#প্রণয়িনী
#আফসানা_মিমি
|১৯তম পর্ব |
হাসপাতালের ৩০৩ নাম্বার রুমে শরীরের অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করছি। চোখ খুলে এক হাত ও পায়ে ব্যান্ডেজ দেখে চুপ হয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু মুখের ডান প্বার্শে হাত স্পর্শ করে থমকে গিয়েছিলাম। আমার ডান গাল যে সাদা কাপড়ে ব্যান্ডেজ করা আছে। আমি যতটুকু জানি এমন অবস্থা হলে কখনও চেহারা আগের মত হয় না যতই সার্জারি করা হোক না কেন। আমার গোঙানির আওয়াজে বাহির থেকে কেউ হন্তদন্ত হয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। মাথা হালকা কাত করে দেখলাম সাদা বিলাই এসেছে। আমার কাছে এসে আমার হাত পায়ে হাত বুলিয়ে বলছে,
– শুভ্রপরী, কি হয়েছে তোমার? কষ্ট হচ্ছে কি খুব? এই যে তোমার সাদা বিলাই তোমার পাশে আছে সদা। কিছু হবে না তোমার। খুব শীঘ্রই আগের মত হয়ে যাবে।
সাদা বিলাইকে কিছু বলতে চাচ্ছি কিন্তু মুখ দিয়ে কিছু বলতে পারছি না। শুধু ও আ করে যাচ্ছি। আমার এই অবস্থা দেখে সাদা বিলাই ভয় পেয়ে যায়। ফোন বের করে ডাক্তারকে আসতে বলে কেবিনে। প্রায় পাঁচ মিনিট পর ডাক্তার এসে আমাকে চেকাপ করে ইনজেকশন পুশ করে দেয় আমার হাতে। কয়েকমিনিটের মধ্যে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাই আমি।
এদিকে তুবা ঘুমিয়ে যেতেই রাদ ছলছল চোখে ডাক্তারের পানে তাকায়। রাদের চাহনি দেখে ডাক্তার আশ্বস্ত করে রাদের উদ্দেশ্যে বলল,
– চিন্তা করবেন না মিস্টার ফায়রাজ রাদ। আপনার স্ত্রী ভয় পেয়েছে তাই এমন করেছে। আমরা ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দিয়েছি। কয়েকঘন্টা পর ঘুম ভাঙলে আপনার স্ত্রীকে কোন বিষয়ে উত্তেজিত হতে দিবেন না। হাসি-খুশি থাকবেন, মজা করবেন তার যে সমস্যা হয়েছে এজন্য তাকে ভরসা দিবেন। এতে আপনার স্ত্রীর মনোবল শক্ত হবে।
ডাক্তার চলে যেতেই ধপ করে চেয়ারে বসে গেল রাদ। রাদকে এখন নিজের কাছে নিজেকে অনেক অসহায় মনে হচ্ছে। একে তো নিজেই তুবার এই অবস্থা দেখতে পারছে না। সহ্য করতে পারছে না তুবার ছটফটানি এখন আবার ডাক্তার বলে গেল তুবাকে ভরসা দিতে। কি করবে সে!
রাদের ভাবনার মাঝেই রাদের মা-বাবা, তুবার মা হাজির হয় কেবিনে। তুবার মা তুবার অবস্থা দেখে হুহু করে কেঁদে উঠে। তাঁর দুষ্টু রাজকন্যার এমন নিস্তব্ধ হয়ে আছে তা মানতে পারছে না তুবার মা। তুবার মা রাদের কাছে গিয়ে অশ্রুমাখা কন্ঠস্বরে বললেন,
– রাদ, আমার মেয়ে এমন নিস্তব্ধ কেন রে? তুবাকে বল না কথা বলতে? ওর কথা না শুনলে যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। কথা বলতে বল বাবা!
