প্রাণস্পন্দন পর্ব ১৩+১৪

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ১৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

সন্ধ্যারাগের আলোকচ্ছটায় প্রাণবন্ত পশ্চিমাকাশ।সোডিয়ামের লাইটগুলো জ্বলে উঠবে খানিক পরেই।অাকাশ জুড়ে থাকবে তখন নিকষকৃষ্ণ অন্ধকার।তার ফাঁক গলিয়ে উঁকি দিবে সুধাংশু।তার মিষ্টি আলোয় কালো অন্ধকার ঢিঙিয়ে ধরণী দেখবে প্রান্তর,উচ্ছল হবে পরিবেশ।বিষন্ন মন পাবে সতেজতা।

বাসায় এসে হাত,মুখ ধুয়ে প্রথমেই হালকা কিছু খেয়ে নেয় নিষ্প্রাণ।মাসের আজ পাঁচ তারিখ।ম্যানেজার আসবে ভাড়া নিতে।গায়ের জামাটা খুলে ঝোলানো দড়িতে তা মেলে দিয়ে বিছানায় বসে নিষ্প্রাণ।একটা সাধারণ চৌকি তার পাশেই পড়ার টেবিল।সেখানে বইয়ে ঠাসা।টেবিলের সামনেই একটা চেয়ার।চৌকিটির পায়ের কাছে একটা বুকশেল্ফ।জামা -কাপড় রাখার জন্য একটা ছোট্ট ওয়্যারড্রব ছাড়া আর তেমন কোন উল্লেখযোগ্য আসবাবপত্র নেই নিষ্প্রাণের এই মেসে।দরজায় খটখটানি হতেই সপ্রতিভ হয় নিষ্প্রাণ।নিশ্চয় ম্যানেজার এসেছে ভাড়া নিতে।খামটা খুলে তিন হাজার টাকা বের করে নিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণ।

ম্যানেজারের চোখ দুটো টসটসে।মুখে থাকা পানের রসটা পিচ করে ফেলে অনাবিল হাসলেন।হেসে হেসে বললেন–

“কেমন আছেন নিষ্প্রাণ সাহেব।আইজ কিন্তু মাসের পাঁচ তারিখ।”

নিষ্প্রাণ স্মিতহাস্য অধরে বললো—

“জ্বী,জানি।এই নিন আপনার ভাড়া।”

টাকাটা হাতে নিয়ে ভদ্রলোক গুনে দেখলেন ঠিক আছে।হাত উঠিয়ে একটা লম্বা সালাম জানালেন নিষ্প্রাণকে।তার বিনিময়ে উষ্ণ হাসলো নিষ্প্রাণ।

দরজা লাগিয়ে ভেতরে আসে সে।মেসের কারো সাথেই সখ্যতা নেই নিষ্প্রাণের।সকাল দিকে একজন মহিলা এসে রান্না করে রেখে যায়।দিনের বেশিরভাগ সময় ভার্সিটি,কোচিং আর বন্ধুদের সাথে কাটায় নিষ্প্রাণ।কোনোদিন বাসায় এসে খায় তো কোনোদিন না।
খামটা সন্তর্পনে খুলে তার ভেতরে অবস্থা দেখে সে।অনুপলেই নিষ্প্রাণের শান্ত চোখ জোড়া চঞ্চল হয়ে উঠে।খামের ভেতর শুধু পাঁচ হাজার টাকা আছে।নিষ্প্রাণ অস্থির হয়ে উঠে,অশান্ত হয়ে উঠে তার মন।কাউকে কল করে নিষ্প্রাণ।কল রিসিভ হতেই ব্যস্ত গলায় বলে উঠে—

“দাদু,আমি আপনাকে বলেছিলাম আমার বাড়তি টাকার প্রয়োজন।কিন্তু…।”

