প্রাণস্পন্দন পর্ব ২৩+২৪+২৫

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ২৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

ক্লাস ভর্তি স্টুডেন্টদের সামনে চওড়া গলায় কথা বলে যাচ্ছেন অ্যাকাউন্টিং ডিপার্টমেন্টের হেড অতুল প্রসাদ।ত্রস্তে সকল শীতল দৃষ্টি তার দিকে।শম্পার বেখেয়ালি চাহনিতে চোখে পড়ে নিষ্প্রাণ। শ্রেয়ার ক্লাসের দরজা থেকে কিঞ্চিৎ সরে দাঁড়িয়ে আছে সে। মধ্য সারিতে বসা শ্রেয়াখে কনুইয়ের গুতো দিয়ে সপ্রতিভ করে শম্পা। শ্রেয়া চোখে,মুখে বিরক্তি ছাপিয়ে নাক কুঁচকে কপালে প্রমত্তা সাগরের ঢেউ খেলিয়ে জানতে চাইলো কী কয়েছে। শম্পা সরস হেসে চোখ দিয়ে ইশারা করে।দরজার দিকে তাকাতেই নিষ্প্রাণের অনঢ় চাহনিতে আটকে যায় শ্রেয়ার নিটোল চোখ।

গত তিনদিনে অনেকটা ঝুঁকে পড়েছে নিষ্প্রাণের প্রতি শ্রেয়ার ভাবাবেগ। নিষ্প্রাণ চোখে হাসে। শ্রেয়াকে বুঝিয়ে দেয় সে তার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে। আজ নো ক্লাস। লজ্জাভর্তি হাসে শ্রেয়া। মানুষটাকে অকারণেই ভালো লাগে তার। অযথাই চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে ওই প্রাণহীন নামের সজীব মানুষটাকে।
,
,
,
ক্যান্টিনে বসে আছে আয়েন্দ্রি। তার অসাঢ়,নির্জীব দৃষ্টি ক্যান্টিনের কাঁচ গলিয়ে দোতলায় দাঁড়ানো নিষ্প্রাণের পিঠে। হলুদ রঙের শার্ট পরেছে নিষ্প্রাণ। হলুদ রঙটায় কেন যেনো নিষ্প্রাণকে আরো বেশি উজ্জ্বল লাগে।সোনা রঙে ধোয়া কোনো স্নিগ্ধ পুরুষ মনে হয় তখন তাকে! আয়েন্দ্রির সামনেই কৌতূহলী হয়ে চেয়ে আছে সীমান্ত। তার কর্কশ স্বরের প্রশ্ন—

“নিষ্প্রাইন্নারে ওই ছেঁড়াত্যানার পিছে লাগাইলি কেন তুই?

আয়েন্দ্রি নিষ্প্রাণের দিক থেকে চোখ সরিয়ে গুমোট শ্বাস ফেলে বললো—

“মেয়েটা ভালো।”

“ভালো হইলেই তুই ওরে নিষ্প্রাইন্নার লগে সেট কইরা দিবি! তুই আন্দি,আন্দিই থাকবি। ভালা হইতি না।”

আয়েন্দ্রি তার প্রস্তুত করা কথা বলতে পারলো না।ততক্ষণে উগ্রমূর্তির দুটো ছেলে হাতে রড নিয়ে ক্যান্টিনের ভেতরে প্রবেশ করে। অকস্মাৎ হামলা করে বসে সীমান্তের উপর। চকিতে ছেলে দুটোর হামলে পড়া আচরণ ঠাওর করতে না পারায় মর্মান্তিক ঘটনার স্বীকার হয় সীমান্ত। ছেলে দুটো সীমান্তকে উপর্যুপরি কয়েকটা আঘাত করতেই নেতিয়ে পড়ে সে। ভয়ে সিদিয়ে যায় বাকি স্টুডেন্টরা। তারা কোনো রা করলো না। সীমান্তের এই বিধ্বস্ত অবস্থায় নিজেকে সামলাতে পারলো না আয়েন্দ্রি। দুটো ছেলের মধ্যে যে ছেলেটা সীমান্ত কলার চেপে ধরে রেখেছে তার হাতে খাবলা মেরে ধরে সীমান্তকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। ছেলেটা এই অযাচিত বিরক্তি সহ্য করলো না। এক হাতে ধাক্কা মেরে বসে আয়েন্দ্রিকে। আয়েন্দ্রি উল্টে গিয়ে ছিঁটকে পড়ে নিষ্প্রাণ বুকের উপর। তার অধর জোড়া চুম্বকের মতো ঝাপটে ধরে নিষ্প্রাণের গলার সেই পোড়া দাগে। হিমশীতল অনুভূতির সুখ পায়রারা হঠাৎ ডানা মেলে উড়তে থাকে বিশাল নীলাভ অন্তরীক্ষের বুকে। ভয়চকিত শ্বাস ফেলে আয়েন্দ্রি।তার উষ্ণ নিঃশ্বাস নিষ্প্রাণের গলায় পড়তেই শ্বাস আটকে নেয় সে।আলগোছে হাতটা উঠিয়ে আয়েন্দ্রির কোমরে রাখে। নিষ্প্রাণের দৈবাৎ স্পর্শে অনুরণন শুরু হয় আয়েন্দ্রির শুষ্ক ওষ্ঠে।কম্পিত হয় তার পাতলা গড়নের দেহ। আয়েন্দ্রির কানের কাছে মুখ নিয়ে আলতো গলায় বলে উঠে নিষ্প্রাণ—

