#প্রণয়ের_পরিণতি
#লেখিকা_সাদিয়া_আফরিন_নিশি
#পর্ব_৯
পরদিন সকাল সকাল চারজন নাস্তা করে মিটিংয়ের জন্য রেডি হয়ে রহনা দিল।
মিটিং করতে যাবে কিছুটা দুরের একটা হোটেলে। ওখানে হাসান কোম্পানির এমডি আর চিন থেকে মি:কংসফোর্ড আসবে।
তনয়া একটু নার্ভাস। কারণ আজকে আবার ওই লোকটার মুখোমুখি হতে হবে। তবু্ও সে নিজেকে খুবই প্রিপেইড রাখার চেষ্টা করছে।
তনিমা বোনের অবস্থা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে কিন্তু কিছু বলছে না।
ওরা গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল গন্তব্যে।
রিশান ড্রাইভ করছে তারপাশে কাব্য বসে পাবজি খেলছে।
তনয়া আর তনিমা পেছনে বসেছে।
তনয়া জানালা দিয়ে বাহিরের মনোরম পরিবেশ উপভোগ করছে।
তনিমাও আজ আর ঘুমিয়ে নেই। সেও বাহিরের দৃশ্য দেখছে মাঝে মাঝে তনয়াকে ডেকে ডেকে এটাওটা দেখাচ্ছে।
পাহাড়ি রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে তাদের কার। দুপাশে সারিসারি ঝাউ গাছ।হালকা হালকা কুয়াশার জন্য সামনের দিকটা ধোঁয়া ধোঁয়া দেখাচ্ছে।
রিশান খুব সাবধানে মনযোগ দিয়ে ড্রাইভ করছে। এসব রাস্তা খুবই রিস্কি। একটু বেখেয়াল হলেই অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
_________
রিশি আজ কলেজে আসেনি।রিশান না থাকায় তাকে অফিসের কিছু কাজের জন্য বাবার সাথে অফিসে যেতে হয়েছে। কিন্তু অফিসে গিয়ে তার কিছুই ভালো লাগছে না। মনটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে ছুটে কলেজে চলে যাই। কিন্তু তার কেন এমন লাগছে কিছুতেই সে বুঝতে পারছে না। আগেও অনেক বার কলেজ বাদ দিয়ে নানারকম কাজে গেছে কিন্তু কখনো এমন লাগেনি।
তৃপ্তি কলেজে এসে রিশিকে খুঁজেছে কিছু কোথাও পায়নি।পরে নীল জানিয়েছে রিশি আজ আসবে না। নীলের কাছ থেকে রিশির না আসার কথাটা শুনে তৃপ্তির অনেক খারাপ লাগল।কিছুটা অভিমান হলো রিশির ওপর। তার শুধু মনে হতে লাগল রিশি কেন তাকে একটা ফোন করল না। ফোন করেও তো জানাতে পারত? কেন তার নীলের কাছ থেকে জানতে হলো?
পরবর্তীতে আবার নিজেকে নিজেই মনে মনে বকা দিল।যে রিশি তাকে ফোন করেনি বাট নীলকে তো করেছে। একজনকে জানালেই তো হলো।জনে জনে বলার কী আছে?