ওপাশ থেকে কিছু একটা বলে লাইন ডিসকানেক্ট করে দেয় দাদু।ফুঁসে উঠে নিষ্প্রাণ।সামনে থাকা চেয়ারে সজোরে এক লাথি মেরে বসে।
,
,
,
সকাল থেকেই থমথমে অম্ব।জমে আছে গুমোট মেঘ।প্রভাকর তার দীপ্তি ছড়াতে পারেনি।বাঁধা আছে তার।কৃষ্ণাভ মেঘের ভাঁজে ভাঁজে আত্মগোপণ করেছে সে আজ।দীর্ঘকায় জারুল গাছটাও চুপ মেরে আছে।ঝিম ধরে আছে তার পত্রপল্লব।প্রকৃতি জানান দিচ্ছে অবশ্যম্ভাবী সেই ক্ষণের।বর্ষণ হবে আজ অন্তরীক্ষের শান্ত চাদর ভেদ করে।

অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথেই শুরু হয়েছে প্রোগ্রাম।বাধ্যবাধকতা নেই সকলের অংশগ্রহনের।শিক্ষার্থীদের অবাধ বিচরণে মুখরিত ভার্সিটির প্রাঙ্গন।আয়েন্দ্রির একান্ত অনুরোধে তার বন্ধুরাও এসেছে।স্টেজ সাজানো হয়েছে তাজা ফুলের সমারোহে।স্টেজ থেকে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে তিন বন্ধু।কথা চলছিল আগামী মাসে অনুষ্ঠিতব্য পরীক্ষা নিয়ে।কথার মাঝেই সীমান্তের ছোট,ছোট অক্ষিজোড়া অশিথিল হয়ে পড়ে।তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু ক্রুটি করে প্রাবিশ।ধাক্কা মেরে হুশ ফিরিয়ে বললো–

“এমন স্ট্যাচু হয়ে গেলি কেন?

সীমান্তের চোখজোড়া সামনেই সীমাবদ্ধ।অনিমেষ চেয়ে থেকে বললো—

“ওইটা আমাগো আন্দি না?

প্রাবিশ আর নিষ্প্রাণ গেইটের দিকে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে যায়।একটা লাল জামদানি পরেছে আয়েন্দ্রি।খোঁপা করা চুলে বেলি ফুলের গাজরা জড়ানো।ভরাট নেত্রযুগলে কাজলের মোটা আঁচড়।অধর রাঙানো সিঁদুর রঙে।আয়েন্দ্রির চোখে,মুখে অদ্ভুত দীপ্ততা।নিষ্প্রাণের ভীত চোখ প্রথমেই থমকে যায় আয়েন্দ্রির ঠোঁটে।আজ আর সেই তীল দৃশ্যমান নয়।স্বাভাবিক চাহনিতেই আয়েন্দ্রিকে দেখে নিষ্প্রাণ।তাদের এই অদ্ভুত চাহনির মাঝেই সামনে এসে দাঁড়ায় আয়েন্দ্রি।সীমান্ত ভাবলেশহীন হয়ে দুই পাশে থাকা প্রাবিশ আর নিষ্প্রাণকে বললো—

“এই সর,সর।আন্দি রে তুই আজ কি মাইখা আইছোস?

তাদের দুজনকে পাশ কাটিয়ে আয়েন্দ্রির পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সীমান্ত।আয়েন্দ্রির গালে তর্জনী দিয়ে একটা ঘঁষা মেরে বললো—

“ওরে আল্লাহ!তুই আমাগো আন্দি তো?কী মাখছোস এডি?

আয়েন্দ্রি রাগ দেখিয়ে বললো–

“একদম হাত লাগাবি না।এক ঘন্টা লাগিয়ে মেকআপ করেছি।তোর এই নোংরা হাত দিয়ে ধরবি না।যা স্যানেটাইজার লাগিয়ে আয়।”

প্রাবিশ ফিক করে হেসে ফেলে।সীমান্ত বিস্ময় নিয়ে বললো—

“এই ছোঢ এক অনুষ্ঠানে তোর এতো সাজ!মাই গড !বিয়ার দিন কিতা করবি তুই?