“ভয় পাস না ধ্রুবতারা। তোর প্রাণ সবসময় তোর সাথে।”

আয়েন্দ্রিকে বুকের কাছে থেকে সরিয়ে নেয় নিষ্প্রাণ।স্বাভাবিক অভিব্যক্তিতে সামনে এগিয়ে যায়। ক্রোধিত ছেলেটি জানে না অনুপলেই বদলে যাবে চিত্র। নিষ্প্রাণ ছেলেটার ঠিক পেছনে দাঁড়ায়। ছেলেটার হাঁটুর পেছনের দিকে খাঁজটায় নিষ্প্রাণ তার হাঁটু দিকে দুর্বল ধাক্কা মারতেই সামনে দিকে হাঁটু ভাঁজ হয়ে পেছন দিকে হেলে পড়ে ছেলেটা। নিষ্প্রাণ সম্পূর্ণরূপে ছেলেটাকে পেছনে হেলে যেতে দেয়নি। অর্ধ হেলে পড়া ছেলেটার মাথার চুল মুষ্টিবদ্ধ করে এক হ্যাঁচকা টান মেরে ফেলে দেয়। ছেলেটা সটান হয়ে পড়ে যেতেই তার গলায় পা দিয়ে পিষে ধরে নিষ্প্রাণ। ছেলেটার হাতের রডটাও নিয়ে নেয়।তা তার হাতের মধ্যে ধুম করে ঠেসে ধরে। কঁকিয়ে উঠে ছেলেটা। তার সহচর নিষ্প্রাণকে আঘাত করতে গেলে সেই রড দুই হাতে ভালো করে ধরে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে তার চোয়াল বরাবর আঘাত করতেই ছিটকে পড়ে আঘাতপ্রাপ্ত ছেলেটা। ঘটনার ক্রমশ বিস্ফোরণ ঘটে পুরো ভার্সিটি প্রাঙ্গনে। রাজনীতির সাথে জড়িতে আরো কিছু ছেলেপেলে ক্যান্টিনের কাছাকাছি আসতেই নিষ্প্রাণ হুংকার দিয়ে উঠে।

“আর একজন ভেতরে ঢুকলেই এই রড একদম ওর হৃদপিন্ডে ঢুকিয়ে দেবো আমি। সো,ডোন্ট মুভ।”

দশ বারোজন এসেছে ক্যান্টিনের বাইরে। নিষ্প্রাণের কড়া ঘোষণায় নীরব হয়ে যায় তারা। হাতে থাকা অস্ত্রগুলো ভয়ে ঢোক গিলে নিলো। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলতে থাকে আয়েন্দ্রি। হৃদগভীরে মাতম শুরু হয়েছে। উথলে উঠেছে ঢেউ। নিষ্প্রাণের এই ভয়াল রূপে চকিত আয়েন্দ্রি।থরথরিয়ে কাঁপছে সে । ভয়াতুর চোখে তাকিয়ে আছে সে নিষ্প্রাণে লুকোনো হাসির সেই বদনে। তটস্থ হয়ে ছুটে এসেছে প্রাবিশ। নিষ্প্রাণের পা এখনো নাম না জানা ছেলেটার গলার উপর। প্রাবিশ ধাক্কা মেরে সরায় তাকে। ব্যস্ত হয়ে বসে ছেলেটার মাথাটা নিজের হাতে নিয়ে নেয়। সীমান্তের মুখে রক্তের প্রলেপ। তাকে আলতো করে ধরে নিষ্প্রাণ।

ভার্সিটির প্রিন্সিপ্যাল এসে দাঁড়িয়েছে ঘটনাস্থলে।এসেছে সারকসহ অন্যান্য সিনিয়র শিক্ষকবৃন্দরা। ছেলে দুটোকে হসপিটালে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। নিষ্প্রাণকে আদেশ করা হয় প্রিন্সিপ্যাল স্যারের কক্ষে আসার জন্য। নিষ্প্রাণ নির্ভয়চিত্তে বললো—

“পালিয়ে যাবো না আমি। সীমান্তকে ফাস্ট এইড করিয়ে আসছি।”

নিষ্প্রাণের এহেন দাম্ভিক স্বরে নির্লিপ্ত সকলে। আয়েন্দ্রি বরফ খন্ডের মতো স্থির। শ্রেয়ার দিকে নরম দৃষ্টিকে তাকায় নিষ্প্রাণ। তার চোখের তারায় জ্বলজ্বল করা প্রশ্নরা উত্যক্ত করছে নিষ্প্রাণকে।সীমান্তকে যত্নের সাথে নিয়ে যাচ্ছে প্রাবিশ।আয়েন্দ্রির সামনে এসে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণ। চোখে হেসে বললো—

“চল ধ্রুবতারা।”

