প্রহেলিকা পর্ব ২৩+২৪

#প্রহেলিকা
#পর্ব_২৩
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

মৃদুমন্দ বাতাস বইছে চারিদিকটায়। চাঁদের সাথে মেঘেরা লুকোচুরি খেলছে আকাশে। হাইওয়েতে শাঁ শাঁ করে অবিরাম ছুটে চলছে গাড়ি। হালকা আলো গাড়ির ভেতরটায় ঝিলিক দিচ্ছে। সেই আলোর ঝলকানিতে জেহেরের রাগী চেহারাটা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে, যা আড়চোখে দেখছে ইনশিতা।

হাত আঠালো হয়ে আছে তার। পরনের জামাতেও তরকারির ঝোল লেগে আছে। অস্বস্তি ঘিরে ধরেছে ইনশিতাকে। পেছনের সীটে কালো গোলাপের বড় একটা বুকে অবহেলায় পড়ে আছে। গাড়ির লাইট অফ। গাড়ির মধ্যকার নিস্তব্ধতা ভালো লাগছে না ইনশিতার। প্রায় একঘন্টা ধরে এমন নিস্তব্ধতার সাথে থাকতে হয়েছে তাকে। আর কতক্ষণ কে জানে?

ইনশিতা বার কয়েক ঢোক গিলল। তখন জেহের ইনশিতাকে সবার সাথে খাবার টেবিলে দেখে কোনো কথা না বলে ইনশিতাকে এঁটো হাতেই টেনে উঠিয়ে নিয়ে বের হয়। ওঠার সময় অসাবধানতায় ঝোল পড়ে যায় ইনশিতার জামায়। জেহেরকে দেখে সকলে ভড়কালেও কিচ্ছুটি বলার জন্য মুখ খুলতে পারেনি। ইনশিতা খেয়াল করেছিল জেহেরের হাতে কালো গোলাপের খুব সুন্দর একটা বড় বুকে। গাড়িতে উঠিয়ে প্রচন্ড রাগ সহকারে বুকেটা পেছনে ফেলে রাখে জেহের। সেই তখন বের হয়েছিল, এখন পর্যন্ত রাস্তাতেই তারা। কোথায় যাচ্ছে ইনশিতা নিজেই জানে না। কথা বলার চেষ্টা করেছিল কয়েকবার। তবে অজানা কোনো কারণবশত কথাগুলো গলা অবধি এসেই জ্যাম ধরে আটকে গেছে।

প্রায় বিশ-পঁচিশ মিনিটবাদে ইনশিতা খেয়াল করল গাড়িটা হাইওয়েতে নেই। একটা সুনসান জঙ্গলের মধ্যকার সরু রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে। ভ্রু কুঁচকে কৌতুহল নিয়ে জানালার বাহিরে মাথা বের করল ইনশিতা। রাস্তার দুপাশে ঘন জঙ্গল। সোডিয়ামের আলোটুকুও নেই, তবে গাড়ির হেডলাইটের আলোয় বুঝতে পারছিল ইনশিতা। জঙ্গল থেকে অদ্ভুত সব আওয়াজ ভেসে আসছে কানে, যা ইনশিতার শরীরে ভয়ের উদ্রেক বাড়াতে সক্ষম।

আচমকা ইনশিতার মাথায় হাত দিয়ে চেপে ভেতরে ঢুকাল জেহের। হতচকিত হয়ে ইনশিতা তাকাল জেহেরের দিকে। জেহের রাগী চোখে দেখছে তাকে। বেশ ধমকের স্বরে বলল,

-“এভাবে গাড়ি থেকে মাথা বের করা কতটা রিস্কি জানো তুমি?”

বলেই জেহের সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলো। ইনশিতার বিরক্তি লাগল। এইখানে তো আর কোনো গাড়ি চলছে না যে অ্যাক্সিডেন্ট হবার আশংকা আছে। সে নিজেও ঠোঁট বেঁকিয়ে জেহেরের কথাটা নকল করে ব্যঙ্গোক্তি সুরে বলল,

-“উঁউঁহ…এইভাবে গাড়ি থেকে মাথা বের করা কতটা রিস্কি জানো তুমি? উউউঁউউঁ…”

ইনশিতার এমন ব্যঙ্গ্যার্থে জেহের চোখ পাকিয়ে তাকালে চুপসে যায় ইনশিতা। ঠোঁটে তর্জনী ঠেকিয়ে চুপ করে থাকে।

.

.

জিহাদ অস্থির হয়ে পায়চারি করছে নিজের রুমে। একটু আগে লোকদের দিয়ে খবর নিতে চেয়েছিল জেহের কোথায় আছে। তবে জানা যায়, তারা জেহেরের গাড়িকে হাইওয়েতে দেখার পর আর খুঁজে পায়নি। সেই চিন্তায় জিহাদ অস্থির হয়ে গিয়েছে। কোথায় গেল ইনশিতাকে নিয়ে জেহের? তাও আবার এত রাতে! চিন্তারা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে মস্তিষ্ককে।

দ্রুত পা চালিয়ে জেবার রুমের দরাজায় নক করল। রাফিদের হাসিমুখের ছবি দেখে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিল জেবা। আর হারিয়ে যাচ্ছিল অনাগত ভবিষ্যতের সুখে, যেখানে রাফিদের সাথে সংসার গড়ার স্বপ্নে বিভোর সে। করাঘাতে স্বপ্নে ব্যাঘাত ঘটে। দরজা খুলে দেখে চোখেমুখে অস্থিরতা জড়ানো জিহাদ দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে ঢুকে জিহাদ প্রথমেই জেবাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,

-“ইনশিতা আর ভাই কোথায় গিয়েছে কিছু জানিস? খোঁজ পেয়েছিস?”

