প্রাণ_ভোমরা পর্ব ১৪+১৫

#প্রাণ_ভোমরা
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (১৪)

“বাইরে চল। একজন তোর সাথে দেখা করতে এসেছে।”

ভ্রমর চমকায়। জিজ্ঞেস করে,

“কে?”

শরীফা খন্দকার রহস্য করে বললেন,

“গেলেই তো দেখবি। চল।”

ভ্রমর মাকে ফেলেই দৌড়ে বসার রুমে চলে গেল। মনে তখন আশার আলো তীব্র হয়ে জ্বলছে। আশার আলো দুদিক থেকে দু রঙের জ্বলছে। ভ্রমর ভেবেই ফেলল হয় তার বাজান নাহয় হৃদ্য এসেছে। সারপ্রাইজ দেওয়ার নাম করে তাকে চমকে দেবে তাই। বসার রুমে পৌঁছাতে ভ্রমরের বিস্তর উৎসাহ ও দম বন্ধ করা উত্তেজনার বিনাশ ঘটল। যা ভেবেছিল তার কিছুই না। কোথায় তার কলিজাভরা বাজান আর কোথায় সুখে ভরপুর হৃদ্য ভাইয়া? কেউ তো নেই! ভ্রমরের আনন্দিত চোখ দুটো নিমেষেই নিরানন্দে রুপান্তর হলো। আগ্রহ হারিয়ে চোখ নামিয়ে নিয়েছে। মলিন মুখ বুকের দিকে ঝুঁকে আসে। সেই সময় একটি মেয়েলি কণ্ঠ,

“Happy birthday,birthday girl. Looking so cute and sweet. Like a freshly blossomed belly flower !”

ভ্রমর মাথা তুলে তাকায়। তাকিয়েই থাকে সামনের মেয়েটির দিকে। ফর্সা গোচের গোলাগাল মিষ্টি মুখ। চিকন ঠোঁটে চমৎকার হাসি। মন ভালো করে দেওয়ার মতো কণ্ঠ। সুশ্রী বদনজুরে আন্তরিকতা! ভ্রমরের চোখে কৌতুহল ভর করে। জানতে ইচ্ছে করে এই মেয়েটি কে। বয়স,গড়ন এবং উচ্চতায় তার থেকে অনেকটাই বড় হবে। ভ্রমর মুগ্ধ ফেলে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না। মেয়েটি তার কাছে এগিয়ে আসে। সৌহার্দপূর্ণভঙ্গি নিয়ে বলল,

“তোমার কোন ফুলটি প্রিয় বলো তো! গোলাপ,জবা,কামিনী নাকি রজনীগন্ধা,শিমুল,শিউলি? শরৎের কাশফুলও হতে পারে অথবা বর্ষার কদম কিংবা গাঁদা ফুল।”

এত ফুলের নাম শুনে অবাক হয় ভ্রমর। এর মধ্যে তার প্রিয় ফুল কোনটি ভুলে যায়। ভাবনায় ডুব দেয়। মনে করার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। মাথা চুলকায়,ঠোঁট কামড়ায় আরো কত কী! তবুও মনে পড়ে না। এতে মেয়েটি আনন্দ পায়। শব্দ করে হেসে ফেলে। সহাস্যে ভ্রমরের ডান হাতটা চেপে ধরে। শরীফা খন্দকারের উদ্দেশ্যে বলল,

“আসছি,আন্টি।”

ভ্রমর পেছনে তাকায়। তার মা এক হাত দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটে বিনয়ী হাসি। মাথা একপাশে হালকা কাত করে বললেন,

“যত রাতই হোক,দিয়ে যেও কিন্তু। ভ্রমর আমাকে ছেড়ে কখনও ঘুমায়নি।”

জবাবে মেয়েটি সামান্য হাসল। তারপর ভ্রমরকে নিয়ে দরজার দিকে এগোয়। ভ্রমর ঘোরের মধ্যে ঢুকে যায়। একবার মেয়েটির দিকে তাকায় আরেকবার মায়ের দিকে। কী হচ্ছে বুঝতে পারছে না। সে অবস্থায় বিল্ডিং ছেড়ে রাস্তায় পা রাখে। তখনও ভ্রমরের হাত মেয়েটির হাতের বাধনে বন্দী। রাতের হাওয়া ভ্রমরের গা ছুঁয়ে দেয়। চাঁদ তার জোসনা দিয়ে গোসল করিয়ে দেয়। দূরের ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলো তাকে আদর করে দেয়। ভ্রমর শিউরে ওঠে। ঘোর কাটে রাতের নিশাচর পাখির ডাকে। চলন থামিয়ে থমকে দাঁড়ায়। পা দুটো শুকনো মাটি খামচে ধরে। ভীত চোখে তাকায় মেয়েটির দিকে। মেয়েটিও বাধ্য হয়ে ভ্রমরের দিকে তাকায়। নরম স্বরেই জিজ্ঞেস করে,

“কী হলো? থেমে গেলে যে?”

ভ্রমর উত্তর দেয় না। সে নিষ্পলকে চেয়ে আছে মেয়েটির দিকে। ভয় কেটে গেছে। স্মৃতির উপর তুমুল চাপ পড়ে। আকস্মিক চোখ দুটো বড় বড় করে বলল,

“আপনি হৃদ্য ভাইয়ার রিধি আপু?”

প্রতিত্তোরে রিধি হাসে। মাথা দুলিয়ে বলল,

“হ্যাঁ। এতক্ষণে চিনলে?”

ভ্রমরের অনুমান সত্যি হওয়ায় সে খুব চমকায়। আরো কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে রিধির দিকে। সহসা বলল,

” সেদিন ভালো করে দেখতে পাইনি তো। বারান্দায় এক নজর দেখেছিলাম। ভালো করে দেখার আগেই পালিয়ে গেলেন। কেন?”

