমাকে নিয়ে ঘরের দিকে পা বাড়াল। এদিকে আমি শাশুড়ি মায়ের উদ্দেশ্য বলে যাচ্ছি,

– ওমা বাঁচাও আমাকে! প্রমিস করছি তোমার হ্যান্ডসাম জামাইকে আর জীবনেও কিছু বলব না। এবারের মত বাচিয়ে দাও। তোমার এই নির্দয় ছেলে আমার জীবনটা শেষ করে ফেলবে।

আর কিছু বলতে পারলাম না তার আগে সাদা বিলাই আমাকে ঘরে এনে ঠাস করে বিছানায় ফেলে দিল। আমাকে রেখে দরজা বন্ধ করতে চলে গেল। দরজা বন্ধ করে আমার কাছে এসে শার্টের হাতা ফোল্ট করতে করতে আমার উদ্দেশ্যে বলল,

– এবার তোমাকে কে বাঁচাতে সুন্দরী? আজ আমার হাত থেকে কেউ তোমাকে রক্ষা করতে পারবে না। হয় আজকে ভালোবাসার শাস্তি গ্রহণ করতে হবে নয়তো আজকে আমার মন ভালো করার জন্য কিছু করবে। বলো কোনটা করবে?

সাদা বিলাইয়ের কথা শুনে শুকনো ঢুক গিললাম। আমার জন্য বিলাই এর দেয়া দুইটা শর্ত পূরণ করা খুবই কঠিন। গোল গোল চোখ করে সাদা বিলাইয়ের উদ্দেশ্যে করুন কন্ঠস্বরে বললাম,

– এবারের মত মাফ করে দিন সাদা বিলাই। আর জীবনেও আপনার বাবার সাথে দুষ্টুমি করব না। একটা কাজ করি, আপনার মন ভালো করার জন্য একটা গান গাই,

– আয়মান, তোমার ঐ তিড়িংবিড়িং গান আমি শুনবো না।

– আরে তীড়িংবিড়িং গান গাইবো না সুন্দর গান গাইবো। এমন গান গাইবো যা একদম আপনার সাথে মিলে যাবে, শুনবেন?

সাদা বেলায় এবার বিছানায় শুয়ে আমার উদ্দেশ্যে বলল,
-শোনাও দেখি।

সাদা বিলার কথা শুনে মিষ্টি হাসি হাসলাম। কোমরে ওড়না বেঁধে দাঁড়িয়ে গাইতে শুরু করলাম,

” তুই সাদা আমিও সাদা আমাদের বাচ্চা হবে গাদা গাদা,
বাচ্চার কান্নাতে পাবি না শান্তি। তোর অশান্তিতে আমি পাবো পরম শান্তি।
তুই সাদা আমি সাদা আমাদের বাচ্চা হবে গা,,,,,

চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে গান গাচ্ছি। আমার গান শুনে সাদা বিলাই আমাকে দিলো এক ধমক,

– স্টপ আয়মান, আমি জানতাম তুমি এরকম কিছু করবে। দাঁড়াও তোমার খবর আছে!

সাদা বিলাইয়ের কথা শুনে এক মিনিটে দাঁড়ালাম না। দৌঁড়ে বারান্দায় চলে গেলাম। বারান্দার দরজা লক করে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ত্যাগ করলিম। সাদা বিলাই বারান্দার দরজার কাছে এসে চিল্লিয়ে বলতে লাগল,

– আয়মান দরজা খুলো। আজ তোমার সব দুষ্টুমি আমি বের করব। আর কি গান গাইলে এতক্ষন! আমাদের বাচ্চা হবে গাদা গাদা? আসো বাচ্চা হবার প্ল্যানিং করি।

সাদা বিলাইয়ের কথা শুনে আমি জিভ কাঁটলাম। দুষ্টুমি করতে করতে উল্টাপাল্টা কত কিছু বলে ফেললাম এই ভেবে।

দু’পাশে নিরবতা। আমি লজ্জায় কিছু বলছি না আর ঐ পাশে সাদা বিলাই কি করছে তাও দেখতে পাচ্ছি না। প্রায় পাঁচ মিনিট পর সাদা বিলাই নরম স্বরে আমার উদ্দেশ্যে বলল,

– আয়মান কবে তুমি আমায় বুঝবে? কবে তোমার প্রণয়ে আবদ্ধ করবে আমায়? আমি যে খুবই ক্লান্ত। ধরা দেবে কি! তোমার প্রনয়ের আগুনে পুড়তে ইচ্ছে করছে যে খুব। ভালোবাসি বউ খুব বেশি ভালোবাসি।

রাদের আবেগি মাখা কণ্ঠস্বর শুনে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ছুটে চলে যাই এবং গিয়ে জাপটে ধরে বলি,’

আমিও যে আপনার প্রণয়ে বারবার ডুবে যেতে চাই।

কিন্তু আর বলা হয় না আমাযর। অজানা কিছু এসে আমাকে আঁটকে দেয়। মন বলে এটা ঠিক না তুবা! আর সামনে আগাবি না।

কারোর চিল্লানোর আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখে আমি প্রতিদিনের ন্যায় সাদা বিলাইয়ের বুকে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছি। সাদা বিড়াল বুকের দুইবার নাক ঘষে আবারো চোখ বন্ধ করব ঠিক তখনই আবারও একই কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। কেউ চিল্লিয়ে বলছে,

– রাদ জান আমার! দরজা খুলো। আমি লিজা তোমার লিজা। কত দিন হয় তোমাকে দেখি না! রাদ আমার সুইটি! দরজাটা খুলো তোমাকে দেখব আমি।

মেয়েদের কণ্ঠস্বর শুনে দ্রুতগতিতে চোখ খুলে গেল আমার। ভোর হতে না হতেই নতুন সতীনের আমদানি? শোয়া অবস্থায় ‘ই বিড়বিড় করে বললাম,

“তুমি লিজা আমি খাবারের পিজ্জা ।
তুমি কালো তো আমি ভালো।
আর যার দিক ভালো সাদা বিলাই হবে তাঁরো।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here