প্রাণস্পন্দন পর্ব ২১+২২

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ২১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

সন্ধ্যা নেমেছে ধরণীর বুকে। মাতাল হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে রিক্সা। সোডিয়াম বাতির আলোক ছটায় মেতে উঠেছে অন্ধকার শহর। হুরহুরে বাতাসেও মনে উচাটন আয়েন্দ্রির।

নিষ্প্রাণের এমন কাজে বিস্ময়ে আত্মা কেঁপে উঠে আয়েন্দ্রির। ছেলেটির হাতে ভাঙা ফুলদানি গেঁথে দিতেই গলগলিয়ে লহুর নহর বইতে থাকে। ততক্ষণে হুলস্থুল,কোলাহলে ভড়কে যায় পুরো পরিবেশ।চিৎকার,চেঁচামেচি আর হৈ হুল্লোড়ে মেলার ভেতরে দৌঁড়ে আসে প্রাবিশ আর সীমান্ত। ক্রোধে বিহ্বল নিষ্প্রাণ ফোঁস ফোঁস করছে। আয়েন্দ্রি একরাশ ভয় নিয়ে চেয়ে আছে নিষ্প্রাণের শান্ত কিন্তু প্রকুপিত মুখটার দিকে। কুসুম আর তৃণা ভয়ে সিটিয়ে আছে।

ছেলেটা স্থানীয় এলাকার বখাটেদের সর্দার। ইচড়ে পাকা আজকালকার ছেলেরা নিজেদেরকে কী ভাবে তা তাদের নিজেদেরও অজ্ঞাত!
ছেলেটার এই অবস্থা দেখেই সাথে থাকা বাকি দুটো ছেলেও ভয়ে আঁতকে উঠে। ঝড়ের তান্ডব মাতিয়ে লোক জড়ো করতে থাকে। ছুটে আসে আরো কিছু ছেলেপেলে। মুহূর্তেই ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হয়।কিন্তু তার আগেই ভীড় ঠেলে নিষ্প্রাণকে বের করে আনে বাকিরা। দ্রুত আয়েন্দ্রি আর নিষ্প্রাণকে একটা রিক্সায় উঠিয়ে দেয়। তার পেছনেই আরেকটা রিক্সায় তৃণা আর কুসুমকে। প্রাবিশ আর সীমান্তকে ঠাওর করতে পারেনি ছেলেগুলো। খেলার ব্যাট,হকিস্টিক,রড কোনো কিছুরই কমতি হলো না। ছেলেগুলো তা হাতে নিয়ে পুরো মেলায় চিরুনি তল্লাশি চালায়। কিন্তু হাত লাগে না কিছুই।

নিষ্প্রাণের কোমল মুখটার দিকে চেয়ে আছে আয়েন্দ্রি।ভয়ে তার বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে। ঢোক গিলতেও ভীষণ কষ্ট!
আয়েন্দ্রি ভয়কাতুরে গলায় বললো–

“এমন করলি কেন তুই?ছেলেটাকে এভাবে কেন মারলি?

নিষ্প্রাণ স্নিগ্ধস্বরে বললো–

“সীমান্ত করলে ওকে এই প্রশ্নটা করতি?

আয়েন্দ্রি গম্ভীর গলায় বললো–

“তুই আর সীমান্ত এক নস। সীমান্ত উড়নচন্ডী।কখন কী করে বসে ঠিক নেই।কিন্তু তুই তা নস।”

আয়েন্দ্রির দিকে মায়াভরা চোখে তাকায় নিষ্প্রাণ। সেই নজর সোজা গিয়ে আটকে আয়েন্দ্রির অধরে। ভারী গলায় বললো—

“তোর ক্ষেত্রে আমি এরচেয়েও ভয়ংকর।”

আয়েন্দ্রি ভয়চকিত গলায় বললো—

“এইসব কী বলছিস তুই?

নিষ্প্রাণ সাবলীল গলায় বললো—

“তোর দিকে হাত বাড়ানোর অধিকার আমি আমার ছায়াকেও দেবো না।”

আয়েন্দ্রি রূদ্ধবাকে আঁখিপল্লব প্রশস্ত করে অপলক চেয়ে থাকে নিষ্প্রাণের দিকে। নিষ্প্রাণ কিয়ৎ কড়া গলায় বলে উঠে—

“থামান মামা।আমি নামবো।”

আয়েন্দ্রি নিষ্প্রাণে হাত টেনে ধরে বললো–

“কোথায় যাচ্ছিস তুই?

