#প্রণয়িনী
#আফসানা_মিমি
|২০তম পর্ব |
আমার বাবা পুলিশ কমিশনার আবু তালিব ছিলেন সৎ ও একনিষ্ঠ অফিসার। বাবার সততার প্রমাণ তিন তিনটে প্রমোশন ব্যাজ। বাবার রিটায়ার্ড হবার ছয়মাস আগে শহরের এক পুরোনো গোডাউনে কিছু বৈদেশিক অস্ত্রের পাচার সম্পর্কে সংবাদ পায় বাবা তাঁর গোপন সহকারীর সহায্যে। দুপুর বারোটায় বাবা ত্রিশজনের এক দল নিয়ে ঐ গোডাউনে তল্লাশি চালায়। বিভিন্ন ধরনের দেশী বিদেশী পিস্তল উদ্ধারসহ দশজনকে একসাথে গ্রেফতার করেন। এই গোডাউনে তল্লাশি করাই বাবার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল ছিল। গোডাউন থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্রগুলো কয়েকঘন্টার মধ্যেই সাংবাদিকরা খবরের হেডলাইনে প্রচার করতে থাকে। বাবাকে এই কাজের জন্য সবাই বাহ্বা দিতে থাকে।
প্রায় এগারোমাস পর বাবা গ্রামে আসেন আমাদের সাথে দেখা করতে। শহরে তখনও আমরা থাকতাম না। বাবার পুলিশের চাকরি করাতে যেন তাঁর পরিবারের কোন ক্ষতি না হয় এজন্য কখনও নিজের কাছে আমাদের রাখতেন না। বাবা আসার কথা শুনতেই আমরা দুই বোন আর ভাই সর্বক্ষণ মেতে থাকতাম। তিন ভাই বোনদের মধ্যে আমি সবার ছোট এবং আদরের ছিলাম। বড়ো ভাইয়া আর মেজো আপুর জান ছিলাম। বড়ো ভাইয়া সবসময় এটা সেটা দুষ্টুমি করে আমাকে কাঁদাতো আর মেজো আপু তখন মায়ের কাছে নালিশ করত। এভাবেই হাসি মজার মাঝেই আমাদের দিন যাচ্ছিল।
শেষবার যখন বাবা গ্রামে আসেন তখন আমরা সবাই বায়না করেছিলাম শহরে আসব বলে। বাবার হাজারও নিষেধ মানিনি আমরা। বাবা আমাদের সাথে পনেরোদিন গ্রামে ছিলেন। আমরা যেদিন শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হবো ঐদিন আমার মামা মারা যায় যার কারনে আমি আর মা গ্রামে থেকে যাই। বাবা ভাইয়া আর আপুকে নিয়ে শহরে চলে যান যেহেতু বাবার ছুটি শেষ হয়ে গিয়েছিল তাই মেজো আপু আর বড়ো ভাইয়াকে নিয়ে চলে যান।
নানু বাড়ি থেকে পাঁচ দিন পর শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হই আমি আর মা। শহরে প্রবেশ করতেই পথিমধ্যে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য এক রেস্টুরেন্টে উঠি। হাত মুখ ধুয়ে খাবারের টেবিলে অপেক্ষা করছি এমন সময় টেলিভিশনের সংবাদ শিরোনাম দেখে হতভম্ব হয়ে যাই। সংবাদ শিরোনাম এমন ছিল,
– পুলিশ কমিশনার আবু তালিবের বাড়িতে জঙ্গি হামলা। জানা গিয়েছে কিছুদিন আগে অস্ত্র উদ্ধার এবং দশজন আসামি গ্রেফতার করা হয়েছিল এসব জঙ্গি এবং তাঁদের অস্ত্র ছিল। আবু তালিবের জন্য যেহেতু জঙ্গিদের এত লোকসান হয়েছে এজন্য জঙ্গিরা আবু তালিবের বাড়িতে জঙ্গিদের মেইন আস্তানা হিসেবে ঘোষণা করেন। বলা বাহুল্য পুলিশ কমিশনার আবু তালিবের বাড়ির দারোয়ানের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি যে, পাঁচদিন আগে আবু তালিব তাঁর দুই সন্তানসহ এই বাড়িতে উঠেন এবং আজ ভোর পাঁচটা নাগাদ জঙ্গিরা আবু তালিবের বাড়িতে আক্রমণ করে। এতে দারোয়ান ভয়ে পালিয়ে যায় আর জঙ্গিরাও খুব সহজেই বাড়ির ভিতর প্রবেশ করতে পারে।