তুবার মায়ের আহাজারি শুনে রাদ চুপ করে রইল।
রাদের ভেতরে যে ঝড় বইছে তা রাদ কাউকে দেখাতে পারছে না। রাদ সবাইকে কেবিনে রেখে বের হয়ে গেল।
প্রায় ঘন্টাখানেক পর রাদ তুবার কেবিনে প্রবেশ করতেই দেখে তুবা অসহায় চোখে রাদের পানে তাকিয়ে আছে। রাদ আসাতে সকলেই কেবিন থেকে বের হয়ে যেতে নিলে রাদ সকলের উদ্দেশ্যে বলে,
– তোমরা সবাই বাসায় চলে যাও। আমি এখানে আছি আয়মানের সাথে। মা আম্মুকে দেখে রেখো।
সকলে বিনা বাক্যে চলে যায় হাসপাতাল থেকে। তুবার মা মেয়ের এই অবস্থা দেখে অসুস্থ হয়ে পরেছে।
——-
কথা বলার জন্য মুখ অনবরত চুলকাচ্ছে আমার। কিন্তু বর্তমানে কথা বলতে ভয় পাচ্ছি। মুখ খুললেই যদি তখনকার মত বোবা রোগে ধরে তো কে আমাকে বিয়ে করবে! ধ্যাত আমার তো বিয়ে হয়েই গিয়েছে কি যে উল্টা পাল্টা বকছি! দু’তলা থেকে পড়ে হাত পায়ের হাড্ডির সাথে মাথার হাড্ডিও মনে হয় ভেঙ্গে গিয়েছে তাই উল্টা পাল্টা বকছি। আমার ভাবনার মাঝেই সাদা বিলাই কখন আমার কাছে এসে আমার দিকে ঝুঁকে গভীর দৃষ্টিতে আমার পানে তাকিয়ে আছে খেয়াল করিনি। খেয়াল হয়েছে তখন যখন সাদা বিলাই নিজের শুষ্ক ছিলা-ছালা অধর আমার অসুস্থ অধর ছুঁয়ে দিলো তখন। আপনারাই বলেন আমার মত নাদুসনুদুস ভোলাভালা অসুস্থ মেয়ের সাথে কেউ এমন ব্যবহার করে! আমি একজন হাত-পা ভাঙ্গা ল্যাংড়া মহিলা বলে আমার উপর অত্যাচার করেই যাচ্ছে তো করেই যাচ্ছে। এক হাতে যতটুকু পারছি চড়-থাপ্পড়, চিমটি কেঁটে যাচ্ছি সাদা বিলাইকে। কিন্তু এই পঁচা হনুমান সাদা বিলাইয়ের কোন নড়চড় নাই। ঠিক কত মিনিট পর যে সাদা বিলাই আমাকে ছেড়ে দিয়েছে জানি না। সাদা বিলাই আমার কপালের সাথে কপাল মিলিয়ে মিহি স্বরে বললেন,
– ভালোবাসি শুভ্রপরী, জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত এভাবেই ভালোবেসে যাবো। কোথাও হারাতে দিবো না তোমাকে। একেবারে বক্ষ পিঞ্জরের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখব বলে দিলাম। তুমি জানো! তোমার এই অবস্থা দেখে আমার কেমন অবস্থা হয়েছিল? আমি তো জীবিত থেকেও মরে গিয়েছিলাম। একবার শুধু সুস্থ হও চোখের আড়াল হতে দিবো না বলে দিলাম।
সাদা বিলাইয়ের এক একটা কথায় আমার ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কেন মানুষটা আমাকে এত ভালবাসে! আমি কি আদৌও এসব পাওয়ার যোগ্য! আমার চোখের পানি দেখে সাদা বিলাই আলতো ভাবে পানি মুছে দিয়ে বলে,
– হুস শুভ্রপরী কাঁদে না। তোমার কান্নার দিন শেষ।
সাদা বিলাইয়ের কথায় নাক টেনে টেনে বললাম,
– ভালাবাসি, সেমি সাদা বিলেইয়ের বাবা। অনেক ভালাবাসি।
আমার ভালোবাসা বহিঃপ্রকাশ করাটা দেখে সাদা বিলাই ভ্রু কুঁচকাল, আমার পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল,
– সেমি সাদা বিলাই মানে?
সাদা বিলাইয়ের কথা শুনে বাম হাতেই কপাল চাপড় দিলাম। ফিচেল কন্ঠস্বরে প্রত্তুত্তরে বললাম,
– আরে আপনি বুঝেন নাই! সেমি সাদা বিলাই মানে আমার আর আপনার ছেলে। আপনাকে যদি আমি সাদা বিলেই ডাকি আর হামিকে মিনি সাদা বিলাই, তাহলে আমাদের ছেলে হলে সেমি সাদা বিলাই ডাকবো কারন আমি জানি, আপনার ছেলে আপনার মতই সাদা বিলাই হবে।
আমার কথা শেষ হতেই সাদা বিলাইয়ের পানে তাকিয়ে দেখি সে মিটমিট করে হাসছে। বুঝতে পারলাম সাদা বিলাই এখন আমার থেকে মজা নিবে।
– ইয়া আল্লাহ! আয়মান, তোমার চিন্তা ভাবনা তো সেই দূর পর্যন্ত? আমি তো তুমি ছোট বলে বাচ্চার কথা মাথায় আনিনি। কিন্তু তুমি! যাইহোক একবার সুস্থ হও সেমি, মিলি সব সাদা বিলাইকে আনার ব্যবস্থা করব।
– ছিহ্ মুখে লাগাম দিন সাদা বিলাই।
– লে, তুমি বললে কিছু না। আর আমি বললেই দোষ?এটা ঠিক না আয়মান!