আয়েন্দ্রি মুচকি হেসে ফিচেল গলায় বললো—

“সেদিন তো তিন ঘন্টা লাগিয়ে সাজবো।আমার বরের চোখে সেদিন সবচেয়ে সুন্দরী আমাকে দেখাতে হবে।”

সীমান্ত মাথা চাপড়িয়ে ধরে।কুসুম কোমল গলায় বললো—

“তোর আবার কী হলো?

সীমান্ত এক বুক নিরাশা নিয়ে বললো—

“ভাবতাছি আন্দির জামাইর কী হবে?
বাসর রাতের পরদিন তো ব্যাটায় আর বাথরুম ছাড়তে পারবো না।সাররাইত যে অখাদ্য খাইবো পেট তো নামবোই।”

আয়েন্দ্রি রেগে সীমান্তের পেটে এক গুঁতো মেরে বসে।নিষ্প্রাণ হালকা ঝুঁকে হাসে।আয়েন্দ্রি খুব করে খেয়াল করে এতো কথার মাঝে নিষ্প্রাণ একটা কথাও বলেনি।
,
,
,
অন্তরীক্ষ আজ বজ্রকঠোর।শান্ত চাঁদোয়া ফেঁড়ে নামবে ধরা সিক্ত বর্ষণ।থমথমে আকাশটা মুহূর্তেই রাশভারী হয়ে গেলো।কৃষ্ণবর্ণ জলদ ছড়িয়ে পড়লো গগন তলে।কিশোরী বিকেলেও প্রকৃতি রূপ নিলো সন্ধ্যারাতির।চারপাশে নেমে এলো অন্ধকার।ধূসরের মাঝে জায়গা হলো কৃষ্ণ কাদম্বিনীর।শুরু হলো সমাহিত গগনের তান্ডব।ক্ষণে ক্ষণে বেজে উঠছে কালো চাঁদোয়া চিরে তীক্ষ্ম সাদাটে আলোর ঝলকানি।সমীরণ খেলে গেলো দুরন্ত খেল।ধরা কাঁপিয়ে তুললো তার তোড়ে।ক্ষণপলেই তার আধিক্য তোলপাড় করে তুললো শান্ত,স্থির,নিষ্কম্প ধরণী।ঝমঝমিয়ে ধরণী বাষ্প গলিয়ে দিলো বাদলের ধারা।

স্টেজ ছেড়ে ব্যস্ত হয়ে উঠে সবাই নিজেকে বর্ষণের তোড় থেকে বাঁচাতে।আয়েন্দ্রি সবেই মাইক হাতে নিয়েছিলো।কিন্ত তার গাওয়া আর হলো না।দ্রুত প্রস্থান করলো সকলে।বিরান স্টেজ শীতল জলে সিক্ত হয়ে গেলো।

ক্লাস রুমে ব্যতিব্যস্ত সবাই।ভিজে জবুথবু সীমান্ত।সিগারেট ফুঁকে মহাজাগতিক সুখে ভাসতে চেয়েছিলো সে।কিন্তু তাকে ভাসিয়ে দিলো বর্ষণের স্রোত।হুড়োহুড়িতে নিষ্প্রাণের কপালের সামনে এসে পড়েছে তার চুল।বাম হাত দিয়ে তা পেছনের দিকে হেলিয়ে দিয়ে সামনে তাকাতেই দেখে হোয়াইট বোর্ডের সাথে দাঁড়িয়ে চোখে কচলে যাচ্ছে আয়েন্দ্রি।এক চোখ কচলাতে থাকলে আয়েন্দ্রির অপর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে স্মিত জলস্রোত।উৎকন্ঠিত নিষ্প্রাণ উঠে দাঁড়ায় বেঞ্চ থেকে।আয়েন্দ্রি কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললো–

“ক্যান আই হেল্প ইউ?

