প্রণয়িনী পর্ব -২২

#প্রণয়িনী
#আফসানা_মিমি
|২২তম পর্ব |

পরিক্ষা শেষ করে ক্যাম্পাসের মাঠে বসে আছি। অপেক্ষা করছি ফারিফতার। আজ শেষ পরিক্ষা ছিলো। এমনিতেও ক্যাম্পাসে বেশি আসা যাওয়া হয়নি আমার। তারমধ্যে সাদা বিলাই নামক প্রাণীটি কঠোরভাবে নিষেধ করে দিয়েছেন যেন অচেনা কারোর সাথে কথা না বলি। কি আর করার! অগত্যা বসে বসে ফোন ঘাটছিলাম এমনিই আমার পাশে এসে কেউ বসলো আর আমার কোলে বাচ্চাকে দিয়ে দিলো। আমার কোলে ছোট ছোট হাত-পা ছড়িয়ে হাসছে পিচ্ছিটা। আমার পাশে থাকা ব্যক্তিকে হচ্ছে ফারিফতার স্বামী আবির। যে আমার পাশে এসে বসেই আমার কোলে তার বাচ্চাকে দিয়ে দিলো। আমিও বাচ্চাকে পেয়ে হেসে উঠলাম। আমার হাসি দেখে অবুঝ বাচ্চাটি কি বুঝলো জানি না সেও সমানতালে হেসে যাচ্ছে আমার সাথে। আবির ভাইয়া এবার আমার উদ্দেশ্যে বলল,

-সে কোথায়?

আবির ভাইয়ার কথা শুনে বুঝতে পারলাম যে, সে ফারিফতাকে খুঁজছে। বউয়ের পাগল হলে যা হয় আর কি। একমিনিট দেখতে না পারলে পাগল হয়ে যায়। আবির ভাইয়ার কথা শুনে বুঝেও দুষ্টামি করে প্রশ্ন করলাম,

– কে কোথায়?

– আরে তুবু! আমার বাচ্চার মা কোথায়? কতক্ষন হয় তাকে দেখি না!

আবির ভাইয়ের কথা শুনে হাসলাম। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখি ফারিফতা ব্যাগে কিছু খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে আসছে।
আবির ভাইয়ার পাশে এসে করে বসে আবির ভাইয়ার উদ্দেশ্যে বলল,

– কি ব্যাপার চেরাগ বাতি! আমার ছানাটা তোমাকে বেশি জ্বালায় নাই তো!

জামাইকে কেউ চেরাগ বাতি বলে সম্মোধন করে তা আজ প্রথম শুনলাম। বাবুর সাথে খেলতে খেলতে ফারিফতাকে ধমকে বললাম,

– জামাইকে কি কেউ চেরাগ বাতি ডাকে! তোর বড়ো হয় না?

আমি যেন এই কথা বলে মহা ভারত অশুদ্ধ করে ফেললাম। আমার প্রশ্নের উত্তরে ফারিফতা আমাকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

– নিজের জামাইকে কি কেউ সাদা বিলাই ডাকে? কোনদিক দিয়ে রাদ ভাইয়াকে বিড়ালের মত লাগে?

ফারিফতার কথা শুনে বুঝলাম, ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছি। ফারিফতাকে এখন কি উওর দিবো ভাবছি,

– কিরে বল?

– আসলে সাদা বিলাইকে সাদা বিলাইয়ের মত লাগে তাই ডাকি। তুইও তো ডাকিস। এবার অফ যা।

আমার কথা শুনে ফারিফতা কিছু বলবে তার আগেই আমার পাশে কেউ এসে বসল। পাশে তাকিয়ে দেখি আমার সাদা বিলাই। সাদা বিলাইকে দেখে খুশিতে ইচ্ছে করছে সবার সামনে জড়িয়ে ধরি কিন্তু তা পারলাম না কেননা আমার কোলে বাবু। সাদা বিলাই বাবুর দিকে একটু ঝুঁকে বাবুর কপালে আলতো করে চুমু খেল। বাবুর গাল টেনে বলতে লাগল,

– আমার মেয়ে হলে তোমার সাথে বিয়ে দিবো। এখন থেকেই শাশুড়ির কোলে আরাম করো, ঘুরার অভ্যাস করো।

সাদা বিলাইয়ের এমন লাগামহীন কথা শুনে সাদা বিলাইয়ের পায়ে চাপড় দিলাম। আমার এই অবস্থা দেখে ফারিফতা বলল,

– হয়েছে আমার বাবুকে আমার কাছে দে। অনেক হয়েছে শাশুড়ির কোলে আরাম করা। এবার দে তো! এখন তোরা ঝগড়া কর দুজন মিলে।

– আমি ঝগড়া করিনি। আমি ভালো মানুষ। এই সাদা বিলাই এসে আমার সাথে ঝগড়া করতে।

– হয়েছে তুবা এবার থাম। রাদ ভাইয়া এই পাগলকে কীভাবে আপনি সহ্য করেন বলেন তো!