– উফ সাদা বিলাই, আপনি চুপ থাকার জন্য এখন কী নিবেন?
– আপাতত! তোমার কিউট কন্ঠস্বরে আবারও ভালোবাসি শুনবো।
– বলবো না না না।
– তুমি বলবে তোমার হাত পা সহ’ই বলবে। আসবো কি আবার ঐ মিষ্টি ঠোঁটের স্বাদ নিতে!
সাদা বিলাইয়ের হুমকিতে ভয় পেলাম। চোখ বন্ধ করা অবস্থায় আবারো ভালোবাসি বললাম। ভালোবাসি বলার পর সাদা বিলাইয়ের পানে তাকিয়ে দেখি তার দৃষ্টি সন্তুষ্টির দৃষ্টি না। সাদা বিলাই নিজের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল,
– এভাবে হবে না আয়মান! ‘ভালোবাসি রাদ’ এভাবে বলতে হবে।
সাদা বিলাইয়ের কথায় কটমট চোখে তাকালাম। আমার যে সাদা বিলাইকে রাদ বলতে লজ্জা লাগে কীভাবে বলি তাঁকে!
– আমি বলবো না।
– তাহলে আমি আসি তোমার কাছে?
কথাটা বলে সাদা বিলাই চেয়ার থেকে যেই না উঠতে নিবে ঠিক তখনই একটু আওয়াজ করেই বললাম,
– ভালোবাসি রাদ!
আমার কথা শুনে সাদা বিলাই মুচকি হেসে নেত্রদ্বয় বন্ধ করে নেয়। সাদা বিলাইয়ের অধরে এখন তৃপ্তির হাসি। সাদা বিলাইয়ের হাসি দেখে আমিও মুচকি হাসলাম। মানুষটা যে তার শুভ্রপরীর জন্য পাগল। শুধু পাগল না মহা পাগল।
—————-
শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে জঙ্গিরা বোমা হামলার প্ল্যান করেছে যা আমরা গোপন সূত্রে জানতে পেরেছি। জনগণের নিকট অনুরোধ যদি কাউকে আপনাদের সন্দেহ জাগে তো দ্রুতই নিকটবর্তী থানায় যোগাযোগ করবেন। আমরা আরো জেনেছি যে, আতঙ্ককারীরা শহরের বিভিন্ন স্থানে নকল আসল বোমা সেট করে রেখেছে। আমাদের পুলিশেরা এখন পর্যন্ত বত্রিশটা বোমা ডিফিউজ করেছেন। আমাদের ধারণা আতঙ্ককারীরা হাসপাতালে সবথেকে বড়ো বোমা হামলা করতে যাচ্ছে।
টিভির পর্দায় রাদ হাসপাতালের কথা শুনে ভয় পেয়ে যায়। এই জঙ্গিদের সাথে যে তুবার অতীতের কোন সম্পর্ক আছে তা রাদ সেদিনই বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু সঠিক সময় চেয়েছিল তুবাকে জিজ্ঞেস করার জন্য। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তুবার অতীত জানতেই হবে রাদের।
সকল ফর্মালিটি পূরণ করে রাদ তুবাকে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করিয়ে নিয়ে আসে। শুধু রাদ না, রাদের মত শত শত মানুষ পরিজনের সুরক্ষার জন্য হাসপাতাল থেকে চলে যাচ্ছে। সৃষ্টিকর্তার পর যদি মানুষেরা কারোর উপর ভরসা করে তো তাঁরা হচ্ছে ডাক্তার। একজন ডাক্তার হাজারো পরিশ্রম করে রোগীকে সুস্থ করতে চেষ্টা করে। এই হাসপাতাল যদি হয় মানুষের মরনের ফাঁদ তো যে কেউ চলে যাবে সেখান থেকে। হাসপাতাল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার আসার পর পরই হাসপাতালে বোম ব্লাস্ট হয়। অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে থেকেই রাদ দেখতে পাচ্ছে আকাশে ধোঁয়া উড়ছে। না জানি কার সন্তান, কার পিতা-মাতা, দাদা-দাদী এই বোমা হামলায় মারা গিয়েছে।