ডেপুটি কমিশনার আমাদের জানিয়েছেন যে, আবু তালিব এবং তার পরিবারের উদ্ধার করার জন্য সকল রকম চেষ্টা করে যাচ্ছে পুলিশ অফিসাররা।
সংবাদ শিরোনাম দেখে আমার আর মার চোখে অশ্রু ঝরে যাচ্ছে। দৌঁড়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে সিএনজির সাহায্যে বাড়ির সামনে চলে আসি। বাড়ির সামনে শত শত পুলিশ দাঁড়ানো। পুলিশ অফিসাররা আমাদেরকে দেখে কিছু পুলিশ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে যে আমরা কোথায় থেকে এসেছি। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের প্রত্যুওরে আমার মা বলল যে, আমরা আবু তালিবের পরিবার। একথা শুনে পুলিশ আমাদের উদ্দেশ্যে বলে, ‘ আপনারা ভিতরে প্রবেশ করতে পারবেন না। জঙ্গিরা খুবই ভয়ানক আপনাদের মেরে ফেলবে।’ কিন্তু আমরা ভিতরে প্রবেশ করব এই পন করেছিলাম।পুলিশেরা আমাদের আটকাতে আটকাতে বিকেল পাড় করে দিয়েছিল। এর মধ্যেই পরপর দশবারের মত গুলির শব্দ আমরা শুনতে পাই। তখন আমি আর মা চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠি আর আহাজারি করতে থাকি এই বলে, ‘ ওরা আমার বাবা, ভাই-বোনদের মেরে ফেলেছে এই বলে আহাজারি করতে থাকি। কিন্তু পুলিশেরা তাদের কথাতেই অটল তাঁরা আমাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দিবে না। অবশেষে রাত আটটা নাগাদ হাজার মিটিং আলোচনা করার পর পুলিশেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তাঁরা টাইম বোমা দিয়ে দরজা ভাঙবে এবং পরবর্তীতে গ্রেনেড ছুড়ে দিবে। কেননা পুলিশেরা ধারণা করছে, এতক্ষণে জঙ্গিরা আমার পরিবারের মেরে ফেলেছে তাই দেশকে বাঁচাতে তারা এ উদ্যোগ নিয়েছে।
এদিকে আমি আর মা চিৎকার করে যাচ্ছি। পুলিশকে না করছি এমনটি না করার জন্য। কিন্তু তারা আমাদের কথা শুনে নেই। অবশেষে টাইম বোমার সাহায্যে দরজা ভেঙে গ্রেনেড ছুড়ে মারে পুলিশেরা। প্রায় পঞ্চাশ মিনিট পর সবকিছু স্বাভাবিক হলো। যেই পুলিশ আমাকে ধরে রেখেছিল তার হাতে কামড় বসিয়ে আমি দৌঁড়ে ভিতরে চলে যাই আর আমার পেছনে মা সহ অন্যান্য পুলিশরা আসতে থাকে।
