প্রণয়ের_পরনতি পর্ব ৮

#প্রণয়ের_পরিণতি
#লেখিকা_সাদিয়া_আফরিন_নিশি
#পর্ব_৮

পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে আপনগতিতে গাড়ি ছুটে চলেছে।
চারপাশে গাছগাছালি।থেকে থেকে মানুষের আনাগোনাও চোখে পড়ছে। দেখতে দেখতে তা আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু একটা দোকানও দেখা যাচ্ছে।
শোঁ শোঁ করে বাতাস বইছে। সেই বাতাস মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করছে মেয়েটি। কখনো চোখ খুলে বাহিরের দৃশ্য দেখছে তো কখনো চোখ বন্ধ করে বাতাস অনুভব করছে।
মেয়েটির পরনে গাঢ় হলুদ রঙের কামিজ সাথে ওরনা আর চুড়িদার কালো রঙের। বাতাসে তার লম্বা চুলগুলো অবাধ্যভাবে উরছে সাথে গায়ে জড়ানো ওরনাটাও।
মেয়েটি বিরক্ত হয়ে বারবার ওড়না আর চুল ঠিক করছে।

অপরপাশের সিটে সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে আনমনেই মিটিমিটি হাসছে একটি ছেলে।
কখনো মেয়েটির মুগ্ধকর দৃষ্টিমাখা মুখ কখনো আবার বিরক্তিমাখা মুখ। দুটোই তার কাছে অসম্ভব ভালো লাগছে।

মেয়েটির ঠিক পাশের সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে আরও একটি মেয়ে। তার এসব প্রকৃতি দেখার সময় নেই। সে তার মতো ঘুমে ব্যস্ত।

ছেলেটির ধ্যান ভাঙলো তারপাশে বসা ছেলেটির ধাক্কায়।

পাশের ছেলেটি:কীরে ওদিকে কী দেখিস

ছেলেটি:কই কীছু না তো

পাশের ছেলেটি:কীছু না তাহলে এদিকে দেখ। চল দুজনে অনলাইন ক্যারাম খেলি।

ছেলেটি:ওকে চল।

পাশের ছেলেটা নিজের সিটে ঠিক হয়ে বসতে বসতে একবার চোখ দিলো অপরপাশের সিটের ঘুমন্ত মেয়েটির দিকে।
একটি বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে বললো, কী মেয়েরে বাবাহ এসে থেকে শুধু ঘুমোচ্ছে (মনে মনে)

তারপর দুজনে ক্যারাম খেলায় মন দিলো।

_________

কলেজে বন্ধদের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে তৃপ্তি। আজ তারা একটা ক্লাস করেছে।বাকি ক্লাসগুলো আর করেনি।
এখন সবাই প্ল্যান করছে কলেজের থেকে কিছুটা দুরে নদীর পারে ঘুরতে যাওয়ার।
রিশির সঙ্গেও তাদের সবার ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। যদিও রিশি ওদের থেকে বড় তবুও সবাই ফ্রেন্ডের মতোই চলাচল করে।

রিশির ক্লাস এখানো শেষ হয়নি। তাই সবাই বসে রিশির জন্য ওয়েট করছে।

হঠাৎ একটা ছেলে এসে তৃপ্তির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,হাই আ’ম সামির।

তৃপ্তি একটু ইতস্তত করে হাত মিলিয়ে বললো আমি তৃপ্তি।

তারপর সামির ওদের সাথে বসে পড়লো

সামির:আমি এই কলেজের স্টুডেন্ট সামির জোয়াদ্দার।তোমরা নিশ্চিয়ই নিউ স্টুডেন্ট।

নীল:হুমম আমরা ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট।
এভাবে টুকটাক পরিচয় পর্ব চলছিল ওদের মধ্যে।

রিশি ক্লাস শেষ করে তৃপ্তির ক্লাসে গিয়ে দেখে ওরা কেউ নেই।ওদের খুজতে খুজতে মাঠে এসে পড়ে রিশি।আর সাথে সাথে রিশি প্রচন্ড রেগে যায়।

