প্রাক্তন পর্ব ১৭+১৮

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১৭

সারাদিন আর রাত এসব ভাবনাতেই কেটে গেল। পরদিন সকালটা শুরু করলাম নতুন ঘটনার সূত্রপাত দিয়ে।

সকালে উঠেই আমি নিজেকে সামলে নিলাম। আকাশটা হালকা মেঘাচ্ছন্ন। কখনও মেঘ কখনও রুদ্দুরের খেলা করছে। কখনও বা অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে পরক্ষণে ধমকা বাতাস দিয়ে সবকিছু আলোকিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার মনের ভেতেরের খেলাটায় বাহিরে হচ্ছে। একবার মনে হচ্ছে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি আরেকবার মনে হচ্ছে আশার আলো খুঁজে পাচ্ছি।

জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম। এমন সময় মা আসলো। এসেই আমার দিকে এগিয়ে বলল

– জানালা দিয়ে বাতাস আর এত ধূলো আসছে তুই জানালা খুলে রেখেছিস কেন? কী রে অপ্সরা তোর হয়েছে টা কী?

আমি মায়ের দিকে তাকালাম। চোখে জল তখন টলমল করছিল। এই বুঝি জলটা গড়িয়ে পড়বে গাল বেয়ে। বুঝতে পারছি না কী করব। মাকে হুট করে জড়িয়ে ধরলাম। গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মা আমাকে টেনে মুখের দিকে তাকিয়ে বলল

– কী রে… হয়েছে কী তোর? এ কয়েকদিন যাবত তোকে বেশ আনমনা লাগছে। কী হয়েছে বল তো।

আমি হালকা গলায় বললাম

– মা কখনও যদি তোমার মেয়ে তার ভালোর জন্য কোনো স্টেপ নেয় তুমি কী কষ্ট পাবে?

– তোর ভালো হবে এটা তে কষ্ট পাওয়ায় কিছু নেই। তোর কী হয়েছে বলবি?

– এখন বলতে পারছি না। কিছু কাজ বাকি। কাজগুলো করেই বলব।

– আবিরের সাথে কিছু হয়েছে?

মায়ের মুখে কথাটা শুনে হুহু করে কেঁদে উঠলাম। মা আমাকে ধরে বলল

– কী হয়েছে তোর? বল কিছু একটা।

আমি চোখটা মুছতে মুছতে বললাম

– কারও সাথে কিছু হয় নি। তবে মা আবিরের সাথে আমার বিয়েটা হচ্ছে না।

মা আমার দিকে তাকিয়ে আরও আড়ষ্ট হয়ে বলল

– এ বিয়ে ভাঙলে মানুষ কী বলবে মা। তুই হুজুগের বশে কোনো সিদ্ধান্ত নিস না।

– মা তোমার মেয়ের প্রতি তোমার কোনো ভরসা নেই? তোমার মনে হচ্ছে আমি হুজুগে এমন করছি? মা গো তুমি কী মানুষের কথা নিয়েই পড়ে থাকবে নাকি মেয়ের ভেতরে বয়ে যাওয়া কষ্টের নদীর গভীরতাটা পরিমাপ করবে। একটা বিয়ে ভাঙ্গার পেছনে অবশ্যই কারণ আছে। তোমাকে আমি কিছুই এখন বলব না। তবে চাই তোমরা পাশে থাকো। এমন হইয়ো না যেখানে বিয়ে বিয়ে করতে গিয়ে আমাকেই হারিয়ে ফেললে।

– দেখ এ চার বছর তোকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছি। বিয়ে করতে চেয়েছিস আবিরকে আমরা রাজি হয়েছি। সবাই জানে তোর এনগেজমেন্ট হয়েছে এখন বিয়ে ভাঙলে প্রতিটা মানুষ তোকে টেনে কথা বলবে। এ পাড়ার মানুষ তো তোর আগের ঘটনা জানে। তাদের মুখ আটকাবি কী করে। সবাই বলে মেয়েকে বেশি স্বাধীন করে আমি ভুল করেছি। যতই তুই চাকুরি কর বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তোকে কেউ মূল্যায়ন করবে না। তোর দোষ খুঁটিয়ে বের করবে। এ বিয়েটা ভেঙ্গে গেলে মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না। মারে এমন করিস না। ঝামেলা টুকিটাকি হবেই। তাই বলে বিয়ে ভেঙ্গে দিবি। সমাজ নিয়ে চলতে হয়। সমাজের কথাটাও ভাব।