নিষ্প্রাণ আলগোছে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয় আয়েন্দ্রির কাছ থেকে। রিক্সা থেকে নেমে নিষ্প্রভ গলায় বললো—

“বাসায় যা।আমার কাজ আছে। যান মামা। ঠিকমতো বাসায় পৌঁছে দেবেন। নিষ্প্রাণের প্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন আপনি।”

আয়েন্দ্রির দিকে সরল দৃষ্টি রেখেই কথাগুলো বললো নিষ্প্রাণ। রিক্সা চালক তেমন কিছুই বুঝলো না। তবে বর্তমান যুগের প্রেমিকযুগলদের তাদের চিনতে ভুল হয় না।লিংক রুটের কাছে আসতেই নেমে যায় নিষ্প্রাণ।আয়েন্দ্রি কিছুতেই বুঝতে পারছে না নিষ্প্রাণ কেন আবার পেছন দিকে হাঁটা শুরু করেছে।
রিক্সা চলতে শুরু করে। আয়েন্দ্রি ঘাড় বাঁকিয়ে নিষ্প্রাণকে দেখছে। কৃত্রিম আলোর বাঁকে বাঁকে হেঁটে যাচ্ছে নিষ্প্রাণ। ক্ষণকাল পরেই ভীড়ের মধ্যে মিলিয়ে যায় সে।আয়েন্দ্রি ঘুরে বসে। তার উন্মনা,দিকভ্রষ্ট দৃষ্টি।
,
,
,

হসপিটালে স্যালাইন দিয়ে রেখেছে আহত ছেলেটাকে।তার সাথে এসেছে তার উশৃঙ্খল বন্ধু-বান্ধব। পাড়ায় বেহায়াপনা করে বেড়ানোর কারণে কোনো লিগ্যাল গার্ডিয়ান তার সাথে আসেনি। তবে বন্ধুদের আশ্বাসিত কথা,যে তার এই অবস্থা করেছে তাকে ঠিক খুঁজ বের করবে। এবং তারও ঠাই হবে এই হসপিটাল।ছেলেটার সাথে তার দুটো বন্ধুই বসেছিলো। চোখে ঘুম জড়িয়ে আসতেই একজন চলে যায়। আরেকজন ঠায় বসে থাকে। তলপেটে চাপ পড়তেই ওয়াশরুমের জন্য কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে। একটু আগেই ডক্টর রাউন্ড মেরে গিয়েছে। তাই এখন সকলে ব্যস্ত তাদের কাজে। নিষ্প্রাণ শান্ত পায়ে হেঁটে গিয়ে ওয়াশরুমের দরজাটা বাইরে থেকে লক করে দেয়।

করিডোর আপাতত ফাঁকা। ছোটখাট নিম্নমানের হসপিটাল হওয়ায় তেমন কোনো সিকিউরিটির ব্যবস্থা নেই। নিষ্প্রাণ সেই সুযোগ কাজে লাগায়।কেবিনে ঢুকতেই দেখে ছেলেটা ঘুমে বিভোর। নিষ্প্রাণ ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে যায়। শুভ্র বিছানার পাশে এসে স্থির হয়। গাঢ় চোখে ছেলেটাকে দেখে।এই ঘুমই তার শেষ ঘুম!

