প্রণয়ের আসক্তি পর্ব -২৮

#প্রণয়ের_আসক্তি
২৮.
#WriterঃMousumi_Akter

সমুদ্র সৈকতে পাগলের মতো নিরব মৃথিলাকে খুজছে।মৃথিলার নাম ধরে খুব জোরে চিৎকার দিয়ে ডাকছে।অথৈ সমুদ্রে নিরবের ডাক প্রতিদ্ধনি হয়ে আবার নিরবের কাছেই ফিরে আসছে।কক্সবাজারের সমস্ত পুলিশ বাহিনী উপস্হিত কিন্তু কোথাও মৃথিলা বা মেধা কাউকে দেখা যাচ্ছে না।চারদিকের মানুষ এগিয়ে এলো, সমুদ্র পাড়ে মানুষের ছড়াছড়ি।গভীর রাতে সবাই নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিলো তখন ই লোকালয় থেকে খানিক টা দূরে নিয়ে মৃথিলাকে মারার চেষ্টা করে মেধা।সমুদ্র পাড়ে লাইট আর লাইট হয়ে গিয়েছে।চারদিকে পুলিশের হুইসেল।মাইকিং ও শুরু হয়ে গিয়েছে।মৃথিলা আর মেধার ছবি সমস্ত জায়গা ছড়িয়ে দেওয়া হলো।কোথাও নেই মৃথিলা।এখানের স্হানীয় মানুষ সহ যত মানুষ ঘুরতে এসেছিলো সমস্ত মানুষ খুজে চলেছে কিন্তু কোথাও নেই মৃথিলা।খুজতে খুজতে সকাল হয়ে গেলো কোথাও পাওয়া গেলো না মৃথিলাকে।শহরের মেইন রোডে পুলিশ পাহারা চলছে মেধা যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে কিন্তু মেধাকেও কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।অবশেষে মৃথিলার লাল বেনারসি নিরব খুজে পেলো।বালি খুড়ে খানিক টা গর্ত করে মৃথিলার বেনারসি পুতে রেখেছে মেধা।নিরবের বুকে প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হলো তাহলে কি মৃথিলার সাথেও এমন কিছু।না এমন হতে পারে না নিরব এমন টা হতে ভাবতে পারছে না।সমুদ্র পাড়ে মৃথিলার গহনা গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।নিরব গহনা গুলো কুড়িয়ে শ্বাসরুদ্ধকর কষ্ট অনুভব করছিলো।মাথা ঠিক নেই নিরবের।সে হয়তো এই মুহুর্তে পাগল হয়ে যাবে।মৃথিলা ছাড়া এই পৃথিবীতে এক সেকেন্ড নিঃশ্বাস নেওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে।একদম ই নিঃশ্বাস নিতে পারছে না নিরব।প্রিয়জন হারানোর ভয়ের মতো পৃথিবীর কোনো কিছু নেই।আজ নিরবের চোখে মুখে ভয় ভীষণ ভয়ে,ভয়ে হৃদপিন্ড ব্লক হয়ে আসছে নিরবের। মৃথিলাকে হারানোর ভয়ে নিরবের মুখটা অসহায় এর মতো লাগছে। যে কেউ দেখলেই বুঝতে পারবে ভেতরে চরম কোনো কষ্ট বয়ে যাচ্ছে।

হঠাত অনেক মানুষের ভীড়ে নিরবের চোখে পড়লো এক ভাবে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছে মেধার বাবা।চোখ মুখ ফুলে উঠেছে কাঁন্নায়।মানুষ টা যাকে পাচ্ছে তাকেই ধরে বলছে ভাই আমার মেয়ে খুজে দিন না ওকে।এই সমুদ্র আমার মেয়েকে কেড়ে নিয়ে যেতে পারে না।কেউ আমাকেও ভাষিয়ে দাও এই সমুদ্রে।কেনো যেতে দিচ্ছো না এই সমুদ্রে।মৃথিলা কারো আমানত আমার কাছে ছিলো।দিনের পর দিন আমি বুকের মাঝে আগলে রেখেছি,পরম মমতায় সেই ছোট্ট শিশুকে আগলে রেখেছি।নিরব এক পা দু’পা করে মেধার বাবার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,কি দেখতে এসেছেন আঙ্কেল?