জেবা কপাল কুঁচকে বলে,

-“আজব! আমি কী খোঁজ নিয়েছি না কি, যে জানব? আর এমনিতেও জেহের ভাইয়ের খোঁজ নেওয়ার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই।”

শেষের কথাটায় সমস্ত রাগ ঢেলে বলল জেবা। জিহাদ বিরক্তিকর আওয়াজ করে চলে যেতে চাইলে জেবা বাঁধা দেয়।

-“তুই এত অস্থির হচ্ছিস কেন? গেছে হয়ত কোথাও, বউ নিয়ে ঘুরতে গেছে বোধহয়।”

জেবার মুখে ইনশিতাকে জেহেরের বউ সম্বোধন করাটা বুকে আঘাত হানলো জিহাদের। আজ যদি জেহের না থাকতো তাহলে হয়ত ইনশিতা আজ জিহাদের বউ হতো। কষ্টটা নিজের মনে সুপ্তাবস্থায় রেখে দ্রুত পদে বেরিয়ে গেল জেবার রুম থেকে। জেদ, রাগ আর কষ্টের মিশ্র অনুভূতিতে মনটা পুরে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।

.

.

গাড়ি এসে থামে অন্ধকার এক উঠোনে। হেডলাইটের আলোয় সামনে একটা ঘর দেখা যাচ্ছে। জেহের গাড়ি থেকে নেমে কোথায় যেন চলে যায়। হঠাৎ ভয়টা ঝেঁকে ধরে ইনশিতাকে। একা গাড়িতে তার মনে হয় এই বুঝি পেছন থেকে কেউ এসে কল্লা কেটে নিয়ে যাবে কিংবা জানালার কাঁচে বড় বড় লাল চোখের রক্ত মাখানো ভুত কামড়ে দিবে তাকে। ইনশিতা ভয় পেয়ে জোরে জোরে জেহেরকে ডাকতে চাইল। তবে ভয়ে কথাগুলো দলা পাকিয়ে মিনমিনে আওয়াজে বের হলো। ইনশিতা একটু শক্তি যোগার করে ডাকল জেহেরকে। সেই মুহুর্তেই ইনশিতার পাশের দরজা খট করে খুলে একটা হাত তাকে ধরে।

চোখ বন্ধ করে গলা কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল সে। তবে অবাক হলো এই ভেবে যে আওয়াজ শোনা গেল না কেন? ভয়ে ভয়ে এক চোখ টিপে খুলে দেখল, তার মুখ বন্ধ কারো হাত দ্বারা। আর মুখের সামনে আবছা আলোয় কারো হৃদয় কাঁপানো দৃষ্টির চেহারা দেখতে পাচ্ছে সে।

-“চেঁচাচ্ছ কেন? ভয় পাচ্ছ বুঝি?”

ইনশিতা কিছু বলতে পারল না। জেহেরের হাত মুখ থেকে সরিয়ে দিলো। তার শরীর প্রচন্ড কাঁপছে। জেহেরের হঠাৎ এত সামনে আসাতে নিজেকে খাপছাড়া লাগছে। কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে।

জেহের ইনশিতার ভয়াতুর চেহারা দেখে অন্য এক ঘোরে পড়ে গেল যেন। নিজের মুখটা আরেকটু বাড়িয়ে ঠোঁট ছোঁয়ালো ইনশিতার গালে। কেঁপে উঠে ইনশিতা পরনের জামা মুঠ করে ধরল। বুকটা ধকধক করছে। ধুকপুকানি আরো বাড়িয়ে দিতেই বোধহয় জেহের ইনশিতাকে কোলে তুলে নিলো। নিজেকে সামলাতে জেহেরের শার্ট খামচে ধরল। জেহেরের শরীর থেকে মনমাতানো ঘ্রাণ ভেসে আসছে।

ইনশিতাকে কোলে নিয়েই ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল জেহের। ইনশিতা ঘরের বাহিরটা ঠিকমতো খেয়াল করতে পারল না। এমনকি ভেতরটাও কিছু আন্দাজ করতে পারছে না কারণ ঘরে একটা টিমটিমে আলোর হলুদ বাতি জ্বলছে। তবে বোঝা যাচ্ছে ঘরটা হয়ত বেশ বড়সড়ই হবে।

একটা রুমে এনে ইনশিতাকে খাটে শুইয়ে দিলো জেহের। চোখে এখনো ঘোর লেগে আছে। ইনশিতা তা ভালো করেই বুঝতে পারছে। জেহেরের কালচে নীল চোখের মায়াজালে বোধহয় সে নিজেও বেঁধে যাচ্ছে।

জেহেরের অপলক দৃষ্টিতে নিজ অজান্তে ডান হাতটা জেহেরের গালে ছোঁয়ায় ইনশিতা। সেই মুহুর্তেই জেহের কিছু একটার গন্ধে ঘোর থেকে বেড়িয়ে উঠে গালে হাত দেয়।

জেহের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখল ঝোলে মাখামাখি হয়ে আছে তার পুরো গাল। বিরক্ত নিয়ে বলল,

-“শিট!”

ততক্ষণে ইনশিতার নিজেরও ঘোর ভেঙে গেছে। ইনশিতাও এবার খেয়াল করল নিজের এঁটো হাতে। মনে মনে নিজেকে ধমকে সুধালো,‘ভাগ্যিস, ঝোল মাখা হাত জেহেরের গালে লেগেছে। নয়তো আজ একটা কান্ড ঘটেই যেত। ইশ! কী যে করতে যাচ্ছিলাম!’

জেহেরের ইচ্ছে করছে দুনিয়ার সমস্ত তরকারির ঝোলকে এক্ষুনি কিছু একটা করে ফেলতে। আজ এই কারণে তার রোমান্টিক মুডটার বারোটা বেজে গেল। এই ঝোল যদি আজ না থাকতো তাহলে হয়তো রোজকে সে নিজের করে ফেলত।

রাত এগারোটা বেজে পঁয়তাল্লিশ। ইনশিতা নিজের জামা খুলে জেহেরের একটা সাদা শার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার পরে চাদর জড়িয়ে বসে আছে বিছানায়। নিজের সাথে যুদ্ধ করে জেহেরকে তখন বলেছিল এটা কোথায় আর এখানে কেন নিয়ে এসেছে? জেহেরের উত্তর ছিল, এটা তার নিজস্ব বাগানবাড়ি। যেটা একমাত্র সবার অজান্তে কিনে নিয়েছিল। আর মাঝে মাঝে এখানে এসেই থাকত সে। আর এখানেই এখন থেকে রোজ থাকবে।

