প্রহর শেষে আলোয় রাঙা পর্ব -১১

#পর্ব_১১
#প্রহর_শেষে_আলোয়_রাঙা
লেখিকাঃ #নুুরুন্নাহার_তিথী
পথিমধ্যে চয়নিকার অ্যা*ক*সি*ডেন্ট ঘটে! ঠিক তার বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেকের দূরত্বের নির্জন স্থানে এক মাইক্রো এসে ধা*ক্কা দিয়ে যায় চয়নিকাকে। রাস্তার ধারে পাথরের সাথে বা*ড়ি খেয়ে খাদে গিয়ে পরে সে। মাথা থেকে র*ক্তের ধারা গড়িয়ে অক্ষিপল্লভে এসে ঠেকেছে। শেষবারের মতো পিটপিট করে ভেজা অক্ষিযুগলে নিজের স্থান দেখে নিলো উদরে হাত দিয়ে বাড়ন্ত ভ্রুণের উপস্থিতি অনুভব করে নিলো। সে বুঝে গেছে সে যদি ভাগ্যক্রমে বেঁচেও যায় উদরে বেড়ে উঠা মানব ভ্রুণটি বাঁচবে না। নিভু নিভু নয়নজোড়া মুদিত হলো। জ্ঞান হারাল চয়নিকা।

সন্ধ্যাবেলা, বেসমেন্টের অন্ধকার আলো-বাতাসহীন বদ্ধরুমে অট্টহাসিতে মেতে উঠল চয়নিকার অতিপ্রিয় মানুষটি। ছাদে সোডিয়াম বাতিটি টিমটিম করে কিছুটা অন্ধকার দূর করার চেষ্টা করে চলেছে। রেড ওয়াইনের গ্লাস হাতে লোকটা স্বগতোক্তি করে,

“সরি ডার্লিং। অ্যাই হ্যাড নাথিং টু ডু। প্লিজ ফরগিভ মি। চিন্তা করো না। তোমাকে আর কিছু করতে হবে না। সোজা উপরে চলে গিয়ে নিজের কাজের হিসেব দিতে থাকো। তোমার মনোবল দুর্বল হয়ে গিয়েছিল যে। প্রহরের সন্দেহের তালিকায় তুমি অনেক আগে থেকেই ইনক্লুডেড। আজ সে অবশ্যই তোমার থেকে কথা বের করতে চাইতো তাই তোমাকেই সরিয়ে দিলাম। আমার কাজে সাহায্য করার জন্য তোমাকে আমি সবসময় ভালোবাসব কিন্তু নিজের স্ত্রীর জায়গায় কখনও না। এবার দেখি প্রহর শেহমাত কি করে আমি পর্যন্ত পৌঁছায়!”

___________

হসপিটালের কেবিনে প্রহর আলোর হাত ধরে নিরব হয়ে নিষ্পলক ভাবে বসে আছে। কিছুক্ষণ আগেও চয়নিকার বাড়িতে গিয়ে চয়নিকাকে খুঁজে এসেছে কিন্তু পায়নি। মিসেস রেহমানকে জিজ্ঞেস করলেও তিনি বলতে পারেন না বলে জানিয়েছেন। প্রহর আনমনে বলতে থাকে,

“খালাজানকে রেখে গিয়েও কিছু করতে পারলাম না। আমার ৫০% সন্দেহ ছিল চয়নিকার উপর। চয়নিকার তোমাকে ফাঁসাতে চাওয়া, তোমার সাথে অকারণে রুড হওয়া। আরও কিছু আছে যা আমাকে সন্দেহ করতে বাধ্য করেছিল। মিসেস রেহমান আমাকে বলেছিল কেউ একজন আমার ক্ষতি চায় যার জন্য চয়নিকাকে বেছে নিয়েছে কিন্তু বুঝিনি এমন কিছু হবে। ওরা সবাই জানে তুমি আমার দুর্বলতা। কিন্তু তুমি তো আমার দুর্বলতা নও। তাই না? আরমান স্যারের দুর্বলতা তুমি ছিলে ও আছো কিন্তু তুমি আমার শান্তি। আমি ডঃ আরমান শেখ নই। যার সব আপনজন একে একে হারিয়ে যায় তার দুর্বলতা কোনো মানুষ হওয়া সম্ভব না। আমাকে দমাতে পারবে না ওরা। তোমাকে খুব খুব জলদি সুস্থ হতে হবে। প্রহরের আলো স্ট্রং। সে ঠিক কামব্যাক করবে। তোমাকে আমি আমেরিকা পাঠিয়ে দিবো। যে বা যারা তোমাকে আমার থেকে দূরে করে আমার শান্তি কেড়ে নিতে চায় তাদের নাগালের বাহিরে থাকবে তুমি।”