মায়ের কথা শুনে আমার গা জ্বলে যাচ্ছিল। যদিও এটা পুরোপুরি মায়ের দোষ না। একটা মেয়ের ২৫ পার হয়ে গেলেই সবার কানাকানি শুরু হয় মেয়েটা বিয়ে কেন করছে না। তখন পরিবারও বিবেকহীন হয়ে কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। সমাজ তখন পরিবারের মানুষ গুলোকেও পাগল করে দেয়। মস্তিষ্ক বিকৃত ঘটায়। এই তো কিছুদিন আগে খবরের কাগজে দেখালাম মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না বলে মা মেয়েকে খুন করে ফেলেছে। সেটার একটা মূখ্য কারণ হলো এ সমাজ। সমাজের মানুষ গুলো মেয়েদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে,এত এত কথা বলা শুরু করে যে তখন মেয়ের পরিবারও বুঝে উঠতে পারে না কী করবে। কখনও মাথা চাপড়ায় কখনও বা বুক চাপাড়াতে থাকে। এর মধ্যে কিছু মানুষের ঘটে মানসিক বিকৃতি। তখন সে কি করে ফেলে সে নিজেও টের পায় না। তাই তখন জঘন্য কাজ করতেও তার বিবেকে বাঁধে না। এখন মায়ের সাথে উগ্র আচরণ করলেও সেটা হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। আমি মাকে ধরে খাটে বসালাম। তারপর বললাম

– মা আমার বিয়ে হয়ে ডিভোর্স হয়ে গেলে তুমি মানতে পারবে?

– এসব কথা কেন বলছিস?

– কারণ আছে। বলো মানতে পারবে কী না।

– না, পারব না।

– আমাকে কী জেনে শুনে কোনো চরিত্রহীন ছেলের হাতে তুলে দেবে? বা এমন কোনো ছেলে যাকে তুমি বিয়ের আগেই জানো তোমার মেয়েকে সে কষ্ট দেবে তখন কী তুমি মেয়ের সুখের কথা ভাববে নাকি সমাজের কথা ভেবে সে ছেলের সাথে বিয়ে দিবে। ঠান্ডা মাথায় উত্তর দাও।

– অবশ্যই আমার মেয়ের সুখ আগে।

– তাহলে মা এখানেই থাকো। আমি এখন থেকে যা যা করব সুখে থাকার জন্য। তুমি শুধু সময়ে অসময়ে পাশে থেকো। আবিরের সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে না। এটার কারণ ও জানতে পারবে। আপাতত বিষয়টা সবাইকে বলার দরকার নেই। আর শুনো রিজিক যেখানে থাকে সেখানেই বিয়ে হবে চিন্তা করো না। ৪০ বছর বয়সী মেয়েদেরও বিয়ে হচ্ছে। আর আমার বয়স ২৭ পার হলো। তবে এত চিন্তা কেন? আমাকে যে রাজপুত্র আর অনেক যোগ্য ছেলে বিয়ে করতে হবে তা’ না। আমি এমন কাউকে বিয়ে করব যে সাবলীল,সাধারণ আর ভালো। আমি তোমাকে আস্তে আস্তে সব বলব। শুধু এটাই কামনা করি কখনও ভুল বুঝবে না। এবার আমার জন্য নাস্তা বানাও একটা কাজ আছে কাজে যাব।

মা আর কোনো কথা বলল না। হয়তো মায়ের বিষয়টা বোধগম্য হয়েছে হয়তো হয়নি। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। আলমিরাটা খুলে সবচেয়ে সুন্দর শাড়ি বের করলাম। আজকাল নিজেকে গুছিয়ে রাখার একটা প্রবণতা ঝেঁকে বসেছে। শাড়িটা বের করে পরে নিলাম। নিজেকে পরিপাটি করে কলেজে কল দিয়ে ছুটি নিলাম।

তৈরী হয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে পেট পুরে খেয়ে নিলাম। যদিও খেতে ইচ্ছা করছে না তবুও জোর করে খেয়ে নিলাম। বাসা থেকে বের হয়েই থানায় গেলাম।

সেখানে গিয়ে লক্ষ্য করলাম সোহান বসে আছে। আমি ওকে বসে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হলাম। ওকে দেখেও আমি তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। কিছুটা না দেখার ভান করেই পাশের একটা চেয়ারে বসলাম। এর মধ্যেই ও বলে উঠল

– আরে অপ্সরা না তুই? একদম বদলে গেছিস। আগের আর বর্তমানে তেমন কোনো মিল নেই। আমি তো চিনতেই পারছিলাম না। তবে কপালের পাশে কাটা দাগ দেখে নিশ্চিত হলাম এটা তুই। কেমন আছিস?