ইনশিতা এমন কথা শুনে মাথা ঘুরে যাওয়া থেকে নিজেকে থামাল। কাউকে কিছু না বলে হুট করে এখানে এসে থাকাটা একদমই মেনে নিতে পারছে না সে। তাও আবার বাড়িটা লোকালয়ের বাহিরে। তার উপর, তার প্রয়োজনীয় জিনিস কিছুই নেই। আবার তার উপর, এখানে একা একা থাকতে পারবে না।

জেহের তখন ধমকে বলেছিল,

-“আমি নিজেই নির্জন জায়গা দেখে বাড়িটা নিয়েছি। তোমার প্রয়োজনীয় জিনিস আমি এনে দেব। আর আমি সবসময় চাইতাম তুমি আমার সাথে একা থাকো। কেউ যাতে ধারে কাছেও না আসে। তার জন্য পারফেক্ট প্লেস এটা। তোমাকে আমি বলেছিলাম নিচে গিয়ে কারো সাথে না মিশতে। বাট তুমি কী করলে? সবার সাথে হো হো করে হেসে খাওয়া দাওয়া শুরু করে দিলে। আমার সাথে কথা বলার সময় তো কখনো এত হাসোনি। হাসি কেন, ঠিকমতো কথাও বলোনি। অথচ ঠিকই তখন সবার সাথে হেসেছিলে। তোমার সাথে কথা বলার জন্য তোমার ফেভারিট কালো গোলাপ নিয়ে গিয়ে দেখি তুমি অলরেডি আমাকে রেখে সবার সাথে মজামাস্তি করছো। সেখানে জিহাদ তোমার দিকে কীভাবে তাকিয়েছিল! অার তুমি, আমি ছাড়া অন্য কারো সাথে হাসবে, কথা বলবে, খাবে, কী করে মেনে নিই? আমার রাগ হয় না? সো তখনই ডিসাইড করেছি তোমাকে নিয়ে এখানে চলে আসবো, এবং এসেও গিয়েছি।”

ইনশিতা মুখ অন্ধকার করে কিছু বলতে চেয়েছিল, জেহের আবারও ধমকে থামিয়ে বলেছিল,

-“নো মোর ওয়ার্ডস।”

ইনশিতাও কিছু বলতে পারেনি। পরে ইনশিতাকে জেহের নিজের একটা শার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার দিয়েছিল। ইনশিতা পরতে চাইছিল না, তবে ঝোল মাখানো জামা পরে থাকতেও অসুবিধা হচ্ছিল। তাই পরে নিয়ে বিছানায় চাদর জড়িয়ে বসে আছে। ঘরটা ঘুরে দেখতেও পারল না সে।

.
বন্য প্রানীর অদ্ভুত আওয়াজে ইনশিতার ঘুম ভেঙে গেল। পাশে জেহের ঘুমিয়ে আছে হাত পা ইনশিতার উপর দিয়ে। একদম দড়ির মতো করে পেঁচিয়ে ধরেছে তাকে। আর জেহেরের মাথা ইনশিতার গলার মধ্যে দেওয়া। দীর্ঘ গরম নিঃশ্বাস ইনশিতার গলায় পড়ছে। কোনোরকম ছাড়িয়ে উঠে পড়ল ইনশিতা। ঘড়িতে চারটা বাজে।

রুম থেকে বেরিয়ে এলো সে। একতলা ঘর। সে ঘর ঘুরে দেখল এবার। এখানে বেডরুম দুটো আর একটি বড় ডাইনিং রুম। ডাইনিং রুমের সামনেই ছাদ থেকে নীচ পর্যন্ত কাঁচ দিয়ে বাঁধানো। ওপাশে লম্বা বারান্দা দেখা যাচ্ছে। ইনশিতা এগিয়ে গেল বারান্দায়। বারান্দায় পাতা রয়েছে কয়েকটি চেয়ার টেবিল। এখান থেকে লাফ দিয়েও মাটিতে নামা যাবে। সামনে জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে জঙ্গল আর বারান্দার মাঝে একটি ছোটোখাটো উঠান রয়েছে যেখানে হালকা আলোর বাল্ব জ্বালানো। পুরো উঠান সবুজ ঘাসে মোড়ানো। হালকা শীত শীত করছে। শীত নামতে আর কতদিন? বেশি দিন নেই বোধহয়। রেলিং ধরে ইনশিতা আজগুবি সব চিন্তা ভাবনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

রোজের উপস্থিতি টের না পেয়ে জেহের তড়িঘড়ি করে উঠে বসল। ঘুম উড়ে গেল তার। হাত দিয়ে আরেকবার চেক করে দেখল, আসলেই কোথাও নেই রোজ। টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে একবার বারান্দা আর বাথরুম চেক করেও পেল না রোজকে। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল জেহেরের।

দরজা খোলা দেখে ব্যস্ত পায়ে রুমের বাহিরে বেরিয়ে আশপাশ খোঁজ নিতে গিয়ে দেখল, ডাইনিংয়ের সামনের বড় বারান্দায় কেউ একজন দাঁড়িয়ে। এবার সে বারান্দার সামনে এসে দাঁড়াল। রোজ একপাশ হয়ে কার্ণিশে কনুই ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে কোনো এক ভাবনায় ব্যস্ত। কাঁচের দরজা ঠেলে নিঃশব্দে রোজের পেছন গিয়ে দাঁড়াল। রোজের চুলের ঘ্রাণে মন উতলা হয়ে গেল তার। থ্রি কোয়ার্টার পরায় হাঁটু থেকে নিচ পর্যন্ত উন্মুক্ত হয়ে রয়েছে যা জেহেরের ভেতরটা নাড়িয়ে দিলো। এক হাঁটু ভেঙে নিচে বসে আচমকা ইনশিতার উন্মুক্ত পায়ে অধর ছুঁইয়ে দিলো জেহের।