রিধি ভাবনায় পড়ে। কিছু মনে করার চেষ্টা করছে এমন ভঙ্গিমায় বলল,

“কোন দিন বলো তো?”

ভ্রমর বলতে গিয়েও থেমে গেল। হতাশ কণ্ঠে বলল,

“ভুলে গেছি। কিন্তু অনেক দিন আগে। প্রায় বছরখানেক আগে হবে।”

রিধির ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেল। মন খারাপের কণ্ঠে বলল,

“উঁহু প্রায় তিন বছর আগের কথা বলছো তুমি।”

ভ্রমর রিধির কথায় সম্মতি রেখে বলল,

“হয় তো। তারপর আর দেখিনি। হৃদ্য ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করার পর বলেছিল। আপুকে দেখেছি। তারপর আমি দেখতে চাইলাম দেখালই না। আপনার ভাইটা খুব পঁচা।”

ভ্রমরে কণ্ঠে স্পষ্ট অভিযোগ। রিধি নীরবে চেয়ে থাকে ভ্রমরের দিকে। তারপর বলল,

“মিথ্যে বলোনি কিন্তু। আমার ভাইটা আসলেই পঁচা।”

ভ্রমর খুশি হয়। পরক্ষণেই বেজার কণ্ঠে বলল,

“আপনিও পঁচা।”

রিধি আশ্চর্য হয়ে বলল,

“কেন? আমি কী করেছি?”

ভ্রমর অনুযোগ তুলে বলল,

“আপনিও তো বারান্দায় আসেন নি। আসলে দেখতে পেতাম। আমি অপেক্ষা করতাম।”
“আমাকে দেখার জন্য অপেক্ষা?”

ভ্রমর উপরনিচ মাথা নাড়ে। রিধি খানিকটা সন্দেহের সুর তুলে বলল,

“নাকি হৃদ্যের রিধি আপু?”
“আপনি আর রিধি আপু কি আলাদা?”
“অবশ্যই আলাদা। শুধু রিধি আপু আর হৃদ্যের রিধি আপু আকাশ পাতাল তফাৎ।”
“কী রকম?”

রিধি হাসল। ভ্রমরের হাত ধরে নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে বলল,

“পরে বলব। আগে বাড়ি চলো।”

ভ্রমর হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল,

“কার বাড়ি?”

রিধি আগের হাসিটাকে প্রশস্ত করে ভ্রমরে গাল টিপে বলল,

“আমার পঁচা ভাইয়ের বাড়ি।”

খুশিতে ভ্রমরের চোখ চকচক করে ওঠে। অবিশ্বাস্য গলায় সুধায়,

“সত্যি?”
“হুম।”

______________________________________
ঘন্টার কাঁটা বারোটায় ঠেকতে শরীফা খন্দকার বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। শ্রান্ত শরীর এবার একটু জিরোতে চায়। খাটনি তো আর কম করেননি! কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হতেই এক পাশ হলেন। সাথে সাথে বুকটা ছ্যাত করে উঠল। ভ্রমর নেই! মনে পড়ল এখনও আসেনি মেয়েটি। মুহূর্তেই অস্থিরতা আর উদ্বিগ্ন ভর করে কপালজুড়ে। উঠে বসেন। দুয়ারের দিকে তাকান। মনে মনে বললেন, ‘কখন আসবে আমার কলিজাটা! তার ছোঁয়া না পেলে কি আমার চোখে ঘুম নামে? ছোট-খাটো অভ্যাস তো নয়,দীর্ঘ আঠারো বছরের অভ্যাস!’ মেয়ে যেমন মাকে ছাড়া কখনও থাকেনি,তেমনি মাও যে মেয়েকে ছাড়া থাকে নি। শরীফা খন্দকারের বুকের ভেতর হাঁসফাঁস শুরু হয়। অস্থিরতায় গা গরম হয়ে আসে। কপালে গাঢ় চিন্তার ভাঁজ পড়ে। অপেক্ষামান চোখদুটো ঠেকে দেয়ালঘড়িতে। বিছানার পাশের টেবিলের উপর থেকে ফোন তুলে নেন। দ্রুত ডায়াল লিস্টে ঢুকেন। ভ্রমরকে ছাড়া আর এক মুহূর্তও থাকা যাচ্ছে না। লিস্টে থাকা নাম্বারগুলো বার বার উপর নিচ করার পর মনে পড়ে,রিধির নাম্বারটা নেওয়া হয়নি। এখন কী হবে? এক দিনের পরিচয়ে হৃদয়ের টুকরো মেয়েটাকে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত হলো কি? তাকে ছাড়া কি একদিনও বেঁচে থাকার কথা চিন্তা করতে পারেন শরীফা খন্দকার? নিশ্বাস আটকে মরবেন যে!

শরীফা খন্দকার ছটফট করছেন। বিছানার এপাশওপাশ করলেন অনেক্ষণ। চিন্তা দূর করতে অন্য কিছু ভাবতে চাইলেন। চোখ বন্ধ করে নিলেন। সাথে সাথে চোখের পাতায় ভেসে ওঠে বহু পূরোনো এক মর্মান্তিক সন্ধ্যাবেলা। তখন ভ্রমর কোলে,বয়স মাত্র তিন মাস। বুকের দুধ খাচ্ছিল। সে সময় হুড়মুড়িয়ে ঢুকলেন ভ্রমরের বাবা মীর খন্দকার। সরাসরি বললেন,

“তুমি নাকি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে?”

শরীফা খন্দকার স্বামীর দিকে তাকান। তারপর মেয়ের দিকে। ভ্রমর ঘুমিয়ে পড়েছে। আলতো করে মেয়েকে শুয়িয়ে দিয়ে ধীরে বললেন,

“মেয়েটা ঘুমিয়েছে,আস্তে কথা বলো।”

মীর খন্দকার দরজা ছেড়ে ভেতরে আসলেন। শরীফা খন্দকারের সমুখে দাঁড়িয়ে বললেন,

“আম্মা কি সত্যি বলেছে?”
“তোমার আম্মা কখনও মিথ্যে বলে?”