এসব ভাবতে ভাবতে নিজেই নিজের উপর চরম বিরক্ত হলো তৃপ্তি।
এরমধ্যেই সামির চলে এলো।সামির এসেই সবাইকে ঘুরতে যাওয়ার অফার করল।কিন্তু কেউ রাজি হলো না কারণটা হলো রিশি।রিশি আগের দিন ওদের মানা করায় কেউই রাজি ছিল না কিন্তু তৃপ্তি বললো সে যাবে।আসলে রিশির ওপর চাপা অভিমানের কারণেই সে যেতে রাজি হয়েছে। সবাই ইনিয়ে বিনিয়ে তাকে বারণ করছে। কিন্তু সে কারো কথাই শুনল না। বাধ্য হয়ে সবাই সামিরের সাথে গেল।
_________
গাড়ি এসে থামলো বিশাল এক হোটেলের সামনে। হোটেলের সামনে বিশাল বড় গেট। চারপাশে ফুলের গাছ দিয়ে ঘেরা। দেখলে মন হবে এটা কোনো হোটেল না একটা পরিপাটি নার্সারি।নানা প্রজাতির ফুল।এর মধ্যে কিছু কিছু ফুল তনয়া চেনে বাকিগুলো চেনেনা। হয়তো বিদেশী ফুল ওগুলো।
বিশাল বড় মাঠ পেড়িয়ে সবাই হোটেলে প্রবেশ করল।
রিসিপশনিস্ট তাদের সাদরে ভেতরে নিয়ে গেল।
সেখানে গিয়ে সবাই একসাথে মিটিং সম্পন্ন করলো।চিন থেকে আসা মি:কংসফোর্ডের বলা কথা শুধু রিশান ছাড়া কেউই বুঝতে পারল না। রিশানই ওনার বলা কথা বাংলায় ট্রাসলেট করে সবাইকে বুঝিয়ে দিল।ডিলটা খুবই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলো।
তারপর তারা সবাই মি:কংসফোর্ডের সাথে লাঞ্চ করার সিদ্ধান্ত নিল।
পুরোটা সময় তনয়া চুপ ছিল।আজ আর সে আগের দিনের মতো অতটা ভেঙে পরে নি।জীবনে এগতে হলে তাকে তো শক্ত থাকতেই হবে।
আর যে তাদের কথা ভাবে না তার জন্য কষ্ট পেয়ে কোনো লাভ নেই।
লাঞ্চ শেষে হাসান কোম্পানির এমডি তারিক হাসান ফিরে এলেন ঢাকায়। মি:কংসফোর্ড থেকে গেলেন ওই দিন, উনি তারপর দিনের ফ্লাইটে চিনে পারি দিবেন।
রিশি আর কাব্য সিদ্ধান্ত নিল দুদিন এখানে বেড়াবে তারপর ঢাকা ব্যাক করবে।এই সিদ্ধান্তে তনিমা অনেক খুশি হলো।তনয়া ও খুশি হয়েছে বাট সেটা বাহিরে প্রকাশ করলো না। রিশান তনয়ার ভাবগতি বোঝার চেষ্টা করলো কিন্তু ফলাফল শুন্য কিছুই বুঝল না।
ওইদিনের মতো সবাই রিসোর্টে ফিরে গেল।বিকেলে ওরা বাহিরে কোথাও গেল না রিসোর্টটাই ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।
_
নিরিবিলি রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে তৃপ্তি। সাথে তার বন্ধুরা সামির একটু আগেই চলে গেছে। এখন তারা বাড়ি ফিরবে।আকাশে মেঘ জমেছে হালকা হালকা বাতাস বইছে এমন পরিবেশে এমন নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে হাঁটার মজাই আলাদা। তাই তৃপ্তি সকলকে বলেছে হেঁটে বাড়ি যাবে।ওদের গ্রুপে সবাই তৃপ্তির কথাই সবসময় মানে।
সামিরের সাথে তারা অনেক জায়গায়ই ঘুরেছে বাট সামির রিশির মতো না। সামিরের চয়েজ ওদের সাথে মিলে না। তাই সবারই একটু আনইজি হচ্ছিল। ঘুড়াঘুড়ির এক পর্যায়ে সামির তৃপ্তির হাত ধরে বসে যেটা তৃপ্তির একদমই ভালো লাগে নি তাই সে নানা অজুহাতে সবাইকে নিয়ে চলে এসেছে। কিন্তু সামির যাওয়ার আগে সবাইকে বলে গেছে আবার নাকি তারসাথে ঘুরতে হবে। আর এবার নাকি তার পছন্দ মতো জায়গায় যেতে হবে।