পায়ে ঠান্ডা স্পর্শ পেতেই কেঁপে গিয়ে পেছনে ফিরল ইনশিতা। নিচে চোখ নিয়ে দেখল জেহের তাকিয়ে আছে তার পায়ের দিকে। কয়েক কদম সরে গিয়ে দাঁড়াল ইনশিতা। ছিঃ ছিঃ! জেহের কী করছে? তার পায়ে…! জেহের দাঁড়াল ইনশিতার সামনাসামনি। চোখে মাতাল করা চাহনি। সেই চাহনি দেখে ইনশিতার বুক কাঁপতে লাগল।

ইনশিতার বুকের উপর শার্টের একটি বোতাম অজান্তেই খোলা রয়েছে। যেখানে কালচে নীল চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো হঠাৎ। উন্মুক্ত গলা আর বুক যেন জেহেরকে সম্মোহিতের মতো টানছে। মাথা ঝিমঝিম করে উঠছে। চারপাশের সবকিছুকে ধোয়াসা লাগছে। নিজেকে সামলাতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে জেহেরের। সেই কষ্টকে আর বাড়তে দিলো না সে। ইনশিতার কোমড় পেঁচিয়ে গলায় মুখ ডুবিয়ে অধর ছোঁয়াতে লাগল। চোখ বন্ধ করে ফেলল ইনশিতা। তপ্ত নিঃশ্বাস ইনশিতার ভেতরে শিহরণ জাগিয়ে দিচ্ছে। জেহেরের হাত বেসামাল হয়ে পড়েছে ইনশিতার সারা শরীরে।

ইনশিতা বাঁধা দিতে চাইল। তবে বাঁধা দিতে সাহস পাচ্ছে না সে। অদৃশ্য এক শক্তি শেকলের মতো বেঁধে রেখেছে তার সমস্ত সাহসকে। রোজের বাঁধা না পেয়ে জেহের যেন আরও প্রশ্রয় পেয়ে গেল রোজকে কাছে পাওয়ার। ইনশিতাকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে নিয়েই বারান্দার চেয়ারে বসে পড়ল। শার্টের ভেতরে জেহেরের হাত ঢুকে পড়েছে। আবেশে ইনশিতার সমস্ত শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। চোখ মুদে এলো। অদ্ভুত ভালোলাগায় হৃৎপিন্ড তুমুল গতিতে ছুটে চলছে। জেহের গলা থেকে মুখ তুলে তাকাল রোজের দিকে। জেহেরের চোখে চোখ রাখতেই ইনশিতা নিজেও সম্মোহিত হয়ে গেল। হারালো নিজের হিতাহিত জ্ঞান। জেহেরের নীল চোখের মণি ঘোলা হয়ে আছে। এ যেন অন্য এক জেহেরকে দেখছে সে।

ইনশিতার ওষ্ঠাধর ক্রমাগত কাঁপার কারণে কাল বিলম্ব না করে নিজের গোলাপী অধরযুগলের মাঝে নিয়ে নিলো জেহের। নিস্তব্ধ পরিবেশে মৃদু বাতাসে মনটা অন্যরকম ফুরফুরে লাগছে ইনশিতার। ইচ্ছে করছে সায় দিতে জেহেরের ভালোবাসায়। কোনো অন্যায় তো আর হবে না। জেহের তো তার স্বামী। তার অর্ধাঙ্গ।

ইনশিতার সাড়া পেয়ে জেহের গভীরভাবে কাছে টেনে নিলো ইনশিতাকে। ঠিক সেই মুহুর্তেই ঘেউ ঘেউ করে কুকুর ডেকে উঠল। চমকে উঠে ইনশিতা দাঁড়িয়ে গেল। হঠাৎ এমন আওয়াজে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। রোজকে উঠতে দেখে জেহেরের সম্মোহনে ব্যাঘাত ঘটে। ঘাড়ের রগ ফুলে উঠল। দপ করে জ্বলে উঠল চোখ। ঘাড় কাত করে দাঁতে দাঁত চেপে একবার দেখল কুকুরটির দিকে। কুকুরটি একদম উঠোনের মাঝখানে গলা উঁচিয়ে ডাকছে। জেহেরের মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল। বাম হাত দিয়ে ঘাড়ের পেছনটা চেপে ধরল।

ইনশিতা তাড়াতাড়ি শার্টের বোতাম লাগিয়ে রুমে ছুট লাগাল। তার প্রচুর লজ্জা লাগছে সাথে রাগও হচ্ছে। এমন একটা মানুষ যে তাকে সবসময়কার জন্য বন্দী করতে চায় তার ডাকে সাড়া দিলো কীভাবে সে? স্বামী বলেই না-কি অন্য কোনো অনুভূতির কারণে নিজের মধ্যকার ইনশিতাকে হারিয়েছিল সে? উফফ!

.#প্রহেলিকা
#পর্ব_২৪
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

জিহাদ আর জেবা বসে আছে রাফিদের সামনের সোফায়। রাফিদের ডান হাতে, পায়ে আর মাথায় ব্যান্ডেজ। এই দু’সপ্তাহে সে ঠিক হলেও পুরোপুরি ঠিক হতে পারেনি। হাঁটতে চলতে কারো না কারো সাহায্য লাগেই। গতকালই হসপিটাল থেকে রিলিজ পেয়েছে।

প্রথমে জিহাদই কথা শুরু করল,

-“পুলিশকে মিথ্যা বলেছিলে কেন?”

রাফিদ কপাল কুঁচকায়।

-“আমি কাউকে মিথ্যা বলিনি। যা হয়েছিল তাই বলেছি।”

-“তোমার কী মনে হয়, আমরা সত্যিটা জানি না? তোমার চেয়ে আমরা বেশি ভালো করে জানি আমাদের ভাইকে। সে কেমন, কার কী করতে পারে এই ব্যাপারে তোমার ধারণা আমাদের চেয়ে কম। পুলিশকে সত্যিটা বললে আজ ভাই হয়তো জেলে থাকতো আর ইনশিতাও রেহাই পেত।”

-“আপনার ভাই কোনো প্রকার এভিডেন্স রাখেনি। তাহলে পুলিশ কীভাবে তাকে ধরত?”

-“তোমার জবানটাই আসল প্রমাণ ছিল। কিন্তু সেটা তুমি করোনি। হোয়াই?”