(সামির রিশির থেকে ওয়ান ইয়ার সিনিয়র।আগে এই কলেজের ক্রাশ বয় ছিল সামির কিন্তু রিশি আসায় সামির এখন সেকেন্ড ক্রাশ কলেজের। কিন্তু সামিরের চরিত্র খুবই বাজে তাই সব মেয়েরা তার থেকে দুরে থাকে। কিন্তু নতুন কোনো মেয়েকে পেলে সামির তার সাথে বন্ধুত্ব করে তার চরম ক্ষতি করে দেয়।
তৃপ্তিকে নতুন দেখেই সে ওদের সাথে বন্ধুত্ব করতে এসেছে।
রিশি আর সামিরের মধ্যে শুরু থেকেই ঝামেলা। তারা কেউ কাউকে দেখতে পারে না। মুলত রিশি সামিরের ওই বাজে কাজের জন্যই তাকে ঘৃণা করে। আর সামির রিশিকে ঘৃণা করে তার থেকে বেশি সুন্দর হওয়ার জন্য। সে মনে করে রিশির জন্য কোনো মেয়ে এখন আর তাকে পাত্তা দেয় না)

রিশি দুর থেকে দেখতে পায় তৃপ্তি বেশ হেসে হেসেই সামিরের সাথে কথা বলছে।এটা দেখেই রিশি রেগে আগুন হয়ে আছে। নিজের রাগকে একটু কন্ট্রোল করে রিশি ওদের কাছে যায়। সামির রিশিকে দেখে বিরক্ত হয় কিন্তু কিছু বলেনা।সামির সবাইকে বিদায় দিয়ে ওখান থেকে চলে যায়।

সামির চলে যাওয়ার পরে রিশি সবাইকে ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করে যে সামির কী বলছিল?

নীতি উত্তরে বলে পরিচিত হতে এসেছিল।
এটা শুনে রিশি সবাইকে সামিরের সাথে মিশতে মানা করে দেয়।
তৃপ্তি বারবার জিজ্ঞেস করে কেন সামিরের সাথে মিশবে না। কিন্তু রিশি কিছুই বলে না। তৃপ্তিও আর কথা বাড়ায় না।
তারপর সবাই তাদের প্ল্যানের কথা রিশিকে জানায়। রিশিও রাজি হয়ে যায়।

তারপর সবাই হইহই করতে করতে নদীর পারের উদ্দেশ্যে রহনা দেয়।

_______

শুনশান নিরিবিলি জায়গা।
সামনেই প্রবহমান নদী তার নিজ গতিতে বয়ে চলেছে। আকাশে আজকে ভালোই রোদ। তারওপর মধ্য দুপুর বলে রোদের তাপটাও একটু বেশি।
ওরা সবাই একটা বড় বট গাছের ছায়ার নিচে বসল।
প্রকৃতিটা বেশ ভালো লাগছে রিশির কাছে। এমন জায়গায় তার কখনোই আসা হয় না। সে তো আগে পার্টি,ফ্রেন্ড, মেয়ে এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকতো।তৃপ্তি তাকে সবকিছু চিনতে শিখাচ্ছে। একদম পাল্টে ফেলছে।
আসলে আমাদের সমাজে এমন কিছু মানুষ আছে যাদের সান্নিধ্যে থাকতে সবসময় ভালো লাগে।কোনো কারনের দরকার হয় না তাদের সাথে কথা বললেই মন ভালো হয়ে যায়। তৃপ্তিও রিশির কাছে তেমনই একজন মানুষ। তৃপ্তির আশেপাশে থাকলে রিশির সবকিছু ভালো লাগে।

আড্ডা দেওয়ার এক পর্যায়ে ইতু বললো আইসক্রিম খাবে। সবাই ওর সাথে সম্মতি দিল। এই গরমে এমন একটা জায়গায় আড্ডা দিচ্ছে সাথে আইসক্রিম হলে আসলেই মন্দ হয় না।
কিন্তু রিশি কোনো কথা বলছে না কারণ সে আগে কখনো আইসক্রিম খায়নি।খায়নি বললে ভুল খেয়েছে অনেক ছোটো থাকতে। বড় হয়ে এসব আর খাওয়া হতো না।

তৃপ্তি:কী হলো রিশি তুমি কীছু বলছ না কেন।

রিশি:আসলে কী বলবো বুঝতে পারছি না। সেই কোন ছোটো বেলায় আইসক্রিম খেয়েছি। বড় হয়ে এসব আর খাওয়া হয়ে ওঠে নি।তাই বুঝতে পারছি না কী বলবো।

তৃপ্তি:তা খাবে কেন সবসময় তো মেয়েদের নিয়েই পড়ে থাকতে এসব খাওয়ার সময় কোথায়(ধমক দিয়ে)
তৃপ্তির ধমকে রিশি চুপ হয়ে গেল।