আমি হালকা হেসে বললাম

– ভালো তুই?

ওহ বলে নিই। সোহান হলো আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। স্কুল কলেজ আমরা এক সাথেই পার করেছি। আমি কোনো ছেলের সাথে কথা না বললেও সোহানের সাথে বলতাম। কিন্তু অনার্সে উঠার পর অরন্য পছন্দ করত না তাই সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলাম। এতদিনে ওকে আমি ভুলেই গেছিলাম। আজ হঠাৎ তাকে থানায় দেখে একটু চমকালাম। সে হালকা হেসে বলল

– ভালো। তা থানায় কী জন্য?

– একটা জিডি করব।

– কিসের?

– একটু ব্যক্তিগত। বলতে পারছি না। তা তোর দিন কেমন চলছে কোথায় আছিস?

– এই তো আছি ভালোই।

– কী করছিস?

– বাবার ব্যবস্যাটায় দেখছি। আর তুই তো কলেজে আছিস তাই না?

– তুই জানলি কী করে? আর বুয়েটে পড়ে জব না করে ব্যবস্যা করছিস কেন?

– তুই ভুলে গেলেও আমি তোর খু্ঁজ মাঝে মাঝে নিই। আর অন্যের অধীনে চাকুরি আমার মোটেও পছন্দ না।

আমি হালকা হেসে বললাম

– বাপের টাকা আছে তাই ভালো লাগে না অন্যথায় চাকুরি ছাড়া উপায় ছিল না। তা কী জন্য এখানে?

– বাসায় ডাকাতি হয়েছে গতকাল।

– কী বলিস। কী কী নিয়ে গেল?

– তেমন কিছু তো ছিল না। তবে ২৫ ভরির মতো মায়ের গয়না ছিল আর ৪ লাখ ক্যাশ টাকা ছিল।

– ভালোই তো নিয়ে গেছে তাহলে। কে বা কারা করতে পারে ধারণা আছে?

– ঐরকম সন্দেহ তো কাউকে আপাতত করতে পারছি না, দেখি কী করা যায়। য়দিও আমার কাজ শেষ। তবে তোকে বাইরে দেখেই বসে ছিলাম যাতে এড়িয়ে যেতে না পারিস। হুট করে কী এমন হলো সেই যে তুই কথা বলা বন্ধ করলি আর কোনো খুঁজ নেই।

সোহানের প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। কারণ যে মানুষটার জন্য তাকে আমি ছেড়েছিলাম সে মানুষটার জন্য আজকে থানায় এসেছি। আমার নীরবতা দেখে সোহান বলে উঠল

– হয়েছে উত্তর লাগবে না৷ ভালো থাকিস। আর তোর আইডিতে এখনও ব্লক লিস্টে হয়তো পড়ে আছি। আর ফোন নম্বরটা আছে তবে কল দেয়ার সাহস পাই নি। বরাবরেই তুই রাগী কী থেকে কী বলিস তাই৷ ভালো থাকিস।

– হুম আচ্ছা।

আর কোনো কথা এগুলাম না। ছেলে মানুষ দেখলেই কেন জানি না স্বার্থপর মনে হয়। সোহান বের হয়ে গেল। আমিও জিডি করে খানিক পর থানা থেকে বের হয়ে উকিলের কাছে গেলাম। উদ্দেশ্য অরন্যকে ডিভোর্স দেওয়া। ডিভোর্সের কাজটা আগে সাড়তে হবে। ডিভোর্সের সকল ব্যবস্থা করে বাসায় আসলাম। আগামি সপ্তাহে এ সম্পর্ক থেকে নিজেকে মুক্ত করব। অরন্য আর আবিরের অফিসে অভিযোগ দেওয়ার ব্যবস্থাও করে আসলাম। আজকে বেশ শান্তি লাগছে। নিজের অজান্তেই মনে হলো এক বড় পাথর বুকের উপর থেকে নেমেছে।