-“তবুও কোনো না কোনো প্রমাণ দরকার ছিল। সেটা যাই হোক, আমি যখন এখানেই কেস ক্লোজ করে দিয়েছি সেখানে আপনারা এত আগাচ্ছেন কেন?”

জিহাদ বিরক্তিতে কপালে হাত ঠেকায়। সে ভালোই বুঝতে পারছে রাফিদ ইচ্ছে করেই পুলিশকে মিথ্যা বলেছে। রাফিদ কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তার এই অবস্থা কে করেছে? উত্তরে রাফিদ বলেছিল, থাইল্যান্ড থেকে দেশে আসার পর সে রাস্তায় একটা ঝামেলায় জড়ায় আর মারামারি লেগে যায়। এই মিথ্যে শুনে জিহাদ আর জেবার, উভয়েরই চোখ কপালে উঠে যায়। অহেতুক মিথ্যা বলার কোনো কারণ পায় না তারা। যদি সত্যি বলত যে জেহেরই এসব করেছে তাহলে অন্তত কিছুটা হলেও পুলিশি ব্যবস্থা নেয়া যেত। আর সেই কারণে জেবা আর জিহাদ রাফিদের কাছে এসেছিল কেন সে মিথ্যা বলেছিল জানতে। তবে এখানেও রাফিদ কথা ঘোরানোর চেষ্টা করছে। যেন সে ইচ্ছে করেই পুলিশকে সত্যিটা জানাতে চায় না।

রাফিদের পায়ে যন্ত্রণা চিলিক দিয়ে উঠছে। এখানে বসে থাকতে ভালো লাগছে না তার। তবুও বসে আছে বিরক্তি নিয়ে। এই জিহাদ ছেলেটাকে দেখলেই তার জেহেরের কথা মনে পড়ে যায়, মনে হয় জেহের নিজেই তার সামনে বসে আছে। তবে জেহের আর জিহাদের মধ্যের পার্থক্যও ভালোভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। জেহেরের বসার ধরণটা বেশ রাজকীয় স্টাইলে, হাঁটা চলা, বসা সবকিছুতেই আলাদা একধরনের অ্যাটিটিউড আছে যেটা সহজেই জেহেরকে জিহাদের থেকে আলাদা করে। আর জিহাদ ছটফটে স্বভাবের, একটু পরপরই অস্থির হয়ে ছটফটানি শুরু করে দেয় এমন। এমনিতেও সে জিহাদকে দেখতে পারে না কারণ জিহাদ ইনশিতাকে ভালোবাসে আর একবার মিসবিহেভও করেছিল। তাই যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে সে।

জিহাদ উঠে দাঁড়ায়। তার দেখাদেখি জেবাও দাঁড়ায়। জিহাদ রাফিদের সোফার দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে রাফিদকে উদ্দেশ্যে করে কটাক্ষ করে বলে,

-“ইউ নো হোয়াট? তোমার বুদ্ধিটা এখনো হাঁটুর নিচে। নাহলে ইনশিতাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মতো ফালতু ভাবনা মাথায়ও আনতে না। কমপ্লেন খাও। বুদ্ধি বাড়বে।”

বলেই দরজার দিকে এগোতে লাগল। এই কথাটি যেন রাফিদের আগুনে ছাই ঢালতে সক্ষম। রাফিদ নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে বাম হাতে সোফার পাশে থাকা ফুলদানি নিয়ে একদম জিহাদের পা বরাবর ছুঁড়ে মারল। পড়তে পড়তে দরজা ধরে বেঁচে গেল জিহাদ। আগুন গরম চোখে রাফিদের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গিয়ে কলার ধরল। অবস্থা বেগতিক দেখে জেবা জিহাদকে ছাড়াতে লাগল।

-“ওর অবস্থা এমনিতে ভালো না। তার উপর তুই আর ঝামেলা পাকাস না ভাই, প্লিজ।”

জিহাদ শুনলো না তার কথা। সে নিজেও রাফিদকে দু’চোখে দেখতে পারে না। জেহেরকে কিছু করতে না পারলেও রাফিদকে সে এক ঘুষিতেই কপাত করতে পারত। সেদিন যদি রাফিদ মাঝ রাস্তায় তাকে অজ্ঞান করে ইনশিতাকে নিয়ে চলে না যেত তাহলে হয়ত অন্য রকম জীবন গড়তে পারত। এই রাফিদই যত নষ্টের মূল। রাফিদকে শেষ করে দেওয়ার ইচ্ছা মনের মধ্যে পুষলেও জেবার কারণে কিছু করতে পারেনি সে। একমাত্র জেবার জন্যই রাফিদ এখনো বেঁচে আছে, নইলে এতদিনে রাফিদের টিকিটারও কেউ খোঁজ পেত না।

জেবা বহুকষ্টে রাফিদকে জিহাদের থেকে ছাঁড়াল। জিহাদকে টেনে বের করিয়ে আনলো ঘর থেকে। তবে যাওয়ার আগে জোরে শব্দ করে দরজায় ধাক্কা মেরে গেল জিহাদ। রাফিদ তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে বলে,

-“আমার বুদ্ধি হাঁটুর নিচে? আর তোরা তো সব গোবর মাথায় নিয়ে চলিস। শালারা!”

একটুবাদে রাফিদের সামনে হঠাৎ জেবা এসে দাঁড়াল। রাফিদ ডান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল জেবার দিকে। জেবা আস্তে করে‘ভালো থাকবেন। টেক কেয়ার।’বলে চলে গেল।

রাফিদ ঠাঁয় বসে রইল। জেবাকে সে এই দু’সপ্তাহ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেছে। সে জানে না কেন এই মেয়েটি তার এতটা খেয়াল রাখছে। বেশিরভাগ সময়টাতেই জেবা রাফিদের কাছে থেকে তার খেয়াল রাখত। মাঝে মধ্যে রাতের বেলায় সে অনুভব করতো জেবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তাহলে কী জেবা তার প্রেমে পড়ল? কিন্তু সে তো ভালোবাসতে পারবে না কাউকে। একমাত্র ইনশিতাকেই ভালোবেসেছিল। আর এখনো বাসে। হোক সে এখন অন্য কারো। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রাফিদের ভেতর থেকে।

.