বাসায় আসতেই নিচ তলায় এক কক্ষে রাদ শিফ্ট হয়ে চলে আসে। তুবাকে খাঁটে ভালোভাবে শুইয়ে রাদ ফ্রেস হতে চলে যায়। রাদ ফ্রেস হয়ে এসেই ফোন নিয়ে বসে পড়ে হাসপাতালের বোমা হামলার খবর জানার জন্য। তুবার সামনে এখন টেলিভিশন চালু করা ঠিক হবে না। বিভিন্ন খবরের মাধ্যমে রাদ জানতে পারে যে, তুবাকে যেই কেবিনে রাখা হয়েছিল ঠিক সেই কেবিনের পাশে ৩০৪ নাম্বার কেবিনে একজন বৃদ্ধ লোক এবং বৃদ্ধ মহিলা ছিলো। তাঁদের খাবারের বক্সেই বোমা ছিলো। এই বোমা হামলায় বৃদ্ধা লোক এবং মহিলা সহ পঞ্চাশ জনের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশের ধারণা করা কথা বিফলে গিয়েছে। কেননা বোমাটা এতটাও বড়ো ছিলো না। বিস্ফারিত বোমার শক্তি ছিলো শুধুমাত্র এক ফ্লোর উড়িয়ে দেয়ার মত এবং তাই’ই হয়েছে। ফোনটা টেবিলের একপাশে রেখে রাদ তুবার বাম পাশে শুয়ে পড়লো। এখন তাঁর। একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। যা তুবার কাছে এসেই সম্ভব হবে।
—————
ছয় মাস পর,
এখন আমি মোটামুটি সুস্থ। গত সপ্তাহে’ই হাতের প্লাস্টার খুলেছে। আর চেহারার প্লাস্টার আরো অনেক আগেই খুলেছে। এই কয়েকমাসে নিয়মিত চেহারা চিকিৎসা করায় অনেকটাই ঠিক হয়েছে। এখন শুধু চেহারায় হালকা দাগ রয়েছে যা ভালো করে তাকালে বুঝা যাবে নয়তো না।
লাঠির সাহায্যে ঘরে আস্তে আস্তে হাঁটতে চেষ্টা করছি। এমন ল্যাংড়া জীবন ভালো লাগে আপনারাই বলেন?
আমার হাঁটাচলার মাঝেই সাদা বিলাইয়ের আগমন ঘটে। আমাকে একা একা হাঁটতে দেখে সাদা বিলাই ধমকে উঠে,
– আয়মান, কত বড়ো সাহস তোমার? একা একা হাঁটছো কেন? মাকে বা হামিকে ডাক দিলেই তো ওরা আসে।
সাদা বিলাইয়ের অতিরিক্ত কেয়ার দেখে ইচ্ছে করে কচুর গাছের সাথে গলায় ফাঁস দেই। আচ্ছা! আমি একা একা হাঁটলে কি পড়ে যাবো? আমি তো লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটছি। আমার সাহায্যকারী লাঠি ছিলো তো! এই কয়েকদিনে সাদা বিলাইয়ের কর্মে হয় রেগে গিয়েছি নয়তো বিরক্ত হয়েছি। সাদা বিলাই আমাকে জভিনেই পা ফেলতে দেয়নি প্রথম প্রথম। তারপর বাবা-মার ধমকে আমাকে পা ফেলতে দিয়েছে এবং আমি হাঁটতে সাহস করেছি।
– আয়মান, নিচে আর থেকো না। খাঁটে এসে বসো! ঐ যে দেখো তেলাপোকা।
সাদা বিলাইয়ের ভয় দেখানো দেখে হাসি আসছে। হাত থেকে লাঠি ফেলে জোরে হেসে যাচ্ছি। হাসা বন্ধ করে বিপদে পড়ে গেলাম। সাদা বিলাইয়ের পানে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠস্বরে বললাম,
” সোয়ামি গো সোয়ামি,
কাছে একটু আসোনি।
পড়বো আমি উঠানে,
ভাঙ্গবে যে কতখানে।”
আমার ছন্দের প্রত্যুওরে সাদা বিলাই আমাকে কোলে তুলে বলল,
কথায় আছে,
ইতর মরে ভিতরে,
খাটাস মরে তেলে।
চলবে………