কাজ শেষে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। হুট করেই গর্জন দিয়ে বৃষ্টি নামা শুরু করল। আমি আমার ব্যাগটা মাথার উপরে ধরে দৌড়ে এক দোকানের নীচে দাঁড়ালাম। এর মধ্যেই সোহান আমার সামনে হাজির। সোহানকে দেখে পুনরায় অবাক হলাম। সে কি আমাকে অনুসরণ করছে নাকি অন্য কিছু। সোহানকে সামনে দেখেও আমি তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া করলাম না৷ সোহানেই হালকা কাশি দিয়ে বলল

– আবারও দেখা হয়ে গেল। তা এতক্ষণ কোথায় ছিলি। কোনো সমস্যা?

আমি বৃষ্টির পানিটা শাড়ি ধরে হাত দিয়ে মুছতে মুছতে বললাম

– কোনো সমস্যা নেই। কেন কিছু বলবি?

– নাহ। দেখলাম উকিলের কাছে গিয়েছিস।

আমি কিছুটা রাগী গলায় উত্তর দিলাম

– তুই কী আমাকে অনুসরন করছিস?

সোহান জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল

– তা কেন হবে। দেখলাম তাই বললাম। কিছু হয়েছে কী?

– কিছু না হলে তো উকিলের কাছে যেতাম না।

– বলা যাবে কী?

– বলা যাবে না কেন? ডিভোর্সের জন্য গেছিলাম।

সোহান কথাটা শুনে মুখটা কালো করে ফেলল। এরকম একটা উত্তর সে আশা করে নি। ফ্যাকাশে মুখে বলল

– তোর বিয়ে কবে হলো আর ডিভোর্সেই বা কাকে দিচ্ছিস।

সাবলীল কন্ঠে জবাব দিলাম

– বিয়ে হয়েছে চার বছর আগে এখন ডিভোর্সের প্রয়োজন তাই ডিভোর্স দিচ্ছি।

– কাকে বিয়ে করেছিস শুনলাম না তো।

– অরন্যকে।

আমার উত্তর শুনে সোহানের মুখটা আরও ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বিস্মিত কন্ঠে বলল

– কিন্তু যতদূর জানি অরন্য অন্যত্র বিয়ে করেছে। তুই কী হেয়ালি শুরু করলি নাকি।

– হেয়ালি না সত্যি। আর জটিল সম্পর্ক সরল করার জন্যই এ ডিভোর্স। আর সবকিছু বুঝতে চাওয়াও উচিত না। ৭-৮ বছর তোর সাথে যোগাযোগ নেই এত দিনের কাহিনি তো একদিনে বুঝে যাবি না। যাইহোক বৃষ্টি কমেছে আমি গেলাম।

– যদি কিছু মনে না করিস আমি পৌঁছে দিই। তোদের কী আগের বাসাটায় নাকি পরিবর্তন করেছিস।

– বাসা পরিবর্তন করেছি অনেক আগেই। আর ধন্যবাদ কোনো সাহায্যের আমার প্রয়োজন নেই। ভালো থাকিস।

বলেই রাস্তায় এসে একটা রিকশা ভাড়া করে বাসায় আসলাম।

ভেজা শাড়িটা পাল্টে নিলাম। শুকনো কাপড় পরে ভেজা চুল গুলো চিরুনি দিয়ে আঁচড়াতে লাগলাম। নিজের মধ্যে প্রশান্তি কাজ করছে যে আমি এখন নিজেকে শক্ত করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছি এটা ভেবে।

চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতেই কলিং বেলের শব্দ পেলাম। মা দরজা খুলে আমার রুমে এসে বলল

– কে জানি এসেছে তোর সাথে দেখা করতে। আমি ভাবলাম হয়তো সোহান এসেছে। কিন্তু সোহানকে তো মা চেনার কথা।

কিছুটা অনিশ্চয়তা নিয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে আঁৎকে গেলাম। কারণ সোহান আসে নি। যে এসেছে তাকে দেখে ভাবতে লাগলাম নতুন নাটকের সূচনা হবে নাকি আবার?
#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৮

যে এসেছে তাকে দেখে ভাবতে লাগলাম নতুন নাটকের সূচনা হবে নাকি আবার? কারণ আবিরের বর্তমান জি এফ সাহেরা এবং অরন্যের স্ত্রী নাফিসা এসেছে। দুজনকে দেখে কিছুটা বিস্মিত হলাম। তবে বিস্ময়টা মুখ অবয়বে আনলাম না। খানিকটা নিজেকে শান্ত করে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম

– আপনারা আমার বাসায় কী জন্য?