আয়েন্দ্রি সম্মোহিনী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।তার মনে হলো নিষ্প্রাণ তার নিঃসাড়,নিশ্চল,স্থির শরীরটাকে নিজের সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে।
,
,
,
বেডে শুইয়ে আছে সীমান্ত। তার চোয়ালের উপরের অংশে দুটো স্টিচের প্রয়োজন পড়েছে। কোমরের যে অংশে রডের আঘাত লেগেছে সেখানের হাড়ে দেখা দিয়েছে ফ্র্যাকচার। আপাতত তাকে মাস অতিবাহিত করতে হবে হসপিটালের শুভ্র বিছানায়।

তার পায়ের দিকের একটা চেয়ারে বসে আছে আয়েন্দ্রি। মুখে ফ্যাকাশে রঙ।নির্লিপ্ত চাহনি।শীতল অনুভূতি।প্রাবিশ খবর দিয়েছে সীমান্তের বড়ো ভাইকে।সে আসতে সময় নিচ্ছে।ঢাকা শহরের জ্যাম আমাজানের জঙ্গলের মতো।

নিষ্প্রাণের দিকে কেমন রাগাম্বিত চোখে তাকিয়ে আছে প্রাবিশ। সে শঙ্কিত,ভীত,সন্ত্রস্ত। নিষ্প্রাণ উঠে দাঁড়ায়।ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রাবিশের কাছে এসে অনুনয়ের সুরে বললো—

“সীমান্তের ভাই আসলে ধ্রুবতারাকে বাসায় পৌঁছে দিস।আমি ভার্সিটিতে গেলাম। আসি।”

প্রাবিশ নীরব সম্মতি দিলো। হসপিটালের করিডোর দিয়ে যখন উন্মনা পা দুটো চালাচ্ছে নিষ্প্রাণ পেছন থেকে পেলব গলায় ডেকে উঠে আয়েন্দ্রি।

“প্রাণ!

দমকে যায় নিষ্প্রাণ। কাতর চোখ দুটো দিয়ে ফিরে তাকায়। ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে আয়েন্দ্রির সামনে এসে আদুরে গলায় বললো–

“কিছু বলবি?

আয়েন্দ্রি কোনোরকম ভাবাবেশ ছাড়াই তীক্ষ্ম কন্ঠে প্রশ্ন করে—-

“ছেলেগুলোকে এভাবে কেন মারলি?

অধর কিঞ্চিৎ দুলিয়ে হাসে নিষ্প্রাণ। ভয়ংকর সুন্দর হাসি। হালকা ঝুঁকে আয়েন্দ্রির কানের কাছে গিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললো—

“ছেলেটা ভুল করে তোকে ছুঁইয়েছে তাই শুধু ওকে মেরেছি। মেরে ফেলেনি।”

সোজা হয় নিষ্প্রাণ। কর্তৃত্বের সুরে বললো—

“বাসায় যা। আর সাবধানে যাবি।”

“তোকে ভার্সিটি থেকে বের করে দিবে!

নিষ্প্রাণ হৃদয় গলানো হাসে। বিগলিত গলায় বললো—

“দিলে দিবে।কিন্তু তোকে ছাড়া আমি কোথাও যাচ্ছি না। তুই আমারই থাকবি।এই নিষ্প্রাণের প্রাণ তুই।আমার বিভাবরীর একমাত্র ধ্রুবতারা।”

আয়েন্দ্রি ভয়াতুর চোখে তাকিয়ে থাকে। তার বুকের ভেতরের সুপ্ত বালিকা বলে উঠে–

“এমন বুকের ভেতর উম,তোমার হৃদপ্রকোষ্ঠে ঘুম,
এমন আদরে জড়ানো মন,আমার কাটছে দ্বিপ্রহর,
তোমার অতন্দ্রিত নক্তের শ্বাস,আমার করেছে সর্বনাশ,
আমার শোধিত অঙ্গের ক্ষরণ,তোমার দৈবাৎ ত্রসনে মরণ।”

—- আইশা

নিষ্প্রাণ চলছে। দ্বিধাহীন,নির্বিঘ্ন,নিরুদ্বেগ পথচলা।
#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ২৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

প্রিন্সিপ্যাল গোলাম সারোয়ারের সামনে নীরব দাঁড়িয়ে আছে নিষ্প্রাণ। সেদিন যেই ছেলেটাকে সীমান্ত মেরেছিলো তারই সহচর এরা। গোলাম সারোয়ার অনেক কথা শোনালেন নিষ্প্রাণকে। মোটামুটি ভার্সিটির সকল শিক্ষকবৃন্দরা উপস্থিত সেখানে। হট্টগোল সামলাতে এগিয়ে আসে সারক। ছেলেদের শান্ত হতে বলে। একগাদা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে গোলাম সারোয়ারের কক্ষের বাইরে। তারা তটস্থ,ব্যগ্র,ব্যস্ত।

গোলাম সারোয়ার দারাজ গলায় বললেন—

“কাজটা তোমার মোটেও ঠিক হয়নি। যে ছেলেটাকে কানে আঘাত করছে সে বধির হয়ে গিয়েছে। আর বাকি একজন আর কখনো তার ঘাড় সোজা করতে পারবে না।”

নিষ্প্রাণ নির্বিকার চাহনিতে অকপটে বললো—

“সীমান্তকে আঘাত করা কী ওদের ঠিক হয়েছে?