ডাক্তার কেবিনে প্রবেশ করে হালকা শব্দ করলে প্রহর উঠে দাঁড়ায়। রক্তিম আঁখিজোড়া একটু কঁচলে নেয়। ডাক্তার বলেন,
“মিস্টার প্রহর ধৈর্য ধরুন। আপনার ওয়াইফ খুব দ্রুত সুস্থ হবেন বলে আশা রাখি । তার অ্যান্টিডোটের প্রতি রেসপন্স ভালো। পেশেন্ট কোমা থেকে কামব্যাক করে অনেক সময় দীর্ঘসময় লাগে।”

প্রহর লম্বাশ্বাস নিয়ে বলে,
“আমি আলোকে আমেরিকা নিয়ে যেতে চাই ডাক্তার। এখানে ওর লাইফ রিস্ক আছে। রেনডম পিপোলের যাতায়াত হসপিটালে হতেই থাকে। আমি সার্বক্ষণিক থাকতে পারব না। আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য যেতে হবেই তখন শ*ত্রুরা আমার অনুপুস্থিতিতে আলোকে মে* রে ফেলতে চাইবে।”

ডাক্তার কিছুক্ষণ ভাবেন অতঃপর বলেন,
“নিয়ে যেতেই পারেন কিন্তু আপনার শত্রুরা কি আমেরিকা যেতে পারবে না? আপনি চাইলে আপনার বাড়িতে হসপিটালের সেটআপ করিয়ে দিতে পারি। সেখানে আপনার বিশ্বস্ত কাউকে দেখাশোনায় রাখবেন।”

প্রহর চিন্তায় পরে যায়। ডাক্তারের কথাটা ফেলেও দিতে পারছে না। শ*ত্রুরা তো আমেরিকাতে ঠিক যেতে পারবে এবং সেখানে দেখাশোনায় প্রহর স্বশরীরে থাকবেও না। প্রহর ডাক্তারকে বলে,
“ঠিক আছে। আপনি সব ব্যাবস্থা করুন। আমি আজকেই ওকে নিয়ে যাব।”

ডাক্তার সম্মতি দিয়ে চলে যায়।

____________
“হ্যাঁ ডার্ক বাটারফ্লাই, আমরা মিস চয়নিকাকে খাদ থেকে তুলে নিয়ে এসেছি। উনার পালস ছিল কিন্তু মিসক্যারেজ হয়ে গেছে।”

“সেন্স ফিরবে কি?”

“মনে হচ্ছে না। মাথার ইনজুরিটা গাঢ়ো। ২৪ ঘণ্টায় জ্ঞান না ফিরলে কোমা নিশ্চিত। ডাক্তার একটু আগে দেখে গেছেন।”

“কেউ যেনো চয়নিকার পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া অবধি ওর খবর না পায়। ওর থেকে সব জানতে হবে। খেয়াল রেখো।”

ডার্ক বাটারফ্লাই নামক ব্যাক্তিটি কল কেটে দিলো। তার সহচররূপে থাকা অনুচররা চয়নিকাকে রাখা রুমটা আটকিয়ে বেরিয়ে আসে।

_________
আলোকে নিয়ে রাত দশটার মধ্যে বাড়ি ফিরেছে প্রহর। হসপিটালের নার্সরা সব সেটআপ করে দিয়ে গেছে। সাথে শিতল ও নিয়াজও আছে। নার্সের থেকে কখন কি করতে হবে তা শিতল জেনে নিয়েছে। নিয়াজ প্রহরের সাথে গার্ডেনে বসে আছে।