নাফিসা প্রশ্নের জবাবে বলল

– অরন্য কোথায়?

প্রশ্নটা শুনেই আমার রাগটা বেড়ে গেল। বেশ কটু গলায় বললাম

– অরন্য কোথায় আপনি খুঁজে বের করুন। আমার কাছে বলতে কেন এসেছেন? আর আবার নতুন নাটক করতে চলে এসেছেন। এর আগে অরন্য না হারিয়েও হারিয়ে যাওয়ার নাটক করেছে এখন আপনি শুরু করেছেন সে একই নাটক।

– শুনো মেয়ে আমি তোমাকে যা বলছি তার উত্তর দাও। দেশে এসেছি গতকাল। অরন্যকে কোথাও পাচ্ছি না। অরন্য কোথায় বলো। অরন্যকে না পেলে ভালো হবে না কিন্তু।

– দয়াকরে এসব নাটক বন্ধ করুন। আর আমার কাছে অরন্যকে না খুঁজে থানায় যান প্লিজ।
অরন্য আর আবিরের নামে জিডি করে এসেছি। আপনাদের নামেও এসব ঝামেলা করলে একই কাজ করতে বাধ্য হব। আপনারা দয়াকরে এসব নিয়ে আমাকে কিছু বলতে আসবেন না।

পাশ থেকে সাহেরা বলে উঠল

– তোমার জন্য আমার সম্পর্কে ভাঙ্গণ ধরেছে। তোমাকে আমি ছাড়ব না। অরন্য ভইয়ার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে তোমাকে দায়ী করে মামলা করব। যে অশান্তি আর ঝামেলা লাগাইছো সেটার শেষ করব।

সাহেরার কথা শুনে আমি একটু হেসে বললাম

– যে মেয়ে নিজের প্রেমিককে অন্যায় কাজে সাহায্য করার অনুমতি দেয় তার কাছ থেকে এমন কথা আশা করায় যায়। দোষটা আবিরের সাথে আপনারও। আপনি একই দোষে দোষী। একটা মেয়ের জীবন নিয়ে আবির আর অরন্য খেলেছে আর আপনি জানার পরও সায় দিয়েছেন। সেখানে সমান অপরাধে আপনিও অপরাধী। আর আপনাদের মামলা করার স্বাধীনতা আছে করতে পারেন। আমিও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার ক্ষমতা আছে সেটা আমি করব৷ আপনারা আপনাদের গতিতে এগিয়ে যান। আমি নাহয় আমার গতিত এগিয়ে যাই। এবার আসতে পারেন। আর চা কফি খেলে বসুন ব্যবস্থা করছি। যদিও বাইরে বৃষ্টি পড়ছে এখন বের হওয়াটা ঠিক হবে না। বসুন আমি চা কফি আনার ব্যবস্থা করছি। যতই হোক প্রথম এসেছেন। এ বাসার অতিথি আপনারা। কিছু খেয়ে যান।

আমার কথা শুনে দুজনেই ফুসিয়ে উঠল। প্রতিত্তোর না দিয়েই মূল দরজাটা বেশ জোরে সোরেই খোলে বের হয়ে গেল। আমি চুল গুলো হাত দিয়ে আঁচরাতে আঁচরাতে নিজের রুমে এসে বসলাম। মা আমার কাছে এসে বলল

– করা ছিল ওরা। আর ঐভাবেই কেন কথা বললি?