শরীফা খন্দকারের পাল্টা প্রশ্নে খানিকটা চুপসে গেলেন মীর খন্দকার। কাঁপা স্বরে বললেন,

“সত্যি চলে যাবে?”

স্বামীর কম্পিত স্বরে শরীফা খন্দকার দুর্বল হয়ে যান। ধপাস করে খাটের উপর বসে পড়েন। নিঃশব্দে কেঁদে উঠলেন। চোখের পানিতে বুক ভিজে যাচ্ছে! লিটন খন্দকার শরীফা খন্দকারের সামনে বসেন। স্ত্রীর একটা হাত মুঠোয় নিয়ে বললেন,

“এমন করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। একটু সময় দেও। আমি আম্মাকে..”

শরীফা খন্দকার হাত সরিয়ে ফেললেন। দ্রুত বললেন,

“পারবে না। তাকে আমার থেকে তুমি বেশি চিন। তিনি যখন বলেছেন এ বাড়িতে তোমার দ্বিতীয় স্ত্রী আসবে। তারমানে আসবেই। যেমনটা আমি এসেছিলাম। তুমি তো আমাকেও আনতে চাওনি মীর। তোমার সম্পূর্ণ ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি এ বাড়িতে পা রেখেছিলাম। মানিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছো। তাকেও নিতে হবে। আম্মার পরের হুকুম তো এটাই হবে!”

কথাটা শেষ করেই শরীফা খন্দকার বিছানা ছাড়লেন। আগে থেকেই সব গুছিয়ে রেখেছিলেন। স্বামী আসার অপেক্ষায় সময় গুনছিলেন। তাঁর অনুমতি ব্যতীত বাড়ির চৌকাঠ পেরোয় নি কখনও। এবার তো শুধু চৌকাঠ না,ত্রিসীমানা পার হবেন। সেখানে অনুমতি না নিলে চলে? এখন আর কোনো অপেক্ষা নেই! শরীফা খন্দকার ব্যাগপত্র একে একে বাইরে রেখে আসলেন। গাড়ি আগে থেকেই ডাকা হয়েছিল। মীর খন্দকার চুপ করে স্ত্রীর কর্মকান্ড দেখছিলেন। সে ভুল কিছু বলেনি। মায়ের কথার অবাধ্য হওয়া এ জীবনে হয় তো আর সম্ভব নয়। কিন্তু শরীফার একটি কথায় খুব আঘাত পেলেন। তাদের সম্পর্কটা কি শুধুই মানিয়ে নেওয়ার মধ্যে ছিল? ভালোবাসা ছিল না?

শরীফা খন্দকার সব শেষে ঘুমন্ত মেয়ের কাছে আসলেন। স্বামীর দিকে তাকাতে পারছেন না। তাকাতে চাইছেনও না। শক্ত মনটাকে শক্ত রাখতে হবে,নরম হলেই সব শেষ! দীর্ঘ শ্বাস টেনে মেয়েকে কোলে তুলে নিতেই মীর খন্দকার ঠান্ডা গলায় বললেন,

“আসলেই কি সব দোষ আম্মার? উনার মাথায় দ্বিতীয় বিয়ের চিন্তা আসার কারণ কি তুমি নও?”

শরীফা খন্দকার চমকালেন। ঘাড় ফিরে স্বামীর দিকে তাকালে তিনি আবার বললেন,

“কী প্রয়োজন ছিল অপারেশন করার? আমি তো বলিনি। আম্মাও বলেননি। তাহলে কেন করলে? এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে আমাকে জানানোর প্রয়োজনও মনে করো নি! পরে শুনতে হয়েছে। আম্মার মুখে। তোমার কি মনে হয় না তুমি অন্যায় করেছো? আমার সাথে এবং আম্মার সাথে?”

শরীফা খন্দকার সাথে সাথে কিছু বললেন না। চোখদুটো বর্ষার পুকুরের মতো থৈ থৈ করছে। এই বুঝি সব ভাসিয়ে দিবে! সে অবস্থায় অবরুদ্ধে বললেন,

“না। মনে হচ্ছে না। আমি যা করেছি,আমার সন্তানের জন্য করেছি।”

মীর খন্দকার বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ততক্ষণে শরীফা খন্দকার ভ্রমরকে কোলে তুলে নিয়েছেন। মা,মেয়ের দিকে তাকিয়ে মীর খন্দকার বললেন,

“ভালোবাসাটা একপেশে হয়ে যাচ্ছে না শরীফা? কী করে পারছো আমার ভালোবাসাকে তুচ্ছ করে,বাধন থেকে ছিন্ন হয়ে যেতে? এমনটা তো কথা ছিল না। আমরা তো একে অপরকে কথা দিয়েছিলাম ইহকাল ও পরকালে এক সাথে থাকব। তাহলে কি মিথ্যে বলেছিলে?”
“না,তুমি ভুল ভাবছো। আমি তোমার থেকে নয়,শ্বশুড়বাড়ি থেকে ভিন্ন হচ্ছি। তুমি আমার স্বামী ছিলে,আমরণ থাকবে। আমার মনের দুয়ার সবসময় তোমার নামেই খোলা থাকবে। আমি তো আমার সুখের জন্য যাচ্ছি না। আমার মেয়ের মঙ্গলের জন্য যাচ্ছি।”

এ পর্যায়ে মীর খন্দকার আর শান্ত থাকতে পারলেন না।চিৎকার করে উঠলেন,

“বার বার মেয়েকে টানবে না। আমার সহ্য হচ্ছে না। এর জন্যই এত ঝামেলা হচ্ছে!”