ভিতরে প্রবেশ করতেই সারি সারি মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখলাম যার মধ্যে কয়েকজন এখনও আর্তনাদ করে যাচ্ছে আর কয়েক জন মারা গিয়েছে। সবকিছু ফেলে বাবাকে আর আপু ভাইয়াকে খুঁজতে লাগলাম। অতটুকু বয়সে আমি এত কিছু সহ্য করতে পারছিলাম না কিন্তু তবুও মনেপ্রাণে আপ্রাণ চেষ্টা করছি শক্ত থাকতে এবং ভাইয়া আব্বু আপুকে খুঁজতে। আমার মনে হচ্ছিল তাঁরা ভাইয়া আপু এবং আব্বুকে কিছুই করেনি কিন্তু আমার ধারণা ভুল। শয়ন কক্ষে গিয়ে বাবার মৃতদেহ খুঁজে পেলাম এবং তার পাশের ঘরে আপুর বিবস্ত্র অবস্থায় দেখতে পেলাম। আমার মা আপুর আবস্থা দেখে সাথে সাথে একটি ভারী চাদর আপুর শরীরের উপর ছড়িয়ে দিলেন। দরজার সামনে ভাইয়ার মৃতদেহ দেখতে পেলাম। ভাইয়ার মৃতদেহের পাশে রক্তের ছড়াছড়ি। এসব কিছু দেখে আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। চিৎকার করে মাকে বলে যাচ্ছি, ‘ মা আপুকে উঠতে বলো! ভাইয়ার কি হয়েছে? এত রক্ত কেন চারপাশে। আম্মু ও আম্মু বলো না তাঁদের উঠতে!’
বাবার কথা মনে পরায় দৌঁড়ে ঘরে আসতে নিলে কেউ আমাকে মাথার পেছনে আঘাত করে বসে। তাকিয়ে দেখি আহতদের মধ্যে একজন বাবার পানে ক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। আমাকে আবার আঘাত করতে যাবে এমন সময় পুলিশরা এসে যায় কিন্তু পুলিশেরা ঐ লোকটিকে ধরতে পারেনি এর আগেই লোকটি জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পিছন দিয়ে পালিয়ে চলে যায়।
সেই ঘটনার পর মাথায় আঘাত এবং মানসিক আঘাত পেয়ে আমি হাসপাতালে থাকি বছরের পর বছর। হাসপাতালে কিছু ডাক্তার নার্সদের সাহায্যে স্বাভাবিক হতে থাকি। এই কয়েক বছরে ডাক্তার আমাকে ট্রেইন করায় সবসময় হাসিখুশি থাকতে। এতে করে আমার মাথার এবং মনের কন্ডিশন সুস্থ থাকবে।
————-
এতক্ষণ সাদা বিলাইকে আমার কালো অতীত সম্পর্কে বলছিলাম। কিছুদিন আগে খবরের কাগজে ছয়মাস আগের হাসপাতালে জঙ্গি হামলা খবর দেখার পর অসুস্থ হয়ে যাই। আজ যখন আবারও খবরে সেই জঙ্গি হামলার কথা শুনতে পাই তখন ঘাবড়ে যাই। এরপরই সাদা বিলাই জোর করে আমার অতীত সম্পর্কে জানার জন্য।
সাদা বিলাইয়ের বুকে গুটিশুটি মেরে বসে হিচকি তুলে কাঁদছি। সাদা বিলাই কিছুক্ষণ পরপর আমার পিঠে হাত বুলিয়ে মাথায় চুমু খাচ্ছে কিন্তু কিছু বলছে না। মনে হচ্ছে সাদা বিলাই ইচ্ছে করে আমাকে কান্না করতে দিচ্ছে। আমার কালো অতীত যে খুবই ভয়াবহ যা স্মরণ করলে আমি পাগল হয়ে যাই। প্রায় পাঁচ ছয় মিনিট পর সাদা বিলাই আমার মুখ তুলে আমার কপালে অধর ছুঁয়ে বলল,
– হুস এবার চুপ করো শুভ্রপরী, আমি থাকতে কেউ তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আর জঙ্গিরা এবারে কোন ক্ষতি করতে পারবে না দেশের। কেননা বর্তমানে পুলিশ অফিসাররা আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে বোমা ডিফিউজ করতে পারে খুব তাড়াতাড়ি। আর এই ছয় মাসে কোন বোমা হামলার ঘটনা ঘটেনি তারমানে জঙ্গিরা এখন আর সর্বোপরি হামলা করবে না। যা অতীতে হয়েছে তা কখনও ফিরে আনতে পারব না কিন্তু বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ কে সুন্দর করার জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব।