আমি মৃদু গলায় উত্তর দিলাম

– আবির যে মেয়েকে পছন্দ করে সে মেয়ে আর অরন্যের স্ত্রী।

মা কিছুটা বিস্মিত গলায় বলল

– আবিরের পছন্দ থাকলে তুই কী ছিলি আবিরের? আর অরন্যের স্ত্রী কেন তোর কাছে এসেছে? অপ্সরা সবটা খুলে বল আমাকে।

আমি মায়ের মুখে অশান্তির ছাপ লক্ষ্য করলাম। মাকে হালকা করে ধরে বসিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা সমস্ত বললাম। মায়ের চোখ টলমল করছে। মাকে দেখতে খুব অসহায় লাগছে। মা আমাকে ধরে বলল

– তোর যে এত সহ্য শক্তি জানতাম না। শুধু জানতাম আমার মেয়েটা অনেক রাগী। কিন্তু আমার মেয়ের যে এত সহ্য শক্তি জানতাম না। মানুষ যা ইচ্ছা বলুক তুই তাতে কান দিস না। তোর মতো করে তুই লড়াই করে যা। তোর বাবার হার্টের সমস্যা আস্তে আস্তে আমি সবটা খুলে বলব। তুই চিন্তা করিস না। কোনো দরকার লাগলে মাকে বলবি। নিজের মধ্যে এভাবে জমিয়ে রাখলে যে আরও কষ্ট পাবি। আমাকে বললে তোর হালকা লাগবে। যা এবার খয়ে নে কিছু।

আমি মায়ের কথায় যেন স্বস্তি পেলাম। এতদিন কাউকে বলতে পারতাম না। আজকে যেন বলার মতো সঙ্গী পেলাম। ভরসার একটা জায়গা পেলাম। ভালোবাসার একটা হাত পেলাম।।যে হাতে কোনো প্রতারণা নেই বরং পুরোটা হাতেই ভালোবাসায় মুড়ানো।

মা চোখের জল মুছতে মুছতে বসা থেকে উঠে রান্না ঘরের দিকে গেল। আমি আমার ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমার ফোন ভাইব্রেট করছে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম অপরিচিত নম্বর থেকে কল এসেছে। আমি কলটা ধরলাম। ওপাশ থেকে সোহানের কন্ঠ ভেসে আসল। কন্ঠটা শুনে বললাম

– কেন কল দিয়েছিস। আজকে দেখার পর থেকেই কেমন জানি করছিস।তোর কাজে আমি রিতীমতো বিরক্ত হচ্ছি সেটা বুঝতে পারছিস না?

– অপ্সরা আমি তো তোকে প্রেম নিবেদন করছি না।তোর ভালো বন্ধু আমি ছিলাম। হঠাৎ করে তুই যোগাযোগ বন্ধ করলি। আজকে হঠাৎ তোকে দেখে সে বন্ধুত্বটা জেগে উঠেছে। তোর বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা কী আমার নেই। আর তুই এত রেগে কেন যাচ্ছিস। তোকে কল দিতে বড্ড ভয় লাগে। এজন্যই এত বছর কল দেই নি। আজকে কেন জানি না মনে হলো তুই অনেকটা শান্ত হয়ে গেছিস তাই কল দেওয়ার সাহস পেলাম । আমাদের বন্ধুত্বটা তো ঠিক করে নিতে পারি।

সোহানের কথায় আর দ্বিমত করতে পারলাম না। হালকা করে বললাম

– ঠিক করে নেওয়ার তো কিছু নেই। বন্ধু ছিলাম আছি। তবে এর বাইরে কিছু না।

-আরে এর বাইরে কী হবে। এবার বল তুই কেমন আছিস?

– অনেক ভালো।

– আচ্ছা আমি একটা বিষয়ে দ্বিধায় আছি। তোর কথার মানে আমি বুঝি নি। একটু কী বলবি?

– এসব বিষয় বলতে চাচ্ছি না। আর এসব বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস ও করবি না।

– করলাম না।

– বিয়ে করিস নি?

– এখনও সুযোগ হয়ে উঠে নি।

– ভালো। রাখলাম। পরে কথা হবে।

– কালকে কী তুই ফ্রী আছিস?

– কেন?

– এক কাপ কফি খেতাম। তুই তো কফি অনেক পছন্দ করিস। বিশেষ করে কোল্ড কফি। একবার মনে আছে তোর কফিতে এক চুমুক দিয়েছিলাম তাই রাগে আমার কফিতে থুথু দিয়ে আমার মাথায় ঢেলে দিয়েছিলি। তোর কত রাগ ছিল। এখনও কী তেমনেই আছিস নাকি একটু রাগ, জেদ কমেছে।

– তোর কথা হয়েছে?