আয়ন্দ্রি খেলনা হারানোর বাচ্চাদের মতো কেঁদেই ফেললো।শিশুসুলভ আচরণের ন্যায় ঠোঁট উল্টে বললো–

“এইটা আবার বলা লাগে!দেখনা চোখে কী পড়েছে।ভীষণ যন্ত্রণা করছে।”

“দেখি।হাত সরাও।”

আয়েন্দ্রির সচেতন মস্তিষ্ক ব্যথায় এতোটা পিষ্টিত যে নিষ্প্রাণকে তুই বলার পরও সে যে কোনো রিয়েক্ট করে নি তা আয়েন্দ্রি খেয়ালই করেনি।আয়েন্দ্রির অক্ষিপুট টেনে ধরে বারকয়েক ফুঁ দিলেও কাজ হয় না।একগটা ছোট্ট পোকা আয়েন্দ্রির চোখের কার্ণিশে জলসিক্ত হয়ে আছে তাই ফুঁ তে তা সরছে না।নিষ্প্রাণ তার পকেট থেকে রুমাল বের করতে গেলে অধৈর্য গলায় বলে উঠে আয়েন্দ্রি—

“তাড়াতাড়ি কর না।”

“ধৈর্য ধরো।”

নিষ্প্রাণ তার রুমালটা রোল করে তার কোণা বের সূঁচালো রুপ দেয় তার।অতি সন্তর্পনে আয়েন্দ্রির চোখের কোণ থেকে সেইটার সাহায্যে পোকাটা বের করে আনে।ব্যাগ থেকে বোতল বের করে আয়েন্দ্রির হাতে দিয়ে বলে—

“পানির ঝাঁপটা দাও ভালো লাগবে।”

খানিক ধাতস্থ হতেই আয়েন্দ্রির ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় জানান দেয় সে এতোসময় নিষ্প্রানকে তুই করে বলেছে।তড়িৎ গলায় বলে উঠে–

“সরি,সরি।আসলে চোখে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছিলো তাই আর খেয়াল করতে পারিনি।তোমাকে তুই বলে ফেললাম।”

নিষ্প্রাণ বিগলিত হেসে ছোট্ট করে বললো–

“ইটস ওকে।”

প্রসন্ন হাসে আয়েন্দ্রি।ভ্যালভ্যাল করে তাদের দিকে তাকিয়ে নিজের শার্ট ঝাড়া মেরে বললো সীমান্ত–

“তুই আর তুমি নিয়া এতো ফর্মালিটিস শুরু করলি ক্যান?আমি তো মাইয়া দেখতে গেলেও এতো ফর্মালিটিস করমু না।”

প্রাবিশ মৃদু হেসে বললো–

“রাইট।ফ্রেন্ডকে তুমি বলা ইটস উইয়ার্ড ইয়ার।যদিও তোদের পরিচয়টা নতুন।তবে নতুন থেকেই সব পুরাতন হয়।কি বলিস?

একগাল হাসে সীমান্ত।হাই বেঞ্চের উপর দুই পা ফাঁক করে বসেছিলো সে।দুই হাতের তালুর উপর ভর দিয়ে বেঞ্চ থেকে নেমে এসে ভেজা গায়েই কাঁধে হাত দেয় নিষ্প্রাণের।হাস্যোজ্জ্বল গলায় বললো—

“আন্দি নিষ্প্রাইন্নারে তুই বলছে এর জন্য আজ নিষ্প্রাইন্না ট্রিট দিবো আমাগোরে।”

নিষ্প্রাণ চমকিত হয়।ট্রিট!আমতা আমতা করে বললো—

“আআআমি?