তৃপ্তি:আচ্ছা হয়েছে এতো মন খারাপ করতে হবে না। আমাদের সাথে ট্রাই করো দেখবে ভালো লাগবে।

রিশি:ওকে

নীল চলে গেল আইসক্রিম আনতে সাথে করে রিশিকেও নিয়ে গেল।
তারা আইসক্রিম পার্লার থেকে সবার বলে দেওয়া আইসক্রিম গুলো নিলো এবং পছন্দ মতো নিজেদেরটাও নিয়ে নিল।

নীল টাকা দিতে গেলে রিশি নীলকে থামিয়ে নিজে টাকা দেয়। তারপর দুজন ওগুলো নিয়ে ওদের কাছে চলে যায়।

সবাই মিলে আইসক্রিম খাচ্ছে। তৃপ্তি খেয়াল করল রিশি এখনো আইসক্রিমটা ভালো করে ধরতেই পারছে না।
তৃপ্তি রিশির থেকে আইসক্রিমটা নিয়ে প্যাকেট খুলে প্যাকেটটা সুন্দর করে পেঁচিয়ে রিশির হাতে ধরিয়ে দিল।

তৃপ্তি:এই নাও ধরো।এবার আর অসুবিধা হবে না।

রিশি তৃপ্তির কেয়ারিং দেখে খুশি হলো।তারপর তৃপ্তির মতো করে আইসক্রিম খেতে লাগলো।

বিকেল পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে যে যার বাড়ি চলে গেল।

_______

তনয়াদের পৌঁছাতে পৌঁছাতে পরদিন রাত হয়ে গেল।
ইয়া বড় একটা হোটেলে এসে উঠল ওরা।
তনয়া আর তনিমা খুব আগ্রহ নিয়ে হোটেলটি ঘুরে ঘুরে দেখছে।
আগে কখনো এমন জায়গায় আসা তো দুর ওরা চোখেও দেখেনি।

রিশান আর কাব্যর তেমন একটা ইন্টারেস্ট নেই কারণ তারা আগেও অনেক বার এখানে এসেছে। ইন ফ্যাক্ট,তারা যতবারই এখানে আসে এই হোটেলেই উঠে এটাই এখানকার সব থেকে বড় হোটেল এবং এই হোটেলের রেপুটেশনও ভালো।

রাতে সবাই ডিনার করে একসাথে। এখানকার খাবারগুলোও খুবই সুস্বাদু।

কাব্য আর রিশান ব্যবসার
বাইরেও ছোটোবেলা থেকেই বন্ধু।অবশ্য তাদের বাবাদের মাধ্যমে তাদের পরিচয় হয়। কারণ তাদের বাবারাও একে অপরের বন্ধু।

কাব্য আর রিশান একটা ঘরে শিপট হয়ে গেল।
আর তনয়া আর তনিমা একটা ঘরে।

রাতে তনয়া বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখছে। এখান থেকে সমুদ্র বেশি দুরে না। চাঁদের আলো সমুদ্রে পড়ে সমুদ্রের পানিগুলো মুক্তর মতো ঝলমল করছে। হালকা বাতাসে আস্তে আস্তে ঢেউ খেলে যাচ্ছে সমুদ্রের পানি। মাঝে মাঝে জোরে একটা ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কুলের বালুচর।

তনয়া খুব মন দিয়ে উপভোগ করছে পরিবেশটা।
তনিমা এখনো ঘুমিয়ে গেছে। আসলে ও একদমই জার্নি করতে পারে না। অনেক টায়ার্ড হয়ে পড়ে।তাই শুধু ঘুমিয়ে পড়ে।

অপরপাশের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে
এই মনোমুগ্ধকর পরিবেশ উপভোগ করছে আরও একটি ছেলে।হাতে তার গরম ধোঁয়া ওঠা কফি।
কফিতে চুমুক দিতে দিতে ছেলেটির চোখ গেল ওই পাশের বেলকনিতে থাকা মেয়েটির দিকে। মেয়েটি এখনো প্রকৃতি দেখায় মগ্ন। মনে হয় সে সবসময় প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে চায়।

ছেলেটির ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিত হাসির রেখা ফুটে উঠল।সে মনে মনে ভাবল, মেয়েটি আসলেই একজন খাঁটি প্রকৃতি প্রেমী।

ছেলেটি আর সেখানে দাড়ালো না সোজা রুমে চলে গেল।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here