ফারিফতার কথা শুনে সাদা বিলাই মাথা চুলকে উত্তর দিলো,

– ওর এসব পাগলামো’ই তো বেশি ভালো লাগে। ওর দুষ্টু মিষ্টি কথা শুনলে ইচ্ছে করে সারাদিন সামনে বসিয়ে রেখে শুনি। আপনার এই পাগল বান্ধবীর সব কিছুই আমার ভালো লাগে।

সাদা বিলাইয়ের কথা শুনে চোখ ভরে আসলো। চোখের পানি লুকানোর জন্য নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিন্তু আমার সাদা বিলাই কীভাবে যেন বুঝে যায়। আমাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে ফারিফতার উদ্দেশ্যে বলল,
– দিলে তো আমার শুভ্রপরীকে কাঁদিয়ে! একদম বকে দিবো কিন্তু ফারু! আমার শুভ্রপরীকে কেউ কষ্ট দিলে তাকে শেষ করে ফেলব।

– আচ্ছা ভাইয়া দুঃখিত। আপনার এই নাদান শুভ্রপরীকে কাঁদানোর জন্য।

পরীক্ষার আজ শেষ দিন। ফারিফতা চলে যাবে শ্বশুরবাড়িতে আর আমি সাদা বিলের সাথে তাই দুপুরে একেবারে লাঞ্চ সেড়ে বের হয়ে আসলাম।

গাড়ি চলছে আপন গতিতে। খোলা জানালার বাতাসে আমার চুলগুলো উড়ছে। আমি জানালার কাঁচ ভেদ করে বাইরের দৃশ্য দেখছি। আমার পাশের জন যে আমার পানে তাকিয়ে আছে তা অনুভব করতে পারছি ঠিকই কিন্তু আমার কেন যেন তাকাতে ইচ্ছে করছে না সেদিকে। সাদা বিলাইকে এখন দেখলেই লজ্জা লাগবে কেননা আমার দুষ্ট সাদা বিলাইটা কিছুক্ষণ আগে এমন কথা বলেছেন যা ভাবতেও আমার লজ্জা লাগছে।

কিছুক্ষণ আগে গাড়িতে উঠেই সাদা বিলাই ফারিফতার বাবুকে দেখে এসে আমার উদ্দেশ্যে বলছিল,

– তোমার তো পরীক্ষা শেষ তাই না! তোমার বান্ধবীর সাথে ছোট থেকে বড়ো হয়েছো ভালো কথা। কিন্তু তোমাদের সবকিছু একসাথে হলো না সেটাই আফসোসের বিষয়।

– কি বলছেন? মাথা ঠিক আছে? ক্লিয়ার করে বলুন।

– আরে শুনো তো! বলছিলাম যে, সে তোমার আগেই মা হয়ে গেল। এখন তোমার উচিত না! তোমার বান্ধবীর সঙ্গ দেওয়া মানে তোমার বান্ধবীর বাচ্চাকে সঙ্গ দেয়া আর কি। আর সে সঙ্গ দেয়া তখনই সম্ভব হবে যখন তোমার একটা ছোট্ট বাবু হবে।

সাদা বিলাইয়ের কথা শুনে এলোপাতাড়ি সাদা বিলাইকে মারতে শুরু করলাম। আমার মারধরের মাঝে সাদা বিলাই আমার দুই হাত নিজের হাতে আবদ্ধ করে কুট করে আমার হাতের আঙ্গুলে কামড় বসিয়ে দিলেন,

– আরে আরে এভাবে মারার কি আছে! যা সত্য তাই তো বললাম! তুমি তো সেদিন বললে যে সেমি সাদা বিলাইকে আনতে হবে তাই বলছি আর কি।

– বলেছিলাম তো কি হয়েছে? এজন্য এভাবে আপনি সরাসরি আমাকে লজ্জা দিবেন? নির্লজ্জ কোথাকার! আপনার সাথে কথা নেই আমার।

আমার কথা শুনে সাদা বিলাই হুহা করে হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলেন। তখন থেকেই আমি চুপ করে বাইরের দৃশ্য দেখছি।