শরীফা খন্দকার ভয়ে মৃদু কেঁপে উঠলেন। ভ্রমর ঘুমের ঘরেই কেঁদে উঠল। মেয়েকে থামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন শরীফা খন্দকার। অস্পষ্ট গলায় বললেন,

“সহ্য হবে কী করে? আম্মার ছেলে বলে কথা!”

কথাটা বোধ হয় মীর খন্দকার শুনলেন না। আগের মতোই তেতেপুড়ে বললেন,

“যেখানে খুশি সেখানে যাও। তোমার পিছু আমি ছাড়ছি না। কিন্তু খবরদার শরীফা,আমাদের মাঝখানে এই মেয়েকে যেন কখনও না দেখি।”

________________________________________
শায়লা হক কেক বানাচ্ছেন। ভ্রমর পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। দুজনের মধ্যে এখনও ভাব হয়নি। তবে ভ্রমর চেষ্টা করছে। উৎসাহ দিয়েছে রিধি। সেই উৎসাহের প্রভাব প্রবলভাবে পড়েছে ভ্রমরের উপর। কেননা,রিধি বলেছে হৃদ্যের বাড়ি না থাকার কারণ একমাত্র শায়লা হকই জানেন। তার তো কারণ জানা চাই-ই চাই
জন্মদিনের মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ দিনে মানুষটা উধাও হয় কিভাবে? বাড়িতে যখন এসেই পড়েছে কারণটাও উদ্ঘাটন করে ছাড়বে। ভ্রমর অকারণেই একটু হাসল। হাসি ধরে রেখে বলল,

“আন্টি আপনি ঘেমে গেছেন। আমি সাহায্য করি?”

শায়লা হক ভ্রমরের দিকে তাকালেন। চোখের দৃষ্টিতে সুপ্ত সন্দেহ। দৃষ্টি একটু গভীর হতেই ভ্রূ কুঁচকে এলো বিরক্তে। এই মেয়েটা রিধির বান্ধবী কী করে হয় বুঝতে পারছেন না তিনি। মেয়ে মাঝ রাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলছে,’আম্মু আজ ভ্রমরের জন্মদিন। একটু কেক বানিয়ে খাওয়াও তো!’

শায়লা হক বিরক্তি ধরে রেখে ডিম ফেটলেন। ময়দার প্যাকেট ধরতে গেলে ভ্রমর ছোঁ মেরে নিয়ে নিল। তারপর মিষ্টি করে বলল,

“আমি ঢেলে দিচ্ছি,আর কী করতে হবে?”

ভ্রমর ময়দা ঢালতে গিয়ে ফেলে দিল। শায়লা হক ক্ষেপলেন। ভ্রমরের হাত থেকে ময়দার প্যাকেট ছিনিয়ে বললেন,

“চুপচাপ সোফায় গিয়ে বসো। আমি কেক নিয়ে আসছি।”

ভ্রমর মন খারাপ নিয়ে বেরিয়ে এলো। বসার রুমের দিকে পা বাড়াতে পাখির ডাকের মতো কিছু বেজে উঠল। ভ্রমর কিছু বুঝার আগে রিধি কোথা থেকে ছুটে এলো। আদেশ দিল,

“হৃদ্য এসেছে। তুমি লুকিয়ে পড়ো।”

ভ্রমর অবাক হলো। রিধির চোখে,মুখে প্রবল উত্তেজনা! ভ্রমর সহজ গলায় বলল,

“কেন? আমি হৃদ্য ভাইয়ার সাথে দেখা করব না?”

রিধি উত্তর দিল না। ভ্রমরকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে বলল,

“জলদি লুকাও। আমি দরজা খুলে দিচ্ছি কিন্তু।”

কথাটা শেষ করে রিধি দরজার দিকে ছুটল। ভ্রমর কিছুক্ষণ নির্বোধের মতো দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর কী ভাবল কে জানে! সে পা চালিয়ে ছুট লাগায়। দ্রুত সামনের একটি রুমে ঢুকে পড়ে।

রিধি দরজা খুললে, হৃদ্য ভেতরে ঢুকে। এলোমেলো পায়ে রুমের দিকে হাঁটা ধরে। পেছন থেকে শায়লা হক বললেন,

“হাত,মুখে ধুয়ে আয়,আমি খাবার দিচ্ছি।”

হৃদ্য থামল। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

“তুমি এত রাতে জেগে?”

শায়লা হক সহজমনে জেগে থাকার কারণ বলতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না। ফোঁড়ন কাটল রিধি। বলল,

“আমি জেগে আছি,তাই আম্মুও জেগে আছে।”

হৃদ্য দ্রুত হাত ঘড়িটা দেখে নিল। তারপর বোনের দিকে তাকিয়ে বলল,

“রাত তিনটা বাজে,আপু। তুই তো এই সময় ঘুমিয়ে পড়িস।”

রিধি আমতা আমতা করে বলল,

“হুম। আজ একটু দরকার তাই জেগে আছি। তোকে এখন কারণ বলতে হবে?”