সাদা বিলাইয়ের কথা শুনে কান্না থামিয়ে দেই। দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম সাদা বিলাইকে। এই মানুষটার কাছে আমি সব শান্তি পাই। এই মানুষটার বুকে মাথা রাখলে সুখের রাজ্যে পাড়ি দেই আমি।
আমাদের ভাবনার মাঝে হামি দরজা নক করে বলে,
– মিষ্টি পরী, দরজা খুলো। কি করছো তুমি ভেতরে? আমি তোমার কাছে আজকে ঘুমাবো। আব্বু আম্মু আবার ঝগড়া লেগেছে। তাঁদের কথার যন্ত্রণায় রাগ করে চলে এসেছি।
হামির কথা শুনে মুচকি হেসে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। এখন আমি লাঠি ছাড়াই হাঁটাচলা করতে পারি কিন্তু খুব সাবধানে পা ফেলতে হয় এই আর কি। দরজা খুলতেই একহাতে বালিশ নিয়ে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে হামি।
আমার সেই মিনি সাদা বিলাই এখন বড়ো হয়ে গিয়েছে। এখন আর সে আগের মত আমার সাথে দুষ্টুমি করে না। এখন আমিও বাইরে কারও সঙ্গে দুষ্টুমি করি না একমাত্র সাদা বিলাইয়ের সামনে ছাড়া। আমার উদ্ভট কথা আর দুষ্টুমি না দেখলে নাকি সাদা বিলাইয়ের সারা দিন ভালো যায় না।
ঘরের দরজা আটকাবো এমন সময় মা বালিশ হাতে নিয়ে আমার কাছে এসে বলে,
– রাদ, তুই এই ঘর থেকে বের হো। তোর বাবা জীবনেও ভালো হবে না। সবসময় আমাকে খোঁচাবে আর আমি কিছু বললেই ঝগড়া বাঁধাবে। আজ থেকে আমি এই ঘরেই থাকব।
মায়ের কথা শুনে আমি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছি। এটা কেমন বাচ্চামো এদের আল্লাহ’ই জানেন। সাদা বিলাই আর মিনি সাদা বিলাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি তারা ইনোসেন্ট চেহারা করে খাটে বসে গালে হাত দিয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে। যেন তারা টেলিভিশনে কোন টক শো দেখছে। দুই ছেলের চাহনি দেখে আমার শাশুড়ি মা বালিশ ছুঁড়ে মারে ছেলেদের দিকে। রাগান্বিত কন্ঠস্বরে দুই ছেলের উদ্দেশ্যে বলে,
– তোরা দুইটাও কখনও মানুষ হবি না। দুনোটাই হয়েছে বাপের মত। কই আমাকে শান্তনা দিবি তা না করে গালে হাত দিয়ে বসে আছিস।
শাশুড়ি মা এবার আমার হাত ধরে বাহিরে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
– চল তো তুবা মা! এদের সাথে আর এক মুহূর্তও না। থাকুক এরা এক হয়ে। আমি আর আমার মা এক হয়ে থাকব।
আহাম্মকের ন্যায় শাশুড়ি মায়ের সাথে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি। পেছনে ফিরে অসহায় চোখে সাদা বিলাইয়ের পানে তাকিয়ে বুঝাচ্ছি,
” ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি,
শাশুড়ি মায়ের ধরি কুঁচি।
যাবো না আমি কোনখানে,
সাদা বিলাইকে ছাড়া একমনে।”
চলবে……
[