মেধার বাবা সাথে সাথে নিরবের পায়ে লুটিয়ে পড়লো ভীষণ কাঁন্নায়।বাবা আমাকে মেরে ফেলো তুমি।আমি সহ্য করতে পারছি না এই কষ্ট।মেধা এতটা জঘন্য হতে পারে আমি ভাবতেও পারিনি।আমি মেধাকে পেলাম না।পেলে এক কোপে ওকে মেরে নিজেও মরে যেতাম।আমার বড় আফসোস মৃথিলা কেনো আমার মেয়ে হয়ে জন্ম নিলো না।

মানুষ টার এমন কাঁন্না দেখে নিরব সহ্য করতে না পেরে উঠিয়ে দাঁড় করালো।বললো,শান্ত হন আপনাকে বলার মতো কিছুই আমার নেই।শুধু এই টুকু জেনে রাখুন আপনাকে সন্তান হারা হতে হবে।

–আমি তো সন্তান হারা হয়েই গিয়েছি।আমার আর কোনো সন্তান নেই।

পুরা দিন গড়িয়ে গেলো কোথাও দেখা মিললো না মৃথিলার।মৃথিলা কি সত্যি হারিয়ে গেলো নিরবের জীবন থেকে।

নিজেদের ফুলসজ্জার জন্য সাজানো রুমে ফিরে গেলো নিরব।রুমময় পড়ে আছে হাজারো গোলাপের পাপড়ি।নিরবের বুকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে ক্রমশ, যন্ত্রণার মাত্রা আরো বেড়ে যাচ্ছে।তাদের ফুলসজ্জার সাজানো খাটের বিক্ষিপ্ত অবস্থা দেখে নিরব বুঝতে পারলো মৃথিলার উপর কত বড় অত্যাচার হয়েছে।রুমের সাদা টাইসের উপর রক্ত আলতার ছাপ রয়েছে মৃথিলার পায়ের।ওয়ালে লেগে আছে মৃথিলার হাতের পাঁচ আঙুলের রক্তের ছাপ।এই রক্তছাপ গুলো দেখে নিরবের বুক কেঁপে উঠলো।একজন প্রেমিকের কাছে প্রেমিকার যন্ত্রণা চোখের সামনে সহ্য করা সম্ভব নয়।মৃথিলা নিরবের, স্ত্রী,প্রেমিকা। নিরবের যন্ত্রণা আরো প্রখড় হতে লাগলো।নিরব শুধু এটাই ভাবছে এই আঘাত গুলো নিরব কে করলে নিরব সহ্য করতে পারতো কিন্তু মৃথিলা বাচ্চা মানুষ সে কিভাবে সহ্য করেছে।মৃথিলার বোধ হয় এত বেশী আঘাত লেগেছিলো নিশ্চয়ই আমাকে খুজেছিলো।বাচ্চা মেয়েটার গায়ে এত আঘাত না লেগে সমস্ত আঘাত নিরবের লাগলো না কেনো।কি করেছিলো মৃথিলা অসহায় এর মতো।ছট ফট করছে নিরবের হৃদয়। যত গুলো আঘাত মৃথিলাকে করা হয়েছে তার প্রতিটা আঘাত নিরব অনুভব করছে নিরব।ক্ষণে ক্ষণে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে নিরবের।নিরব ফ্লোরে তাকিয়ে দেখলো,রক্ত দিয়ে আই লাভ ইউ নিরব লেখা।এটা মৃথিলার রক্তেই লেখা।নিরব ফ্লোরে আলতো ভাবে হাত বোলালো।নিরবের চোখের পানি পড়ছে টপ টপ করে ফ্লোরে।এই রক্তের ছাপ ওয়ালে, ছড়ানো ছেটানো ফুল গুলো সাক্ষি দিচ্ছে এই বন্ধ ঘরে মৃথিলা কতটা কষ্ট সহ্য করেছে।নিরব এর ফোনের ওয়াল পেপারে মৃথিলার হাসি খুশি ছবিটা হাসছে।ফোনটা বুকের সাথে চেপে ধরে ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে নিরব বলছে কোথায় হারিয়ে গেলো মৃথিলা,প্লিজ ফিরে এসো।আমাকে এত ভয়ংকর শাস্তি দিও না।পৃথিবীতে অনেক ভয়ংকর শাস্তি আছে কিন্তু তার মধ্য সব থেকে অসহনীয় যন্ত্রণার শাস্তি তুমি ছাড়া বেঁচে থাকা মৃথিলা।আমি তোমার প্রতিটি আঘাতের শোধ নিবো মৃথিলা।কিন্তু তাতে কি হবে তুমি যে কষ্ট টা পেয়েছো সেটা তো মুছে দেওয়া যাবে না।সময় কাটছে না নিরবের প্রতিটা সেকেন্ড যেনো নরকীয় যন্ত্রণার।মৃথিলা তার জীবনে কতটা জায়গা জুড়ে ছিলো মৃথিলার অনুপস্হিতি নিরব কে বোঝাচ্ছে।বুকের মাঝে বিন্দু বিন্দু ভালবাসা গাড় রুপ ধারণ করেছে নিরবের মনে।মৃথিলা ছাড়া এই মহাশুণ্য সে ভীষণ একা।