“আমি ভাবতে পারছি না চয়নিকা এসবে আছে। চয়নিকা তোকে পছন্দ করে বলে জানতাম।”

প্রহর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“আমিও তাই জানতাম। এখন বিশ্বাস করলি তো? এখন চয়নিকা আমাদের ক্লু দিতে পারত কিন্তু ওকেই পাচ্ছি না।”

নিয়াজ চিন্তিত হয়ে বলে,
“আমার মনে হয় আমাদের আরেকবার চয়নিকার বাড়িতে যাওয়া উচিত। ওর পারসোনাল ল্যাপটপ, মোবাইল, পেনড্রাইভ এসবে কিছু তো পাবো। কোনো হিন্টস।”

প্রহর নিঃশব্দে উঠে যায়। নিয়াজ বোকার মতো তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারলো না হঠাৎ প্রহর উঠে গেলো কেনো! দুই মিনিটের মধ্যে প্রহর হাতে করে একটা ল্যাপটপ নিয়ে আসে। নিয়াজের সামনে রেখে বলে,

“এতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট লক!”

নিয়াজ হতাশ হয়ে বলে,
“পেনড্রাইভ পেলে ভালো হতো। ল্যাপটপটা রেখে দে। চয়নিকাকে খুঁজতে হবে।”

প্রহর দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়।

★★★বহু বছর পর মা-মেয়ের সাক্ষাত তাও এমন এক পরিস্থিতিতে যে প্রাণ ভরে উপভোগ করতে পারছে না। রঞ্জনা খালা আলোর কাছেই বসে আছেন আর শিতল রান্নাঘরের কাজ সামলাচ্ছে। হালকা কিছু বানিয়ে নিয়াজ ও প্রহরকে ডাকতে এলো।

“তোমরা খেতে এসো। হালকা কিছু খেয়ে নাও।”

প্রহর বলে,
“নিয়াজকে নিয়ে যা। আর খালাজানকে কিছু খাওয়া। উনার ডায়াবেটিস আছে। দুপুরে ঘটনা ঘটার পর কিছু খাননি তাছাড়া রোদে অনেকক্ষণ ছিলেন। সুগার ফল করতে পারে।”

শিতল নিষ্প্রভ কণ্ঠে বলল,
“মা তো আলোর পাশ থেকে সরছেই না। আমার ডাকেও সাড়া দিচ্ছে না।”

“উনি নিজেকে দোষী ভাবছেন। উনি হসপিটালেও কয়েকবার আমার হাত ধরে কান্না করে ক্ষমা চেয়েছেন।”

প্রহরের উদ্দেশ্যে নিয়াজ বলে,
“তুই নিজে খাবার নিয়ে গিয়ে বল। মা নিজেকেই গিল্টি ভেবে চলেছেন যেখানে উনার কোনো দোষ ছিল না। বরং উনি না বললে অ্যান্টিডোট পেতে দেরি হতো আর আলো হয়ত….!”

“হুম। যাচ্ছি। শিতল আমাকে খাবার বেড়ে দে। তোরাও খেয়ে নে।”

শিতল মলিন কণ্ঠে বলে,
“তুই খাবি না?”

“খিদে নেই।”

কথাটা বলেই প্রহর বাড়ির ভেতরে চলে যায়। শিতল ও নিয়াজ প্রহরের যাওয়ার পানে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিয়াজ বলে,
“প্রহরের ইচ্ছে ছিল কয়েকদিনের মধ্যে আলোকে নিয়ে আমেরিকা যাবে তারপর আলোকে সেখানে রেখে এসে নেপাল যাবে। আমিরের ল্যাপটপে নেপালের ম্যাপে হিমালয়ের কাছে ক্রস করা। কিন্তু আমিরকে কঠোরভাবে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে বলেছে এই ম্যাপটা তার কাছে এক প্রাইভেট মেইল থেকে এসেছে। এই ম্যাপ দেখেই সে দেশ ত্যাগ করে ইন্ডিয়া হয়ে নেপালে যেতে চাচ্ছিল।”

“সেখানে কি তবে আরমান স্যারকে পাওয়া যাবে?”