– হ্যাঁ অনেক আগেই।

– তাহলে কলটা রাখ। আর তোর কফি তুই খা।

বলেই কলটা কেটে হালকা হাসলাম। সে পুরনো দিনগুলো বেশ রঙ্গিন ছিল। সোহান ছিল আমার খুব কাছের বন্ধু। আমার যত অকর্ম আছে সব কাজে সে সহয়তা করত। স্কুল পালানো। ক্লাস ফাঁকি দেওয়া। আর কোনো ভাবে যদি ও সাহায্য না করত তাহলে সকল রাগ ওর উপর ঝেড়ে দিতাম। সে সময়গুলো সত্যিই অনেক রঙিন আর ঝলমলে ছিল। পুনরায় স্কুল আর কলেজের জীবনে যেতে পারলে অনেক ভালো হতো। যত বড় হয়েছি ততই জটিলতা যেন আকঁড়ে ধরল।

আবারও গর্জন দিয়ে বৃষ্টি নামছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। অরন্য কী সত্যি নিখোঁজ হলো নাকি আবার কোনো নাটক। ইদানীং যা হচ্ছে সব কিছুতেই একটা রহস্য লুকিয়ে থাকে।

পরদিন সকালে গেলাম কলেজে। ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরলাম বিকেলে। বিকেলে বাসায় ফিরতেই পুলিশের মুখোমুখি হলাম। কারণ নাফিসা মামলা করেছে। অরন্যকে পাওয়া যাচ্ছে না তাই আমাকে দায়ী করে মামলা করেছে সে। আমাকে জিজ্ঞাসা বাদ করল। আমি পুরো বিষয় খুলে বললাম। উনারা মামলাটা তদন্ত করবে বলে জানিয়ে গেল। সে সাথে জোরালো প্রমাণ না থাকায় তারা আমাকে ধরে নিয়ে যেতে পারলো না। বাসায় সবাই বিষয়টা জানলো। এলাকায় ও জানাজানি হলো হালকা। আমাকে ধরে নিতে পুলিশ এসেছিল কথাগুলো যেন হাওয়ার বেগে ছড়িয়ে পড়ল। বিব্রতকর একটা পরিস্থতির সম্মুখীন হলাম।

তবে পরিবারের যথেষ্ট সাপোর্ট পাচ্ছি এটাই বড় বিষয়। কে কী বলল সেটা গায়ে লাগানোর প্রয়োজন মনে করছি না। কিন্তু অরন্য কোথায়। অরন্য কী কোথাও ইচ্ছা করে লুকিয়ে পড়েছে নাকি গায়েব হয়ে গেছে বুঝতে পারছি না। চিন্তা যেন গ্রাস করছে আমাকে। সারাদিনের ব্যস্ততা সে সাথে এসব চিন্তা আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। বাসার সবাই নিস্তব। তাদের মুখেও চিন্তার ছাপ। আমি ঘরে বসে আছি। এ জীবন থেকে মুক্তির পথ খুঁজছি। যতই বিষয়টা সহজ করার চেষ্টা করছি ততই জটিল হয়ে যাচ্ছিল।

রাতটা কোনোরকম কাটিয়ে দিলাম।।সোহান দু বার কল দিয়েছিল। ইচ্ছা করেই ধরে নি। সকাল সকাল উঠে বাইরে হাঁটতে গেলাম। সকালে হাঁটলে মন মানসিকতা শান্ত হয়।

রাস্তাটা বেশ শান্ত। দু একটা টঙের দোকান খোলেছে সবে। হালকা বাতাস আসছে। এ বাতাসে হাঁটতে বেশ ভলো লাগছে। একাকীত্ব টাকে বেশ উপভোগ করছিলাম। এর মধ্যেই মনে হলো কেউ একজন মুখ চেপে ধরল। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম অরন্য। আমার গা হাত পা কাঁপতে লাগল। আমি কিছুটা জোর খাটিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছিলাম। তবে বলতে পারছিলাম না। হাতে আর মুখে এমন ভাবে ধরেছে যে নড়তে পারছিলাম না। পুরো রাস্তাটা ফাঁকা। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে এত নীরব রাস্তায় চলে এসেছি খেয়াল নেই। আর এ শহরে জোরে চিৎকার দিলেও কেউ সহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে না। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। এমন সময়..

চলবে?

( কপি করা নিষেধ,চাইলে শেয়ার করে পাশে থাকতে পারেন)
চলবে

( কপি করা নিষেধ। চাইলে শেয়ার করে পাশে থাকতে পারেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here