আমাদের বাড়ি আর দুই গলির পার হলেই। বাড়ির কাছাকাছি চলে আশায় সাদা বিলাই গাড়ির স্পিড কমিয়ে দিলেন। কারণ এখানে তিন-চারটে মোড় পাওয়া যায়। আর এই মোড় ঘুরানোর মধ্যেই যদি কোন দূর্ঘটনা হয়ে যায় তাই স্পিড কমিয়ে দিয়েছেন। আমাদের বাড়ি যেতে হলে এখন শুধু একটা মোড় পড়বে। ডানে মোড় নিলেই আমাদের বাড়ির রাস্তা। সাদা বিলাই ডানে মোড় ঘুরাবে এমন সময় কেউ একজন এসে আমাদের গাড়ির সামনে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায়। এদিকে সাদা বিলাইও ঠিক সময় গাড়ি ব্রেক করে ফেলে।

হৃদপিণ্ড এখনো জোড়ে জোড়ে লাফাচ্ছে। জানিনা সামনের মানুষটির অবস্থা কেমন আছে। আচমকা গাড়ি ব্রেক করাতে সাদা বিলাই একহাতে আমাকে ধরে রেখেছে আরেক হাত গাড়ি স্টিয়ারিংয়ে ভর করা। সাদা বিলাই এবার গাড়ি থেকে নেমে সামনে গেল। আমিও সাদা বিলাইয়ের পিছু নিয়ে সামনে এগিয়ে দেখি একজন মধ্যে বয়স্কলোক গাড়ির সামনে পড়ে আছে। সাদা বিলাই মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে লোকটির পালস চেক করল। না! লোকটি বেঁচে আছে শুধুমাত্র জ্ঞান হারিয়েছেন। আর সারা শরীর চেক করে বুঝা গেল যে লোকটি কোনো গুরুতর আঘাত পায়নি। শুধু হাতে পায়ে লেগেছে এই আর কি। আর কিছু না ভেবে সাদা বিলাই আর আমি লোকটিকে ধরে গাড়ি পিছনে বসিয়ে দেই এবং রওনা হই বাড়ির উদ্দেশ্যে।

বাড়িতে এসে লোকটিকে ধরে নিচ্ছি গেস্টরুমে। সাদা বিলাই সাথে সাথে আমাদের পার্সোনাল ডাক্তারকে ফোন দিয়ে বলে আসতে। প্রায় আধা ঘণ্টার মধ্যেই ডাক্তার চলে আসে এবং মধ্যবয়স্ক লোকটিকে ভারো করে চেকআপ করে বলেন,

– ভয়ের কিছু নেই রাদ! শরীরের দুর্বলতার কারণে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে এছাড়া মনে হয়ে কিছুদিন ধরে খায়নি। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করলে সুস্থ হয়ে যাবে আশা করি।

ডাক্তার চলে যেতেই লোকটির জ্ঞান ফিরে আসে। লোকটি নিভু নিভু চোখে সবারদিকে একবার নছর বুলিয়ে কেঁদে উঠে। লোকটির কান্না দেখে আমরা ভরখে গেলাম। চোখের সামনে একজন বৃদ্ধ লোকের কান্না দেখতে খুব খারাপ লাগছে। আমি বিছানার পাশের চেয়ারটিতে বসে লোকটির উদ্দেশ্যে বললাম,

– কি হয়েছে চাচা? কান্না করছেন কেন?

আমার কথা শুনে বৃদ্ধ লোকটি কান্নামাখা কন্ঠস্বরে উওর দিলো,
– আমিতো ভাবছি আইজ মইরা’ই যাইমু। এই গরিবরে দেহার মত কেউ নাই রে! আইজ পাঁচ দিন হয় পেটে দানা পানি পড়ে নাই। তরকারি লাগবো না। দুই মুঠ ভাত দিবা গো! নুন মরিচ দিয়া মাখাইয়া খামু।

লোকটির কথা শুনে কষ্টে আঁখি পল্লবে পানি জমা হলো। চোখের পানি মুছে প্রত্যুওরে বললাম,

– আমি এখনই ভাত নিয়ে আসছি তরকারি দিয়ে। আপনাখে নুন মরিচ দিয়ে খেতে হবে না।

কথাগুলো বলে চাচার জন্য খাবার আনতে চলে গেলাম।
এদিকে তুবা যেতেই বৃদ্ধ লোকটি রহস্যময় হাসি দিলো সকলের আড়ালে।

চলবে………

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here