“হ তুই।আর আইজ আন্দি সাইজ্জা গুইজ্জাও আইছে।সাথে সুন্দরী থাকলে ডিসকাউন্ট পাওয়া যায় বুঝলি।ওই সেদ্ধ ডিমের কুসুমডা কইরে?এইটা সাথে নিয়া নেই।ওইটারেও ভালো লাগতাছে আজ।হলুদ আর সাদা।পুরাই বয়েলিং আন্ডা।”

হু হা করে হেসে উঠে সবাই।নিষ্প্রাণের চিন্তিত হাসি।এমনিতেও টাকা কম পাঠিয়েছে তার দাদু।এখন আবার বাড়তি খরচ।নিষ্প্রাণের গলা ধরে আসে।

বাইরে চলছে নিরবধি বর্ষণ।কৃষ্ণ নীরধর ক্রমশ গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে।উঁকি দিচ্ছে শুভ্র আকাশ।
#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ১৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

নক্ষত্রলোকের ক্লান্তিহীন অশ্রুজলে সিক্ত পত্রপল্লব।ধরিত্রীর প্রভঞ্জনে হিমশীতলতা।শান্ত প্রকৃতির অশান্ত,বিমূঢ় আচরণে উৎকন্ঠিত মনুষ্যগন।যামবতীর নিকষকৃষ্ণ আঁধার ফুঁড়ে বজ্রধ্বনি।ঝমঝমিয়ে মৃত্তিকার বুকে পড়া কলধ্বনি।নির্বাক,শীতল পরিবেশে ছন্দপতন শুধু বর্ষণের।

পিচঢালা সড়ক পথের পায়ের গোড়ালি ডুবন্ত পানি।শহরাঞ্চলে বর্ষণের অতি পরিচিত রোমাঞ্চকর রূপ।ক্ষণিক বর্ষণে জমে যায় জলদবারি।ডুবো ডুবো পায়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির তাল সামলিয়ে একটা ক্যাফেতে ঢুকে চার বন্ধু।নভোমণ্ডলের ক্রন্দন আজ যেনো থামবার নয়।খানিক সময় পরপর মৃদু সুরে সে ঝরায় অশ্রুনীর।তাতে প্রলেপিত হয় বসুন্ধরা।

মাঝখানে অবস্থিত একটি টেবিলের দুই পাশে বসে আয়েন্দ্রি,সীমান্ত আর প্রাবিশ,নিষ্প্রাণ।সীমান্ত পাতলা শার্ট দ্বিতীয়বারের মতো বৃষ্টির কবলে পড়ে।আয়েন্দ্রির শরীরে মৃদু বৃষ্টির ছটা।আঁচলটা পেছনের দিকে মেলে দিয়ে লম্বা শ্বাস ফেলে সে।ফ্যানের বাতাসে কম্পিত দেহেও প্রশান্তি।আর্দ্র দেহে উষ্ণতার যোগান প্রয়োজন।প্রাবিশ মুখে লেগে থাকা পানি মুছে নেয় টেবিলে থাকা টিস্যু পেপার দিয়ে।সেই মতো ঘটনার পূনারাবৃত্তি ঘটায় আয়েন্দ্রি।ঝাঁকড়া চুলগুলো পেছনে হেলিয়ে দেয় নিষ্প্রাণ।শার্টের উপরের দুই বাটন খুলে কলারটা পেছন দিকে ছড়িয়ে দিয়ে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে সীমান্ত।তার অগোছালো বসার কায়দা দেখেও নির্বিকার সকলে।এক পা হাঁটু ভেঙে বেঞ্চে উঠিয়ে রেখেছে।দ্রুত বেগে ঘুরছে ফ্যান।সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

ক্যাফের ছেলেটা এসে অর্ডার নিয়ে যায়।পারসেট আড়াইশত টাকার সেটমেন্যু অর্ডার করে সীমান্ত।আজকের স্পেশাল অফারে চারশত টাকার বদলে তা আড়াইশত করা হয়েছে।নিষ্প্রাণের মনে চলছে নিরবচ্ছিন্ন অস্থিরতা।তার দাদু তাকে এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি।ভুলতে পারেনি ভয়াল সে অতীত।সেই আগুন,আগুনে দগ্ধ লাশ,ছাই হয়ে স্তুপে পরিণত হওয়া সেই দেহাংশ।নিষ্প্রাণের মানসলোকে প্রকটিত হয় সেই আর্তনাদ,সেই মৃত্যু আহাজারি,চোখের সামনে লহুতে রঞ্জিত সেই লাল তিলওয়ালা ঠোঁট। যার চোখে সম্ভ্রম হারানোর কাতরতা।প্রস্ফুরণ শুরু হয় নিষ্প্রাণের শরীরে।শ্বাসের বেগ বাড়তে থাকে।নিষ্প্রাণ অব্যক্ত রাগে ফুঁসতে থাকে।তার বেগতিক অবস্থায় ধমকে উঠে সীমান্ত–

“ওই নিষ্প্রাইন্না !কী হয়েছে তোর?