পকেট থেকে রুমাল সমেত হাতটা বের করে ছেলেটার নাকের উপর কিছুক্ষণ চেপে ধরে। ছেলেটা এইবার সত্যি সত্যিই নিশ্চেতন। স্যালাইনের প্লাস্টিকের বোতলের দিকে দৃষ্টি ফেলে নিষ্প্রাণ।তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে একটা মোটা বই বের করে।তার মাঝে একটা ছোট্ট কাঁচের শিশি। বইয়ের মাঝখানে বেশ খানিকটা জায়গা কেটে সেই গর্তেই বসানো সেই শিশি।সেখান থেকে সিরিঞ্জের মধ্যে কিছুটা তরল নিয়ে স্যালাইনে পুশ করে যা একটু একটু করে প্রবেশ করছে ছেলেটা সমাহিত শরীরে। যা একটু পরেই ছেলেটার হৃদকম্পন থামিয়ে দেবে।

নিষ্প্রাণ একটু ঝুঁকে পড়ে ছেলেটার মুখের উপর। অদ্ভুত সেই সিটির আওয়াজ নিঃসৃত হয় নিষ্প্রাণে বলয় আকৃতির ওষ্ঠাধর থেকে। ছেলেটার হাতের দিকে তাকাতেই তার শান্ত চোখ দুটো ক্ষীপ্ত হয় উঠে। ব্যান্ডেজ করা হাতটার সবগুলো আঙুল ভেঙে ফেললো এক এক করে। ব্যান্ডেজ খুলতেই কাটা হাতটাতে হেয়ালি চোখে তাকিয়ে থাকে। তাতেও প্রশান্তি পেলো না সে। ছেলেটার হাতে লাগানো স্যালাইনের সূঁচটা খুলে নিয়ে তা টুকটুক করে ঢুকাতে থাকে ছেলেটার হাতে। রক্তে ভিজে উঠে সফেদ চাদর।পুলকিত হয় নিষ্প্রাণ।ছেলেটার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো—

“ওকে আমি বাঁচাতে পারিনি ওদের ওই লালসা থেকে।কেড়ে নিয়েছে ওরা ওকে। রক্তাক্ত করেছে ওকে।হিংস্র হায়েনার মতো খুবলে খেয়েছে।আমি শুধু সেই আর্তনাদ শুনেছি। দেখেছি সেই রক্তের নদী। কিন্তু আমার ধ্রুবতারার দিকে হাত তো দূরের কথা,যে চোখ ওকে সেই নজরে দেখবে তার শ্বাস আমি কেড়ে নেবো।মৃত্যুই হবে যার ভবিতব্য।”

কেবিন থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে নিষ্প্রাণ। মৃদু আওয়াজে সেই সিটি। যা দেওয়ালে দেওয়ালে কম্পন ধরিয়ে দিয়েছে।
#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ২২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

অনুভূতিশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আয়েন্দ্রি। মাথার উপর বিশাল দগদগে সূর্যের পিঠ জ্বালা করা তাপে দাপিয়ে উঠছে দেহপিঞ্জর। নিষ্প্রাণের মায়াময় মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে ফিকে আওয়াজে বললো–

“তোর জন্য গার্লফ্রেন্ডের ব্যবস্থা করেছি।”

নিষ্প্রাণ হৃদয় ভেজা হেসে বললো–

“আমার তো তোকে প্রয়োজন।”

আয়েন্দ্রি সরু চোখে তাকিয়ে বললো—

“সামনে তাকা।”

কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে পেছন দিকে হেলে বসে আছে নিষ্প্রাণ। তার পাশেই ঘাসের উপর পা মুড়ে বসে আছে আয়েন্দ্রি। চকচক চোখে তাকিয়ে আছে ভার্সিটির নার্সারির পাশে দাঁড়ানো লম্বা মেয়েটার দিকে। নিষ্প্রাণ সেদিকে পলক ফেলে গাঢ় হাসে। হলুদ রঙের সালোয়ার কামিজ পরা একটা মেয়ে দাঁড়ানো।মেয়েটার ভারী,ঘন,রেশমি চুল তার নিতম্বের নিচে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। পলকহীন চোখে সেদিকে তাকিয়ে মেয়েটাকে আদ্যোপান্ত দেখছে নিষ্প্রাণ। পাশ থেকে আয়েন্দ্রি কলের মানবের মতো বলতে থাকে–

“অনার্স প্রথম বর্ষ।অ্যাকাউন্টিং ডিপার্টমেন্ট।শ্রেয়া নাম।দেখতেও মাশাআল্লাহ্!

নিষ্প্রাণ তার ঘনপল্লবে আবৃত আয়তলোচন দিয়ে শ্রেয়াকেই দেখছে। তার নিমেষহীন আঁখিযুগলের দিকে তাকিয়ে ফিচেল হাসে আয়েন্দ্রি। ফট করে বললো—

“মেয়েটাকে পটাতে পারবি?