“জানিনা। কিন্তু আলোর সাথে যা হলো তাতে প্রহর কিভাবে যাবে বুঝতে পারছি না।”

“আমরা আছি তো। আলোর সুরক্ষা আমরা করতে পারব।”

নিয়াজ হতাশস্বরে বলে,
“দেখো প্রহর কি করে। ও যা করবে বুঝেই করবে। আমরা সবসময় ওর পাশে আছি।”

শিতল মুচকি হেসে নিয়াজের কাঁধ জড়িয়ে ধরল।

__________
রঞ্জনা খালাকে জোর করে প্রহর কিছু খাওয়াতে সক্ষম হয়। এখন উনাকে ঘুমানোর জন্য শিতলের সাথে পাঠিয়েছে। প্রহর ব্যালকনির রাতের হীমশিতল হাওয়ায় নিজের হতাশা উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টায় আছে। ভাবতে থাকে চার বছর আগের কথা,,

ফ্ল্যাশব্যাক★★★
চার বছর আগে প্রহর সবে মাস্টার্স শেষ করেছে। ওর রিসার্চের ফ্যাকাল্টি হচ্ছেন ডঃ আরমান শেখ। অনার্সে থাকাকালীনই আরমান শেখ প্রহরকে নিজের রিসার্চ স্টুডেন্ট হিসেবে পছন্দ করেছিলেন। প্রহরের ডেডিকেশন দেখে তিনি পছন্দ করেছিলেন। প্রহর জানতো ডঃ আরমান শেখও একজন পরিবার ছাড়া নিঃসঙ্গ লোক। তাই প্রহর নিজের একাকিত্ব অনুভব করে ডঃ আরমান শেখের সঙ্গ দিতো। যেদিন প্রহরের মাস্টার্সের পরীক্ষা শেষ, সেদিন ডঃ আরমান শেখ প্রহরের হাতে একটা পেনড্রাইভ দিয়ে বলেন,

“প্রহর, তুমি আমার সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র তাই তোমাকে বিশ্বাস করে এটা দিলাম। আমার অবর্তমানে এটার রক্ষা করবে। কেউ জেনো না জানে। এমনকি তোমারও খোলার প্রয়োজন নেই।”

প্রহর অবাক হয়ে বলে,
“কিন্তু স্যার এতো গুরুত্বপূর্ণ হলে এটা আমাকেই বা দিচ্ছেন কেনো?”

তখন আরমান শেখ হাসি দিয়ে বলে,
“তুমি ছেলেটা একটু উঁড়ো উঁড়ো স্বভাবের হলেও মনের ও দায়িত্বের দিক দিয়ে সবসময় এগিয়ে। আমার প্রিয় আরেকটা কিছুর দায়িত্বও তোমাকে দিবো। সেটাও তোমার সারাজীবন আগলে রাখতে হবে।”

“কী স্যার?”

“আমার আলো!”

প্রহর তখন হেসে ওঠে অতঃপর বলে,
“আপনার আলো তো আমি কবেই নিজের করে নিয়েছি। আপনার জ্ঞানের আলোতে আজ আমি এই পর্যায়ে।”

আরমান শেখ নিঃশব্দে হাসেন। তিনি প্রহরের কাঁধে হাত রেখে বলেন,
“আমার জ্ঞানের আলো তুমি পেয়েছ ঠিক এখন তোমাকে আমার মেয়ে আলোর দায়িত্ব নিতে হবে। সারাজীবনের জন্য।”

প্রহরের অবস্থা তখন আকাশ থেকে পরার মতো!
“স্যার! আপনার মেয়েও আছে? কই কখনও তো বলেননি তাছাড়া আমি আপনার বাড়িতে অনেকবার গিয়েছি। কখনও দেখিওনি। একটা ছবিও না।”

আরমান শেখ মুচকি হেসে বলেন,
“সব জানতে পারবে। আগে আলোকে নিয়ে আসি।”

চলবে ইনশাআল্লাহ,
দুঃখিত আমার স্টাডি প্রেশার চলছে বলে দুইদিন দিতে পারিনি। ভুল ক্রটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here