ফট করেই অক্ষিপল্লব মেলে ধরে নিষ্প্রাণ।উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক পলক ফেলে তাকাতেই দেখে সব শান্ত,স্বাভাবিক।নেই উষ্ণতা,নেই শোনিত জড়ানো সেই লাশ,নেই কৃষ্ণকায় দগ্ধ দেহ,নেই আর্তনাদ।নিজেক ধাতস্থ করে লোচনজোড়া থেকে চশমাটাটা নামিয়ে রাখে টেবিলে।একটা টিস্যু নিয়ে ঝাপসা চশমাটা মুছে পূর্বের স্থলে প্রতিস্থাপন করে।মুচকি হাসে আয়েন্দ্রি।প্রশ্ন করে—

“পাওয়ার কতো?

নিষ্প্রাণ নির্দ্বিধায় বললো–

“মাইনাস 1….।”

সীমান্ত খটমটিয়ে বললো—

“তোর দরকার কী?তুই ও আন্দা হবি নাকি?অবশ্য তুই তো নাম রাখার পর থেইকাই আন্দি।”

সীমান্তের মাথায় চাটি মেরে বসে আয়েন্দ্রি।সীমান্ত ছোট্ট দম ফেলে নিরুদ্যম গলায় বললো—

“ডিমের কুসুমডার ভাব বাড়ছে।রিকোয়েস্ট করলাম তাও আইলো না।”

আয়েন্দ্রি অনুদ্বেগ গলায় বললো–

“ও আসলে ওর মামা,মামী রাগ করবে।অন্যের বাসায় থাকে বুঝিস তো ব্যাপারটা।”

“কেন তিনকোনা মানাইতে পারতো না?হুরর!যত্তসব।”

আয়েন্দ্রি হতাশ গলায় বললো–

“তৃণা লেখাপড়া নিয়ে সিরিয়াস।এইসবে ওর ইন্টারেস্ট নেই।”

“ওরে যাইয়া বলিস ওর মধ্যেও কোনো ইন্টারেস্ট নাই আমার।”

কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁঞ্চি করে তিন জোড়া স্থির চোখ সীমান্তের দিকে অকস্মাৎ তাকাতেই মিনমিনে গলায় বলে উঠে সে—

“আরে আগে থেইকা কইয়া রাখলাম আরকি।ওইসম বইয়ে ডুইবা থাকা ললনা দিয়া আমার পোষাইবো না।”

নিষ্প্রাণ অধর কোণে হেসে সামনের দিকে তাকাতেই তার শিথিল দৃষ্টি অনুপলেই অশিথিল,অচক্রী,তীক্ষ্ম,
উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে।পেছনের বিশাল আয়নায় আয়েন্দ্রির উন্মুক্ত পিঠের অর্ধাংশ দৃশ্যত।তাদের টেবিল থেকে দুই টেবিল পড়ে থাকা টেবিলে উপবিষ্ট দুই জোড়া ছেলের মধ্যে একজনের নিমেষহীন চাহনি আয়েন্দ্রির শুভ্র,বাঁকহীন নগ্ন পিঠে।তরতর করে নিষ্প্রাণের থিতিয়ে থাকা সেই বন্দি মানব যেনো জাগ্রত হতে চাইছে।সকলের অগোচরে ভাবাবেগ ছাড়াই উঠে দাড়ায় নিষ্প্রাণ।আয়েন্দ্রির পাশে গিয়ে টেবিলের উপর এক হাত রেখে ঝুঁকে যায়।আয়েন্দ্রির কর্ণরন্ধ্রে ফিসফিসানো আওয়াজ—

