প্রহর শেষে আলোয় রাঙা পর্ব -১২

#পর্ব_১২
#প্রহর_শেষে_আলোয়_রাঙা
লেখিকাঃ #নুুরুন্নাহার_তিথী
“প্রহর শেষে আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস,
তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ।
এই সংসারের নিত্য খেলায় প্রতিদিনের প্রাণের মেলায়,
বাটে ঘাটে হাজার লোকের হাস্য-পরিহাস,
মাঝখানে তার তোমার চোখে আমার সর্বনাশ। ”
বৃষ্টি থামার পর চা-বাগানের ভিতর একটা কাঠ গাছের গুঁড়ির পাশে গিটার রেখে বসে বসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতবিতান পড়ছিল প্রহর। কবিতার এই পঙক্তি গুলো চোখ বন্ধ করে নিজে নিজেই আওড়াচ্ছিল। ঠোঁটকোলে তার মিষ্টি হাসি। সে তো খেয়ালই করেনি কেউ একজন সামনের গাছটার সাথে গা এলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রকৃতিতে বর্ষাকাল। চা-বাগানের সৌন্দর্য অতুলনীয়। বৃষ্টির ছাঁট লেগে থাকে চা পাতার কুঁড়িতে কুঁড়িতে। স্নিগ্ধ অন্তরীক্ষকে সবুজের সমোরোহে মনে হয় রঙ-তুলির ক্যানভাসের কোনো দৃশ্য। মাটি স্যাঁতস্যাঁতে হলেও জামা-কাপড় নোংরা হওয়ার ভয় নেই প্রহরের। কারণ, বাড়িতে গেলে কেউ তো আর বকবে বলে বসে নেই! একাকিত্বে সে বেশ মানিয়ে নিয়েছে। আফসোস থেকে প্রকৃতির কোনো রূপ নিংড়ানো থেকে দমিয়ে রাখে না নিজেকে।

মনে প্রফুল্লতা নিয়ে আঁখিজোড়া খুলে সামনে এক সাদা শাড়ি পরিহিত রমণীর সাক্ষাত পায়। ফুলস্লিভসের ঘটি ব্লাউজের সাথে শিফন শাড়ি। খোলা কোমড় ছাঁড়ানো চুলে কানের পিঠে গুঁজা বুনোফুল ও সিঁথির মধ্যিখানে সাদা পাথরের ব্রোঞ্জ। হাত ভর্তি সাদা কাঁচের চুড়ি, কানে সাদা পাথরের ঝুমকো। প্রহরের অপলক দৃষ্টি সম্মুখে স্থির হয়ে গেছে। শুভ্র কায়ায় শুভ্র রঙ! যেনো ধরিত্রীর বুকে কোনো শুভ্রতার রানী নেমে এসেছে। নিজের চোখের ভ্রম ভেবে দুয়েকবার ভালো করে হাত দিয়ে নয়নযুগল কঁচলে নিয়েছে। কিন্তু ফলাফল শূণ্য! এটা তার ভ্রম না। বাস্তব!

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি প্রহরের অবস্থা বুঝে মিটমিট করে হেসে খানিক এগিয়ে এসে বলে,

“হাই। মাইসেল্ফ আলো শেখ। চা-বাগানে ঘুরতে এসে আপনার কবিতা শুনে থমকে গেলাম তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম। খুব সুন্দর আবৃতি করেন আপনি।”

প্রহরের চোখ-মুখ দেখে আলোর মনে হয়না প্রহর ওর কথা শুনেছে বা বুঝেছে। তাও সে প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে আছে। প্রহরের হুট করে কি হলো নিজেও জানেনা। ফট করে উঠে হনহনিয়ে চলে যেতে লাগল। আলো পিছনে বোকার মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। কী হলো বুঝতে পারছে না সে। কিছুদূর গিয়ে প্রহর আবার পিছনে ফিরে আসলে আলোর ওষ্ঠদ্বয় প্রসারিত হয় কিন্তু প্রহর তো ফিরে এসেছে তার বই আর গিটারটা নিতে। এই দুটো নিয়ে আবার সবুজের মাঝে হারিয়ে গেলো। আলো কিছুক্ষণ তার অচেনা ছেলেটির গমনপথে তাকিয়ে থেকে নিজের মতো করে চা-বাগান ঘুরতে লাগল। বৃষ্টির কারণে মাটি নরম ও ভেজা তাই শাড়ি পড়ে হাঁটতে বেগ পেতে হচ্ছে। কিন্তু তার বহুদিনের শখ ছিল একাকি চা-বাগানের বৃষ্টিস্নাত রাস্তায় সবুজের মাঝে শাড়ি পড়ে হাঁটবে। ইচ্ছে পূরণ করতে চুপিচুপি দারোয়ানকে অনুরোধ করে বেরিয়ে এসেছে।