নিরব সিসি টিভি ফুটেজ চেক করে সম্পূর্ণ ভিডিও দেখলো।কিভাবে মৃথিলাকে নিষ্টুরের মতো আঘাত করেছে মেধা।মৃথিলা নিরবের জন্য কতটা ছটফট করেছে।নিরব মাথার চুলে হাত গুজে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো।সরি মৃথিলা আমি তোমাকে এত বড় চক্রান্তের হাত থেকে রক্ষা করতে পারলাম না।রাগে ফুশে উঠলো নিরব।এক্ষুণি মেধাকে শেষ করে দিতে মন চাইছে নিরবের।মেধাকে কুচি কুচি করে কেটে লবন লাগালেও শান্ত হবে না নিরব।

এর ই মাঝে মেধার নাম্বার থেকে ফোন।নিরব ফোন রিসিভ করেই বললো,অমানুষ কোথায় তুই?তুই যেখানেই থাকিস আমি তোকে খুজে বের করবো।তোর সাথে যেটা করবো পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ শিউরে উঠবে।ভালবাসার জন্য একটা ছেলে কতটা ভয়ানক হতে পারে তুই বুঝবি মেধা।

মেধা অট্ট হাসি দিয়ে বললো,তোমার এই যন্ত্রণা আমার মনের তৃপ্তি মেটালো।একটা নিউজ দিতেই ফোন করলাম। কষ্ট করে খুজেও লাভ নেই নিরব। মৃথিলাকে আমি কুচি কুচি করে কেটে সমুদ্রে ভাষিয়ে দিয়েছি।মাছের পেটে এতক্ষণে হজম হয়েছে মৃথিলা।

নিরব না বলে চিৎকার দিলো।মেধা ফোন কেটে দিলো।মেধার ফোন আবার সুইটস অফ।

পরের দিন সমুদ্রের পাড়ে মাছে খাওয়া একটা মেয়ের মাথা পাওয়া গেলো।চারদিকে খবর ছড়িয়ে পড়লো মৃথিলা মারা গিয়েছে।এই মাথাটা মৃথিলার বলেই মেনে নিলো সবাই।চারদিকে খবরে খবরে ছড়িয়ে গেলো মৃথিলার এই ভয়ানক মৃত্যুর খবর।

কিন্তু নিরবের মন সায় দিলো না।নিরব মেনে নিলো না মৃথিলা আর নেই।নিরবের বিশ্বাস মৃথিলা আছে সে এইভাবে নিরব কে ছেড়ে যেতে পারে না।মৃথিলা আছে,কোথাও না কোথাও আছে।

কেটে গিয়েছে সাতদিন।এই পৃথিবীতে মৃথিলার আপন কেউ নেই।তাই মৃথিলাকে ভেবে রাতের পর রাত কাঁদার মতো কেউ নেই।সবাই মেনে নিয়েছে মৃথিলার মৃত্যু। শুধু বিগত সাত দিন নির্ঘুম ভাবে কেটেছে নিরবের রাত।কখন দিন আর কখন রাত নিরব বুঝতেই পারে নি।নিরবের পাশাপাশি মেধার বাবা ও ভেঙে পড়েছে।রিফাত, সুপ্তি,মুনতাহা নিরবের পাশে আছে সব সময়।

আজ তারা ঢাকা ফিরছে,,,
মৃথিলাকে ছাড়ায় ফিরে যেতে হচ্ছে নিরবকে।নিয়তি কি এতই নিষ্টুর আর নির্মম হয়।নিরবের আম্মু একমাত্র ছেলের পাশে ছায়ার মতো লেগেই আছে।ছেলেকে বোঝানোর মতো ক্ষমতা নেই তার।নিরবের প্রতিটা রাত অসহনীয় যন্ত্রনায় পার হচ্ছে।যে প্রিয়জণ হারিয়েছে সেই বুঝবে এই যন্ত্রণা।