হৃদ্য আর কথা বাড়াল না। মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,

“আম্মু,আমি অনেক ক্লান্ত,ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। এখন আর খাব না। ঘুমিয়ে পড়ব। তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো।”

চলবে#প্রাণ_ভোমরা
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (১৫)

অন্ধকার রুমে আলো জ্বালায় হৃদ্য। আলোর উজ্জ্বল ছায়া মেঝেতে ছড়িয়ে পড়তে সে চমকায়। দরজার ঠিক কাছ থেকে এলোমেলো বিন্যাসে পায়ের ছাপ ভেতরে গিয়েছে। কার পায়ের ছাপ? হৃদ্য ভাবনায় পড়ে যায়। সুক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে সাদা মিহিদানাময় ছোট ছোট পদচিহ্নে। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে,’আপু আমার রুমে এসেছিল?’ সে পেছন ঘুরে। গলা ছেড়ে ‘আপু’ শব্দটি উচ্চারণ করতে গিয়েও থেমে যায়। পুনরায় সামনে ঘুরে। মনে হলো কেউ তার সামনে দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। বারান্দায় প্রবেশের দরজাটা হালকা নড়ছে। কেউ হাঁটছে কি? মুখ টিপে হাঁসছে? অজান্তেই হৃদ্যের মনের কল্পনায় একটা হাসিখুশি মেয়ের মুখ ভেসে উঠল। যার চোখ জুড়ে দুষ্টুমি,ঠোঁটে উত্তাল লজ্জা!

হৃদ্য মোহতে পড়ে যায়। নিষ্পলকে সামনে হেঁটে চলে,বড্ড ধীরগতিতে। হৃদয়ে স্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। জড়ো হচ্ছে অসংখ্য কৌতুহল,বিস্তর উত্তেজনা। চাপা উৎসাহ তাকে বারান্দাতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। দরজার নিকটে আসতে হৃদ্য চোখ বন্ধ করে ফেলে,শুকনো ঢোক গিলে। তারপর উৎকন্ঠিত দৃষ্টি রাখে ডানপাশে। সঙ্গে সঙ্গে চোখদুটো বড় হয়ে আসে। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তার অগোছালো শখের ফুল বাগানের মধ্যিখানের মেয়েটির উপর। সে উঁবু হয়ে ফুল ছিড়ছে আর গুনগুনিয়ে গান গাচ্ছে। হৃদ্য পেছনে থাকায় এখনও চেহারা দেখতে পারছে না। তবে পিঠ ঢাকা চুলগুলো তার পরিচিত। গানের সুরটিও পরিচিত। মেয়েটির পেছন ভাগের গড়নটিও পরিচিত। হাতে,পায়ের চঞ্চল অঙ্গভঙ্গিও পরিচিত। বহুবার দেখেছে,অসংখ্যবার আঁখিবরণ করেছে। স্বয়নে,স্বপনে বারংবার! আবার হারিয়েছেও ততবার। ছুঁতে পারে নি কখনও। যেন হাত দিয়ে স্পর্শ করা তার জন্য কঠিন নিষেধ। উপরওয়ালার বাঁধা নিয়ম। কড়া কালি দিয়ে অদৃষ্টে লিখে দিয়েছেন,’ দেখিও ভেঙে লাজশরম,ছুঁইতে তোমার কঠোর বারণ!’

হৃদ্য অনেক্ষণ সামনের মেয়েটির কার্যকলাপ দেখল। সে একের পর এক ফুল ছিঁড়েই যাচ্ছে। ফুলগুলো কী কাজে লাগাচ্ছে বুঝা যাচ্ছে না। হৃদ্য আর অপেক্ষা করতে পারে না। তার সর্বাঙ্গে উসখুসরা খেলা করছে। হাতদুটো নিশপিশ করছে সামনের মেয়েটিকে একটি বার ছুঁয়ে দেখার জন্য। চোখ দুটো ক্ষুধার্ত জ্বালায় জ্বলছে একটিবার তার পুষ্পরানিকে দেখার জন্য! হৃদ্য আপনমনে উচ্চারণ করল,’পুষ্পরানি!’ সেই সাথে মনের মধ্যে অন্য কিছু বাড়ি দিয়ে গেল। মনে পড়ল সে এখন ঘুমাচ্ছে না। তারমানে স্বপ্নও দেখছে না। তাহলে এই পুষ্পরানির উদয় হলো কী করে? তাহলে কি এই মেয়ে পুষ্পরানি নয়? অন্য কেউ? কিন্তু কে? কার সাহস হলো হৃদ্যের অনুমতি ব্যতীত এই স্বয়নগৃহে প্রবেশ করার? তার পরম যত্নে সাজিয়ে তোলা পুষ্পবাগে পদার্পণ করার? ফুলে হাত দেওয়া? সুবাস নেওয়া, লালিত ফুল ছেঁড়ার? মুহূর্তেই হৃদ্যের চোখে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। রাগে মাথার তালু ফুটো হওয়ার উপক্রম,হাতের পেশিগুলো শক্ত হয়ে আসছে। সে বড় কদম ফেলে মেয়েটির সামনে দাঁড়ায়। কঠিন স্বরে ধমক দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও সে নরম স্পর্শে মেয়েটির কাঁধে হাত রাখল। সাথে সাথে মেয়েটি হৃদ্যের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। হৃদ্য চমকাল,বিস্ময়ের অতিকে ওঠে জিজ্ঞেস করল,

“ভ্রমর তুই?”

ভ্রমর খুব দ্রুত বলল,

“কে ভ্রমর?”

ভ্রমরের পাল্টা প্রশ্নে হৃদ্য হতবাক! ক্ষনিকের জন্য কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলল। নির্বোধের মতো ভ্রমরের দিকে তাকিয়ে সহসা বলল,

“আমার সাথে ইয়ার্কি? দেব গালে চড় বসিয়ে। তখন বুঝবি কে ভ্রমর!”

হৃদ্যের আকস্মিক রাগান্বিত মুখ ও কণ্ঠে ভ্রমরের ঘাবড়ে যাওয়ার কথা। সাধারণত,সে হৃদ্যের ধমকাধমকিতে পড়ে না। আজ পড়েছে। কিন্তু ভ্রমর ঘাবড়াল না। তার বদলে হাসল। যাকে বলে ঠোঁট টিপে হাসি। এতে হৃদ্যের রাগ আরো বেড়ে গেল। রাগি স্বরেই বলল,

“হাসছিস কেন?”