________প্রহর আলোর দৃষ্টির আড়াল হলেও আলোকে নিজের নজরের আড়াল করেনি। আলোর নাম শুনেই সন্দেহ হয়েছে এটাই তার প্রফেসর ডাঃ আরমান শেখের মেয়ে। চেহারায় কিছুটা সাদৃশ্য আছে। তাইতো আড়ালে শুভ্ররানীকে নজরে নজরে রাখছে।

আলোর ফোনে কল আসে। স্ক্রিনে বাবার নাম দেখে তাচ্ছিল্য হাসে আলো। এতো বছর তো তার থেকে বহুক্রোশ দূরে ছিল। কই তখন তো এতো তলব ছিল না! এখন না বলে বেরিয়েছে বলে মনে পরছে। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে আলো ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলে,

“জি ডাঃ আরমান শেখ। হঠাৎ আমার কথা মনে পরলো কেনো?”

আলো ‘বাবা’ সম্বোধন না করায় আরমান সাহেবের খারাপ লাগলেও প্রকাশ করলো না।
“কোথায় তুমি? তোমাকে মানা করা হয়েছিল না? আমাকে না বলে কোথাও বেরোবে না?”

“হয়েছিল কিন্তু আমি তো তার জন্য ঘরে বন্ধি হয়ে থাকতে পারব না। আমার একা একা ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে। নিজের ইচ্ছের প্রাধান্য দেওয়া তো আমি আপনার থেকেই শিখেছি প্রফেসর ডাঃ আরমান শেখ!”

আরমান শেখ মলিন কণ্ঠে বলেন,
“তোমাকে বারবার আমাকে আমার পদবি মনে করিয়ে দিতে হবে না। আমি জানি আমি কি, কেনো করছি।”

“হুম।”

“কোথায় তুমি?”

“চা বাগানে।”

“বিকেলের শেষ সময় এখন আলো। বাড়ি ফিরে এসো। সন্ধ্যাবেলা ওখানে সেফ না।”

আলো আশেপাশে নজর বুলিয়ে বলল,
“আমার তো চা বাগানের সূর্যাস্ত দেখার ইচ্ছে। সূর্যাস্ত দেখেই বাড়ি ফিরব।”

আরমান শেখ হুট করে রেগে গেলেন। ধ*ম*কে ওঠে বলেন,
“তোমার ধারণা আছে তুমি কি বলছ? সিলেটকে তুমি আমেরিকা মনে করছ। ওখানের পরিবেশের সাথে এখানের পরিবেশের বিস্তর ফারাক। এখানে সন্ধ্যা নামলে আতঙ্ক বিরাজ করে।”

“আমি সেল্ফ ডিফেন্স জানি। নিজেকে রক্ষা করতে পারব।”

আরমান শেখ কপালে হাত ঘষে বিচলিত কণ্ঠে বলেন,
“ব্যাপারটা সেল্ফ ডিফেন্সের না। ধা*রা*লো অ*স্ত্রের মোকাবেলা কিভাবে করবে তুমি? দারোয়ান বলল তুমি শাড়ি পড়ে বেরিয়েছ। জলদি ফিরে এসো। বিয়ের পর হাজবেন্ডের সাথে সূর্যাস্ত দেখো। এখন বাড়িতে ফিরে আসো।”

আলোর একরোখা জবাব,
“ফিরব না আমি। সূর্যাস্ত দেখে তবেই ফিরব।”