নিষ্প্রাণ নির্বিকার গলায় বললো—

“যদি পারি তাহলে কী দিবি আমায়?

আয়েন্দ্রি কপট হেসে বললো—

“তোর প্রস্তাব ভেবে দেখবো।”

নিষ্প্রাণ ঝট করেই উঠে দাঁড়ায়।উরুর উপর রাখা কালো ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বললো—

“মনে রাখিস।”

আয়েন্দ্রি ভয়াতুর ঢোক গিলে। সে মনেপ্রাণে চায় নিষ্প্রাণ শ্রেয়ার প্রেমে পড়ুক। গভীরভাবে তার হৃদকোঠরে জায়গা করে নিক শ্রেয়া। শ্রেয়া সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছে আয়েন্দ্রি। মেয়েটা লেখাপড়ার পাশাপাশি চরিত্রেও ভালো।

আয়েন্দ্রির ভাবনার সুতো কাটে। সে ক্ষীণ দৃষ্টিতে দেখলো শ্রেয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে নিষ্প্রাণ।

নিষ্প্রাণকে দেখে ভ্রু কুঞ্চি করে শ্রেয়া। দুধসাদা মুখটার অধরপল্লব লাল রঙে রঙিন। চোখে গাঢ় কাজল। থুতনিতে দৃশ্যমান খাঁজ। সেইটা যেনো শ্রেয়ার সৌন্দর্য আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিলো। তপ্ত লাভায় মৃদু প্রভঞ্জনের দোল। শ্রেয়ার রেশম কালো চুল উড়ছে।কয়েকগাছি চুল তার ছোট্ট,মোলায়েম, সমান্তরাল ললাটে আস্তানা গাড়তেই ব্যস্ত হাতে তা কানের পাশে গুঁজে নিয়ে চকিত গলায় বললো–

“কে আপনি?

স্মিত হাসলো নিষ্প্রাণ।তাতেই তার চোখে খেলে গেলো দুরন্তপনা। চোখের কার্ণিশে মৃদু কুঞ্চন। ভ্রমরকালো ভ্রুযুগল টানটানভাব। শ্রেয়া বিস্মিত হলো। নিষ্প্রাণের অর্ধ বাঁকের হাসিতে কিছু একটা ছিলো! যা বিষবাণের হয়ে বিঁধলো শ্রেয়ার বক্ষস্থলে। শ্রেয়া ভ্রু নাচিয়ে ফের প্রশ্ন করে—

“কে আপনি?

শ্রেয়ার পাশে দাঁড়ানো তার সহপাঠী শম্পা কুঞ্চিত কপালে সন্দিহান সুরে বললো—

“আপনি নিষ্প্রাণ? কেমেস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট? এইবার সেকেন্ড ইয়ারে টপ করেছেন?

শম্পার দিকে এক নজর তাকিয়ে চোখ ফেরায় নিষ্প্রাণ। শ্রেয়া অদ্ভুত সুরে বললো—

“তুই চিনিস?

“হুম।ভাইয়ার ব্যাজমেট।”

“ও।আপনি এখনো দাঁড়িয়ে আছেন?

নিষ্প্রাণকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করতেই নম্র গলায় প্রত্যুক্তি করে সে—

“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

বিমুগ্ধচিত্তে নিষ্প্রাণের কন্ঠনালীর দিকে তাকায় শ্রেয়া।চওড়া কাঁধ বিশিষ্ট নিষ্প্রাণের গলার ডানপাশে একটা দাগ। মনে হচ্ছে পোড়া দাগ! তার শুভ্র রঙে বড্ড বেমানান তা! সেখানেই নিগূঢ় দৃষ্টি শ্রেয়ার। নিষ্প্রাণ শম্পার দিকে তাকিয়ে অনুনয়ের সুরে বললো—

“প্লিজ।”

শম্পা বুঝতে পারলো নিষ্প্রাণ শ্রেয়ার সাথে একা কথা বলতে চায়। তাই সে ক্লাসের দিকে হাঁটা ধরে। শ্রেয়ার সন্দিহান দৃষ্টি পড়তেই বিগলিত হেসে বলে উঠে নিষ্প্রাণ—

“কেমন আছো?