ভ্রমর আবার হাসল। তারপর মিষ্টিস্বরে বলল,

“আমি হলাম পরী। পরীরা সবসময় হাসে। মানুষের মতো ওদের এত রাগ নেই। পরীদের মানুষের মতো গরম রক্ত না। তাদের রক্ত হয় শীতল!”

ভ্রমরের কথাগুলো হৃদ্যের কাছে ছন্দের মতো ঠেকল। বেশ আশ্চর্যও হলো। আসলেই কি পরীদের রাগ নেই? তাদের রক্ত শীতল? হতে পারে। এই ব্যাপারে তার কোনো জ্ঞান নেই। তাই সে তর্কে জড়াল না। বলল,

“তুই পরী? তোর পাখা কই?”

এবার ভ্রমর বিচলিত হলো। ঠোঁটের হাসিটা সংকুচিত হলো। সাথে সাথে উত্তর দিতে পারল না। অভিনয়ের ব্যর্থ ছাপ মুখে ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে। হাল ছেড়ে দিয়ে নিজের রূপে ফিরে আসতে গিয়ে হঠাৎ বলল,

“আমি তো ছোট পরী তাই পাখা নেই। কয়েক দিন পর গজাবে। তখন আমি তোমার বাড়ির ছাদের উপর উড়ব আর খুশির গান গাইব। কারণ পরীরা সবসময় সুখী! মানুষের মতো ওরা ঝগড়া করে না,কাড়াকাড়ি করে না,অন্যের সুখ দেখে হায় হায় করে না।”

হৃদ্য এক ভ্র উঁচু করে ভ্রমরের দিকে তাকাল। চোখের দৃষ্টিতে যথেষ্ট সন্দেহ। ভ্রমর ভেতরে ভেতরে ভয় পাচ্ছে। জিততে গিয়ে সে এগুলো কী বলছে?

হৃদ্য কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল,

“ওহ আচ্ছা,তা এই ছোট পরীর আমার এখানে আসার কারণ কী?”

হৃদ্যের কথায় ভ্রমর আগ্রহ নিয়ে বলল,

“পর্যবেক্ষণ করতে।”
“কিসের পর্যবেক্ষণ?”
“তোমার ফুলের বাগানের পর্যবেক্ষণ। এই যেমন ধরো,বাগানে কেমন ফুল ফুটছে,কয়টা করে ফুটছে,সুবাস দিচ্ছে কেমন,বেঁচে থাকছে কতদিন,ঝরে পড়ছে কখন,ফুলে পোকা ধরছে নাকি। বাগানের মালি গাছের যত্ন নিচ্ছে কেমন? এই সব আরো ইত্যাদি ইত্যাদি।”

কথাগুলো শেষ করেই ভ্রমর দম ছাড়ল। ভারি ঢোক গিলল। তন্মধ্যেই হৃদ্য বলল,

“পরীরা এসব কাজ করে বেড়ায়?”
“সবাই করে না। একেক পরি একেক কাজ করে। আমি তো ফুল বাগানের ফুলপরি,তাই এগুলো আমি করি।”

হৃদ্য চোখ কপালে তুলে বলল,

“তুই ফুল পরি?”

ভ্রমর মাথা উপর নিচ দ্রুত নাচিয়ে বলল,

“আমাকে দেখে বুঝতে পারছো না?”

ভ্রমরের কথায় হৃদ্য এবার ওর আপাদমস্তক পরীক্ষা করল। পায়ের ফাঁকে ফাঁকে ফুল গাঁথা। গলার ওড়না কোমড়ে বাঁধা। সেই ওড়নার কিনারের চারধারে ফুল গুঁজে রেখেছে। হাতের আঙুলের ফাঁকে,কনুই ভাঁজে,কাঁধে,কানে এবং চুলেও অসংখ্য ফুল গেঁথে আছে। হৃদ্য হতাশ চোখে তার ফুল গাছে তাকাল। একটাও ফুল নেই। হতাশ দৃষ্টি ভ্রমরের দিকে ফিরে আনে। সেই সময় ভ্রমরের কাঁখতলি থেকে একটা ফুল নিচে পড়ে গেল। হৃদ্য ফিক করে হেসে দিল। হাসতে হাসতে বলল,

“ফুলপরীর কি সুপার গ্লু লাগবে?”

ভ্রমর ঠোঁট উল্টিয়ে ফেলল। তারপর বেজার মুখে বলল,

“পরীদের নিয়ে মজা করতে নেই,তারা কষ্ট পায়। অসন্তুষ্ট হয়ে অভিশাপ দেয়।”
“তাই নাকি? দে দেখি একখান অভিশাপ!”

ভ্রমর কপাল কুঁচকিয়ে ফেলে। চোখ সরু করে,নাকের পাতা ফুলিয়ে বলল,

“তোমার কপালে বউ জুটবে না। তোমাকে ফাঁকি দিয়ে অন্য কোথাও পালাবে।”

হৃদ্য আবার শব্দ করে হাসল কিছুক্ষণ। তারপর রঙগরসে বলল,

“একবার বলে বউ জুটবে না,আবার বলে ফাঁকি দিবে। বলি,বউ যদি নাই জুটে তাহলে ফাঁকি দিবে কিভাবে? পরীদের তো জ্ঞানের ভান্ডার শূন্য!”