.

ড্রয়িংরুমের সামনে বড় খোলা বারান্দায় পাতানো চেয়ারের এক হাতলে পা ছড়িয়ে আরেক হাতলে পিঠ হেলান দিয়ে বসে আছে ইনশিতা। হাতে মৃদু গরম কফির মগ। হালকা শীতের সন্ধ্যায় কফি খাওয়ার মজাটাই আলাদা। গায়ে পাতলা একটা শাল জড়ানো। কফিটির স্বাদ অন্যরকম। কারণ আজকের কফি অন্য একজন বানিয়েছে। এই দুই সপ্তাহ লাগিয়ে জেহেরকে সে কফি বানানো শিখিয়েছে কিনা।

জেহের খুব মনোযোগ দিয়ে রোজের কফি খাওয়াটাকে লক্ষ্য করছে। কফিটি কেমন হয়েছে সেটা এখনো পর্যন্ত বলেনি রোজ। উৎসুক মনটা রোজের মন্তব্যের জন্য চাতক পাখির মতো চেয়ে আছে।

জেহের ঢোক গিলছে বারবার। গলা শুকিয়ে আসছে। হাত পা ঝিমঝিম করে কাঁপছে। নাহ, কফির ভালো খারাপ মন্তব্যের জন্য নয়। রোজ ছোট্ট ছোট্ট চুমুক দিয়ে ঠোঁটটাকে কফির মগে ডুবাচ্ছে। আবার কখনো ঠোঁটটাকে চুমুর মতো ভঙ্গিমা করে কফিতে ফু দিচ্ছে। যেন কফিটাকে খুব যত্ন করে খেতে চাইছে সে। তা দেখে জেহের এখন মনে মনে চাইছে, সে কেন কফির মগটা হলো না? তাহলে রোজ তাকে কফির মগ ভেবে এভাবে ঠোঁট ছোঁয়াতো। এত সুন্দর করেও বুঝি কেউ কফি খায়? কফিটাও কী তার রোজের প্রেমে পড়ে গেল না কি? নাহলে এতক্ষণেও ঠান্ডা হচ্ছে না কেন? রোজের ঠোঁটের উষ্ণ বাতাস পেতে কফিটাও কী ইচ্ছে করে গরম হয়ে আছে? এক মুহুর্তের জন্য নির্জীব কফিটার উপর খুব রাগ হলো জেহেরের।

জেহের টান মেরে কফির মগটা রোজের মুখ থেকে সরিয়ে নিলো। রোজ চকিতে তাকাল জেহেরের দিকে। অবাক দৃষ্টি যেন জীবন্ত হয়ে বলছে,‘কফিটা কেন নিয়েছেন?’

জেহের কফির মগটা ছোট টেবিলের উপর রেখে বলে,

-“কেমন হয়েছে সেটা তো বললে না?”

ইনশিতা চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। এভাবে হুট করে মুখের সামনে থেকে কফি নিয়ে নেওয়াটাকে ভালো চোখে দেখছে না সে। ভালোই তো লাগছিল গরম গরম কফিটা। রাগমিশ্রিত গলায় চাপা স্বরে বলল,

-“সেটা বললেই পারতেন। কফির মগটা নিয়ে নিলেন কেন?”

জেহের থতমত খেয়ে বলল,

-“তুমি কফি খাওয়াতে এতটাই ব্যস্ত ছিলে যে কেমন হয়েছে সেটা বলতেই ভুলে গিয়েছ। তাই তোমার ধ্যান ভাঙালাম।”

-“ভালো হয়েছে কফিটা। এবার দিন তো, ঠান্ডা হয়ে গেলে ভালো লাগবে না খেতে।”

ইনশিতা কফিটা নিতে গেল। তা দেখে জেহের এক চুমুকে কফিটা নিয়ে সাবাড় করে দিলো। ইনশিতা চরম রকমের বিরক্ত হলো। বলল,

-“এটা কী করলেন?”

জেহের মগটা টেবিলে রাখতে রাখতে গম্ভীর গলায় বলে,

-“দেখলে না? কফি খেলাম। শুনেছি, স্বামী স্ত্রী এক কাপে ভাগাভাগি করে খেলে নাকি ভালোবাসা বাড়ে। তাই ভালোবাসা বাড়াতে তোমার অর্ধেক খাওয়া কফিটা আমি খেয়ে নিলাম।”

বলে উঠে ভেতরে চলে গেল। তার কফিটা ভালো লাগছে না একটুও। দুনিয়ার চিনি দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে সে। তাও রোজের কথায়। রোজ চিনি ছাড়া কফি খাবে না। আর জেহের চিনি দেওয়া কফি দু’চোখেও দেখতে পারে না।

রাতের খাবার খাওয়ার সময় ইনশিতা কিছু একটা বলতে চাইছিল জেহেরকে। বেশ কয়েকবার ইতস্তত করে বলতে চেষ্টাও করেছিল। তবে জেহেরের গাম্ভীর্যপূর্ণ চেহারা দেখে কথাগুলো জড়িয়ে আসছে।

এই দুই সপ্তাহ এখানে রয়েছে। সময়টা ইনশিতার খারাপও কাটেনি, আবার ভালোও কাটেনি। দুটোর মাঝামাঝিতে লটকে আছে। প্রতিদিন সকালে জেহেরের সাথে উঠে জগিং করায় আলাদা এক আনন্দ রয়েছে। এই জঙ্গলের ছোট একটা পথেই তারা জগিংয়ে বের হয়। বেরোলে কারো দেখাও পায় না সে। কোনো মানুষের চিহ্ন নেই এলাকায়। তবুও দুজনে একসাথে পাশপাশি দৌড়াতে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে। হাঁপিয়ে গেলে যখন জেহের ইনশিতাকে কোলে করে নিয়ে আসে কিংবা যত্ন করে জুতোর ফিতে লাগিয়ে দেয় তখন নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে বেশি ভাগ্যবতী বলে মনে হয় ইনশিতার। তবুও মনের মধ্যে যেন কিছু একটা নেই, কিছু একটা নেই ভাব লেগে থাকে।