অবাক হলো শ্রেয়া। অপরিচিত একটা ছেলে তাকে প্রশ্ন কেন করছে!
শ্রেয়া চোখের পল্লব ধীরেসুস্থে ফেলে বললো–

“ভালো।আপনি?

“কোনটা বলবো?পরিচয় নাকি কেমন আছি?

শ্রেয়া নির্ভয়চিত্তে হাসে।ঝরা গলায় বললো–

“আসলে আপনি কী চাইছেন বলুন তো?

নিষ্প্রাণ হুট করেই মুক্ত কন্ঠে বললো—

“চুলের যত্ন করো অনেক!

শ্রেয়া ভ্রু কুঞ্চন করে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়। চোখের কোণ সংকুচিত করে বললো—

“তেমন কিছু নয়।আপনি কি আমার চুলের প্রশংসা করতে এসেছেন? ইটস রিয়েলী উইয়ার্ড! চুলের প্রশংসা করে কাউকে ইমপ্রেস করা,হাস্যকর!

নিষ্প্রাণ চোখে হেসে বললো—

“আমি নিষ্প্রাণ মুনতাসির। অনার্স থার্ড ইয়ার। কেমেস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট। এইটুকু তোমার বান্ধবী তো বলেই দিয়েছে। এখন আমি যা বলতে চাইছি শোনো। ওইদিকে দেখো। ও আমার ধ্রুবতারা। ও তোমাকে ভীষণ পছন্দ করে। কেন করে তা আমি জানি না। তবে হয়তো তুমি স্পেশাল!তাই।”

শ্রেয়া অবিশ্বাস্য চোখে তাকায়। ছেলেটা বলে কি!
শ্রেয়া চোখ ঘুরিয়ে তাকায় আয়েন্দ্রির দিকে। আয়েন্দ্রি প্রাণহীন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। শ্রেয়া সরল গলায় বললো—

“ও আপনার ধ্রুবতারা?

“হ্যাঁ।”

“ওভাবে তাকিয়ে আছে কেন?

“জানি নাতো।”

শ্রেয়া মুচকি হাসে।জানার আগ্রহ নিয়ে বললো—

“ও কি আপনার বন্ধু?

নিষ্প্রাম মৃদু হেসে স্নিগ্ধ স্বরে বললো–

“হ্যাঁ।”

শ্রেয়া বেশ সময় ধরে আয়েন্দ্রিকে দেখে। সাধারণ গোলগাল চেহারার মেয়েটার মধ্যে দাম্ভিকতার সৌন্দর্য না থাকলেও ভারি মিষ্টি দেখতে। নাতিদীর্ঘ চুলগুলো পনিটেইল করা। একটা খয়েরী রঙের থ্রিপিস পরেছে।তাতে ফিকে ফর্সাভাব একটু ঝলকে এসে তাপিত রৌদ্দুরে হানা দেয় চোখের মনিতে। ছিমছাম গড়নের দেহে অতিরিক্ত মেদ না থাকলেও দেখতে বেশ লাগে। ফট করেই অধর ছড়িতে হেসে ফেলে শ্রেয়া। নিষ্প্রাণের দিকে আদুরে চোখে তাকিয়ে বললো–

“বেশ মজার বিষয়! আপনার ফ্রেন্ডের আমাকে ভালো লাগে তাই আপনি আমার সাথে কথা বলতে চলে এলেন?

নিষ্প্রাণ সজীব হেসে বললো—

“উহু। আসলে ও বলেছে আমি যদি তোমাকে ইমপ্রেস করতে পারি তাহলে ওকে বলা আমার অনুভূতিকে ও একবার ভেবে দেখবে।”

মুহূর্তেই কালো মেঘে ছেয়ে যায় শ্রেয়ার লাস্যময়ী মুখটায়।মন মরা গলায় বললো–

“কোন অনুভূতি?