খট করে ফোনটা কে*টে দেয় অতঃপর ফ্লাইটমুডে দিয়ে দেয়! প্রহর এতক্ষণ আড়ালে থেকে আলোর সব কথা শুনেছে। নির্জন নিস্তব্ধতায় হালকা শব্দও জোড়ালো শোনায়। প্রহর দেখলো আলো সামনের কিছু জায়গায় পানি জমা সেটা পারি দিতে শাড়ি উুঁচু করেছে। আলোর পায়ে প্লাস্টিকের ওয়াটারপ্রুফ কেডস দেখে ওর হাসি পেলো। মনে মনে বলে,

“বেশ স্মার্ট। আমেরিকায় বেড়ে উঠা মেয়ে স্মার্ট হবে স্বাভাবিক। কিন্তু স্যারের সাথে এতো রুড কেনো? জানতে হবে সব।”

গৌধূলি প্রহর। সূর্য তার রক্তিম আভায় আ*গুনের গোলার ন্যায় আস্তে আস্তে পশ্চিম দিকে হারিয়ে যাচ্ছে। আলো মুগ্ধচিত্তে ধরণীর দিবাকরের শেষ আলোটা উপভোগ করছে। আলোর সাথে সাথে প্রহরও আড়ালে থেকে সময়টা উপভোগ করছে। তার ইচ্ছে ছিল আলোর সাথে গিয়ে দাঁড়াতে কিন্তু আলো যেহেতু সময়টা একা একা উপভোগ করতে চায় তো করুক। মনের আক্ষেপ রাখতে নেই প্রহরের মতে। সূর্য ডোবার পর আলো বড়ো বড়ো কদম ফেলে চা বাগান থেকে বেরিয়ে আসছে। অন্ধকার ক্রমশ বাড়ছে তার সাথে সাথে গা ছমছম ভাবটাও বাড়ছে। সামনেই সোডিয়াম বাতির আলোয় রাস্তা দেখা যাচ্ছে বলে মনে বল পাচ্ছে। হঠাৎ কানে এলো একাধিক পদধ্বনি। ভেজা মাটি বলে শুকনো পাতার শব্দ আসছে না কিন্তু জোরে হেঁটে আসার শব্দ ঠিকই কানে আসছে। পিছনে ঘুরে দেখতে নিলে একটা গাছের শিকরের সাথে বেজে পরে যেতে ধরে কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে সামনে তাকাতেই তিনজন ব্যাক্তিকে দেখতে পায়। পোশাক-আশাকে সভ্য ঘরের বলে মনে হচ্ছে না এমনকি দাঁড়ানোর ভঙ্গীতে সুস্থ মনে হচ্ছে না। একজন বলে ওঠে,

“খা*-সা মা*-ল মাইরি! আসমান থিকা হুরপরি জমিনে নাইমা আইছে দেখ।”

“আরে মা*-ল টারে তো এইখানে আগে দেখা নাই। তা সুন্দরী কোথায় তোমার বাড়ি? পথ হারাইছো নাকি? যাবা আমাদের সাথে পৌঁছায়ে দিবো।”

আলো দুই কদম পিঁছু হটলো। ওদের অশ্রাব্য সম্বোধনে নাক ছিঁটকালো কিন্তু মনের সাহস হারালো না। লোকগুলো যে নে*শায় বুদ হয়ে আছে বোঝাই যাচ্ছে। আলো হালকা ঝুঁকে হাঁটুর নিচে আটকানো চা*বু*কটা আনার চেষ্টা করল। লোকগুলো তো একনাগাড়ে নানারকম বাজে বকেই চলেছে। আলো লম্বাশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে গায়ের সর্বোচ্চ জোড় দিয়ে চা*বু*কটা দিয়ে সামনের দিকে চালালো। লোকগুলোর বুঝে উঠার আগেই ধ*রাশায়ী। মাটিতে পরে কাঁতরাচ্ছে একেকজন। আলো ওদের কথা চিন্তা না করে দ্রুতপদে স্থান ত্যাগ করে রাস্তায় উঠে গেলো। পেছোনে প্রহরের ঠোঁটকোলে ফুটে উঠে অবাকমিশ্রিত হাসি। আনমনেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে,

“ইমপ্রেসিভ!”

চলবে ইনশাআল্লাহ,
রিচেক ছাড়া পর্ব। ভুল ক্রটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here