“সীমান্ত ভালো আছে।”

গোলাম সারোয়ার উচ্চ আওয়াজে বলে উঠলেন। চোখে হেসে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো নিষ্প্রাণ। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে চেয়ে মুঠো হাতটা গোলাম সারোয়ারের টেবিলের উপর রাখলো। সকলে উৎসুক চোখে চেয়ে আছে। নিষ্প্রাণ আলতো চোখে তাকিয়ে হালকা ঝুঁকে রহস্য হাসলো। বিভ্রান্ত হলেন গোলাম সারোয়ার। তিনি কপালের মাঝ বরাবর ভাঁজ অঙ্কিত করলেন। নিষ্প্রাণ তার হাতের মুঠো আলগা করতেই একটা কালো ভয়ংকর মাকড়সা সুরসুর করে বেরিয়ে গোলাম সারোয়ারে দিকে ধাবিত হয়। গোলাম সারোয়ার আঁতকে উঠেন। ত্রাসিত চোখে চেয়ে লাফিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। উপায়ন্তর না পেয়ে টেবিলে থাকা পেপার ওয়েট দিয়ে মাকড়সাটিকে চেপে ধরলেন। উপস্থিত সকলের সন্ত্রস্ত দৃষ্টি। নিষ্প্রাণ হৃদয় ভেজা হেসে বললো—

“মাকড়সাটিকে মারলেন কেন স্যার?

গোলাম সারোয়ার সচকিতে বললেন—

“এইটা কী করলে তুমি! যদি মাকড়সাটা কামড়ে দিতো আমাকে?

নিষ্প্রাণ মুচকি হেসে আনম্র গলায় বললো—

“এখনো কামড়ায়নি তো স্যার। তবুও মেরে ফেললেন?

“আমি কী সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করবো নাকি?

নিষ্প্রাণ চোখে হাসলো। সদর্পে বললো—

“তাহলে আমারও কি সীমান্তকে মেরে ফেলা অব্দি অপেক্ষা করা উচিত ছিলো?

অগনিত চক্ষুদ্বয় একে অপরের ভীত চোখে চেয়ে চোখে চোখে নিজের ভাবের আদান-প্রদান করছে। সারক নিষ্প্রাণের কাছে এসে অবলীলায় বললো—

“মানছি তোমার কথা। কিন্তু এইভাবে কাউকে আঘাত করা তোমার ঠিক হয়নি। ছেলেগুলোর অঙ্গহানি ঘটতে পারতো। এখনো যে ক্ষতির সম্মুখীন ওরা হয়েছে তা সারতেও বছর লাগবে।”

নিষ্প্রাণ ঝরা গলায় বললো—

“যদি তাই হয়ে থাকে তাতেও আফসোস নেই আমার। আপনারা আমাকে যেকোনো শাস্তি দিতে পারেন। যদি সত্যিই আমি অপরাধী হয়ে থাকে। দ্যাটস অল।”

কানাঘুষো শুরু হলো উপস্থিত জনতার মাঝে। সকলের মতামত অনুসারে সিদ্ধান্ত হলো নিষ্প্রাণকে এইবারের মতো ক্ষমা করা হবে। কিন্তু পরবর্তীতে এই ধরনের কাজে তাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে।

দাম্ভিকতার সাথে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের কক্ষ থেকে বের হয় নিষ্প্রাণ। ছেলেগুলো সরোষে তাকিয়ে আছে। নিষ্প্রাণের সরু অধরে বাঁকা হাসি।
,
,
,
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির দোরগোড়ায়। নিষ্প্রাণ সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বললো–

“বাসায় যাসনি কেন?

আয়েন্দ্রি নিষ্প্রাণের প্রশ্ন উপেক্ষা করে। সরল গলায় বললো—

“কী বলেছে স্যার?

নিষ্প্রাণ হেয়ালি গলায় বললো–

“ওয়ার্নিং দিয়েছে। চল তোকে বাসায় পৌঁছে দেই।”

দ্বিরূক্তি করলো না আয়েন্দ্রি।
কাসার থালার মতো চন্দ্রের আলোতে সিক্ত ধরণী।খিলখিলে হাসি তার। সেই হাসিতে ঝরছে রুপালি জ্যোৎস্না।
রাত হওয়ায় রিক্সা নেয় নিষ্প্রাণ। তাদের মাথার উপরের উদিত চন্দ্র চলছে তাদের সাথে। অন্তরীক্ষ আজ খুশিতে হাসছে।

আয়েন্দ্রির মুখটা পাংশুবর্ণ। সে উদাসচিত্তে চেয়ে আছে সড়কের বামদিকে। নিষ্প্রাণ ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে—

“কিছু খাসনি তাই না?

কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণ রিক্সা থামাতে বলে। আয়েন্দ্রি ত্রস্তে ফিরে তাকায়। দৃঢ় চোখ জোড়ায় তীব্র আতঙ্ক। রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে বিদায় করে নিষ্প্রাণ। রাস্তার পাশেই ছোট্ট ফাস্টফুডের দোকান। থাই স্লাইড করে ভেতরে প্রবেশ করে নিষ্প্রাণ আর আয়েন্দ্রি। অর্ডার করে ফ্রেন্স ফ্রাই,শর্মা আর লাচ্চি। নিষ্প্রাণ খেলেও দুম ধরে বসে আছে আয়েন্দ্রি। ভারাক্রান্ত চোখে তাকিয়ে আছে সে। নিষ্প্রাণ মায়াময় গলায় বললো—

“খেয়ে নে ধ্রুবতারা।”

আয়েন্দ্রি চাপা কষ্টে ভুগছে। দ্বিধান্বিত সে। নিষ্প্রাণ তাকে বাধ্য করছে নিজেকে নিয়ে ভাবতে। নিজেকে মানাতে পারছে না আয়েন্দ্রি। সামনে এগুতে পারছে না সে। নিষ্প্রাণের শীতল স্বরও কাঁপন ধরিয়ে দেয় আয়েন্দ্রির শরীরে। দূরেও সরাতে পারছে না নিজেকে। বুকে ব্যাথা হয়। খুব বেশিই হয়। তা দমাতেও অনেক কষ্ট,যন্ত্রণা,তীব্র দীর্ঘশ্বাস।

নিষ্প্রাণ সরব গলায় বললো—

“কী হয়েছে তোর? খাচ্ছিস না কেন?

আয়েন্দ্রি সশব্দে বললো—

“খাবো না আমি।”

নিষ্প্রাণ লাচ্চিতে সিপ দিয়ে আবাব থমকে যায়। পাশ ফিরে দেখে তাদের থেকে একটু দূরের আরেকটি টেবিলে বসে আছে একটি ছেলে। ছেলেটা বারংবার আড়চোখে তাদের দুইজনের দিকে তাকাচ্ছে। বিশেষ করে আয়েন্দ্রির দিকে। নিষ্প্রাণ নাকের পাটা ফুলিয়ে অতি স্বাভাবিক গলায় বললো—

“ওই দিকে তাকাবি না। জলদি খেয়ে নে। রাত হচ্ছে।”

আয়েন্দ্রি মেঘাচ্ছন্ন চোখে তাকায় নিষ্প্রাণের দিকে। কেমন অদ্ভুত ভয়ংকর সেই দৃষ্টি। আয়েন্দ্রি তবুও খেলো না। দৈবাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে যায় নিষ্প্রাণ। লাফিয়ে উঠে আয়েন্দ্রি। সেই সাথে তার কলিজা কাঁপতে থাকে। নিষ্প্রাণ সোজা গিয়ে সেই ছেলেটার কলার চেপে ধরে তাদের টেবিলে সার্ভ করা পাস্তার ডিশ থেকে কাটাচামচ উঠিয়ে তার চোখের সম্মুখে ধরে। চিৎকার দিয়ে উঠে আয়েন্দ্রি। ফাস্টফুডের ছেলেগুলোও আতঙ্কে আত্মহারা। নিষ্প্রাণের ভয়াল কান্ডে সন্ত্রস্ত তারা।ছেলেটা কাঁপতে থাকে। চোখের পল্লব বেয়ে টুপ করে জল খসে পড়লো ছেলেটার। নিষ্প্রাণ হট করেই ছেলেটার কলার ছেড়ে দেয়। হাতের কাঁটাচামচটা ফেলে দুই হাত উঁচুতে উঠিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো—

“সরি!সরি এভরিবডি।”

ত্রাসের সহিত বিরক্তি ছেয়ে যায় সকলের চোখে,মুখে।ছেলেটার সাথে থাকা মেয়েটা শঙ্কিত গলায় বললো—

“এইসবের মানে কী! কী করছিলেন আপনি?

নিষ্প্রাণ ছোট্ট করে হেসে অনুনয় করে বললো—

“আই এম এক্সট্রেমলি সরি। আমার ধ্রুবতারার মনটা ভালো নেই। কিছুই খাচ্ছে না। তাই।”

মেয়েটা দাঁত,মুখ খিঁচে সক্রোধে বললো—

“আর ইউ ম্যাড?

নিষ্প্রাণ একগাল হেসে বললো—

“হয়তো।”

সকলের দিকে সরস চোখে তাকায় নিষ্প্রাণ। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে নিষ্প্রাণকে পর্যবেক্ষণ করছে সকলে। দুই হাত দোষী সাব্যস্ত অপরাধীর মতো উঠিয়ে বিগলিত হেসে বললো—

“সরি,সরিইইই।”

নিষ্প্রানের আকুঞ্চিত ভ্রু জোড়ায় ঢেউ উঠেছে।আয়েন্দ্রির ওষ্ঠাধর তিরতির করে কাঁপছে।আবেশিত,আচ্ছন্ন,ভীত সে।
,
,
,
আয়েন্দ্রিকে বাসার সামনে পর্যন্ত এগিয়ে দেয় নিষ্প্রাণ। আধাঘন্টার পথে আর একটা কথাও বলেনি আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণের প্রতি জমাট বাঁধা বিন্দু,বিন্দু ভয় হিমালয়ে রূপ নিচ্ছে। আয়েন্দ্রির ভাবুক মন নিষ্পেষিত হচ্ছে। কী করে কাটাবে এই ভয়!