ভ্রমর নাক,মুখ শক্ত করে বলল,

“বউ হওয়ার আগেই ফাঁকি দেবে।”

কথাটা শেষ করেই ভ্রমর বারান্দায় গঠিত ছোট্ট বাগান থেকে বেরিয়ে এলো। সাজের সব ফুল হৃদ্যের গায়ে ছুঁড়ে মারে। ধপধপ পায়ে রুমে ঢুকে। গাল ফুলিয়ে বিছানার উপর বসে। হাত বুকে শক্ত করে বাঁধে।

হৃদ্যের হাসি তখনও চলছে। হাসি শেষে ধীরপায়ে রুমে প্রবেশ করে। ভ্রমরের কাছে এসে দাঁড়ায়। বেশ কিছুক্ষণ নীরবে চেয়ে থাকে অভিমানী ভ্রমরের দিকে। তারপর হঠাৎ এক কাণ্ড করে বসে যেটা সে এতগুলো বছরেও করে নি। ধুপ করে ভ্রমরের কোলের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে হৃদ্য। ভ্রমর অবাক হয় না। কোনো প্রতিক্রিয়াও প্রকাশ করে না। আগের ন্যায় মুখ ঝামটি মেরে বসে থাকল। হৃদ্যের মধ্যেও বিশেষ মাথাব্যথা দেখা গেল না। সে নীরবে চোখ বন্ধ করে থাকে কিছুক্ষণ। আরো কিছু সময় অতিবাহিত হয় এভাবেই। হৃদ্যের এহেন আচরণ আর সহ্য করতে পারছে না ভ্রমর। অভিমান থেকে এবার কঠোর রাগে রূপান্তর হলো। আগুন চোখে তাকাল হৃদ্যের দিকে। সেই চোখের আগুনে ঝলসে যাওয়ার মতো উত্তাপটা বুঝি হৃদ্য তৎক্ষণাৎ টের পেয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে ফেলে। ভ্রমরের রাগকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ওর নাক টেনে ধরে বলল,

“একটা গল্প শোনা তো,পুচকি।”

ভ্রমর ব্যথিত চোখে তাকাল। তারপর নাক উঁচিয়ে বলল,

“পারব না।”

হৃদ্য ভ্রূ কুটিয়ে তাকাল। যেন ভ্রমরের মুখে এই কথাটা এই প্রথম শুনছে সে। ভারি আশ্চর্য তার সেই চোখের দৃষ্টি!

ভ্রমর দেখেও দেখল না। হৃদ্য তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখের দৃষ্টি গভীর হতে থাকে। নিবিড়ভাবে ভ্রমরের নাক,মুখ,চোখ,ঠোঁট পর্যবেক্ষণ করছে। হঠাৎ খেয়াল হলো ভ্রমরের চোখের মনিদুটো আগের থেকেও আরো কালো ও বড় হয়েছে। নাকের দুই পাশ আগের থেকেও মসৃণ হয়েছে। গালগুলো বেশ ভারি ও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। ঠোঁটের অগভীর রেখাগুলো এখন গভীর হয়েছে। সবকিছুই বেশ স্পষ্ট! এইটুকু দেখে হৃদ্যের মন ভরল না। উপরন্তু আরো ক্ষুধার্ত হয়ে উঠল। চোখের দৃষ্টি থুতনি বেয়ে গলা,গলা বেয়ে আরেকটু নিচে আসতেই ভ্রমর বলে উঠল,

“তুমি বলো,আমি শুনি।”

হৃদ্যের চোখের দৃষ্টি আবার গিয়ে ঠেকল ভ্রমরের চোখে। একটু আগে ফুটে উঠা রাগ আর দেখা যাচ্ছে না। কৌতুহল ও আনন্দের দীপ্তি ছড়াচ্ছে। সেই চোখের দিকে চেয়ে থেকেই হৃদ্য চোখ বন্ধ করে নিল। জোরে নিশ্বাস ফেলার শব্দ হলো। তারপর গুনগুন শুরু করে দিল। গল্পের জায়গায় গান শোনাচ্ছে এতে ভ্রমরের একটুও খারাপ লাগল না। বরং ভালো লাগল। সে মাথা হালকা এদিক সেদিক দুলিয়ে উপভোগ করতে থাকে। তাদের জীবনে আরো কিছু ভালো লাগার সময় যোগ হতে থাকে। ভ্রমর গানের তালে তালে হারিয়ে যায়। দূর,বহুদূর! যেখান থেকে ফেরার কথা চিন্তায় আসে না কারো। যদি না কেউ তাকে ফিরিয়ে আনে। ভ্রমরও আসতে চাচ্ছিল না। তবে আসতে হলো। হঠাৎ খটখট শব্দ কানে বাজে। ভ্রমর মৃদু কম্পনে চমকে ওঠে। চোখ মেলে দরজার দিকে তাকায়। ধূসর সাদা রঙের পর্দার মধ্যে কারো ছায়া দেখা যাচ্ছে। অপ্রত্যাশিত কারো উপস্থিতে ভ্রমর ভয় পেয়ে যায়। দ্রুত তাকায় হৃদ্যের দিকে। সে গান গায়ছে না। ঘুমিয়ে পড়েছে। নিবিড় ঘুমের নিষ্পাপ মুখটি বড্ড মায়াময়। ভ্রমর ভালো করে দেখতে পারল না। তার আগেই পর্দার আড়াল থেকে রিধির গলা ভেসে আসে,

“ভ্রমর জলদি আয়। তোর মা এসেছে।”

মায়ের কথা শুনতে ভ্রমরের রক্ত চলাচল অত্যধিক দ্রুত হয়। কোথায় আছে,কিভাবে আছে বেমালুম ভুলে বসে। বসা থেকে অকস্মাৎ দাঁড়িয়ে যায়। হৃদ্যের মাথা নরম খাটের সাথে বাড়ি খায়। যা ভ্রমরের নজরে আসে না। সে ছুটে হৃদ্যের রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সোজা বসার রুমে উপস্থিত হয়। মায়ের বুকে এমনভাবে ঝাপিয়ে পড়ে যেন কতকাল মাকে দেখেনি!