এই ঘরের চিলেকোঠার একটা বড় রুম আছে। ওখানে শত শত ইংরেজী বই। জেহের আগে এগুলো পড়ত। রোজের জন্য সে আলাদা করে রোজের পছন্দের বই এনে রেখেছে। সেখানে বেশিরভাগ গিয়ে বই পড়ে কাটায় ইনশিতা। তবে জেহের যতক্ষণ বাসায় থাকে অর্থাৎ সন্ধ্যা থেকে সকাল অবধি, ততক্ষণ জেহেরের সামনে সামনেই থাকতে হয় ইনশিতার। বারান্দায় গেলেও জেহেরকে নিয়ে যেতে হয়।

ইনশিতা জেহেরের কোলেই বসে। কারণ এটা জেহেরের আদেশ, খাওয়ার সময় তাকে জেহেরের কোলে বসতেই হবে, আর জেহের খাইয়ে দেয় তাকে। ইনশিতা শেষ পর্যন্ত বলেই দিলো,

-“জেহের, আসলে আমি একটু…”

-“হুম। তুমি একটু?”

-“আমি একটু কথা বলতে চাই সবার সাথে। মানে মা বাবার সাথে… ফোনে… কথা বলবো।”

জেহের কর্ণপাত করলো না ইনশিতার কথায়। খাবার ঢুকিয়ে দিলো ইনশিতার মুখে। ইনশিতা আবারও বলল,

-“প্লিজ, একটু তো কথা বলতে দিন।”

-“কী বলবে? কেমন আছে, কী করছে, খেয়েছে কিনা? এসবই তো? এসব বলে কোনো লাভ নেই। তাই কথা বলেও লাভ নেই। আর তোমার বাবা মা ভালোই আছে, আমি তাদের কোনো দিক দিয়ে কমতি রাখিনি।”

ভারী অবাক হয়ে ইনশিতা বলল,

-“আশ্চর্য! এই সামান্য কথাটুকুতেও অনেক ভালোবাসা আছে। এইটুকু তো বলতে দিন।”

জেহের শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। কন্ঠ শীতল করে বলল,

-“তোমার ভালোবাসা শুধুমাত্র আমার জন্যই। বিয়ের আগে তাদের ভালোবেসেছ, এখন সমস্তটা দিয়ে আমাকে ভালোবাসবে। তাদের কথা ভাবার দরকার নেই।”

-“ওনারা আমার মা বাবা। ওনাদের জন্য ভালোবাসা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থাকবে আমার। আপনার সামান্য ভালোবাসার জন্য আমার মা বাবার ভালোবাসাকে তো আমি হেলাফেলা করতে পারি না তাই না?”

জেহের খাওয়ার প্লেটটাকে উল্টে ফেলে দিলো। ইনশিতা চমকে গিয়ে উঠতে চাইলে জেহের টেনে ধরে বসিয়ে দেয়। আগুন ঝরানো চোখ নিয়ে বলে,

-“আমার ভালোবাসা সামান্য? কোনদিক দিয়ে সামান্য লেগেছে বলো? তোমার যা পছন্দ হয় সব করেছি, তাও সামান্য বলছো?”

ইনশিতা বোঝাতে চাইল জেহেরকে,

-“আমি সেটা বলিনি।”

-“সেটাই বলেছো তুমি।”

-“না, আমি শুধু বলেছি, সবকিছুর উর্ধ্বে বাবা মায়ের ভালোবাসা। শুধু সেটাই বুঝিয়েছি। …”

-“আমার ভালোবাসাকে তার মানে নিচে দেখিয়েছো? আমি তোমার সবকিছুতে উপরে থাকতে চাই, ভালোবাসাতেও উপরে থাকব আমি। সব…”

ইনশিতা থেমে গেল। তারই ভুল হয়েছে ভালোবাসার কথাটা উঠানো। জেহের যে ছোট একটা বিষয় নিয়ে সীনক্রিয়েট করে ফেলতে পারে সেটা তার কল্পনার বাইরে ছিল। ভেবেছিল জেহের বুঝবে তার মনের অবস্থা। অথচ এই ভাবনাটাও তার বৃথা। এখন জেহেরকে শান্ত করবে কীভাবে? তবুও চেষ্টা চালালো,

-“আচ্ছা, আচ্ছা। এখন রাগ করিয়েন না। শুনুন, বাবা-মা…”

জেহের ইনশিতার গাল চেপে ধরে বলল,

-“বাবা মা, বাবা মা করবে না। আই হেট বাবা মা। কোনো বাবা মায়ের ভালোবাসাই ভালো না। সবাই স্বার্থপর, সবাই। সব সময় নিজের দিকটাই বুঝে সবাই। এইসব যা যা ভালোবাসা দেখায় সবটাই তাদের ছলনা। তাদের ভালোবাসা সবটা মিথ্যে।”

বলতে বলতে জেহেরের চোখ লাল হয়ে গেছে। ইনশিতা গালের ব্যথার দিকে নজর না দিয়ে অবাক চোখে দেখে জেহেরকে। জেহেরের লাল চোখে জমা হয়ে আছে বিন্দু বিন্দু জল। চোখে একরাশ ঘৃণা বাবা মায়ের জন্য। জেহেরের কথায় অভিমান আর ঘৃণা স্পষ্ট টের পেল ইনশিতা। বাবা মায়ের প্রতি জেহেরের এত ঘৃণার কারণ খুঁজে পেল না ইনশিতা। যেন জেহের কথাগুলো নিজ বাবা মা’কে উদ্দেশ্য করে বলছে।

জেহের ইনশিতাকে ছেড়ে উঠে চলে গেল। ইনশিতা ভাবতে লাগল, সামান্য একটা কথাকে কেন্দ্র করে জেহের কি না কি বলে ফেলল। ইনশিতার সিক্সথ সেন্স বলছে, জেহের কোনো না কোনো কারণে তার বাবা মায়ের উপর রেগে আছে। আর সেই কারণে পৃথিবীর কোনো বাবা মায়ের ভালোবাসাটাকেও মেনে নিতে পারছে না।