মইন সিদ্দিকী কে ঢাকায় চালান করা হয়েছে আগেই।টানা সাতদিন রিমান্ড চলেছে মঈন সিদ্দিকীর। সে কিছুই স্বীকার করে না।নিজের সমস্ত অন্যায় সে স্বীকার করেছে।মৃথিলার মৃত্যুতে সে ভীষণ খুশি হয়েছে।

কেটে গেছে পনেরো টা দিন।আজ পনেরো দিন পর নিরব ডিউটি তে ফিরেছে।মুখে হাসি নেই,চেহারায় মরুভুমির মতো খা খা অবস্থা। মঈন সিদ্দিকী আর মুনতাহার ডিএনএ ম্যাচ করেছে।নিরব রিপোর্ট নিয়ে মঈন সিদ্দিকীর সামনে ফেলে প্রচন্ড মার ধোর করে।এ কদিনে সর্বোচ্চ রিমান্ড দেওয়া হয়েছে মঈন সিদ্দিকী কে।নিরব কলার ধরে বললো,নিজের মেয়েকে তুই এখনো অস্বীকার করবি?তোর জালে মেধাকে ফাঁসিয়ে মেধাকে দিয়ে ভয়ঙ্কর অপরাধ করিয়েছিস।তোকে যে রিমান্ড দিয়েছি তার থেকে হাজার গুন কড়া শাস্তি মেধা পাবে।আমি শুধু বেঁচে আছি তোকে আর মেধাকে তিলে তিলে শেষ করতে।মেধা আমার কলিজা ছিড়ে নিয়ে গিয়েছে।শুধু একবার মেধাকে পেয়ে নেই আমি।খুব কষ্ট লাগছে মুনতাহার জন্য।মেয়েটা তোর মতো অমানুষ এর মেয়ে।কাল তোর স্ত্রী,সন্তান পরিবার আসবে তোর আসল চেহারা দেখতে।

মঈন সিদ্দিকী হাত জোড় করে অনুরোধ করলো আমার মুন কে আমার কাছে এনোনা তোমার পায়ে ধরছি আমি।

এমন সময় মেধার প্রবেশ করলো।মেধার বাবা বললো রহিম নিজের ভাই এর মতো জেনেছি তোমাকে আর তুমি কিনা এমন করলে।তোমার আড়ালে তোমার এত জঘন্য রুপ ছিলো।আমার মেয়েকে দিয়ে এমন পাপ কেনো করালে।আমার দুটো মেয়েকে এইভাবে শেষ করলে?

নিরব বললো আঙ্কেল চলুন আপনি?এই জানোয়ার কি বলবে আর।

ঘড়িতে রাত দুইটা বাজে।নিরব মৃথিলার ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। তার ফোনের হাজার হাজার ছবি মৃথিলার।
“জানো সবাই বলে তুমি নেই,কিন্তু আমি এটা মানিনা মিথু।তুমি আছো মিথু,তোমাকে যে থাকতেই হবে।চারদিকে সবাই বলে তুমি অনেক দূরে চলে গিয়েছো,আমার ভীষণ কষ্ট হয়।তুমিহীনা আজ কত গুলো নির্ঘুম রাত।আমার জীবন সেই রাতেই থমকে গিয়েছে।জানোতো অক্সিজেন আমার ভিতরে আর প্রবেশ করে না কারণ আমার অক্সিজেন ছিলে তুমি।তোমার চলে যাওয়ায় বদলে গিয়েছে পৃথিবীর সব নিয়ম।এই আমি টা অগোছালো, এলোমেলো হয়ে গিয়েছি।এই যে আমার হাতে এখন জলন্ত সিগারেট। তুমি থাকলে নিশ্চয়ই রাগ করতে,তো এখন কেনো রাগ করছো না।তোমার না থাকা আমাকে সিগারেট ধরতে বাধ্য করেছ।”

ভীষণ মন খারাপে নিরব গান প্লে করেছে অনেক দিন পরে।

O Khuda Bata De Kya Lakeeron mein lickha humne to..
duniya ye jeet gayi dil haar gaya..
nahi socha tha mil kar kabhi honge judaa..

o khuda..
bata de kya lakreeron mein likha
humne to..
humne to bas ishq hai kiya

গান শেষ না হতেই নিরব এর ফোনে কল এসছে।আননাউন নাম্বার।নিরব ফোন রিসিভ করতেই ওপাস থেকে কাঁন্নার আওয়াজ ভেসে আসছে।যে কাঁন্নায় স্তব্ধ হয়ে গেলো নিরব।

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here