“সামনের টেবিলে গিয়ে বসো।”

নিষ্প্রাণের ক্ষীণ কন্ঠ ভয়ংকর শীতল মনে হলো আয়েন্দ্রির।তার উষ্ণ নিঃশ্বাসে শিরশিরিয়ে উঠলো আয়েন্দ্রির দেহপিঞ্জর।দ্বিধান্বিত আয়েন্দ্রি বিনাশব্দে উঠে নিষ্প্রাণের জায়গায় বসে।হতভম্ব চোখে অবলোকন করছে প্রাবিশ আর সীমান্ত।খাবার দিয়ে যেতেই স্বাভাবিক হয় পরিস্থিতি।কিন্তু নিষ্প্রাণের নজর সেই ছেলেটির প্রতিটি অঙ্গভঙ্গিতে।আয়নায় তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নিষ্প্রাণ।তার অভীপ্সা জাগ্রত দুই চোখে খেলে যাচ্ছে আয়েন্দ্রির দেহের গভীরতার লুকায়িত বাসনা।খাবারে মনোযোগ নেই নিষ্প্রাণের।

আধুনিক ক্যাফে হওয়ায় হাত ধোয়ারও আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে।সম্মুখে উপস্থিত আরশিতে লোচনজোড়া স্থির হতেই আয়েন্দ্রি ঠাওর করে তার লাল ঠোঁট দুটোতে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে লিপস্টিক।টিস্যু দিয়ে মুছে নেয় তা।আয়েন্দ্রির নগ্ন কোমরে যেই না হাত ছোঁয়াতে যাবে ছেলেটি তাকে এক ঝটকায় টেনে হাতের মুষ্টি তার চোখের সন্নিকটে এনেও রুখে যায় নিষ্প্রাণ।নাকের পাটা ফুলিয়ে,দাঁতে দাঁত নিষ্পেষন করে নিজেকে শান্ত করে নিষ্প্রাণ।স্বল্প সময়ের পার্থক্যে হুলস্থুল কান্ড।ছেলেটি অস্বীকার করে তার উদ্ধত নোংরা কাজটির।নিষ্প্রাণ গজরাতে থাকে।পকেট থেকে হাজার টাকার নোট বের করে ধরিয়ে দেয় সীমান্তের হাতে।কঠিন গলায় বললো—

“বিলটা পে করে দিস।আই এম ফিলিং রেস্টলেস।”

নিষ্প্রাণের পরাস্থতায় পৈচাশিক হাসে ছেলেটি।ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আর্দ্র,বালিতে দলিত সড়কপথে হাঁটা ধরে নিষ্প্রাণ।চূড়ান্ত রাগের বহিঃপ্রকাশ তার পদতলে।দপ দপ করে পা ফেলতেই সড়কের জমা পানি আর পানিমিশ্রিত বালু,আবর্জনা নিষ্প্রাণের দুই প্যান্ট মাখিয়ে ফেলেছে।তবুও অশান্ত দুই পা এগিয়ে চলছে।
,
,
,
ক্রন্দনে হাঁসফাঁসিয়ে উঠা নিশীথিনীর অম্বু শান্ত।টানা বর্ষণে ভারী বুক হালকা হয়েছে তার।রাতের স্নিগ্ধ আকাশে উদিত চন্দ্রিকা।ঝিলমিলে তারকারাজি আজ অদৃশ্য।সমীরণে এখনো আর্দ্রতা।পথঘাট পানিতে পরিশ্রান্ত।