নিষ্প্রাণের সামনে ম্রিয়মান বদনে দাঁড়িয়ে আছে আয়েন্দ্রি।তমসাচ্ছন্ন মায়ায় আয়েন্দ্রির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে নিষ্প্রাণ। চকিতে নিষ্প্রাণ ঝড়ের বেগে আয়েন্দ্রির অধরের কাছে চলে আসে। আয়েন্দ্রি হুট করে চোখ বন্ধ করে ওড়নার দুই প্রান্ত খামচে ধরে। নিষ্প্রাণের চকিত স্পর্শ ওআ পেয়ে ধীরে ধীরে আঁখিপুট মেলে ধরে আয়েন্দ্রি। উদ্ভাসিত নয়নজোড়া হতবিহ্বল। নিষ্প্রাণ হৃদয় ভেজা হাসে।
আদুরে গলায় বললো—

“ভয় পাস না। যতদিন না তুই একান্ত আমার হচ্ছিস ততদিন তোকে আমি শুধু ভালোবাসবো। সেই ভালোবাসায় তোকে নিজের করে পাওয়ার তীব্র বাসনা থাকবে।কোনো কামনা থাকবে না।”

আয়েন্দ্রি নির্বিকার চোখে শ্রবণ করে নিষ্প্রাণের মায়াবী স্বীকারোক্তি। বাড়ির গেইটের সামনে যেতেই ডেকে উঠে নিষ্প্রাণ।

“ধ্রুবতারা!

আয়েন্দ্রি ফিরে তাকায় নিষ্প্রাণের দিকে। নিষ্প্রাণ আলতো করে হাত উঠিয়ে বিদায় জানায় তাকে।সরস গলায় বলে উঠে—-

“তোর চোখেই আমার বাস,সেই চোখেই আমার শ্বাস
তোর হৃদয় আমার ত্রাস,তোর নেশায় আমার সর্বনাশ।”
#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ২৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

প্রায় মিনিট বিশেক শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে আয়েন্দ্রি। নির্ঝরের মতো ধাবমান শীতল জলে নিজেকে সিক্ত করে। জলের স্রোতে ঝেড়ে ফেলে তার সমস্ত বিষন্নতা।

ভেজা চুলে তোয়ালে ঘষতে ঘষতে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে আয়েন্দ্রি। ধীম ধীম পায়ে এগিয়ে এসে বিছানায় বসে। বিছানার হেডবোর্ডের সাথে মাথাটা হালকা হেলিয়ে দিয়ে সিলিং এ চোখ নিবদ্ধ করে। হাতের তোয়ালেটা নৈঃশব্দে নিচে পড়ে যায়। আয়েন্দ্রির অন্তরিন্দ্রিয়তে দহন হচ্ছে। সেই দহনক্রিয়ায় জ্বলছে সে। কাউকে সে তার সাথে শামিল করতে পারছে না। বলতে পারছে না তার নীরব ঘাতকের কথা। যা তীলে তীলে তাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।

আয়েন্দ্রি শঙ্কিত, উদ্বিগ্ন, ত্রস্ত। আয়েন্দ্রির বাবা নিষ্প্রাণকে কখনো মেনে নিবে না। একটা এতিম ছেলের হাতে সে তার মেয়েকে কখনও তুলে দিবে না। নিষ্প্রাণের নিজের কোনো উপার্জন নেই। অন্যের অর্থে দিন অতিবাহিত করে। সমবয়সী তারা। আয়েন্দ্রির বাবা হুট করে চাইলেই আয়েন্দ্রিকে বিয়ে দিতে পারে। কিন্তু নিষ্প্রাণের পক্ষে এখন না বিয়ে করা সম্ভব, না উপার্জন।

নিজেকে সামলাতে বড্ড বিপাকে পড়েছে আয়েন্দ্রি।
মন আর মস্তিষ্কের খেলে মনকে হারাতে চায় সে। আয়েন্দ্রির ভাবনার রেশ কাটে তার মায়ের জোরালো গলার স্বরে। চকিতে তাকাতেই দেখল ঝুমার বিষন্ন মুখ। নিজের উৎকন্ঠা চাপা পড়ে মায়ের ভীত মুখ দেখে। অলস ভঙিতে প্রশ্ন করে আয়েন্দ্রি—

“কী হয়েছে মা?

ঝুমা ব্যস্তসমস্ত হয়ে আয়েন্দ্রির সামনে বসল। ভীত গলায় বলল—

“দেখ না সে কখন থেকে দরজা বন্ধ করে বসে আছে মেয়েটা! খুলছেই না।”

খানিকটা বিস্মিত হলো আয়েন্দ্রি। কার কথা বলল?তার বোন!
আরিশা তো দরজা বন্ধ করে থাকার মেয়ে নয়! তার তো পুরো বাড়ি দলিয়ে ফেলার কথা! তাহলে?

আয়েন্দ্রির বিস্মিত ভাব কেটে গিয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণেই তা মাথায় টোকা মারল। চিন্তার গভীর রেখা ফুটে উঠল তার সরু কপালে। বিশদভাবে জানার ইচ্ছা পোষণ করে বলল—

“কেন? কী হয়েছে?

ঝুমা তীব্র হতাশ নিঃশ্বাস ফেললেন। ভীত গলায় প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন—

“জানি নারে মা। স্কুল থেকে ফেরার পর থেকে কেমন অস্বাভাবিক ব্যবহার করছে! দুপুরে খায়ওনি। ঘুমিয়েছিল। ঘুম থেকে ওঠার পর ঘরেই বসে আছে। কতবার ডাকলাম কোনো সাড়াশব্দ নেই। তুই একটু দেখ না মা।”

আয়েন্দ্রি ভাবুক চোখে তাকায়। তার বোনটা চড়ুই পাখির মতো। এ ডালে ও ডালে ঘুরে বেড়ানোর জন্যই তার জন্ম। তাহলে আজ কেন সে বন্দি!