“প্রাণহীন অনুভূতি।”

বলেই সশব্দে হেসে উঠে নিষ্প্রাণ। কেমন অস্থির,অসহিষ্ণু চোখে নিষ্প্রাণকে দেখে শ্রেয়া। ছেলেটা কী অদ্ভুত কথা বলে!চোখের চাহনিও নিগূঢ়তায় ছাওয়া!যে কেউ সহজে পড়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। কিন্তু শ্রেয়ার পড়তে ইচ্ছে হলো সেই চোখ।খুব করে জানতে ইচ্ছে হলো অদ্ভুত কথা বলা এই মানুষটাকে।নিষ্প্রাণ!এ আবার কেমন নাম?

তাদের দুইজনকে অপলকে দেখছে আয়েন্দ্রি। সূর্য হেলে পড়তে শুরু করেছে পশ্চিম দিগন্তে। ধূসর আকাশ একটু পরেই হারিয়ে যাবে তমসা যামিনীতে। সন্ধ্যাদীপ জ্বলে উঠার আগেই ফিরতে হবে আয়েন্দ্রিকে।আয়েন্দ্রির বেখেয়ালি মনের দর্পণে টুক করেই কড়া নাড়ে প্রাবিশ। তার পাশেই বসেই চুলের আগায় হালকা টান মেরে বললো—

“প্ল্যানের কী হলো তোর?

আয়েন্দ্রি নীরস শ্বাস ফেলে প্রাবিশকে সামনে তাকাতে ইঙ্গিত দেয়। প্রাবিশের চোখ দুটো চমকে উঠে।শ্রেয়ার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে নিষ্প্রাণ। গাঢ় কন্ঠে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্যের দিকে উন্মনা দৃষ্টি রেখে বললো প্রাবিশ—

“কাজটা কী ঠিক হচ্ছে?

আয়েন্দ্রি ব্যথাতুর শ্বাস ফেলে। নরম করে চাহনি। পায়ের উপর থাকা ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কেমেস্ট্রি বইটা ঠাস করে বন্ধ করে বললো—

“তুই জানিস বাবা এইসব পছন্দ করে না। আমাকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন।”

প্রাবিশ তীক্ষ্ম সুরে কিঞ্চিৎ রাগ মিশ্রণ করে বললো—

“আঙ্কেলের কথা ছাড়। তুই ওকে পছন্দ করিস নাকি সেইটা বল?

আয়েন্দ্রি পূর্ণ নজর ফেলে নিষ্প্রাণের দিকে। তখনই আয়েন্দ্রিকে অবাক করে দিয়ে তার দিকে চোখের কোণে হেসে তাকায় নিষ্প্রাণ। ঝিমুনি দিয়ে উঠে আয়েন্দ্রির শরীর। মনটা হঠাৎ বেখেয়ালি হয়। কাতর হয় ওই চাহনিতে। বিদ্ধ হয় প্রেমাসুখে। জ্বলে উঠে প্রেমানলে। আয়েন্দ্রি নিজেকে লুকোয়। নিজের বক্ষস্থলে আবিষ্ট কম্পিত যন্ত্রণটার স্পন্দনকে নজর আন্দাজ করে। নিস্পৃহ গলায় মিথ্যের হাতেখড়ি করে বললো—

“প্রাণকে আমার ভয় হয়।”

দীর্ঘ সময় পরে আয়েন্দ্রির মুখ নিঃসৃত এই বাক্য ঝড় তোলে নিষ্প্রাণের প্রাণহীন দেহে। তার ধ্রুবতারা তাকে ভয় পায়!কেন ভয় পায়? সে তো তাকে অতলান্ত মায়ায় মুড়িয়ে রাখবে। ভালোবাসার চাদরে জড়িয়ে রাখবে।আদুরে বিড়ালছানার মতো তার হৃদযন্ত্রের পাশে গুঁজে রাখবে। ভরিয়ে রাখবে আদরে আদরে। তার বুকের বদ্ধ প্রকোষ্ঠে যে কলিজা আছে সেখানে গেঁথে রাখবে।পাঁজরে পাঁজরে যুদ্ধ বাঁধিয়ে বদ্ধ করে দিবে সে দ্বার। যেখান থেকে তার ধ্রুবতারাকে কেউ দেখবে না,পারবে ছুঁতে তার প্রেমাস্পর্শ।

চলবে,,,
চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here