ইনশিতা রুমে জেহেরকে খুঁজে পেল না। অন্য রুমেও না পেয়ে সোজা ছাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। গিয়ে দেখল জেহের ছাদের রেলিংয়ে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। একটু অসাবধানতা হলেই জেহের সোজা নিচে পড়ে যাবে। ভয়ে ইনশিতার বুক কেঁপে উঠল। এখন জেহেরকে জোরে ডাকাও যাবে না, কিংবা কোনো কথাও বলা যাবে না। যদি হঠাৎ ডাকে চমকে গিয়ে পড়ে যায়! তবুও উপায় না পেয়ে মৃদুস্বরে জেহেরকে ডাকে। জেহের পেছন ফিরে দেখে রোজ হেঁটে আসছে তার দিকে। রোজকে দেখেও সে রেলিং থেকে নামে না।

ইনশিতা ছাদের লাইটের আলোয় খেয়াল করল জেহেরের চোখে এবার টলমল করছে পানি। চোখমুখ লাল হয়ে আছে। জেহের কী কান্না করেছে? জেহের হঠাৎ ইনশিতাকে কাছে টেনে বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরে। জেহেরের শরীর কাঁপছে। ইনশিতা এক হাতে জেহেরের পিঠে দিয়ে আরেকহাতে জেহেরের মসৃণ চুলে হাত বুলায়। জেহের ধরা গলায় বলে,

-“কোনো মা বাবাই ভালো না রোজ। কেউ না। আমাকেও কেউ ভালোবাসে না।”

জেহেরের কথায় প্রচন্ড অভিমানের আভাস পাওয়া গেল। ইন‌শিতা আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল জেহেরকে।

-“কে বলেছে আপনাকে ভালোবাসে না? সবাই আপনাকে ভালোবাসে। আপনার ভাই, বোন, মা বাবা…”

জেহের বাচ্চাদের মতো রাগ ধরে বলে,

-“উহুম। বলেছি না, কেউ না। আমার কোনো মা নেই। কোনো বাবা নেই। সবাই পর। আমাকে যদি ভালোবাসতো তাহলে…”

এটুকু বলার পর থেমে যায় জেহের। ইনশিতা কৌতুহলী গলায় বলে,

-“তাহলে কী।”

জেহের নিরুত্তর। ইনশিতাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আজ এমন ছোঁয়ায় ইনশিতা কোনো কামনার ইঙ্গিত পাচ্ছে না। বরং এমন ছোঁয়ায় তাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার ইচ্ছা পোষণ করছে। যেন ইনশিতাকে বলতে চাইছে কোথাও না যেতে। জেহেরের কাছে থেকে তাকে সবসময় সাপোর্ট করতে।

জেহের মাথা একটু তুলে মায়া ভরা কন্ঠে বলে,

-“তুমি আমাকে সবসময় ভালোবেসো। আমাকে কখনো ছেড়ে যেও না। বাবা মা কাউকেই না তোমার লাগবে আর না আমার। আমরা দুজন দুজনের থাকবো আজীবন। তুমি আমাকে ভালোবাসো তো রোজ?”

জেহেরের প্রশ্নে চুপ হয়ে যায় ইনশিতা। জেহেরকে সে ভালোবাসে কী বাসে না সেটা নিজেই বুঝতে পারছে না। তবে এতদিনে জেহেরের মায়ায় পরে গেছে। মায়া আসলেই খারাপ জিনিস, একবার কারো মায়ায় পড়লে সেখান থেকে উঠে পড়া দায় হয়ে যায়। তবে এটুকু বুঝতে পারছে যে জেহেরকে ছেড়ে থাকতে পারবে না সে। মায়া ছাড়া আরেকটা কারণও আছে। তার মনে হচ্ছে জেহের কোনো একটা কারণে মনে মনে খুব কষ্টে আছে। তবে কাউকে বোঝাতে দিতে চায় না। নিজেকে বাহিরে স্ট্রং দেখালেও কষ্টটা ভেতর থেকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। আর এই কষ্টটা ইনশিতার কাছে আসলেই হাওয়া হয়ে যায়। যেন ইনশিতাকে নিয়েই সব কষ্টের জয় করতে পারবে জেহের।

জেহের সবসময় নিজেকে সবার থেকে আলাদা রাখতে চায়, একা বাঁচতে চায়, আড়ালে রাখতে চায় নিজেকে। কারো সাহায্য চায় না পাশে। তবে রোজের কাছে আসলেই জেহেরের সবকিছু জুড়ে তার রোজ থাকে। তখন জেহেরের মনে হয়, পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য তার রোজ পাশে থাকলেই যথেষ্ট। কোনো কষ্ট নেই দুনিয়াতে। কাউকে লাগবে না শুধুমাত্র রোজ ছাড়া। সকল আবদার, ভালোবাসা, অভিমান রোজেতে ঘিরে থাকবে।

-“কী হলো? বললে না, আমাকে ভালোবাসো কি না?”

ইনশিতা মুচকি হেসে বলে,

-“সেটা কোনো একদিন বলবো। তবে এটা জেনে রাখুন যে আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।”

-“তুমি না চাইলেও থাকতে হবে আমার সাথে।”

-“আচ্ছা, এখন নামুন এখান থেকে। ভয় করে না এখানে বসার? যদি পড়ে যেতেন?”

-“অভ্যেস আছে।”

-“অভ্যেস থাকলেও চলবে না। আর যেন কোনোদিন না দেখি। বুঝেছেন?”

ইনশিতা শাসনের সুরে কথাটা বলল। জেহের মিষ্টি করে হাসলো। কারো এমন শাসনের খুব প্রয়োজন ছিলো তার জীবনে। তার জীবনটা অগোছালো। সবাই হয়তো জেহেরকে দেখে বলবে পারফেক্ট জীবন কাটাচ্ছে। অথচ ভেতরে ভেতরে সে অগছালো। বড্ড অগোছালো। এই অগোছালো জীবনকে সাজিয়ে গুছিয়ে দেবার জন্য একজন এসেছে। তার রোজ।

.
.
চলবে…
[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here