অচিরে উঠে দাঁড়ায় আয়েন্দ্রি। অশান্ত চিত্তে ছুটে যায় বোনের কাছে।

কোলাহল চলছে মেসের ভেতরে। সিঁড়ি বেয়ে নিমগ্নচিত্তে উঠছে নিষ্প্রাণ। একাগ্রমনে শুনছে আয়েন্দ্রি ও তার মায়ের কথোপকথন। আশেপাশে নজর নেই তার। কোনো আগ্রহও নেই। নিষ্প্রাণ চলছে আপন মনে মেসের করিডোর দিয়ে।

অনেকক্ষণ যাবৎ দরজায় করাঘাত করার পর দরজা খুলে আরিশা। তাকে দেখেই হতবাক দৃষ্টি আয়েন্দ্রির। কচি, উচ্ছলতায় আচ্ছন্ন থাকা মুখটি বিবর্ণ। চোখের পাতা সিক্ত। অশ্রুসিক্ত নয়নযুগল রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। চোখের নিচের অংশ ফুলে গিয়েছে। ওষ্ঠাধর ফুলিয়ে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেলে আরিশা। বোনের বুকে আঁছড়ে পড়ে। আয়েন্দ্রি শক্ত হাতের বেড়িতে বোনকে জড়িয়ে নেয়। ঝুমা ভেতরে আসলেন না। দরজার চৌকাঠ থেকে ফিরে গেলেন। আয়েন্দ্রি তটস্থ হয়ে ভেতরে দিকে নিয়ে আসে আরিশাকে। বিছানার উপর বসিয়ে চোখ, মুখ মুছিয়ে আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করে—

“কী হয়েছে আরু? কাঁদছিস কেন তুই?
কেউ কিছু বলেছে?

আরিশা ঠোঁট ভেঙে ফুঁপাতে থাকে। তার নাকের ডগা সংকুচিত, প্রসারিত হচ্ছে। বুক কেঁপে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। আয়েন্দ্রি ঝপাৎ করে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ধরে আরিশাকে। পিঠের উপর আলতো হাত রেখে বলল–

“আরু, বোন আমার। কী হয়েছে আপুকে বল?

আরিশা ঝমঝমিয়ে কাঁদে। হেঁচকি তুলে তুলে কম্পিত গলায় সবটা বলে।
আরিশা যেখানে কোচিং ক্লাস করে সেখানে তাদের ম্যাথ টিচার প্রায়ই আরিশাকে অপদস্ত করে। তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত লাগায়। আজও তা করেছে যা আরিশা সহ্য করতে পারেনি। ভয়ে কাউকে সে এ কথা বলেনি। তার বাবা পড়ালেখার বিষয়ে খুব কড়া। আয়েন্দ্রি বোনের মনস্তত্ত্বাত্তিক উচাটন শান্ত করতে আশ্বাস দেয় সে দেখবে এই ব্যাপারটা। এমনকি তার বাবার সাথেও কথা বলবে। প্রয়োজনে সেইখানে কোচিং করা বন্ধ।

সবটা শান্তভাবে শুনে নেয় নিষ্প্রাণ। নিরুদ্বেগ, নিরুত্তাপ। দরজার কপাট খুলে নিজের ঘরে ঢুকে সে। ঘুটঘুটে তমসাচ্ছন্ন কক্ষের কিছুই স্পষ্ট নয়। ভেতরে প্রবেশ করেই ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দেয় নিষ্প্রাণ। অন্ধকারে ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সে। হাঁটুর কাছে বিছানার অস্তিত্ব অনুভব হতেই নৈঃশব্দে বসে। ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দেয় বিছানার পাটাতনে। নিকষকালো অন্ধকারময় ঘরে নিষ্প্রাণ তার নিজের উপস্থিতিও টের পাচ্ছে না। তার মানসলোকে প্রশ্নের ছড়াছড়ি। কেন পৃথিবীর মানুষ এমন? কেন নারীদেহে তাদের এত লালসা? নারীর রক্তে এত কেন সুখ খুঁজে পায় মানুষ রূপী হায়েনারা? নারী কেন শুধু ভোগ্যবস্তু?

নিষ্প্রাণের মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে নির্গত হয়–

“মা!

অন্ধকারে চোখ বুজে নেয় নিষ্প্রাণ। আচম্বিতে অমিলীত চোখে উঠে বসে। তার সামনেই কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। আয়েন্দ্রি নয় সে। শুভ্র একদলা মেঘ যেন কৃষ্ণ কাদম্বিনীর মাঝে উঁকি দিচ্ছে। একজন মায়াবতী কামিনী। যার দু’চোখে অকৃত্রিম মায়া, প্রেম, স্নেহ।
তার হাতের তালুতে দন্ডায়মান সফেদ রঙের মোমের শিখায় জ্বলন্ত অগ্নিশিখা। চমকিত গলায় বলে উঠে নিষ্প্রান—

“তারা! নয়নতারা! তুমি ফিরে এসেছো?