ঢাকা শহরের টিবিগেট একটা ঘনবসতি এলাকা।মূল সড়ক থেকে ভেতরের অলিগলি বেশ সংকীর্ণ।লাগোয়া ঘরবাড়ি।ভেতর গলির প্রশস্ততা এতোটাই সংকীর্ণ যে প্রশ্ন হতে পারে আদৌ সেখানে তিন চাকায় চালিত রিক্সার প্রবেশ সম্ভব?এখানেরই সাইড দেওয়াল আর টিনের ছাউনি বেষ্টিত তিন বেডরুম আর রান্নাঘর,স্নানাগার বিশিষ্ট নিজস্ব বাড়িতে থাকেন জহুর মিয়া তার দুই ছেলেকে নিয়ে।ছোট ছেলে এখানকার ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট।

একজন চেইন স্মোকার জহুর সাহেবের ছোট ছেলে জেমি।রাতের খাবার খেয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে বাইরে বের হয়ে আসে।ভগ্নিপতী এসেছে বলে নিজের ঘরটা তার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে।বড় ভাইয়ের সকালে অফিস।সে নিজ কক্ষে নিদ্রাচ্ছন্ন।বাবা অসুস্থ। হাফ দেওয়ালের বাউন্ডারির বাড়িটির ছোট্ট গেইট খুলে বাইরে এসে সিগারেট ধরায় জেমি।দুই আঙুলের ফাঁকে রেখে দুটো টান দিতেই আচমকাই তার মুখে কেউ রুমাল চেপে ধরে।জেমি কিছু বুঝে উঠার আগেই নিশ্চেতন হয়ে ঢলে পড়ে পেছন দিকে।তার পুরো ভর সামলে নেয় নিষ্প্রাণ।সহজ,স্বাভাবিক নিষ্প্রাণ ভেজা রাস্তায় শুইয়ে দেয় জেমিকে।জেমি অচেতন।হাতের সিগারেটটা নিচে পড়ে যেতেই জলের সংস্পর্শে নিভে যায় তা।এক হাঁটু গেড়ে বসে নিষ্প্রাণ।নীরব,নিস্তব্ধ,নির্বাক চারপাশ।নিষ্প্রাণের চাহনিতে অবিশ্বাস্য স্বাভাবিকতা।কোমল স্বরে বললো—

“আমার ধ্রুবতারার দিকে হাত বাড়িয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করলি তুই।”

নিষ্প্রাণ সাবলীলভাবে একটা ছোট্ট শিশি বের করে পকেট থেকে।তার ছিপি খুলে কাত করে ভেতরে থাকা তরল ঢালতে থাকে জেমির মুখের উপর।অদ্ভুত আওয়াজে ঝলসে যেতে থাকে জেমির মুখমণ্ডল।সালফিউরিক এসিডে দগ্ধ হয়ে যায় জেমির সুশ্রী মুখটা।তীর্যক হাসে নিষ্প্রাণ।ঘুমের চাদরে আবৃত নগরীতে জেগে আছে রাস্তার নেড়ি কুকুর।আবছা আলোতে নিষ্প্রাণকে দেখে সশব্দে ডেকে উঠে কালো রঙের হাড় বেরিয়ে আসা কুকুরটি।নিষ্প্রাণ আলতো হাসে।আরো কয়েকটা কুকুর এসে জড়ো হওয়ার আগেই জেমির গলায় ঢুকিয়ে দেয় বিশাল এক লোহার তীক্ষ্ম দন্ড।যা সহজেই ঢুকে যায় স্বরনালীর গভীরে।গলগলিয়ে রক্তের ধারা বইতে থাকে।কুকুরের আত্ম চিৎকার শুরু হতেই অন্ধকারের প্রলীন হতে থাকে নিষ্প্রাণ।তার ঠোঁটে সেই অদ্ভুত সিটির সুর,তৃপ্তির হাসি।কুকুরগুলো জেমিকে ঘিরে সমানতালে চেঁচিয়ে পুরো এলাকার ঘুমন্ত মানুষদের জাগিয়ে তুলছে। শীতল,স্বচ্ছ পানির সাথে মিশে যাচ্ছে জেমির উষ্ণ,লাল রক্ত।

চলবে,,,

(বিঃদ্রঃ
সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন😒😒😒)
চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here