________
বিশাল বড় বটগাছের উচু ডাল থেকে বেয়ে এসেছে বাহারি রকমের ফুলে মোড়ানো সুন্দর একটি দোলনা। বটগাছটির গাঁ ঘেঁষে বয়ে চলেছে এক বিশাল লেক। লেকের পানি একদম স্বচ্ছ সবুজ।
সেই বটগাছের ফুলে মোড়ানো দোলনায় অবিরত দোল খেয়ে যাচ্ছে মেয়েটি। পরনে তার হালকা ক্রিম কালারের জর্জেট থ্রি-পিছ।ওরনাটা গলার সামনে দিয়ে ঢেকে পেছনে ঝুলছে।
মেয়েটি যখনই দোল দিয়ে সামনে এগোচ্ছে তার পা দুটি তখন প্রায় লেকের পানি ছুঁই ছুঁই অবস্থা। সেই সাথে পেছনের দিক দিয়ে সমান তালে উড়ে চলেছে তার ওরনা আর চুল।মেয়েটির মনে আজ সীমাহীন আনন্দ। ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা টেনেই হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে মেয়েটি ভেসে চলেছে শুন্যে।
বরাবরের মতো এবারও এই মনোরম দৃশ্য নজর এড়ালো না ছেলেটির। লেকটি ছিল রিসোর্টের ঠিক পেছনে। ছেলেটি আসছিল লেকের পারে বসে দক্ষিণা হাওয়ায় মনটা ফ্রেশ করতে।কিন্তু এখানে এসে সে এক অপরুপ মনমাতানো মুহূর্তের সাক্ষী হলো।
ছেলেটি এক ধ্যানে চেয়ে রইলো তার থেকে কিছুটা দুরে শুন্যে ভাসমান সেই মোহনীয় রমনীর দিকে। তার যেন চোখের পলকই পরছে না।
অনেকক্ষণ এভাবে থাকার পর সন্ধ্যা নেমে এলো চারদিকে। মেয়েটি ততক্ষণাত নেমে এলো দোলনা থেকে।
এবার আর ছেলেটি পালিয়ে যেতে পারল না। চোখাচোখি হয়ে গেল চারটি চোখের। হয়তো কিছু কথাও হলো কিন্তু কথা গুলো হয়তো চাপা রয়ে গেল নিরবে।কারণ এই কথার ভাষা তাদের কারোরই জানা নেই।
মেয়েটি আর এক মুহুর্ত দাড়ালো না সেখানে। ছুটে পালিয়ে গেল।
ছেলেটি আস্তে আস্তে এগোলো সেই দোলনার কাছে। দোলনার নিচে দাড়িয়েই মেয়েটির হাতের স্পর্শকৃত স্থানে নিজের দু হাত আটকে নিল।কিছুক্ষণ এভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে লেকের ওপারের সারিসারি নারকেল গাছগুলোর দিকে চেয়ে থাকল।তারপর একসময় একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ওই স্থান ত্যাগ করল।
________
রাতে রিশি বেলকনিতে বসে বসে একের পর এক সিগারেট খেতে থাকল।এমনিতে এসব সে খায় না। বন্ধদের কাছ থেকে শিখেছে খাওয়া। যখন অনেক রেগে যায় রাগ কন্ট্রোল করতে তখন এক প্যাকেট একবারেও শেষ করে ফেলতে পারে। বাড়িতে কেউ তার এই কুকীর্তি জানেনা। জানলে আস্ত রাখত না আর তাকে।লুকিয়ে লুকিয়ে এসব করে।
আজ যখন সামির তৃপ্তির হাত ধরে তখন রিশি ওটা দেখে ফেলে।সে তখন বাবার সাথে কারে করে বাড়ি ফিরছিল অফিস থেকে। হঠাৎ জানালা দিয়ে রাস্তার অপর পার্শ্বের ফুচকার দোকানে ওদের সবাইকে দেখতে পায়। আর সামির তখন তৃপ্তির হাত ধরা ছিল।
বাড়ি ফিরে সে অনেক বার তৃপ্তিকে ফোন করেছে কিন্তু তৃপ্তি ফোন তোলে নি।রাগে আছাড় মেরে ফোনটাও সে ভেঙে ফেলেছে। আর এখন বসে বসে সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে রাগ কমানোর চেষ্টা করছে।
চলবে,