___________________________________________

বিষন্ন সন্ধ্যায় বিষন্ন মুখে বাড়ি ফিরেছে শ্রাবণ। আজকাল তার মুখে হাসি নেই বললেই চলে। যেন সে মলিন মুখের বিশেষ অধিকারী মানব! এক পলকের জন্যও মুখ থেকে এই মলিনতা, বিষন্নতা দূর করলে পাপ হয়ে যাবে,মহাপাপ! তবে সে চেষ্টা করে ঠোঁটে হাসি আনার। সেই চেষ্টাটা একমাত্র বাবার সামনে। ইদানিং বাবাকে খানিকটা এড়িয়েই চলছে শ্রাবণ। চাইলেই কি পারা যায়? যেখানে দুজন একি ছাদের নিচে, এক বিশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে আছে।

শ্রাবণ সারাদিনের ক্লান্ত ধুয়ে স্নাগার থেকে বেরোতই জড়তা ঝাপটে ধরল। তার বাবা লোকমান সাহেব বিছানায় বসে আছেন। শ্রাবণ না চাইতেও ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ঝুলিয়ে বলল,

“আমি এখনই তোমার সাথে দেখা করতে যেতাম,বাবা। সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিল তাই তাড়াহুড়ো করে বেরোতে হয়েছে। শরৎ বলেছিল,তুমি ডেকেছো।”
“বউমা কবে আসবে?”

বাবার প্রশ্নটা শ্রাবণের বুকে গিয়ে ফুঁড়ে। ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে ছোট্ট হৃদয়টাতে। বহু কষ্টে টেনে আনা হাসিটুকু মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়। শ্রাবণ সবটা আড়াল করতে তোয়ালেটা মুখে ধরে যেন পানি মুছছে। সেভাবেই যথেষ্ট সহজ গলায় স্বল্পবাক্যে বলল,

“আসবে। কিছু দিনের মধ্যেই।”

লোকমান সাহেব বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। ছেলের অতি নিকটে এসে বললেন,

“তোদের মধ্যে কি ঝগড়া হয়েছে?”

শ্রাবণের মুখ থেকে তোয়ালে সরে যায়। সরল চোখে তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে। উত্তর দিতে পারে না। মানুষটাকে আর কত মিথ্যে আশ্বাস দিবে? রিধি কি আদৌ এ বাড়ি ফিরবে?

লোকমান সাহেব অস্থিরতাসহিত বললেন,

“সেরকম হলে আমাকে বল। আমি নিজে বউমার সাথে কথা বলি। বাড়ির বউ এত দিন বাপের বাড়ি পড়ে থাকলে চলে? তিন মাস হতে চলল প্রায়। কী হয়েছে ঠিক করে বল তো বাবা।”

শ্রাবণ চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। তোয়ালেটা মেলে দিতে দিতে বলল,

“বসো। তোমার সাথে আমার জরুরী কথা আছে।”

লোকমান সাহেব আগের থেকেও বেশি অস্থির হয়ে উঠলেন। বসার বদলে শ্রাবণের কাছে গিয়ে বললেন,

“একদম এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবি না। আমি আর সহ্য করব না। গত দুই মাস ধরে তোর এড়িয়ে যাওয়া দেখছি।”

শ্রাবণ সামান্য হাসল। ক্লান্ত হাসি,শুকনো হাসি। সেই হাসি দেখে ভয় পেয়ে যান লোকমান সাহেব। ছোটকাল থেকে তিন ছেলেকে দুহাতে আগলে বড় করছেন। সামলাচ্ছেন। এখনও তাই করে যেতে হচ্ছে। এই হাসির মানে তো অবশ্যই বুঝতে পারবেন। তিনি শ্রাবণের কাঁধ ছুঁয়ে বললেন,

“কী হয়েছে আমাকে বলবি?”

শ্রাবণ বাবার বাহু ধরে বিছানায় বসাল। নিশ্বাস টেনে ঠিক করল রিধির সাথে ঘটা আগাগোড়া সব বলে দিবে বাবাকে। টেনে নেওয়া নিশ্বাস ধরেই বাবাকে একে একে সব বলে দিল।

শ্রাবণের কাছ থেকে সবটা শোনার পর লোকমান সাহেবের প্রথম কথাটি ছিল,

“তুই রিধিকে ভালোবাসিস?”

শ্রাবণ বাবার দিকে তাকায়। পরমুহূর্তেই চোখ সরিয়ে আনে মেঝেতে। ধীরে বলল,

“রিধি আমার দুঃস্বপ্ন। আমি দুঃস্বপ্নকে ভুলে যেতে চাই।”
“আমি যদি বলি রিধি তোর সুস্বপ্ন?”

শ্রাবণের চোখ পুনরায় বাবার দিকে আটকায়। তিনি মৃদু হাসলেন। বললেন,

“ভালোবাসা শুধু বুকের মধ্যে জমিয়ে রাখলে হয় না,খরচও করতে হয়।”

শ্রাবণের সরল চাহনি এবার বিস্ময়ে পরিণত হলো। বাবা আবারও হাসলেন। বললেন,

“পকেট থেকে ফোন বের কর।”
“কেন?”
“কল দিবি।”
“কাকে?”
“রিধিকে।”
“কেন?”
“বেহায়া হতে!”
“মানে?”

ছেলের প্রশ্নে এবার লোকমান সাহেব বেশ বিব্রত হলেন। লজ্জায় বার্ধক্যের ছাপ পড়া গাল দুটো গোলাপী আভা ফুটে ওঠে। হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,

“ভালোবাসার শীর্ষ উপাধি হলো ‘বেহায়া’। সেটা যতদিন না অর্জন করতে পারবে ততদিন ভাববে তুমি ভালোবাসতে শিখনি।”

এর বিপরীতে ছেলের মুখ থেকে কিছু শুনতে প্রস্তুত নন লোকমান সাহেব। তাই দ্রুত বললেন,

“কী হলো কলটা দে। আজ রাতের মধ্যেই বউমাকে এই বাড়িতে দেখতে চাই।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here