মেয়েটি উষ্ণ হাসল। বলল–

“কেমন আছিস নিষ্প্রাণ?

কালবিলম্ব না করে নয়নতারা অপার্থিব অবয়বটির সামনে এসে দাঁড়িয়ে স্থির হয়ে অপলক চেয়ে থাকে নিষ্প্রাণ। মেয়েটা একটুও বদলায়নি! এমন কী করে হয়!
নয়নতারা সশব্দে হেসে উঠে। খুশমেজাজে বলল—

“আয়েন্দ্রিকে খুব ভালোবাসিস তাই না?

জ্বলন্ত অগ্নিশিখা ভেদ করে নিষ্প্রাণের উৎসুক চাহনি নয়নতারার সুশ্রি মুখচ্ছবিতে। আগুনের শিখার জ্বলজ্বলে প্রতিচ্ছবি নয়নতারার চোখে। সেদিকেই বদ্ধদৃষ্টি নিষ্প্রাণের। নয়নতারা বিগলিত হাসল। স্নেহাসিক্ত গলায় বলল—

“ওকে আগলে রাখিস। আমার মতো হারিয়ে যেতে দিস না নিষ্প্রাণ। ওরা তো আমাকে বাঁচতে দিল না। তুই তোর ধ্রুবতারাকে তোর বুকের ভেতরেই রাখিস।”

টলটল করে উঠে নয়নতারার চোখ। ভিজে উঠে তার গলা। নিষ্প্রাণ টিমটিমে গলায় বলল—

“ওকে আমি ভালোবাসি। আমার ধ্রুবতারা ও। ওকে হারাতে দেবো না আমি।”

বিমুগ্ধ হাসল নয়নতারা। নিষ্প্রাণ অপরাধী গলায় স্বীকারোক্তি দেয়।

“আমি তোমাকে বাঁচাতে পারিনি তারা। আমাকে ক্ষমা করেছ তুমি?

নয়নতারা খিলখিলিয়ে হাসে। ভয়চকিত চোখে আঁতকে উঠে নিষ্প্রাণ। নয়নতারা মৃতপ্রায় গলায় বলল—

“এতে তোর দোষ নেই।আমি তো নয়নতারা। সময় শেষে ঝরে গেলাম। ও তোর ধ্রুবতারা। কালো আকাশে সবসময় জ্বলবে। তোকে আলো দিবে। আমি ওই দূর আকাশ থেকে তোদের মিলন দেখব।”

নিষ্প্রাণ আবেগী হয়। তার দুই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
মৃদু গলায় রোষানলে জ্বলে বলল—

“আমি ওদের কাউকে বাঁচতে দেইনি তারা। ওদেরকে ওদের পাপের শাস্তি দিয়েছি। ছাই হয়ে গিয়েছে ওরা সব। যেই বদ্ধ ঘর তোমার আর্তনাদ শুনে কেঁদেছে সেই ঘরেই ওদের জীবন্ত সমাধি করেছি আমি। চিৎকার করে বাঁচতে চেয়েছে ওরা। আমি শুধু শুনেছি।”

বক্র হাসে নিষ্প্রাণ। চকচক করে উঠে নয়নতারার চোখ। চট করেই বলল—

“বিয়ে করবি আমায়?

ধপ করে নিভে যায় মোমবাতির শিখা। নিষ্প্রাণ অধৈর্য হয়ে পড়ে। আঁধার হাতড়ে উদ্ভ্রান্তের মতো চেঁচিয়ে উঠে–

“তারা! তারা!

দৈবাৎ আলো জ্বলে উঠে। নয়নতারা যেখানটায় দাঁড়িয়েছিল সেখানে। কিন্তু নিষ্প্রাণ ভড়কে যায়। নয়নতারার পুরো দেহপিঞ্জর রঞ্জিত। কাতর চোখে চেয়ে আছে সে। ওই চোখে বাঁচার আর্তনাদ। ঠিক সেদিনকার মতো। আচমকা জ্বলে উঠে আগুন। নয়নতারাকে ঘিরে ফেলে আগুনের বলয়। তার তীব্র আভায় ছিটকে সরে আসে নিষ্প্রাণ। ঘামতে শুরু করে সে। আগুনের লেলিহান শিখার উত্তাপে তার শরীরের উষ্ণতা বাড়তে থাকে। জ্বলন শুরু হয় চামড়াতে। নিষ্প্রাণ হাত বাড়ায়। বাঁচাতে চায় নয়নতারাকে। নয়নতারা হাসছে। হেসেই যাচ্ছে। আগুন গিলে নেয় নয়নতারাকে। নিষ্প্রাণের মনে হলো কেউ তার কলিজা খামছে ধরেছে। পানিবিহীন মাছির মতো অবস্থা তার। চিৎকার দিয়ে উঠে নিষ্প্রাণ–

“তারা আআআআআআ!

বিছানা থেকে উঠে বসে নিষ্প্রাণ। তার শরীর ঘামে ভিজে জবুথবু। স্বগতোক্তি করে বলল—

“স্বপ্ন! স্বপ্ন! তারা! আমার ধ্রুবতারা!

চলবে,,,
চলবে,,,
চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here